কবিতা উন্মূল জীবনের আখ্যান নয়। আকস্মিক কোনো ঘটনার সংবাদভাষ্যও নয়। তবু এই দু’য়ের মিথস্ক্রিয়ায় কবিতার শরীর ও আত্মার সৃজনক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বিশ্বচরাচরের যেকোনো ঘটনাপ্রবাহ যেমন কবিতাকে ঋদ্ধ করতে পারে, তেমনি মানবমনের যেকোনো গহন কথাও একে প্রণোদিত করে। কবি সেখানে অনুলিখক মাত্র। অনেকটা অনুপ্রেরণার ফলই এ ধরনের কবিতা। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচক, পাঠক হয়তো কবিতায় অনুপ্রেরণার প্রসঙ্গকে অস্বীকারও করতে পারেন।
প্রকৃত কবিতা অনেকটা ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। ঐতিহ্যকে ধারণ করে যে কবিতার সৃজনক্রিয়া সম্পন্ন হয়, সে কবিতার আয়ুষ্কালও দীর্ঘ হয়। কবিতা থেকে কবিতা সংক্রমিত হওয়ার বিষয়টি একটি সাধারণ ও স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায় মাত্র। কিন্তু কোনো কোনো অনুপ্রাণিত কবি পূর্বসূরির প্রভাব স্বীকার করতে অনীহ। অথচ আপন কবিতার ধমনির ভেতর অহরহ অনুভব করেন পূর্বসূরির কবিতার বিপুল ঋণ। শুধু কবিতার নয়, পূর্ববর্তী, দূর অতীতের কোনো ঔপন্যাসিক, নাট্যকার কিংবা দার্শনিকও অনুপ্রাণিত ও উত্তরসূরির চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখেন দীর্ঘদিন। উপকবি, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর কবি পূর্বসূরির ঋণস্বীকারে বিব্রতবোধ করেন। কারণ তাদের ঋণপরিগ্রহণের পরিমাণ এমন আশঙ্কাজনক যে, ঋণপরিশোধের পর সারবত্তা বলে কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। বড় কবি পূর্বসূরির সৃষ্টিকর্ম থেকে ঋণপরিগ্রহণ করেন এবং ঋণগ্রহণ করেন সমসাময়িক কবি-কথাসাহিত্যিকের সৃজনভুবন থেকেও। উত্তরসূরির মন ও মননরাজ্যও তার চেতনালোকে প্রভাব ফেলে। প্রত্যেক শক্তিমান কবি তার সৃজনকর্মের রসদ সংগ্রহ করেন আরেক শক্তিমান, দুর্বল, উপকবি, তৃতীয় শ্রেণীর মননভূমি থেকেই। সৎকবি বিষয়টি স্বীকার করেন, উপকবি অস্বীকারের ভেতর আত্মপ্রসাদ খোঁজেন।
কবি ঋণগ্রহণে যতটা স্বচ্ছ, ততটা স্বীকার না করলে চৌর্যবৃত্তির দায়ে তাকে অভিযুক্ত করা যায়। কাল সে রকমই করে। সঙ্গত কারণে ঋণস্বীকারও কবির কাব্যকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কোনো কোনো ভাষার একটি বিশেষ বাঁকবদলের ক্ষেত্রে সমসাময়িক প্রধান কবিদের ভেতর ঋণপরিগ্রহণের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বিষয়টি অনেকটা অবচেতন মনেও ঘটে। সচেতনভাবেও। অবচেতন মনে ঘটে, কারণ পঠিত বিষয়টি আত্মস্থ হয়ে যাওয়ার পর অনেক সময় বিনির্মাণের হাত ধরেই কবির কবিতায় উদ্বোধন ঘটায়। যেমন বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশ। সাধারণত ইয়েটসের প্রভাবের বিষয় বোদ্ধাপাঠক ও সমালোচকরা উল্লেখ করেন। এলিয়টও যে তার কবিমানসকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল দীর্ঘকাল, সে বিষয়টি অনেকেই এড়িয়ে যান।
