পদ্য-গদ্য যা-ই বলি না কেন সাহিত্য মানেই শব্দের ছবি। কোন চিত্রশিল্পী তার ছবি কিভাবে প্রকাশ করবেন, সেটি নির্ভর করে তার নিজস্ব অবধারণা, মেধা, অভিজ্ঞতা, কল্পনা, নিজস্ব চেতনা, অন্তর্দৃষ্টি ও চিন্তনের ওপর। প্রত্যেক শিল্পীরই নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, স্টাইল, ভাষা রয়েছে; যাতে ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে নিজস্বতার স্বরূপ প্রকাশিত হয়। এ কারণে মানুষের প্রকাশভঙ্গি বিভিন্ন হয়, বিভিন্ন কাঠামো, বিভিন্ন শিল্পরূপ দেখা যায়। সাহিত্যিক মনের ভাব প্রকাশ করেন বা ছবি আঁকেন শব্দ দিয়ে, চিত্রশিল্পীরা ছবি আঁকেন রঙ দিয়ে। উভয় ক্ষেত্রেই প্রকাশের স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান।
কবি নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, আবেগ, ব্যঞ্জনা, অভিজ্ঞতা ও সময়ের প্রেক্ষাপটে আপন ভাবনাকে আপন শৈলীতে চিত্রিত করেন শব্দে, ছন্দে, মাত্রায়, উপমায় ও প্রকরণে। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘ ‘গদ্যে শব্দেরা স্বাধীন নয়। তারা অভিধান-শাসিত।’ কবিতায় ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে স্বাধীনতা রয়েছে যা কেবল কবিই নির্ধারণ করেন। আর ভাষার আভরণে ভাবনার উৎকৃষ্ট রূপটি মেলে পাঠকের সামনে। কবিতার চিত্রররূপের সারফেস বা উপরি-কাঠামো এবং অভ্যন্তরীণ ভাবার্থ আর্কিটেকচার বা স্থাপত্যশিল্পের তুল্য। স্থাপত্যশিল্প ইনটেরিওর ও এক্সটেরিওর রূপকাঠামোতে মোহাকর্ষক হয়ে ওঠে, তেমনি কবিতারও এ দুটি রূপ কাঠামোতে নির্মিত হলে কবিতাও হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে মোহনীয়। ইনটেরিওর রূপ হলো কবিতার ভাব-দর্শন আর এক্সটেরিওর রূপ হলো শব্দ, ছন্দ, মাত্রা, উপমা ইত্যাদির ব্যবহার। শুধু কবিতার ক্ষেত্রে নয়, ফিকশনেও ইমেজ তৈরির নিপুণতাই মানুষের মধ্যে ভালো লাগার আবেগে সিক্ত করে। শিল্পী বুঝবেন, এক্সটেরিওয়র ও ইনটেরিওয়র ডেকোরেশন কিভাবে করবেন? চিত্রকল্প বা ইমেজ তৈরির জন্য থাকা চাই অখণ্ড ও পূর্ণ থিমের বা ভাবের কনসিসটেনসি। এ প্রসঙ্গে ক্রোচের একটি বাক্য উল্লেখযোগ্য—What is called image is always a nexus of images, since image-atoms do not exist anymore than thought-image.
