[পূর্বলেখ: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২, ঢাকার শ্যামলীতে অবস্থিত ‘বই চত্বর’-এ কবি তুষার গায়েনের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ, ‘কাটা করোটির ছায়াপথে’র মোড়ক উন্মোচন এবং আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকী মেজাজের এই আলোচনা অনুষ্ঠানে বইটি সম্পর্কে আমার বক্তব্য পরবর্তী সময়ে ধারণকৃত ভিডিও থেকে অনুলিখন করেন কবি একরাম আজাদ। সেই অনুলিখিত বক্তব্যটি কিছুটা পরিমার্জনা শেষে পাঠক সমক্ষে পেশ করা হলো। তাই লেখাটি প্রবন্ধ বা নিবন্ধ অপেক্ষা বৈঠকী আলাপের মেজাজের ভাষায় পঠিত হোক। —লেখক।]
আমি মূলত লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের একটু প্রচারের দিকে একরকম সীমাবদ্ধতা আছে। তবে লিটল ম্যাগাজিনের যারা লেখক তাদের মধ্যে একটা যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায়। সেই সূত্রে তুষার গায়েনের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের লেখালেখির পরিচয়। তুষারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ সম্ভব হয় ফেসবুকের কল্যাণে। কারণ আমি আজীবন চট্টগ্রামেই থেকেছি। ‘লিরিক’ নামে আমাদের একটা পত্রিকা আছে। এজাজ ইউসুফী এর সম্পাদক এবং আমরা সম্পাদনা পরিষদে কাজ করেছি। দীর্ঘদিন এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে আমরা উত্তর আধুনিকতা বিষয়ে কাজ করেছি। আরও অনেকের মতো তুষার গায়েনও একই বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। আমাদের আলী আফজাল খানও একই বিষয়ে কাজ করেন। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের নাম এ মুহূর্তে না নিলেই নয়, তাঁর অনেক অবদান আছে এই চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে। আমাদের কিছু বন্ধু পশ্চিমবঙ্গেও কাজ করেন, কিছু আসামে আছেন, কিছু বালুরঘাটে আছেন। এরকম আমাদের অনেক বন্ধু এই চিন্তাচর্চার সঙ্গে জড়িত। আমরা সবসময়, আমি অন্তত, চেষ্টা করেছি এই চিন্তাগুলোকে একটা জায়গায় আনার। কারণ সবাই বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছেন। উত্তর আধুনিকতার মূল চিন্তাগুলোর মধ্যে যে-বিষয়গুলো ছিল, সেগুলো হচ্ছে পুঁজিবাদী যে-সমাজব্যবস্থা আধুনিকতার নামে, ব্যানারে বা মোড়কে আমাদের যেভাবে ধোঁকা দিচ্ছে, তা থেকে বেরিয়ে আসা। এই যে অবক্ষয়ী আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ ও চিন্তা থেকে উত্তরণ লাভের যে-চেষ্টা, একটা সামষ্টিক চিন্তাকে সামনে নিয়ে এসে মানুষের চিন্তা-চেতনা-সমাজ অর্থাৎ জীবনব্যবস্থার একটা পরিবর্তনের লক্ষ্যে এক ধরনের আদর্শিক চর্চা, তা আমাদের নানাজন নানান জায়গায় বসে নিজেদের মতো কাজ করার কারণে এই চিন্তাচর্চার মধ্যে বিভিন্নজনের বিভিন্ন রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিন্তা যুক্ত হয়েছে। তবে, আধুনিক কবিরা অনেক সময় যে ম্যানিফেস্টো নিয়ে কবিতা লিখতে বসেছেন বা অনেক রকম আন্দোলন করেছেন, উত্তর আধুনিকতা বা আধুনিক-উত্তরবাদ নিয়ে এই ভূখণ্ডে যারা কাজ করেছেন, আমাদের তেমন কোন ম্যানিফেস্টো নেই। ম্যানিফেস্টোর পরিবর্তে একটা সামগ্রিকতার চিন্তা, একটা সামষ্টিক যৌথজীবনের চিন্তা, মানুষ যে দিন দিন বিচ্ছিন্ন এবং একা হয়ে যাচ্ছে, এই পরিবেশ থেকে উত্তরণের চিন্তাচেতনা নিয়ে উত্তর আধুনিকতাকে ধারণ ও তার চর্চা করে থাকি।
আমার একটি বই অনেক জায়গায় পাঠ্য হয়েছে, অনেকে পড়েন বলে আমি জানি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগেও অনেকে আমার এই ‘উত্তর আধুনিকতা : এ সবুজ করুণ ডাঙায়’ পাঠ করে বলে জানি। ২০০১ সালে বইটা বের হয়েছে, ২০১৮-তে পরিবর্ধিত সংস্করণ বেরিয়েছে। এই একই ধারাবাহিকতায় আমি দেখেছি কবি তুষার গায়েনও গভীরভাবে কাজ করেছেন। তুষারের প্রবন্ধের বই, ‘বাংলা কবিতা: অধুনান্তিকতার অভেদ সন্ধান’ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এ বিষয়ে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করে নিবিষ্টভাবে অনেক কাজ করেছেন এবং সেই বইটি নিয়ে যখন আলোচনা হয়েছিল, সেদিন পেশাগত ব্যস্ততার কারণে আমি উপস্থিত হতে পারিনি। না হলে আমার সেখানেও উপস্থিত থাকার কথা ছিল। আমি মনে করি যে উত্তর আধুনিক চিন্তাচর্চার সামগ্রিক একটা চিত্র এতে ছিল। সেই চিন্তাচর্চার জায়গা থেকেই তুষারের সঙ্গে আমার একটি আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। আমরা বেশ দীর্ঘ সময় ফেসবুকে, মেসেঞ্জারে এবং ফোনে আলাপ করে কাটিয়েছি। এ আলাপগুলোতে তাঁকে সবসময় একদম ক্লান্তিহীন সতেজ অবস্থায় পেয়েছি। এভাবেই নানা অনুসঙ্গে আমাদের চিন্তার সাযুজ্য তৈরি হয়েছে।