ঋণপরিগ্রহণের প্রশ্নে ইয়েটস-এর ‘দ্য স্কলার্স’র সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের ‘সমারূঢ়’র প্রসঙ্গ সুবিদিত। জীবানানন্দ দাশের একটি কম পঠিত কবিতা ‘ভিখিরি’। এটি পাঠক সাধারণের তেমন দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে পারেনি। কারণও সহজ। এটি তার শিল্পচূড়াস্পর্শী অন্যান্য কবিতার ভিড়ে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নয়। কিন্তু এ কবিতাটিই জন্ম দিয়েছে পরবর্তীকালে একাধিক কবিতা। যা লিখেছেন একাধিক শক্তিমান কবি। একটি মৌল ভাবনা কবি থেকে কবিতে রূপান্তরিত হয়, কবির পাঠ, আচরণ ও অভ্যাসের ওপর। রুচিবোধের পার্থক্য ও সামঞ্জস্য এবং সাদৃশ্যও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবার দেখা যাক কয়েকটি কবিতার মূল পাঠ ও অনুসৃত কবিতার পাঠ।
মূলপাঠ
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো
তবে আমি হেঁটে চলে যাবো মানে মানে
বলে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত।
আগাগোড়া শরীরটা নিয়ে এক কানা যেন বুনে যেতে চেয়েছিলো তাঁত;
তবুও তা নুলো শাখারীর হাতে হয়েছে করাত।
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোঠা ঘুরে
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি পাথুরিয়া ঘাটা
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো
তা হলে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা।
-বলে সে বাড়ায়ে গ্যাসলাইটে দিলে মুখ।
ভিড়ের ভিতরে তবু হ্যারিসন রোডে-আরো গভীর অসুখ
একপৃথিবীর ভুল; ভিখিরির ভুলে: একপৃথিবীর ভুলচুক।
(ভিখিরি: জীবনানন্দ দাশ)বিনির্মাণ: অনুসৃতি
যদি বাঁচি চার দশকের বেশি
লিখবো।
যদি বাঁচি দুই দশকের কম
লিখবো।
যদি বেঁচে যাই একটি দশক
লিখবো।
যদি বেঁচে যাই দু’চার বছর
লিখবো।
যদি বেঁচে যাই একটি বছর
লিখবো।
যদি বেঁচে যাই একমাস কাল
লিখবো।
যদি বেঁচে যাই একদিন আরো
লিখবো।
(ইচ্ছা: শামসুর রাহমান)মূলপাঠ
আমি যদি হতাম বনহংস;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে,
তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে
ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ
(আমি যদি হতাম: জীবনানন্দ দাশ)বিনির্মাণ: অনুসৃতি
যদি আমি হতাম হুডিনি
তাহলে আমার জাদুদণ্ডের ছোঁয়ায়
যাবতীয় বন্দুকের নলগুলি এক লহমায়
হতে যেত পাখিদের চোখ,
সারি সারি ট্যাঙ্কের বদলে
বেবাক বার্থ-ডে কেক দিতাম সাজিয়ে,
যোজন যোজনব্যাপী সেনাবাহিনীরকুচকাওয়াজকে
দিতাম বানিয়ে
তন্বী ব্যালেরিনাদের অপরূপ রাজহংসী নাচ,
আর জেনারেলদের মেডেলগুলিকে
মল্লিকা, টগর আর খোদ সমর-নায়কদের
বাংলার বাউল!
