গোলাম কিবরিয়া পিনুর প্রথম কবিতার বই ‘এখন সাইরেন বাজানোর সময়’। প্রকাশকাল ১৯৮৪। তাঁর বইয়ের সংখ্যা ২৩ । কবিতার বই ১৪টি।। কবিতাকে গোলাম কিবরিয়া পিনু আত্ম-প্রকাশের মাধ্যম হিসেবেই নিয়েছেন। তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে সময়। যে সময়ের ভেতর দিয়ে তিনি জীবনকে দেখছেন, সেই সময়কেই আন্তরিকতার সঙ্গে তুলে ধরতে চেয়েছেন। এতে করে তার কবিতায় স্বকালের লক্ষণ যেমন স্পষ্ট, তেমনি যে সময়ের ভেতর দিয়ে তিনি যাত্রা করেছেন, তারও নিখুঁত চিত্র উঠে এসেছে। সেই সময়ের বর্ণনার ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে জীবন। সময় এবং জীবনের অনুষঙ্গের ভেতর দিয়েই প্রকৃত প্রস্তাবে পরিপূর্ণতা আসে সব উপাদানের। যা দৃশ্যমান না অথবা যা দৃশ্যমান—তার সবই এই দু’য়ের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে তার কবিতায় সময় এবং জীবন নানাদিক থেকে আলো ফেলে উঠে আসে। সেখানে বিষয়ের বৈচিত্র্য থাকে। থাকে প্রকাশের আন্তরিকতা আর থাকে তার নানামাত্রিক ব্যবহার।
সমকালীন বিষয়কে বর্ণনা করতে গোলাম কিবরিয়া পিনু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেও, তার কবিতা থেকে হারিয়ে যায়নি বোধের স্ফূরণ। তিনি একরৈখিকভাবে শুধু একদেশদর্শী বিষয়কেও তুলে আনেননি। ‘মানুষ অনন্ত সম্ভাবনাময়’ মানুষের সেই অনন্ত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই তিনি কবিতায় ‘মানুষ ভজো’ নীতিকে প্রাধ্যান্য দিয়েছেন। মানুষের ভেতরে মানুষকে সন্ধান করেছেন। জীবনে চলার পথে মানুষের যে নানামুখী বৈশিষ্ট্য, যা কখনো উপকারী অবার কখনো অপকারী—সব দিককেই তিনি স্পষ্ট করে তুলতে চেয়েছেন। কবিতায় ব্যক্তি ‘আমি’র চেয়ে তিনি সমষ্টিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলে দেখা দৃশ্যকে, তিনি বর্ণনা করেছেন, যা থেকে পাঠক নিজেকে এবং নিজের সময় ও প্রতিবেশ খুঁজে পেয়েছে।
জাহাজে জাহাজে সংঘর্ষে জাহাজও বাঁচে
. মানুষও বাঁচে—
মানুষে মানুষে সংঘর্ষে মানুষ কতটুক বাঁচে?
. কোথায় কিভাবে হয় রক্তক্ষরণ-
এই সংঘর্ষের আঁচে!কতকিছু পুড়ে যায়-ছাই হয়ে যায়
গোপন হ্রদের জল এক লহমায় উবে যায়
. সমুদ্রও শুকিয়ে যায়
তারপরও মানুষ কীভাবে বাঁচে?
সব সংঘর্ষে দেখা কি যায়?কেউ কেউ কাটা মুরগীর মতন নিজের উঠানে তড়পায়
অন্তরের অন্তর্বাস পরে থাকার পরও মানুষের কোনখানে বাস?
মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে কীভাবে নাচে!
রেশম ও কার্পাস-মিশ্রিতবস্ত্র কখনো কখনো অস্ত্র হয়ে যায়—
. সংঘর্ষে ভেতর ও বাইরে নগ্ন হয়ে যায়
চার ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে সুদূরতম প্রান্তে পৌঁছে
সংঘর্ষের বীজ ছড়িয়ে আঘাত হানে,পর্দা বা চাঁদোয়া টানাবার প্রয়োজন কখনো কখনো টানে—
. কাদায় নিমজ্জনের খেলা
. মরুতে ভূপাতিতের খেলা
ঘটে সংঘর্ষের বেলা!