আরেকটা কথা না বললেই নয় যে তুষারের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ভারতবর্ষে, অর্থাৎ ওপার বাংলায় ২০১৯-এর জানুয়ারি মাসে। তুষার সাধারণত ফেব্রুয়ারিতে দেশে আসেন, বইমেলা সামনে রেখে। ২০১৯ সালে আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম, ‘আপনি জানুয়ারিতেই আসেন, আসার সময় একটু ভারতবর্ষ ঘুরে আসেন।’ তিনি বললেন, ‘ঘটনা কী?’ তাঁকে জানালাম, ভারতে উত্তর আধুনিকতা নিয়ে আসন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন প্রসঙ্গে। ভারতে কবি অমিতাভ গুপ্ত এবং তাঁর কিছু বন্ধুর সহযোগিতায় সম্মিলিতভাবে একটা কনফারেন্স করার চেষ্টা আমরা করছিলাম এবং পরে তা ২০১৯-এর জানুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাটে সংগঠিত হয়। এটা তিন দিনব্যাপী একেবারে রেসিডেনশিয়াল সম্মেলন ছিল, যা বেশ গুরুত্বপূর্ণ কবিতায় উত্তর আধুনিকতাচর্চার ক্ষেত্রে এবং সেখানে আমরা নানা ধরনের পেপার প্রেজেন্টেশন, গবেষণামূলক আলোচনা করেছিলাম। এই অনুষ্ঠানে আমি তুষারকে আমন্ত্রণ জানাই। এবং তুষার আমার এক কথাতেই টিকিট পরিবর্তন করে তাঁর সমস্ত লাগেজ নিয়ে সরাসরি ভারতে গিয়ে হাজির হন এবং সেখানে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। তিনদিনের সেমিনার শেষে আমরা বাংলাদেশে আসি। এসব মিলিয়েই আমি বলবো, তুষারের ভেতর যে একটা নিবেদিত কবি প্রাণ আছে, সেটা আমি বহুদিন ধরে আবিষ্কার করেছি।
কবিতায় বাস্তবতাকে, দগদগে ক্ষতগুলোকে তুলে আনা এত সহজ কাজ নয়। কারণ কবিরা এমনিতেই একটু আড়ালপ্রিয়, একটু অলঙ্কারপ্রিয়। কিন্তু সেই অলঙ্কার, কবিতার যে-বৈশিষ্ট্য সবকিছুকে রক্ষা করে এসব বাস্তবতাকে কবিতায় নিয়ে আসা অনেক দূরহ বলে আমি মনে করি।
আরও একটি বিষয়ে একটু বলে রাখি। তুষার গায়েনের একটি কবিতা আমাকে খুব বেশি আলোড়িত করেছিল সেটা হচ্ছে ‘ইকথিয়ান্ডার’। আপনারা ইকথিয়ান্ডারের কথা জানেন সম্ভবত। একটু মনে করিয়ে দিলেই মনে পড়বে, ‘উভচর প্রাণী’ নামে একটা বই শৈশবে আমরা প্রায় সবাই পড়েছি। ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’ পরে আবার বইটি প্রকাশ করেছে। কিন্তু আমরা সম্ভবত ‘রাদুগা’ কিংবা ‘প্রগতি প্রকাশনী’র বইটি পড়েছিলাম। সেই যে একা একটা ছেলেকে মাছের মতো করে পানিতে বসবাস করতে হয়েছিল। তার কিছুক্ষণ ডাঙায় কিছুক্ষণ পানিতে থাকা, তার ভেতরের যে-কষ্ট, যে-যন্ত্রণা, তার বাবার যে-যন্ত্রণা, সেই বিষয়গুলো ছোট্ট একটি কবিতার মধ্যে তুলে এনে বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তুষার ‘ইকথিয়ান্ডার’ কবিতায়, সেটা নিয়ে আমি এতটা মুগ্ধ হয়েছিলাম যে কবিতাটি নিয়ে আমি বেশ বড়সড় একটি গদ্য লিখেছিলাম। গদ্যটি ‘চিন্তাসূত্র’ নামে একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং পরে আমার ‘কবিতা : পাঠে পাঠান্তরে’ বইতে সংকলিত হয়। সেই থেকে আমি দেখেছি, তাঁর কবিতার মধ্যে যে-জিনিসটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো সংবেদনশীলতা, অসম্ভব বেশি সংবেদনশীলতা। কবিমাত্রই সংবেদনশীল হবে—এটাই আমরা আশা করি, যার প্রমাণ আমি পেয়েছি তার ‘কাটা করোটির ছায়াপথে’ কাব্যগ্রন্থে। এ বইটির যে-কবিতাগুলো আমাকে আকর্ষণ করেছে, তার কয়েকটি এখানে আলোচনা করার সামান্য চেষ্টা করছি। তাঁর ভেতর যে সংবেদনশীলতার কথা বলছি, সেই সংবেদনশীলতা প্রতিটা কবিতার পঙ্ক্তিতে বিরাজ করছে। এই ‘কাটা করোটির ছায়াপথে’ বইটির কবিতাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আমরা আসলেই এমন একটি যুগে, এমন একটি সমাজে বাস করছি, যেখানে আমাদের যে-কোনো মুহূর্তে যে-কোনো জীবনের বিনাশ হচ্ছে, করোটি কেটে ফেলছে, হত্যাকাণ্ড হচ্ছে। বিশেষ করে তুষার যে-সময়টি তুলে ধরেছেন—ব্লগারদের হত্যা করা হচ্ছে, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি বা গার্মেন্টস শ্রমিকদের দুরবস্থা—এ রকম নানা সমস্যা এখানে খুব সংবেদনশীলভাবে উঠে এসেছে।