যদি আমি হতাম হুডিনি,
তাহলে আমার জাদু-দণ্ডের ছোঁয়ায়
চোখের পলকে পৃথিবীর সবগুলি
বোমারু বিমান হতো পারাবত আর
নিউট্টন বোমা
তাজমহলের জ্যোৎস্না-সফেদ গম্বুজ।
(যদি আমি হতাশ হুডিনি: শামসুর রাহমান)
আবদুল মান্নান সৈয়দের কোনো কোনো কবিতা এতইটা সংক্রামক যে, পরবর্তী সময়ে কোনো কোনো কবি তার এসব কবিতা থেকে নতুন কবিতা সৃষ্টির সামর্থ্য দেখিয়েছেন। যেমন ‘বুদ্ধিজীবী’ ও ‘রাস্তা’। ‘বুদ্ধিজীবী’ কবিতার অনুসরণে ব্রাত্যরাইসু লিখেছেন ‘বুদ্ধিজীবীদের কথা খুব শুনতে ইচ্ছা করতাছে’। আবার রাস্তা কবিতার অনুসরণে আবিদ আজাদ লিখেছেন ‘কবিতা দিকে’ এবং ময়ুখ চৌধুরী লিখেছেন ‘চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি’। পাঁচটি কবিতার পাঠোদ্ধার করে বিষয়টা পরিষ্কার করা যাক।
মূল কবিতা:
সময় ছিলো না, তাই মিছিলে হয়নি তাঁর যাওয়া
তাছাড়া আজকাল মিছিলে প্রচণ্ড ভিড় হয়,
আর ছেলেছোকরাগুলো বেয়াদব বড়ো।
তবে কি না প্রতিবাদলিপিতে স্বাক্ষর দিয়েছেন দ্বিধাহীনভাবে
দিয়ে তৃপ্তি পেয়েছিলেন গভীর।
পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে,
খবর-কাগজ আসা মাত্র হুমড়ি খেয়ে পড়েন কাগজে:
হ্যাঁ, জ্বলজ্বল করছে বটে তাঁর নামখানি,
তবে অমুকের পরে তাঁর নাম ছাপা কি হয়েছে ঠিক?
অমুক ছোকরার পরে!
(বুদ্ধিজীবী: আবদুল মান্নান সৈয়দ)বিনির্মাণ: অনুসৃতি
ভারী বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কিছু বলুন এবার
ভারী বুদ্ধিজীবীরা খুবই বুদ্ধিজীবী, রাশভারী
………..
ঝামেলা এড়িয়ে চলে। নিরাপদ দূরত্ব থেকে
সঠিক বিবৃতি ছাড়ে-লক্ষ্যবস্তু বাদ দিয়ে আশেপাশে লাগে
অথচ তাতেও তৃপ্ত, রাশভারী, কথা বলে কম
হাসিতে অক্ষম
(বুদ্ধিজীবীদের কথা খুব শুনতে ইচ্ছা করতাছে: ব্রাত্য রাইসু)মূল পাঠ
রাস্তা, তুমি কোথায় গিয়েছো?
-আমি গেছি নারীর শরীরে।
রাস্তা, তুমি গিয়েছো কোথায়?
-আমি গেছি কবরে, শ্মশানে।
রাস্তা, তুমি মিশেছো কোথায়?
-মিশে গেছি ঘাসের ভিতরে।
রাস্তা, তুমি কোথায় মিশেছো?
-মিশে গেছি সন্ধ্যার আকাশে।
রাস্তা, তুমি চলেছো কোথায়?
-আমি যাচ্ছি আশ্চর্য রাস্তায়।
(রাস্তা: আবদুল মান্নান সৈয়দ)বিনির্মাণ: অনুসৃতি ১
-কোন দিকে যাবে, বাঁয়ে?
-না।
-কোন দিকে যাবে, ডানে?
-না।
-কোন দিকে যাবে, উত্তরে দক্ষিণে পুবে না পশ্চিমে?
-আমি কবিতার দিকে যাবো।
-কোন পথে যাবে?
-সব পথে যাবো, সব পথই গেছে কবিতার দিকে।
(কবিতার দিকে: আবিদ আজাদ)বিনির্মাণ/অনুসৃতি:২
-এই রিক্সা যাবে নাকি?
-যাবো স্যার; কোথায় যাবেন?