যুদ্ধ কখনো কখনো এড়িয়ে যাওয়া যায় না
চিত্কার করে আকাশ মাথায় করার পরও।’
(সংঘর্ষের বেলা: নিরঙ্কুশ ভালোবাসা বলে কিছু নেই)
আপাতদৃষ্টিতে গোলাম কিবরিয়া পিনু’র কবিতায় ভেতরে সরলতার ছাপ থাকলেও, ভাবের প্রকাশের তার দূরদৃষ্টি পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায় না। খুব সহজ ভাষায় তিনি পাঠককে টেনে নেন নিজের কবিতার এক জটিল ভুবনে। যেখানে রয়েছে হৃদয় এবং মস্তিষ্ক দু’য়েরই ব্যবহার। প্রতিনিয়ত নৈতিকতার পক্ষে যুক্তিযুক্ত হয়ে উপস্থাপিত হয় তার ভাবনা। যে ভাবনার জগতে প্রবেশের ক্ষেত্রে পাঠককে তিনি কখনোই কষ্ট কল্পনার আশ্রয় নিতে দেন না। বরং প্রতিনিয়ত মানুষ যে জীবন-যুদ্ধের ভেতর দিয়ে জীবনযাপন করেন, সেই যাপিত জীবনের ছবিকেই গোলাম কিবরিয়া পিনু স্পষ্ট করে তোলেন। তাতে করে পাঠকের পক্ষে কবির চিন্তার সঙ্গে নিজের চিন্তাকে মিলিয়ে নিতে অসুবিধা হয় না। প্রকাশের এই আন্তরিকতাই তাকে পাঠকের মনযোগ আকৃষ্ট করতে সহায়তা করে।
আমাকে বাঁচতে দিতে চায় না
মুড়িওয়ালা পর্যন্ত। রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যান্য শত্রুর কথা
বাদই দিলাম। মুড়িওয়ালা তার মুড়িতে ইউরিয়া
শুধু মিশাচ্ছে না-মিশাচ্ছে আরও রসায়ন
. যেন মুড়ি সাদা হয়—
সাদা পোশাক পরে আছে যেন মুর্দাফরাস
অন্যদিকে টেনে ধরে আছে তার বন্ধু অক্টোপাস
দেখার কি কেউ নেই আশপাশ?অনেক চড়া দামে আপেল কিনেছি
তাতেও বিষাক্ত রসায়ন—
. মাছে ফরমালিন!
কিডনি পাচ্ছে মৃত্যুর পরওয়ানা-
. কে দেবে জামিন?
বিচারকরাও ঘুমাচ্ছে ছুটিতে গিয়ে গ্রীষ্মকালীন!বাণিজ্যলোভ দিয়ে তৈরি সব!
শব হয়ে আমরা কখন যে পৌঁছে যাচ্ছি
চোরাগোপ্তা পথে গুপ্তস্থানে—
. বুঝতে পারছি না!
সবাই কি আজ মজে যাচ্ছি হিমগানে?
(হিমগান: ফুসলানো অন্ধকার)
গোলাম কিবরিয়া পিনুর কৃতিত্ব তিনি কবিতাকে চাক্ষুষ করে তোলেন। তিনি অনুভব করেন সভ্যতার বিস্তারে মানুষে মানুষে যে দ্বন্দ্ব, মানবিকতার সঙ্গে ক্ষমতার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, যে দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে মানুষ ধ্বংসোন্মুখ হয়ে ওঠে, যে দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে মানুষের কাণ্ডকারখানার ভেতর দিয়ে কোলাহল আর ক্লান্তির যে দীর্ঘ ভ্রমণ, যা প্রকৃতপ্রস্তাবে মানবিকতার অনেক বাইরে অবস্থান করে। সেই সাজানো মনোবৃত্তির বাইরে থেকে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে গোলাম কিবরিয়া পিনু অনুভব করেন আলো এবং অন্ধকারের রহস্য। হারানো পথকে খুঁজে ফিরে তিনি বারবার মানুষের স্বরূপ সন্ধান করেন। আকারে-ইঙ্গিতে বর্ণনায় কোথাও তিনি কোলাহল ও চিত্কারকে স্থান দেননি। স্ববিরোধিতায়ও মেতে ওঠেনি তার ভাবনা। ফলে জীবনের আর্দশের সঙ্গে কখনোই সংঘাত সৃষ্টি হয়নি তার ভাবনার, তার বর্ণনার। সৃষ্টির পিপাসা মিটিয়ে তিনি যে আত্মপ্রকাশের আনন্দে মেতে উঠেছেন, সেই আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে তার ভাবজগতের সন্ধান পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠেনি কখনোই। আত্মসর্পণের সুর থাকলেও সেই সুরকে তিনি বেঁধে ফেলেননি কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে। এতে গোলাম কিবরিয়া পিনুর কবিতা যে দুঃসাহসী পথ অতিক্রমের স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, সেই যাত্রা কখনোই বাধাগ্রস্ত হয়নি।
গতকালের চেয়ে আরও বেশি অন্ধকার
জমাট বাঁধছে-
. সাদামাটা জীবনও রক্তাক্ত হচ্ছে!