কয়েকটি কবিতার মধ্যে, যেগুলো পঙ্ক্তিগুলো আমার ভালো লেগেছে, সেই জায়গাগুলো একটু ধরে ধরে আলোচনা করতে চাই। তুষার এখানে শুরুতে সমুদ্র রেখেছেন, আবার শেষেও সমুদ্র রেখেছেন। এটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। এই যে আমাদের উত্তাল তরঙ্গ, এই তরঙ্গিত জীবন এবং তার যে-ব্যাপারস্যাপারের পাশাপাশি তুষারের যে-সমুদ্রতীরবর্তী অবস্থান সবকিছুর একটা বিন্যাস আমি দেখতে পাই। যেমন ‘অয়ি তরঙ্গমালা-১’ কবিতায় একটা জায়গায় দেখুন:
সমুদ্র দূরত্বে কথা বলি আমরা
আকাশ দূরত্বে কথা বলি আমরা
নক্ষত্র দূরত্বে কথা বলি আমরা
যতক্ষণ কথা বলি ততক্ষণ
পরস্পর নিবিড় আশ্রয় …
এই পাঁচটা লাইন পড়ার পর আমার কাছে মনে হয়, আমি যে তাঁর সঙ্গে সবসময় কথা বলি সেই কথাগুলোই তুষার বোধ হয় বলছেন। আপনি বা যে-কোনো পাঠক এটা ভাববেন। জানি না তুষার কী ভেবে লিখেছেন, পাঠক হিসেবে আমি এভাবেই দেখবো যে তুষার সমুদ্রের দূরত্বের কথা বলছেন। শুধু তিনি নন, আমাদের সমাজে যেগুলো হচ্ছে, আমরা যেন সমুদ্রের দূরত্ব থেকেই লিখছি। আমার একটা কবিতা আছে ‘শাদা শার্ট’— বিশ্বজিৎকে হত্যা করা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কাছাকাছি, সেখানে তাকে কুপিয়েছে, তার সাদা শার্ট লাল হয়ে গেছে, আর লোকজন ভিডিও করেছে। কত লোক ভিডিও করেছে, শত লোক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে! কেউ বাঁচাতে যায়নি। সবাই যেন দর্শক! সবাই যেন যোজন দূরত্বে, সমুদ্র দূরত্বে অবস্থান করছে। শত শত লোক গিয়ে যদি গুটিকয়েক দুর্বৃত্তকে ধরত, তাকে বাঁচানো খুব কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু আমরা যেন সমুদ্র দূরত্বে বাস করি। এরকমভাবে আমি দেখেছি যে, তুষারের কবিতাগুলোর অনেক স্তর আছে, পাঠের এবং বোধের। এ জিনিসটা আমাকে খুবই আকৃষ্ট করেছে। আরেকটা জায়গা থেকে একটু উদ্ধৃত করি:
তরঙ্গ, চুপ হয়ে আছি
কলমে বিদীর্ণ কালি পুনরাবৃত্তি মনে হয়
রক্তধারা থামাতে পারিনি …
[অয়ি তরঙ্গমালা-৫]
এই যে আমরা রক্তধারা থামাতে পারছি না। একের পর এক আমাদের মৌলবাদী, ধর্মান্ধদের আঘাত, তাদের আক্রোশ আমাদের সৃজনশীল প্রাণগুলো কেড়ে নিচ্ছে, সেই ব্যর্থতার কথা এখানে উঠে এসেছে। এবং সেটা যে অপরাধ, সেটার ব্যাখ্যা একটু পর আমরা পাচ্ছি:
কালো কালি যে আলো করে বিকিরণ
তার আকর্ষণ পরাহত উন্মাদের কাছে
পুন্যলোভের ফাঁদে কীটানু পতঙ্গ—ধারাল কৃপাণ
প্রতিদিন ধড়হীন দেহ ফেলে যায় রাস্তায়!
কী বিবর্ণ এ দৃশ্যটা! কী ভয়াবহ এ দৃশ্য! এটা কবির কলমে কী ভয়ংকরভাবে দৃশ্যায়িত হয়েছে যা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মন বিষণ্ন হতে বাধ্য। কারণ দৃশ্যটা আমার চোখে ভাসছে। কবি দৃশ্য তৈরি করে, দৃশ্যপট তৈরি করে এবং তাকে কত স্তর দিতে পারে, তা আমি দেখতে পারছি। এই কবিতারই ৭ম অংশে উল্লেখিত ‘অপ্রকাশের ভার প্রকাশিত হয় নিজস্ব নিয়মে’—এই পঙক্তিতে ফিলোসফি উঠে এসেছে, ‘হলাহল উগরে দিয়েছ অবশেষে/ যা কিছু তোমার ধমনীতে সঞ্চারিত/ রাহুগ্রস্থ পৃথিবীর থেকে—’। আরেকটু পরে আবার দেখি:
অন্তর গভীরে তবু বয়ে যায় প্রেমনদী
স্তরীভূত শিলার অতলে বিশুদ্ধ পানীয় জল
নিজেকে নিঃশব্দে বহমান রেখে দিতে জানে…
তুষার কিন্তু প্রগতিপন্থী লেখক, হতাশার লেখক নন। তুষার আমাদের বলছেন, ভেতরে কিন্তু বহমান একটা বিশুদ্ধ পানীয় জল আছে গভীরে, অনেক গভীরে—তাকে আমাদের বের করে আনতে হবে। এই জায়গাটা তুষার আমাদের ইঙ্গিত করছেন। এই বাস্তবতা, অন্ধকারের মধ্যে চারিদিকে কাটা করোটি, তারই গ্যালাক্সিতে আমরা—ঘুরছি ছায়াপথে। সেই ছায়াপথে আমরা, কিন্তু তার তলায় কোথাও না কোথাও, কোনো এক গভীরে বিশুদ্ধ পানীয় জল নিশ্চয়ই বিরাজ করছে। আমি জানি না আমি সঠিক বুঝেছি কিনা, তুষার ভালো বলতে পারবেন, এটাই আমার কাছে মনে হয়েছে।
আরেকটি কবিতায় তাঁর আরেকটি চিত্রকল্প, ‘তোমার শরীর যেন রৌদ্রধোয়া রক্তের বিপদ’—আমার হঠাৎ করে মনে হলো, অনেকদিন পর যেন ‘সোনালী কাবিন’-এর মতো উজ্জ্বল পঙ্ক্তির বিভায় উদ্ভাসিত হলো। এত সুন্দর পঙ্ক্তি !