-যাবে চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি।
……
-এবার কোন দিকে স্যার?
-সব দিকে যাও। চন্দ্রমল্লিকা যেহেতু নেই কোনোখানে
তার মানে সব দিকে আছে।
তুমি আরও যেতে থাকো-
আকাশে আরেক চন্দ্রমল্লিকার ইশারা তো পাবে!
(চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি: ময়ুখ চৌধুরী)
প্রথম পাঠেই ধরা পড়ে মান্নান সৈয়দের ‘বুদ্ধিজীবী’ কবিতা কী করে ব্রাত্য রাইসুর ‘বুদ্ধিজীবীদের কথা খুব শুনতে ইচ্ছা করতাছে’ হয়ে যায়। আবার মান্নান সৈয়দের ‘রাস্তা’ কী করে আবিদ আজাদ ‘কবিতা দিকে’ ও ময়ুখ চৌধুরী’র ‘চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি’ হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, আবিদ আজাদের ‘কবিতার দিকে’ কবিতাটিকে মূল কবিতা ধরে কবি-সমালোচক আবু হাসান শাহরিয়ার ‘কবিতা অকবিতা অল্পকবিতা’ নামক প্রবন্ধে ময়ুখ চৌধুরী’র ‘চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি’ কবিতাটিকে অনুসরণ কবিতা বলে ময়ুখ চৌধুরীকে অনুরসণকারী কবি বলেছেন। তার কবিতাটিকে ‘অল্পকবিতা’ আখ্যা দিয়েছেন।
গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, অনুসরণের প্রথম কাজটি করেছেন আবিদ আজাদ, অপেক্ষাকৃত সেই দুর্বল অনুকৃতির ভিতের ওপর কিছুটা শৈল্লিক অবয়বে উপস্থাপনের কাজটি করেছেন ময়ুখ চৌধুরী। অনুকরণের প্রসঙ্গ যদি তুলতেই হয়, তাহলে সে অভিযোগ প্রথমে আবিদ আজাদ-এর বিরুদ্ধেই তোলা সঙ্গত। উপর্যুক্ত পাঠোদ্ধার থেকে প্রমাণ করার চেষ্ট করেছি যে, মান্নান সৈয়দ কতটা প্রভাববিস্তারে সংক্রমনশীল কবি। তার দু’টি কবিতা তার সমকালেই পরবর্তী কবিরা কী করে বিনির্মাণ করে নতুন তাৎপর্যসহ উপস্থাপন করেছেন।
এক্ষেত্রে প্রভাব, অনুকরণ, বিনির্মাণ কিংবা ঋণগ্রহণের প্রক্রিয়াও অনেকটা শিশুর আচরণের মতো। কবিমনের গোপন আকাক্সক্ষা আবেগে মথিত এবং প্রবল প্রাণোচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ। কবি কামনার রেশকে স্বর্গীয় ও পরিপূর্ণ পুণ্যে রূপান্তরিত করেন বলে ঝড়ের ভীষণ তাণ্ডব লীলার মধ্যেও মাতাল কবি মাত্রই সৃষ্টির সূচনা দেখতে পান। কবিতা কবির মগ্নচৈতন্যের শব্দচিত্র মাত্র নয়; সে সঙ্গে চিরায়ত সত্যের আন্তরিক বংশীবাদনও। যুগে যুগে কবিতা প্রকাশ করছে, মানবজীবনের ঘটনা ও দুর্ঘটনার চিত্ররূপময় প্রতিবেদন।
সেখানে আনন্দের হিল্লোল যেমন আছে; তেমনি আছে বিষাদের ম্লান ছোঁয়াও। সেখানে নৈতিকতার প্রশ্ন অবান্তর। কবিতা কি আসলে মীমাংসাযোগ্য কোনো শিল্প? না কি বিজ্ঞানের মতো কোনো তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিষয় যে, এর সহজ কোনো সমাধান পাওয়া সম্ভব? কবিতা আসলে বহুতর জটিলগ্রন্থিমোচনের ঘোরের প্রকাশ। কবিতা আনন্দ আর প্রজ্ঞার অনুষঙ্গ যতটা, তারও অধিক ঘোরের, সম্মোহনের। এভাবেই একটি অনুভবও যুগে যুগে বিভিন্ন কবির উপলব্ধির ভেতর দিয়ে কবিতা হয়ে ওঠে।