কবিতার শিল্পের স্বরূপই বা কী? কবি কি অডিয়্যান্সকে মাথায় রেখে কবিতা নির্মাণ করেন, না কবিতার ভেতরের ও বাইরের রূপে তৈরি হয় অডিয়্যান্স। এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রত্যেকে শিল্প স্রষ্টাই চান তার শিল্পকর্মের বৃহত্তর অডিয়্যান্স ও শিল্পের অভিকর্ষ রূপ। কোনো কোনো শিল্পী হয়তো অডিয়্যান্সকে মাথায় রেখে সচেতনভাবে শিল্প তৈরি করেন আবার অনেকেই হয়ত সে রকম কোনো বোধের বেড়াজালে বন্দি না হয়ে নিজের ধ্যান-ধারণা নিয়ে নিরিবিলি নিরবধি কাজ করেন যা কালের প্রবাহে তার কর্ম যাচাই করে অডিয়্যান্স তৈরি হয়। দুটি ধারণাই গ্রহণযোগ্য হতে পারে, অডিয়্যান্সকে বিবেচনা করে শিল্প নির্মাণ এবং শিল্পের প্রয়োজনে শিল্প নির্মাণ। একটি কবিতা যখন নির্মাণ করা হয়, তখন কবির মনের ভাব থেকেই উৎসারিত হয় শব্দসম্ভার; যা দিয়ে তিনি কবিতা নির্মাণ করেন ঝরনাধারার মতোই শব্দ প্রবাহিত হয়। কবিতা অন্তত জোর করে সৃষ্টি করা যায় না, কবিতা সৃষ্টি হয় মনের ভেতর থেকে সাবলীল ধারায়। কবিতা পাঠে যদি নদীর স্রোতের মতো মনের ভেতরে একটি সাবলীল ও প্রাঞ্জল ধারা প্রবাহিত হয়, তখন সে কবিতাটি মানুষের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হয়। এছাড়া মানুষের জীবনের কথা আছে, আছে পরিবর্তনের কথা, আছে দর্শনের ভাবনা, আছে চিন্তার খোরাক, আছে মহাজাগতিক রূপের আভাস সেরকম কবিতাও মানুষ গ্রহণ করে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় জাগতিক ও মহাজাগতিক ভাব-দর্শনে চিত্রিত, অন্যদিকে ত্রিশোত্তর অনেক কবির কবিতায় বস্তবাদের আশীর্বাদে ঋদ্ধ। সুকান্তের কবিতায় তৎকালীন সমাজ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট চিত্রিত ছিল বলেই কবিতা দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়েছে। এদিক থেকে বলা যায়, কবিতা শিল্পের জন্য সমসাময়িক সময়ও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
কবিতার ভাষা আবেগের ভাষা। গদ্যের ভাষা চিন্তনের। কবিতার ভাষার আবেগের শব্দসম্ভারে পূর্ণ হলেও এবং প্রতীক ও উপমায় ভরপুর হলেও শব্দের ধ্বনি কবিতাকে চিত্তাকর্ষক করে, পঠনে আসে নদীর স্রোতের মতো সাবলীল স্বতঃধারা। আর তখনই একটি কবিতা হয়ে ওঠে প্রাঞ্জল, ব্যঞ্জনাময়, হৃদয়ে ধারণ করার উপজীব্য। এ কারণে সমার্থক শব্দ জেনে যুতসই ধ্বনির শব্দটিকে যথাস্থানে বসানোর কাজটি যে কবিতা করতে পারেন, সে কবির কবিতাই অধিকতর মানুষের হৃদয় জয় করতে পারে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করা যেতে পারে, ‘গদ্য জ্ঞান লইয়া এবং পদ্য অনুভব লইয়া। বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্থের সাহায্যে পরিস্ফুট হয়; কিন্তু অনুভব কেবলমাত্র অর্থের দ্বারা ব্যক্ত করা হয় না, তাহার জন্য ছন্দের ধ্বনি চাই; সেই ধ্বনি অনির্বচনীয়কে সঙ্কেতে প্রকাশ করে। আমাদের বর্ণনায় যে অংশ অপেক্ষাকৃত অনির্বাচনীয়তর, সেগুলোকে ব্যক্ত করিবার জন্য বাংলা ভাষায় এই সকল অভিধানের আশ্রয়চ্যুত অব্যক্ত ধ্বনি কাজ করে।’
শিল্পের স্বরূপ কী হওয়া উচিত? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি কোনো শিল্পই ফেলনা নয়। একেক শিল্পের একেক ধরনের অডিয়্যান্স তৈরি হয় এবং সে অডিয়্যান্সই সেই শিল্পকে লালন করে কাল থেকে মহাকাল। অনেক প্রথিতযশা শিল্পী হয়তো বাংলাদেশের রিকশার পিছনের আঁকা ছবিকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করবেন না, আবার অনেকেই এই শিল্পকে এখন সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন আয়োজন করেছেন। রিকশার পেইটিংয়ের কারিগর বা শিল্পীরা কখনো শিল্পের চেতনা থেকে ছবি আঁকেননি বরং তারা সাধারণ মানুষ, যারা রিকশায় চড়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ছবি আঁকেন। তাদের নেই শিল্পের লেখাপড়া, নেই বৌদ্ধিক চর্চা। রক্সি পেইন্ট আর কমদামি ব্রাস দিয়েই মনের ধারণা অনুযায়ী কিংবা সিনেমার পোস্টার দেখে দেখে ছবি আঁকেন। অথচ এগুলোও মানুষের আবেগের অংশ, ঐতিহ্যের ধারক-বাহক, সংস্কৃতির অংশ—যাকে পরিহার করার যৌক্তিকতা নেই। কে রিকশা-পেইন্টিংয়ের প্রবক্তা, কারা আঁকেন তাদের নামও আমরা জানি না; কিন্তু তাতে কি আর এই ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাবে?