তোমার শরীর যেন রৌদ্রধোয়া রক্তের বিপদ
আমি কোন বোধে যাব বলো তোমার নিকট
বলো কোন সর্বনাশে, পলিপড়া নদীজলে
শুশুকের স্বগতোক্তি থেকে তোমার উৎসারণ
[তুমি বিগ্রহ জ্যামিতিপথে]
এই যে দৃশ্যকল্প হঠাৎ তৈরি করার মুনশিয়ানা, এটা আমি তাঁর প্রায় কবিতায় পেয়েছি। আগের বইগুলোতেও তার প্রকাশ দেখেছি। বইগুলো হাতের কাছে নাই দেখে উদ্ধৃত করতে পারছি না। আমার ইচ্ছা ছিল একটা নিবন্ধ আকারে তৈরি করে নিয়ে আসতে, কিন্তু সময়ের অভাবে সেটা সম্ভব হলো না।
‘জঙ্গিদেশে সরস্বতী’, এখানে দেখেন তিনি কিভাবে লিখছেন, ‘সরস্বতী জন্ম নিলেন জঙ্গিদেশে’—যেখানে অন্ধত্ব, যেখানে ধর্মের নামে অন্ধকার আমাদের জেঁকে বসছে, সেখানে বিদ্যাদেবী, সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর অবস্থান তিনি তুলে আনছেন এই কবিতায়:
সরস্বতী জন্ম নিলেন জঙ্গিদেশে
গোলাপরাঙা রাতুল চরণ পাহাড় ঠেলে
এক হাতে তার খুলছে সাদা বইয়ের পাতা
অন্য হাতে বাজছে রুবাব সোয়াতকূলে’
দেখেন এখান তিনি সোয়াতের কূলে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের, সেখান থেকে মালালা—সেটা কোথায়? পাকিস্তানে! আমরা পাকিস্তানের সেই মালালাকে কার সঙ্গে তুলনা করছি? সরস্বতীর সঙ্গে। এই জায়গাটা দেখে আমি অবাক হয়েছি:
সবাই যখন জীবন্মৃত অন্ধকারে
রাষ্ট্র যখন কাঁপছে ভয়ে থরথর
চতুর্দশী একাই লড়ে চেতন ভরে
ওষ্ঠ জুড়ে দারুণ ফোটা কথকতা
এই যে এখানে যে-চতুর্দশী, তার যে-প্রকাশভঙ্গি, তাকে যে-তুলে আনা—অন্ধকার সময়কে তুষার তার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে বিশ্লেষণ করছেন। কিন্তু সেখান থেকে আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে। এখানেই হচ্ছে তাঁর পজিটিভিটি, তাঁর প্রগতিপন্থী চিন্তার প্রকাশ।
আরেকটি কবিতার দিকে আগাই, ‘এজলাসে বিহ্বল ঘাতক’। আমি হয়তো বুঝতে পেরেছি, আমাদের যে-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, যারা হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে, নরঘাতক ও নরপশুর মতো তাদের যে-আচরণ, তাদের যে-লোভ—আদালতে আবার সেই নগ্ন রূপ প্রকাশ পেয়েছে। কাদের সামনে প্রকাশ পেয়েছে? তাদের সন্তানদের সামনে, তাদের পরিবারের সামনে। সে সময় এই ঘাতকদল কোনো কথা বলতে পারেনি। তারা বিহ্বল হয়ে বসে আছে, হতবাক হয়ে বসে আছে। তারা ভাবেনি তাদের এ নগ্নতা, পশুবৃত্তি, নেগেটিভিটি তাদের পরিবার ও স্বজনদের সামনে প্রকাশ পাবে। এই চমৎকার কবিতায় বিশ্লেষণটা খুব সুন্দরভাবে এসেছে। পড়লে আপনার মনে হবে, একাত্তরের ট্র্যাজেডিটা আবার জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভাসছে।
একইভাবে আমরা যদি আরেকটা কবিতা, এখানে আসলে একটা নয় তিনটি কবিতা—সেটা হচ্ছে ‘অন্তর্জালে অভিমন্যু’। আমরা জানি অভিমন্যু মহাভারতের সেই অবিস্মরণীয় চরিত্র যে যুদ্ধে গিয়েছে এটা জেনে যে সে ফিরে আসতে পারবে না। কারণ সে যুদ্ধে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গেছে, ফেরার যে-টেকনিক সেটা সে জানে না। তো সেই অভিমন্যুর মতো যারা জানে এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তারা শেষ হয়ে যাবে। আমাদের সেই রাজীব হায়দার, আমাদের সেই তরিকুল ইসলাম শান্ত, ওয়াশিকুর রহমান বাবু—এদের কথা কবিতাক্ৰমে এসেছে : ‘বসন্ত শহীদ’, ‘স্বীকারোক্তি’ এবং ‘বৃষ্টি বৃহন্নলা’। আমি আর কোনো বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। শুধু ‘বৃষ্টি বৃহন্নলা’র কাব্যিক যে-রূপায়ণ, সেটা নিয়ে আমি একটু বলতে চাই।
কী আছে বাংলায় এই বৃষ্টি ছাড়া?