যুগ্ধ-বিগ্রহ, বন্যা-মহামারী কিংবা স্মরণযোগ্য কোনো ঘটনা একই সময়ে একাধিক কবির মনেও অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে। সে অভিঘাতই একাধিক কবিকে দিয়ে একাধিক কবিতা লিখিয়ে নিতে পারে। একই বিষয়, একই ঘটনা। কেবল প্রকাশশৈলী ও শব্দ নির্বাচনের স্বাতন্ত্র্যবোধের কারণে ভিন্ন কবিতা হতে পারে। যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে যে সব শোকগাথা রচিত হয়, তা আসলে বিলাপ! ততটা, যতটা না হলে মার্জিত হৃদয়বান মানুষ হওয়া যায় না। মার্জিত হৃদয়বান মানুষ হওয়ার পূর্ব শর্ত সহিষ্ণু স্বভাবজাত ও সংবেদনশীল চিত্তের সমন্বয়ে নতুন সত্তার উত্তরণ।
সচেতন প্রয়াসে মূল্যহীন হয়ে যায় কবিতার আন্তঃসংগঠন প্রক্রিয়া। অবশ্য বিশ্ব চরাচরের বহু নিগূঢ় তথ্য ও ঘটনা-দুর্ঘটনার পূর্বাভাষ দেবদূতের মতো কবিরাই সবার আগে জানেন, উপলব্ধি করেন; সে সঙ্গে অন্যদেরকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সতর্কবাণীও শোনান। সে সতর্কবাণীকে স্বয়ং কবিই মূল্যহীন বিবেচনায় উড়িয়ে দেন বাওকুড়ানী হাওয়ার প্রবল ঘূর্ণির ভেতর, স্বপ্নের ভেতর এবং উত্তাল সমুদ্রে ঝড়ের চরম মুহূর্তের ভেতর। ফলে কবির করোটির ভেতর পরস্পর বিরোধী দৃশ্য ও অনুভূতি বারবার ঘাঁই মারে। বোধের সামীপ্যে কোন একক সংজ্ঞাই আর ধ্রুব বলে মেনে নেয় না কবিমন। তাই একই কার্য-কারণ সম্পর্কের আন্তঃসংগঠন প্রক্রিয়ার ভেতর কবি খোঁজেন অনেকার্থক ঘটনার রেশ। যতক্ষণ না কবিমন প্রবোধ পান, তার মনের মুকুরে ভেসে ওঠা সংবেদের সপক্ষে কোনো স্বস্তিদায়ক অনুকল্পের। অবশ্যই কবিতায় সব সময় কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা এবং সে রকম যু্ক্তির অন্বেষণ করা সঙ্গতও নয়। তবে মানব মনের অবদমনকে কবিতায় মূর্ত করে তোলা হয় অনেক সময় মৌল সংবেদ হিসেবে। এই ইচ্ছার অবদমন শেষ পর্যন্ত কবিতা হয়ে উঠলো কী করে, প্রশ্নটা অবান্তর নয় যদিও, তবু সবসময় বিশেষ করে কবির কাছে এরকম প্রশ্নের অবতারণা করা শোভন সম্মত নয়।
এলিয়ট যখন What the Thunder Said কবিতায় শতবর্ষ আগে বলেছিলেন:
I sat upon the shore
Fishing, with the arid plain behind me
Shall I at least set my lands in order?এবার বসেছি তীরে
শিকারেমগ্ন ধীবর, পেছনে রেখেছি উষর প্রান্তর
আমার ভূমির দখল আমি কি নেবো না অন্তত?