এখন ফুটবার সময় নয়—
. এখন ফুঁসবার সময়!
ধোঁকা দেবার জন্য ছদ্মরূপ ধারণ করে
ইতর প্রাণীরা—.
পাখা নিয়ে আকাশে উড়ছে—
প্রতারিত করে দুর্বলচিত্তকে ভয়ের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
মনে হচ্ছে শান্ত আবহাওয়ার বিপরীতে এখানেও
মরুভূমির গরম ধূলিঝড় বইছে—
ক্রোধ ও কাণ্ডহীন আচরণ নিয়ে
জমাট অন্ধকার আরও
ঘুটঘুটে করে ফেলবে আগামীকালকে?
(ছদ্মরূপ: কবন্ধ পুতুল নাচে)
বিষয়ের বৈচিত্র্য এবং শব্দের সচেতন ব্যবহারে গোলাম কিবরিয়া পিনুর কবিতা সচেতন। কবিতায় মাটি, দেশ, নিসর্গ, প্রকৃতি আর মানুষ এ সবের প্রতি সম্মিলিত ভালোবাসাই তাকে পথ দেখিয়েছে। তার কবিতা হয়ে উঠেছে সময়ের দর্পণ। অতীত,বর্তমান আর ভবিষ্যতের ভাবনাকে তিনি মিলিয়ে দিয়েছেন শব্দের গাঁথুনিতে। যেখানে দ্বিধা নেই। প্রতিদিনকার ব্যবহূত শব্দকেই ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি নতুন রূপ দিয়েছেন। তার ভাবনারা ডানা মেলেছে। খুব সাধারণ শব্দের ব্যবহারের মধ্য দিয়েও যে ভাবনার অসাধারণত্বকে মুক্তি দেয়া যায়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকেও যে সার্বজনীন করে তোলা যায় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ গোলাম কিবরিয়া পিনুর কবিতা। শুরুতে যে দশকের কথা বলে, গদ্যে ফাঁকি দেবার প্রসঙ্গে অবতারণা করেছিলাম, তা যে আসাঢ় ছিল, গোলাম কিবরিয়া পিনুর কবিতা সেই সত্যকেই প্রতি পংক্তিতে স্পষ্ট করে তোলে।
যে দিকে তাকাই সেই দিকে
ভিটেমাটি হদুল বর্ণের রূপ নিচ্ছে
কেন?
এই স্বপ্নচোখ
জণ্ডিসে আক্রান্ত হচ্ছেক্রমাগত—
দোষ ও দুষণে
বীজ ও বীজাণুর প্রাদুভার্ব
এতবেশি
চারদিক,
সর্বগ্রাসী হলুদ আঁধার নেমে আসছে,
বিপরীতে—
জোনাকীর ক্ষীণ আলো জ্বলছে।
রাত্রির স্তব্ধতা ভাঙে ঝিঁঝি পোকা
আমরা কী ভাঙি?
গোলাম কিবরিয়া পিনু, কবি। তার কবিতার প্রকাশভঙ্গি, তার কবিতার বিষয় নির্বাচনই তার কবিতার প্রধান প্রাণশক্তি। অভিজ্ঞতা ও কল্পনার মিশ্রণে যে জগৎ তিনি সৃষ্টি করেন, তা শুধু একটি সময়কেই ধরে রাখে না, হতাশার কথাই ব্যক্ত করে না, শুধু গতিহীনতার কথাই বলে না; একইসঙ্গে সময়কে আলাদা করে চিহ্নিতও। তেমনিভাবে আমাদের হৃদয়ের ভেতর থেকে উঠে আসা অনুভূতিমালাও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তার রচিত পঙ্ক্তিতে। স্বাধীনসত্তার ভেতর দিয়ে তিনি যে পথ নির্মাণ করেছেন, তা একান্তই তার নিজের। ভিড়ের ভেতরে হারিয়ে যাওয়ার নয়।