প্রতিকারহীন পাপ, রক্তধারা, চাপাতির কোপে
ছিট্কে পড়া ধূসর মগজ ধুয়ে নিতে দিগন্তরেখায়—
অর্থাৎ এই বাংলায়, এই বৃষ্টির বাংলা, বর্ষার বাংলা—দেখেন এই বৃষ্টিকে, বর্ষাকে রবীন্দ্রনাথ একেবারে ধুয়ে ফেলেছেন। সেই বর্ষার এই নতুন যে-বিশ্লেষণ—আমার তো একটা ধারণা ছিল যে বর্ষাকে নিয়ে আর লেখার কিছু নেই। বর্ষাকে আর কোনো রূপে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে না—এরকম একটা ধারণা আমার সবসময় ছিল। কিন্তু এখানে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? এখানে বৃষ্টি কী করছে? আমাদের এই প্রতিকারহীন পাপ, এই রক্তধারা, চাপাতির কোপে ছিটকে পড়া ধূসর মগজ—বৃষ্টি এগুলো দিগন্তরেখায় ধুয়ে নিচ্ছে।
চৈত্রবন্দি গুমোট বিস্ফার কেটে বিদ্যুৎ ঝলকে নামে
বৃষ্টি বৃহন্নলা (কাপুরুষ সাক্ষী রেখে) সবুজান্ধকারে…
এবার তাঁর যে-নামকবিতা, ‘কাটা করোটির ছায়াপথে’… আমি এটা পড়তে পড়তে শিউরে উঠেছি! শিউরে উঠেছি কারণ, এই হচ্ছে সেই অভিজিৎ হত্যা যেখানে চাপাতির কোপ, তার করোটির পড়ে থাকার ব্যাপার—এগুলোকে বেশ লোমহর্ষকভাবে তিনি তুলে আনতে পেরেছেন। কবিতায় বাস্তবতাকে, দগদগে ক্ষতগুলোকে তুলে আনা এত সহজ কাজ নয়। কারণ কবিরা এমনিতেই একটু আড়ালপ্রিয়, একটু অলঙ্কারপ্রিয়। কিন্তু সেই অলঙ্কার, কবিতার যে-বৈশিষ্ট্য সবকিছুকে রক্ষা করে এসব বাস্তবতাকে কবিতায় নিয়ে আসা অনেক দূরহ বলে আমি মনে করি। যারা কবিতায় কাজ করেন, এখানে অনেকেই আছেন, আমি জানি আপনারা সবাই সেটা মানবেন। আমি একটু করে পড়ি:
পুনরপি এলে অন্ধকারে,শ্বাপদসংকুল ধর্মের জঙ্গলে
একদা আলোর সন্ধানে গিয়ে মেরুদূর, ফিরে আসা এই
বধ্যভূমে ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’—পিছু নেয়া, শান দেয়া
ধারাল চাপাতি অতর্কিত করোটিকে হানে! মগজমথিত
রক্তধারা ফিন্কি দিয়ে নামে জনাকীর্ণ জ্ঞানের উৎসবে
জনাকীর্ণ জ্ঞানের উৎসব—বইমেলা, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের বাংলা একাডেমি— সেখানে আক্রান্ত হন অভিজিৎ রায়, আক্রান্ত হন হুমায়ুন আজাদ। ‘তারা যে নিয়েছে ভার বিধাতার’ … দেখেন এখানে ফিলোসফিও নিয়ে এসেছেন তিনি। এবং বাস্তবতা হলো তাদের যে-পলিটিক্স, রাজনীতির বাইরে তো কিছু নাই —আমরা আবুল হাসান থেকে শিখেছি, ‘দালান উঠছে তাও রাজনীতি,/ দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি’। এই যে এরা ধর্মের নামে আমাদের আক্রমণগুলো করছে :
তারা যে নিয়েছে ভার বিধাতার—মনীষা কতল ক’রে রক্ষা করে বটে
অলৌকিক আসমান তাঁর! মৃত্যুরায় নিয়ে অভিজিৎ রায় উবু হয়ে
পড়ে আছেন রাস্তায়;
কিভাবে তিনি ঘটনার পেছনের পরিপ্রেক্ষিত এবং তার কাঠামো বিন্যাসকে মিলিয়েছেন, তার সঙ্গে তিনি বিশ্ববীক্ষার সংশ্লেষ ঘটিয়েছেন, সেটা আমরা এখানে পাচ্ছি কোথায়? এখানে দেখুন:
মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে,
আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ভস্মীভূত বইয়ের বিলাপ
নালন্দা পোড়ানো শতবর্ষী আগুনের আঁচে
নিমরুদ ও হাত্রায় ভাস্কর্য হত্যার উল্লসিত স্বর
ঘিরে রাখে চোখবাঁধা রায়ের বাজার—
নিভে গেছে উদ্যানের আলো, মোহনায়
অনেক মানুষ নির্বিকার দেখে চলে যায়
মৃত্যু মহিমাবিহীন আজ শ্যামল বাংলায়;
এই যে এখানে আলেকজান্দ্রিয়া, নালন্দা থেকে শুরু করে আমাদের একাত্তর সবগুলো দিক উঠে এসেছে—রায়েরবাজার বধ্যভূমি যেখানে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। আমি এই ‘কাটা করোটির ছায়াপথে’ থেকে আরেকটি পঙক্তি পাঠ করছি যেখানে তাঁর কাব্যিক বোধ ও বিষয়গুলোকে কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন, আমি দেখাচ্ছি:
আমাদের সিংহাসন চাই, মনুষ্যবিহীন মরুভূমে
আশ্চর্য খোয়াবনামা উটের গ্রীবায় ঢাকা খেজুরের গাছ
জ্ঞানার্জনে গিরিপথ,চাপাতি অর্জন সংক্ষেপে সম্ভব—
মহিমা কীর্তন তাঁর রক্তসম্ভোগে; সকাল সন্ধ্যা উচ্চনাদ
সপ্ত আসমান ফুটো করে কাঁপে উন্মাদের কল্পিত ঈশ্বর