গ্রাম্যবধূ—যিনি কাপড়ের পাখায় সুতো দিয়ে মরিচের, পাতার, পাখির ছবি আঁকেন, তা অনেকের কাছে হাস্যকর চিত্রকর্ম মনে হলেও এসব কর্মে যে প্রেম ও আবেগ আছে, তার মূল্যায়নও হচ্ছে। ‘যাও পাখি বলো তারে/ সে যেন ভোলে না মোরে।’ বাক্যটি বিদগ্ধজনকে আকৃষ্ট না করলেও এই বাক্যেরও কিন্তু অডিয়্যান্স আছে। এরূপ অনেক বিদগ্ধ কবি বা সাহিত্যিক অনেকের কবিতাকে তাচ্ছিল্য করতে পারেন, যা আমাদের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রামের বাজারে ‘ভটকবিতা’ নিয়ে বিদগ্ধ কবি-সাহিত্যিকরা হাসাহাসি করতে পারেন, তাদের জ্ঞান, লেখাপড়া ইত্যাদি নিয়ে তাচ্ছিল্য করতে পারেন কিন্তু একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, সেই ‘ভটকবিতা’ কিন্তু মূল্যহীন নয়। ‘ভটকবিতা’রও অডিয়্যান্স আছে। অনেক পাঠক সেগুলো পড়েন, আবেগতাড়িত হন এবং সেই কবিতাকে ভালোবাসেন। তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ও মধুসূদন অর্থহীন কিন্তু সেই ‘ভটকবিতা’ অর্থবহ। তাহলে শিল্পের স্বরূপ কী? শিল্পস্রষ্টার ভাবনা তার নিজের জগৎ নিয়ে, তিনি ভাবেন না অন্যের জগৎকে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সিরামিক ইনডাস্ট্রির বিকাশ তেমন ঘটেনি। তখন গ্রামে অনেকের বাড়িতে চিনামাটির প্লেট দেখা যেত যেগুলোতে মরিচের বা পাতার ছবি আঁকা থাকতো। এই শিল্পের ব্যবসায়িক সফলতার দিকটিও এখানে বিচার্য। তারা জানেন মানুষের আবেগকে স্পর্শ না করা পর্যন্ত ব্যবসায়িক সফলতা অসম্ভব। গ্রামের মেয়েদের চিন্তা বা ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হয়তো মরিচ বা পাতার ছবি দিয়ে চিনামাটির প্লেট বানাতেন; যদিও এই ধরনের শিল্পকর্ম বেশিদিন টেকেনি। চিনামাটির পাত্রের শিল্পের বিকাশ এখন চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো নান্দনিক বৈশিষ্ট্যে নন্দিত হচ্ছে।
আগেই বলা হয়েছে স্থাপত্য শিল্পের ব্যঞ্জনার সঙ্গে কবিতা-শিল্পের সাজুয্য পাওয়া যায়। একজনের চোখে যা নান্দনিক অন্যজনের চোখের কাছে নান্দনিক নাও হতে পারে। এখানেও অডিয়্যান্সকে বিবেচনা করা যথার্থ বলে প্রতীয়মান হয়। গাবতীল বাসস্ট্যান্ড পার হলে দেখা যাবে একটি পেট্রোলপাম্পের সামনে বিরাট উড়োজাহাজ স্থাপিত, কী এর তাৎপর্য? কেনই বা টাকা খরচ করে এমন উদ্ভট জিনিসটি স্থাপন করা হলো? এমন ভাবনায় অনেকেই নিমজ্জিত হতে পারেন; কিন্তু যিনি স্থাপন করেছেন তিনি বুঝে-শুনেই স্থাপন করেছেন। এই পাম্পের অডিয়্যান্স কে? তারা যেন সহজেই শনাক্ত করতে পারে এমন চিন্তা করেই তিনি এটি স্থাপন করেছেন। তারা বলবে উড়োজাহাজওয়ালা পাম্পের কথা। এখানে শিল্পের বোধ জাগায় আবেগ দিয়ে।