(অনুবাদ: মোহাম্মদ নূরুল হক)তখন আপন অধিকার আদায়ে একজন দৃঢসংকল্পক কবিকে চিনি। এ প্রত্যাশার সমধ্বনি শতবর্ষ পরের বাঙালি কবির কবিতায়ও মেলে।
ক্রন্দসী বেহুলা ঘুমে,
সোনার রেকাবে তার এসেছি নোলক।
মাছে-ভাতে স্বপ্নমোড়া গুপ্ত পুলসেরাত;
আমাকে দাঁড়াতে হবে।
কেরামান-কাতেবিন, দ্রাবিড় কিতাবে লিখ প্রত্ম-ইতিহাস।
অ-হল্য জীবন চরে এইখানে দাঁড়ালাম ধৃষ্টলাঠিয়াল:
আমার দখল নেবে কে আছে এমন?
(১০ম সর্গ: লখিন্দরের গান/ কাজী নাসির মামুন)
অন্তরের বাসনা একই। প্রকাশশৈলীই কেবল ভিন্ন। দুই ভাষার দুই কবি শতবর্ষের আগে-পরে অভিন্ন চেতনা লালন করেন। এখানেই কবিতে কবিতে অভিন্ন আত্মার সম্মিলন। এখানেই কবি ঘোরের ভেতর, ঘুমের ভেতর পায়চারী করলে তার নিবিড় পাঠকও তাই করেন। এখানে মানবিক সম্পর্ককে যুক্তিতর্কের উর্ধ্বে তুলে বিবেচনার প্ররোচনা দেন কবি। কারণ মানবিক সম্পর্ক গঠনের ক্ষেত্রে কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয় অবচেতন মনের দহনক্রিয়া ও বিলোড়িত কাক্সক্ষার সমন্বয়ে। সমগ্র অলৌকিকতার মোহকে নির্মোহ মানসিকতায় গ্রহণ করা কবির পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ কবি নিজেও কিছুটা অলৌকিক বাণীর বাহক। কবি দেবদূত হয়েও মাটি-মানুষের ভীড়ে যাপিত জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতকে অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারে যোগ করেন দিনের পর দিন। হয়তো সে কারণে মাঝে মধ্যে কবিকে দেখি কিংকর্তব্যবিমুখ হয়ে পড়তেও। তখন প্রশ্ন জাগে, কবি স্বয়ম্ভু শিল্পী, না ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার?
এ প্রশ্নের সমাধানের মধ্যে একজন কবির মৌলিকত্বের বিষয় নিহিত। স্বয়ম্ভু বা সম্পন্ন এবং ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বিরোধ থাকতে পারে মৌলিকত্ব ও অনুকরণের মধ্যে। কবি অন্যের অনুকরণের মধ্যে নিজের সময় ও মেধার অপচয় ঘটালেন কি না, সে প্রশ্নের মীমাংসা আগে করা জরুরি। কখনো কখনো বিস্মৃতপ্রায় কবির দ্যুতিময় পঙ্ক্তিও উত্তরকালের কোনো শক্তিমান কবির কবিতায় নবজন্ম লাভ করে। সেখানে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ তোলা যায় না। চৌর্যবৃত্তি ও ঋণপরিগ্রহণের ক্ষেত্রে উভয় কবির শক্তিমত্তাও বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। কবি কোনো ভুঁইফোড় প্রাণী নয়। একেবারে পরম্পরাহীন কোনো বিষয় কল্পনা করা তাই তার পক্ষে অসম্ভব। সেখানে নিজের রুচি অনুযায়ী বিষয় বিন্যাস ও নিরীক্ষার সুযোগ কবি গ্রহণ করেন কখনো কখনো। সেক্ষেত্রে অনুকরণপ্রবণতার অভিযোগ কবির বিরুদ্ধে তোলা অসঙ্গত।
(সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য–২০১১ থেকে)