‘উন্মাদের কল্পিত ঈশ্বর’ আমি যদি এই উপমার বিশ্লেষণ করি যেভাবে তিনি দেখাচ্ছেন—এই যে হত্যাকাণ্ড যার নামে তারা করছে, সেই ঈশ্বরও এখন কাঁপছেন এদের কাণ্ড দেখে, তাঁর আসমান ফুটো হয়ে যাচ্ছে।
কবিতা যে দৃশ্যকল্পের একটা বিশাল ব্যাপার সেটা তার কবিতায় বারবার দেখতে পাই। এখানে যেমন আরেকটা জায়গায় আমরা দেখি:
রাত ওঠে ঘন রাত, রাতের আঠালো চাঁদ
লেপ্টে থাকে শিরীষ গাছের রোমশ শরীর
ঝিঁঝিঁর কোরাস একটানা মন্ত্রধ্বনি
ত্রিভূজ আঁধার ভেঙে আনন্দ গোঙানি …
[মনোপনিবেশ]
আমি এটা পড়তে পড়তে চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম দৃশ্যটা… সেই রাত, আঠাল চাঁদ, কীভাবে কী ঘটেছিল, সেখানে যে-আনন্দের ব্যাপারটা আমি অনুভব করতে পারি। তেমনি তাঁর যে ‘দৃষ্টিভ্রম’ কবিতা, সেখানেও আমি দেখতে পাই তিনি দৃশ্য তৈরি করতে করতে দর্শনও তৈরি করছেন:
আমরা হাঁটছি নদীতীরে, পাশাপাশি এই তো বাসছি ভালো
তীব্র খুনসুটি আর তপ্ত বাক্য বিনিময়ে, যা কিছু পেলাম
আমরা আয়ত্বাতীত প্রকৃতির থেকে তাই শুধু নির্বিরোধ
জল থেকে উঠে আসা মৃদুমন্দ বাতাসের মত খেলা করে
তোমার উড়ন্ত চুলে, আর যা কিছু ইতিহাসের দায় তাই
বিরোধের চিহ্ন হয়ে চলেছে সমান্তরাল—
দেখেন প্রকৃতিতে আমাদের সকলের সমান অংশগ্রহণ, কিন্তু যা-কিছু ইতিহাসের দায় তা নিয়েই আমাদের বিরোধ। সে জায়গাটা কত সুন্দরভাবে, কত সহজভাবে এই পঙক্তিগুলোতে উঠে এসেছে,’যা কিছু ইতিহাসের দায় তাই/ বিরোধের চিহ্ন হয়ে চলেছে সমান্তরাল/—দেখা যায় দূরে দিগন্ত রেখায় তারা মিশেছে বিন্দুতে’।
এই আশাবাদের মধ্য দিয়ে বইটি শেষ হয়েছে, যা তুষারের একটা মাইলফলক কবিতাগ্রন্থ।কাটা করোটির ছায়াপথে যেন পাঠক হৃদয়ের ছায়াপথে আলোকের ঝরনাধারা বিলিয়ে যায়, তা একান্ত কাম্য।
‘যে কান্না কংক্রিট ভেদ করে যায়’ কবিতাটি আমি যখন পড়ছিলাম, রানা প্লাজার ঘটনার কথা মনে পড়ছিল আমার, মনে হচ্ছিল কংক্রিট না আমার পাঁজর ভেদ করে যাচ্ছে। রানা প্লাজার সেই ঘটনার কথা যদি মনে করেন, তাহলে দেখবেন এখানে কীভাবে লিখছেন তিনি, ‘সহস্র সেলাইকলে নিবিড় আঙুলগুলো অবিরাম সুতো ভরে দেয় সুঁইয়ের শূন্যতায়’—এভাবে তিনি সুঁইয়ের সেলাইকে চিত্রিত করছেন এবং তাদের কোথায় বাস, কোথায় তারা কাজ করে? ‘পাষাণপুরীর গায়ে ফাটল দেখার ভয় কাটিয়ে উঠতে চায় আগুয়ান দুপুরের ক্ষুধা, একদিন কাজের কামাই যদি তিন দিনে শোধ দিতে হয়—বুকের ভেতর ভয়, হায়াৎ মউত রয় আল্লাহর হাতে—বাকীটা মালিক আর তার পোষা কুকুরেরা জানে’। দুপুরের খাবারের জন্য তারা বিল্ডিংয়ের ফাটল নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পাচ্ছে না, দুপুরের আগুয়ান ক্ষুধা তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কী ভয়ংকর! দুপুরের ক্ষুধার জন্য তারা এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে আগে ঘোষণা করা হয়েছে বিপদের কথা, ফাটলের কথা জানানো হয়েছে যে এটা নিরাপদ নয়, কিন্তু তারা এগিয়ে যাচ্ছে ‘হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে’ জেনে। আর কার? বাকীটা মালিক আর তার পোষা কুকুরেরা জানে।
‘ডোবার উপরে ভাসে যেই ঘর তিনতলা গাঁথুনির ’পর কী যে কুদরত দশতলা ওঠে আরো দমাদ্দম বেহেশতে যাবার মোকাম—সহস্র সেলাইকলে আঙুলের নিবিড় মগ্নতা প্রার্থনার মত একটানা শব্দ করে বয়ে যায় বড় …’।
দেখেন তারপর ধসে পড়ল, রানা প্লাজা ধসে পড়ল। কী হচ্ছে?
ঐ তো একটি পা তার দ্রুত উদ্বিগ্নতা নিয়ে চাপা পড়ে আছে দেয়ালের নিচে
ঐ তো একটি পা রক্তে আলতামাখা নুপুরের সিঞ্জনী বাজায় আকাশের দিকে
ঐ তো হাতদুটো থরথর বাঁচার আকুতিঘেরা প্রার্থনায় স্থির
ঐ তো কাঁধে পৃথিবীর ভার নিয়ে ধুলায় লুটায় প্রমিথিউস’
তারপর দেখুন:
আমাকে উদ্ধার করো না হয় আমার পা কেটে
আমাকে উদ্ধার করো আমার দু’হাত ভেঙে
তিলে তিলে আয়ু এই নিঃশেষ হবার আগে বের করো
পাতালে ক্রমশঃ ডুবে যাওয়া যক্ষপুরী হতে
নন্দিনীকে বের করো রাজাকে শোনাবে যে
সেলাইকলের মূর্চ্ছনায় জেগে ওঠা গান …
আমাকে উদ্ধার করো হে দেবতা মুনাফার!