বিভিন্ন নগরের বিভিন্ন এলাকার বাড়িগুলো বিভিন্ন রকম হতে দেখা যায় এবং এদের স্থাপত্যশিল্পও বিভিন্ন রকম। গ্রামের অনেকের পাকা বাড়িতে কারও কারও কাছে রুচিশীল স্থাপত্যশিল্প না হলেও অনেকের কাছে সেগুলো সৌন্দর্যের প্রতীক। অনেকের বাড়িতে রঙ করার জন্য বাজারের যত রঙ আছে ততগুলোই দেয়ালের গায়ে লাগানো হয়ে থাকে। তাই বলে বলার অবকাশ নেই যে, ওই ব্যক্তির রুচি নেই। আমাদের ধারণা, তার রুচি অনুযায়ী তিনি তৈরি করেছেন, যার অডিয়্যান্সও আছে প্রচুর। গুলশান-বনানীর স্থাপত্যশিল্পে অনেক রুচিশীল মানুষের মন ভরে গেলেও সেই নানা রঙের চমক দেওয়া বাড়িগুলোকে যারা পছন্দ করেন, তাদের কাছে এই রুচিশীল স্থাপত্য অর্থহীন যতদিন না তাদের এই স্থাপত্যের জ্ঞান ও চিন্তা বিকশিত না হয়।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে—তাহলে শিল্পের মানদণ্ড কী? আমি মনে করি, শিল্পের মানদণ্ড নির্ধারণ করবে অডিয়্যান্স। অডিয়্যান্স কার শিল্পকর্মকে কিভাবে বিশ্লেষণ করছে, তাদের বোধগম্যতার ব্যাপ্তি কতটুকু, তাদের অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। পৃথিবীতে একই ধরনের মননশীল মানুষের বসবাস নয়। উন্নত চিন্তার মানুষের কাছে শিল্পের যে মানদণ্ড নির্ধারিত হবে অনুন্নত মানুষের কাছে সেই শিল্পের মানদণ্ড একইভাবে নির্ধারিত হওয়ার কথা নয়। ‘রূপবান’ যাত্রাপালা কিংবা ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ চলচ্চিত্র আবেগের জোয়ারে মানুষের মন ভাসিয়ে দিয়েছে। যত মানুষকে নাড়া দিয়েছে, যত মানুষ এই দুটি কাহিনীকে ভালোবেসেছে, সে তুলনায় ক্ল্যাসিক ফিল্ম ‘দুখাই’ শতভাগের একভাগ মানুষের মনকেও জয় করতে পারেনি। এই ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্রটি শিল্পবোদ্ধাদের কাছে বড় মাপের কাছে শিল্পকর্ম হলেও ‘রূপবান’ বা ‘বেদের মেয়ে জোছনার’ অডিয়্যান্সের কাছে অর্থহীন। এক্ষেত্রে মানুষকে দুটি সারিতে দাঁড় করানো যায়। একটি হলো ক্ল্যাসিকের পক্ষে এবং অন্যটি হলো আবেগের পক্ষে। একটু ভাবলেই এ দুই সারির মানুষ আবেগ ও শিল্পবোধ থেকে একে অন্যের আপসহীন প্রতিপক্ষ। অডিয়্যান্সকে যদি মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে দুটি শিল্পকেই মূল্য দিতে হবে, ছাড় দিয়ে শিল্পের আলোচনা করা মানেই কোনো একটি পক্ষকে অবজ্ঞা করার নামান্তর, যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বাংলাসাহিত্যের