‘রক্তকরবী’র নন্দিনীর কথা এসেছে যে গান শোনাতে চায় রাজাকে। আমি জানি না, আপনারা আবেগটা বুঝতে পারছেন কি না! কেন আমি বলেছি যে এই কবিতা আমার পাঁজর ভেদ করে গেছে।
নারী শ্রমিকদের নিয়ে তাঁর আরও একটি কবিতা ‘বস্ত্র দেবতার বরাভয়’। নামের ভেতর দেখুন—বস্ত্র দেবতার বরাভয়, কীভাবে শুরু হয়েছে কবিতা—’তোমার সেলাইয়ের হাত খুব ভালো/ তোমার রক্তে শত যুগের সেলাইকর্মের স্মৃতি’, তো আমি সেখান থেকে না গিয়ে যাচ্ছি আমাদের যে-নারী শ্রমিক, তাদের যে-বংশধারা ও পরম্পরা, সেটা তিনি কীভাবে প্রকাশ করছেন:
তোমাকে সে পেয়েছে এই জলাভূমি কাদার দেশে
যে মাটিতে শস্য ফলে সে মাটিতেই প্রতিমা গড়েন
তোমার পিতামহ, আল্পনা আঁকা তোমার পিতামহী
কারুকার্যে ভরা পিঠাগুলো দারুণ বানাতেন …
তুমি খুব অনুগত, সংসারে কাজের চাপ যত বাড়ে
তোমার হাতের সংখ্যাও তত বেড়ে যায়, তুমি দশভূজা
নির্বিবাদে সব কাজ করে যেতে পারো হাসিমুখে
সেই নারীকে আমাদের জন্য কাপড় সেলাইয়ের দিকে ঢুকিয়ে দিয়েছে, কারণ তারা বসতভিটাহীন। তাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই, মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে তাদের কাজ করতে হয়।
‘ভাস্কর্যে প্রোথিত প্রাণ’, এই কবিতায় তুষার আরও স্পষ্ট হয়েছেন যেটা অভিজিতের হত্যাকারীদের নিয়ে আগে লিখেছেন, ধর্মান্ধদের নিয়ে আগে লিখেছেন। এখানে এসে তিনি আকার ও নিরাকার যে লড়াই তাকে স্পষ্ট করেছেন। স্পষ্ট করছেন এইভাবে:
আকার ও নিরাকারে কী বিরোধ, হে ধর্মষাঁড়?
নিরাকার চৈতন্যের লীলাময়ী প্রকাশের সাধ
ঝলকে ঝলকে ফুটে ওঠে রূপমুগ্ধ সমূহ আকারে!
তুমি কি নও অন্তর্গত তার?
এবং এই কবিতার শেষদিকে এসে বলছেন, ‘আমাদের ইতিহাস বয়ে চলে/ মর্মরে খোদিত মানবসত্তার …/ তুমি কে ভাঙার সেটা অন্ধ জানোয়ার?’ এখানে তিনি প্রকাশ্যে এসেছেন শিল্পীতভাবে।
সড়ক আন্দোলন নিয়ে আমরা জানি, আমাদের ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছিল। নিরাপদ সড়ক চেয়ে আন্দোলন এবং আমরা দেখেছি দুদিন তারা আমাদের বড়োদের কীভাবে শাসন করেছিল, তাদের ত্রুটি কীভাবে তুলে ধরে দেখিয়েছিল। সেটা তাঁর ‘কিশোর বিদ্রোহ’ কবিতায় তুলে এনেছেন। ছোটো কবিতা, ছন্দোবদ্ধ, এত চমৎকার—খুব অল্পের ভিতর সবকিছু এ কবিতায় তুলে আনেন।
যান উন্মাদ মৃত্যু সড়ক
স্বেচ্ছাচারের গাড়ি
তর্জনী দিয়ে থামিয়ে করে
লাইসেন্স তল্লাশি …
অস্তগামী পাপের বোঝা
শিশুর কাছে নত,
অর্ধশত বর্ষের ক্লেদ
ঝরছে অবিরত!
পঞ্চাশ বছরের স্বাধীনতা যখন আমরা উদযাপন করছি, তখন শিশুরা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে আমাদের পাপের বোঝা। আমরা শিশুর কাছে নত হয়েছি সেদিন।
তার মানে তুষার কেবলই প্রতিবাদ ক্রান্তিকালের উচ্চারণ নিতেই মগ্ন থাকেন তা নয়। ‘বসন্ত বিপ্লব’ কবিতায় বিপ্লব এবং একাত্তরের পাশাপাশি প্রেমও এসে পড়ে অবলীলায়। এখানে ফাগুনের সঙ্গে যেমন প্রেমের বসন্তের সুবাস ছড়ায়, তেমনি ছড়িয়ে পড়ে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিও।
আজকে যদি হাঁটতে পারি তোমার সঙ্গে
ফাগুনরাঙা পলাশমাখা হৃদয়পুরে
আঙুলগুলো খুঁজছে আড়াল আঙুল মাঝে
শব্দগুলো বিহ্বলতায় যাচ্ছে মিশে
আজকে ফাগুন আগুন রাঙা বিপ্লবী সুর
ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপছে হৃদয় সমুদ্দুর
গেরুয়া তোমার শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দাও
কপাল জুড়ে লাল টিপের ওই সূর্যখানা
উঠছে যখন একাত্তরের আলোয় ভরে
তখন কেন রাখবে দূরে মর্মে গাঁথা
হৃদয় জুড়ে গাদা ফুলের কথকতা!