উচ্চমানের সাহিত্য, যেগুলো চিহ্নিত করা হয়, সেগুলোর যেমন কদর রয়েছে, পক্ষান্তরে অডিয়্যান্সের বিবেচনায় নিম্নমানের সাহিত্যেরও কদর রয়েছে। জোর করে কারও মনে আসন পাওয়া যায় না; পেতে হবে অডিয়্যান্সের উপযোগী উপকরণ দিয়েই। মানুষের জীবনে প্রতি ক্ষেত্রেই শিল্পের দায়দেনা যেমন আছে, তেমনি চর্চাও আছে। রান্নাঘরের খাবার তৈরিতে কি শিল্প নেই? সেখানেও তো দেখা যায় কাব্যিক ব্যঞ্জনা। কাব্যিক ব্যঞ্জনায় তুষ্ট হয় আমাদের রসনা।
ফিরে আসা যাক কবিতার শিল্পে। কবিতা শিল্পের জন্য ভাষা, উপমা, শব্দ চয়ন, শব্দের ব্যবহার ইত্যাদি কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করছে একটি কবিতার সৌন্দর্য। এক্সটেরিওয়র ও ইনটেরিওয়র নকশা ও ডেকোরেশন কেমন হবে, তা শিল্পীকে বুঝতে হবে। অনকে আধুনিক নকশাবিদের অল্পস্বল্প উপকরণে খুব সাধারণ নকশায় ফুটে ওঠে অভূতপূর্ব সৌন্দর্যের প্রতীক। মনে হয় ঠিক জায়গাতেই ঠিক উপকরণটি বসানো হয়েছে। এসব নকশার বাড়ি দেখলে মনে হয় অপূর্ব কবিতা। কবিতাতেও এমন শিল্প চিন্তার প্রতিফলন যদি ঘটে, তাহলে চিত্তাকর্ষক হয়। কোনো কোনো কবি বলেন, রবীন্দ্রনাথের হাত যেন ঈশ্বরের হাত ছিল। যেখানে যে শব্দটি ব্যবহারের কথা সেখানেই ঠিক সেই শব্দটিই ব্যবহার করেছেন তিনি। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। একইভাবে বলা যায় কবিতায় তিনি যে উপমার প্রয়োজন হয়েছে, সেই উপমাই ব্যবহার করেছেন। উপমা ঠাসিয়ে কবিতাকে নাভিশ্বাস থেকে রক্ষা করেছেন। অনেক কবির কবিতায় দেখা যায় উপমা ঠেসে কবিতার মূল ভাবের সমাধি রচনা করেন, যা থেকে ভাবকে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে, যা শিল্প হিসেবে একই বাড়িতে নানা রকম রঙ দেওয়ার মতো স্থাপত্য। এ ধরনের কবিতা থেকে ভাব উদ্ধার করতে পাঠককে প্রাণান্তকর কষ্ট করতে হয়, প্রাণান্তকর চেষ্টা করে ভাবার্থ উদ্ধার করা হলেও কবিতার প্রতি পাঠকের অনীহা দেখা দেয়। কারণ, কষ্ট করে বুঝে কবিতা পড়ার জন্য কারা দায় রয়েছে? অনেক ক্ষেত্রে কবিতাও অর্থহীন হয়ে কেবল কঠিন উপমা, প্রতীক আর বাক্যের একটি জড়কাঠামোর রূপ অধিগ্রহণ করা যায়। ইটের গাঁথুনিতে যেমন একটি প্রাসাদ তৈরি হয়, সুতোর বয়নে যেমন একটি বস্ত্র তৈরি হয়, ঠিক তেমনি শব্দের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি হয় কবিতা। কী ইট দিয়ে প্রাসাদ তৈরি করবেন, কোন সুতো দিয়ে বস্ত্র তৈরি করবেন, সে সিদ্ধান্ত নেবেন নকশাবিদরা। কবিদেরও এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কী শব্দ দিয়ে নির্মাণ করবেন কবিতার শরীর। বস্ত্রের কোথায় বুটিক দেবেন, কোথায় দেবেন জরি, তা যেমন কারিগর নির্ধারণ করেন, ঠিক কবিকেও শব্দ নির্ধারণ করে কবিতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য ভেবে-চিন্তে উপমা ও প্রতীকের ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়। উপমা কবিতার অলঙ্কার এ কথা সত্য, কিন্তু কেবল অলঙ্কারে দিয়ে শরীর মুড়িয়ে রাখা হয়, তাহলে বাসনার জলাঞ্জলি হওয়া ছাড়া উপায় কী? কবিতার রূপকাঠামোতে উপমার প্রয়োজন আছে, তবে সেই রূপকাঠামোতে কবিতার মূল ভাবটিই খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে পাঠক কবিতার আস্বাদন কিভাবে লাভ করবে—এমন সংশয় থেকেই যায়।
কবিতা মেটাফরিক বিমূর্ত ভাব-দর্শনের ওপর বা প্রতীকাশ্রয়ে নির্মিত হয়ে থাকে। সেখানে উপমার খুব বেশি কি প্রয়োজন হয়? কবিতা মূর্ত বিষয়ের কবিতাও কম সৌন্দর্য বহন করে না, যাকে ছবির ভাষায় পোর্টেট বলা যেতে পারে। অনেক বিমূর্ত পেইন্টিং দেখে দর্শকরা কিছুই বুঝতে পারেন না স্বয়ং শিল্পী যদি বিমূর্ত ভাবের সূত্র ধরিয়ে না দেন। তবে বিমূর্ত পেন্টিং বোঝার ক্ষেত্রে প্রত্যেক শিল্পবোদ্ধারই নিজস্ব ধ্যান-ধারণা-উপলব্ধি থেকে অনুধাবন করেন, বা করার স্বাধীনতা রয়েছে। শিল্পীরাও এ ব্যাপারে উদার। তারাও বলে থাকেন যে, বিমূর্ত ছবিতে শিল্পীর ভাবনার রঙ লেগেছে, প্রতিফলিত হয়েছে তার চিন্তনের অভিব্যক্তি, যে চিন্তা থেকে শিল্পবোদ্ধারা নিজ নিজ অবধারণা থেকে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করবেন। এক্ষেত্রে শিল্পীর কোনো দায় নেই। শিল্পী কী ভেবেছেন, তা বোঝা দুরূহ। তাই চিত্রদর্শকগণ নিজের উপলব্ধি থেকেই সে শিল্পকে ব্যাখ্যা করেন।
বিমূর্ত ভাব-দর্শনের কবিতাও বিমূর্ত পেন্টিংয়ের মতো। কবিতার গূঢ় রহস্য উদঘাটন করতে হলে কবির কাছে যেতে হবে। কিন্তু সব পাঠকের পক্ষে কবির কাছে যাওয়া সম্ভব নয় বিধায় একেকজন একেকভাবে কবিতার ব্যাখ্যা করেন। তাতে কিন্তু কবিতার কোনো সমস্যা নেই বরং একটি কবিতা আরও বেশি সার্থক হয়ে উঠতে পারে যদি কবিতাটি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পাঠক ব্যাখ্যা তৈরি করে। একটি ভালো মানের কবিতার নানা মাত্রিক ব্যাখ্যা হতে পারে। ‘বনলতা সেন’ কবিতাকে স্থাপত্যশিল্পীরা স্থাপত্য শিল্পের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যদি এর ব্যাখ্যা করেন তাতে আপত্তির কিছু আছে বলে মনে হয় না।