‘স্বীকারোক্তি’ কবিতায় তুষার প্রেম ও শৃঙ্গারের প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন ঠিকই। ভালবাসেন তিনি দোলনচাঁপা মুখ, ভ্রুপল্লবের প্রেম, সবকিছুই যথার্থ উপস্থিত বটে। তবে, কবি যখন গণজাগরণের শ্লোগানে মুখর, তখন মানসিক দূরত্বে থাকা নারীর কাছে তা নাস্তিক্য প্রতিভাত হয়, যার জবাবে অবলীলায় কবি প্রেয়সীকে তার বেদনার্ত কিন্তু দৃপ্তস্বরে স্মৃতি থেকে তাকে মুছে ফেলার অনুরোধ করেন।
‘স্লোগানে স্লোগানে আমি যখন ফেটেছি কণ্ঠে
রক্ত তুলে গণজাগরণে, তুমি যদি তাকে নাস্তিকতা বলো
কীভাবে মিলন হবে আমাদের এই জন্মকালে, প্রদোষ বেলায়?’
[…]
‘চেতনার বিষে বিষক্ষয় করে তোমাকে শুদ্ধ করে নেব
সে সাধ্য আমার নেই—’
[…]
একদিন অকপটে যেই কথা বলেছি তোমাকে
তোমার অন্তরে যদি তা গভীর দাগ কেটে থাকে
ধীরে ধীরে মুছে দিও তাকে বিস্মৃতির নরম পরশে …
[স্বীকারোক্তি]
মাঝেমাঝে প্রেমিক কবির দৃষ্টিভ্রমও ঘটে। কবি বর্ণনা করেন প্রেয়সীর সঙ্গে খুনসুঁটি ও বিবাদের ভেতর দিয়ে নদীতীরে হেঁটে বেড়ানোর। আর আয়ত্বের অতীত প্রকৃতির সঙ্গে প্রেয়সীর উড়ন্ত চুলের তুলনা ভেসে আসে কবিতায়।
আমরা হাঁটছি নদীতীরে, পাশাপাশি এই তো বাসছি ভালো
তীব্র খুনসুটি আর তপ্ত বাক্য বিনিময়ে, যা কিছু পেলাম
আমরা আয়ত্বাতীত প্রকৃতির থেকে তাই শুধু নির্বিরোধ
জল থেকে উঠে আসা মৃদুমন্দ বাতাসের মত খেলা করে
তোমার উড়ন্ত চুলে,
[দৃষ্টিভ্রম]
পাহাড়ি পথে চলতে চলতেও কবি নারীর রূপে মুগ্ধ হন, তুলনা করেন চিত্রল হরিণার সঙ্গে।
আবার এসেছ চর্যা, আঁকাবাঁকা পথ ঘুরে
অজস্র রেখায় বন্দী পাহাড়ের সানুতল …
গড়িয়ে পড়ছে জল ছলচ্ছল করতলে
বিস্মৃত জলের তৃষ্ণা বুকে চিত্রল হরিণী তুমি
জলপান করো … করো জলপান!
কিন্তু এইসব একান্ত ব্যক্তিক প্রেম তুষারের বয়ানে প্রায়শঃ সামষ্টিক সমস্যাকে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায়। তাই কবির কলম থেকে উৎসারিত হয় ‘নিখিলাগ্নি নুসরাত’-এর মতো জ্বলন্ত কবিতাবলী। এছাড়াও বিশ্বকবিতার পরিমণ্ডলে তুষারের কবিতা নানা অনুষঙ্গের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ‘ক্রিস্টাল কন্যার দেশে ক্রিসমাস আসে’, ‘নিউইয়র্কের সামান্য দর্শন’, কিংবা ‘চিকাডি ও বৌনদী’ সহ বেশ কয়েকটি ভিন্নমাত্রার কবিতায়।
আরেকটি বিষয় হলো ‘করোনা’। মানবজাতিকে নতুন শিক্ষা দিয়ে গেল এই বিশ্বমারী। আমাদের কবিও এই করোনার ধ্বংসলীলায় বহু মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন অন্য সকলের মতো। ‘করোনা সংক্রান্তি’ ‘বারবারিকের যুদ্ধ দর্শন’ ও ‘করোনা আয়না’ কবিতাগুলো কবির মর্মযাতনার স্বাক্ষর হিসেবে বিদ্যমান। পুরো বইটি ফর্ম বা অবকাঠামোগত নিরীক্ষাধর্মিতা অপেক্ষা বিষয় বৈচিত্র্যে বহুবর্ণিল হয়ে দীপ্যমান।
সমুদ্র দিয়ে কবি এই গ্রন্থের যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং সমুদ্র দিতেই তিনি শেষ করেছেন। শেষ কবিতায় তুষার আমাদের ইঙ্গিত দিচ্ছেন সম্ভাবনার—সেটা হচ্ছে ‘সমুদ্র জাগছে দূরে’:
বালি, এইখানে বালি, সাদা ধু ধু বালিয়াড়ি
আকাশ গড়িয়ে নামে আলো চন্দ্রাহত
জোৎস্না মাড়ানো পর্যটক পায়ে পায়ে
দূরে জাগছে সমুদ্র নৈঃশব্দের গায়ে এঁকে
গম্ভীর শঙ্খের ধ্বনি, দুপুরে ভাটার টানে
হঠাৎ উধাও জল, বালির পাঁজর ফুঁড়ে
উন্মোচিত শূন্য চরাচর এখন উঠছে ফুঁসে
গর গর রাগে জল,
জল কিন্তু ফুঁসে উঠবেই! সেই যে আগে কবিতায় বলা হয়েছিল গভীরে বিশুদ্ধ জলটা আছে, সেই জল আমাদের বিকশিত হবে। এই আশাবাদের মধ্য দিয়ে বইটি শেষ হয়েছে, যা তুষারের একটা মাইলফলক কবিতাগ্রন্থ।কাটা করোটির ছায়াপথে যেন পাঠক হৃদয়ের ছায়াপথে আলোকের ঝরনাধারা বিলিয়ে যায়, তা একান্ত কাম্য।