মূর্ত কবিতার ক্ষেত্রে পাঠকরা সরাসরি ভাবাবেগকে উদঘাটন করতে পারে। এ কারণে সাহিত্যে রয়েছে নানা রকম পরিভাষা। কবির সেসব পরিভাষা জানতে হবে, এমন কোনো কথা নয়। কবি নির্মাণ করবেন কবিতা, পাঠক বা সমালোচক বিভিন্ন পরিভাষার আলোকে বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা করবেন, এখানে কবির বিশ্লেষণের দায় নেই। বরং দায় হলো সৃষ্টির মহিমায় সৃষ্টি করা।
সুকান্তের অধিকাংশ কবিতাই পোর্টেটের মতো কোনো ভাবকে জীবন্ত করেছেন। কোনো কোনো কবিতায় রূপক ভাব-দর্শনে চিত্রিত হয়েছে। হয়তো ‘পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি’ একটি উপমা আশ্রিত চিত্রকল্প। এই কবিতায় পোর্টেটের মাঝে একটি এমন চিত্রকল্প তৈরি করেছেন, যা যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে দাগ কেটে থাকবে। এটিই কবিতার শিল্প, এটিই শিল্পের কবিতা। ‘আঠার বছর’ কবিতাটি সরাসরি প্রোটেট চিত্রণ করেছেন তিনি। এই কবিতায় কি কোনো উপমা আছে? কিন্তু কবিতাটি মিছিলকে আগুনমুখো করার জন্য কতটা শক্তিশালী তা বাংলাভাষার মানুষের বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ‘কবর’ কবিতায় উপমা নিরুদ্দেশ হলেও এই কবিতা পাঠককুল গ্রহণ করেছেন। অনুরূপ ‘রানার’ কবিতাটিতেও একজন মানুষের ছবি চিত্রিত হয়েছে, এ কবিতায় উপমার প্রয়োজন নেই। তাহলে উপমা দিয়ে ঠেসে দিলেই যে ভালো কবিতা হবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। আধুনিক কবিতায় বিমূর্ত ভাব-দর্শনের ভেতরে উপমায় ঠেসে কবিতাকে নাস্তানাবুদ করতেও অনেক কবিকে দেখা যায়। তখন আর পাঠকের ধৈর্য থাকে না জটিল বিষয়কে উদ্ধার করার কাজে নিজেকে ব্যাপৃত করতে।
কবিতায় শিল্পের জন্য ক্রিয়া ও বিশেষণ পদের যথার্থ ব্যবহার যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। ক্রিয়াপদ হলো দিগন্ত প্রসারিত ভাবের আমদানিকারক এবং বিশেষণ হলো বসন্তের প্রস্ফুটিত পুষ্পকানন। এই দুয়ের ব্যবহার কবিমানসকে রপ্ত করে কবিতায় ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে আমাদের ধারণা।
শিল্পের জন্য কবিতা আর কবিতার জন্য শিল্প এমন ভাবনা থাকা কবির উচিত। কবিতার ভাষাটাও শেখা দরকার। একটি বাক্য কতভাবে সাজানো যায়, এমন কিছু নিরীক্ষাও করেও কবিতায় ব্যবহার করা যেতে পারে। ‘গ্রামের সবাই মৃতের বাড়িতে গেল তাকে দেখতে’, এভাবে না বলে যদি বলা যায়, ‘গ্রামের সবকটি পথ গিয়ে মিশেছে মৃতের বাড়িতে’—তাহলে কি ভিন্ন রূপ ধারণ করে না? একই অর্থ বহনকারী দুটি বাক্যের প্রথমটিতে সরল প্রকাশ আর দ্বিতীয়টিতে কাব্যিক ব্যঞ্জনায় প্রকাশ। এমন কাব্যিক ব্যঞ্জনায় প্রকাশই তো কবিতার শিল্প।