কবিতার খুব সুপ্রাচীন উৎস রয়েছে; এটি আফ্রিকার শিকার কবিতা কিংবা নীল, নাইজার অথবা ভোলগা উপত্যকার সাম্রাজ্যবাদী স্তূতি কাব্য বা শোকমূলক কাব্যের ঐতিহ্য নিয়ে প্রাগৈতিহাসিক সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। আফ্রিকার প্রাচীন কিছু কবিতার নমুনা খ্রিষ্টপূর্ব ২৫তম শতকের সময়কালে মিশরীয় পিরামিডের দেয়ালচিত্রে পাওয়া যায়। যেখানে ইউরেশীয় মহাদেশের প্রথম দিকের কবিতাগুলো লোকগীতি বা মৌখিক মহাকাব্যের পুনঃপুনঃ বলার প্রয়োজন থেকে বিকশিত হয়েছিল। প্রাচীনকালে শব্দই একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো কিংবদন্তি, গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বর্ণনা এবং নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রচারে। যেহেতু তখন লেখার প্রচলন হয়নি এবং বিষয়টি অজানা ছিল; তাই তখন কবিকে হৃদয় দিয়ে সবকিছু মনে রাখতে হতো। জিউস, জিউসের কন্যাগণ, মেনোমোসিন এবং স্মৃতিজগতের দেবীদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা অর্জনের পরেই কবি তার প্রতিভা সক্রিয় করতেন। কবি যখন ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণা পান, যাদুকরী উপহার প্রাপ্তির মতো সে উপহারকে তিনি কবিতার মাধ্যমে মানুষের কাছে বার্তা হিসেবে পৌঁছে দিতে সক্ষম হন। কবিতা তাই পুরো প্রত্নসভ্যতার জন্য একটি পবিত্র উপস্থাপন। তবে এই কবিতার নিয়ন্ত্রণে কবির ভূমিকা ছিল না; এটি কেবল সেই মাধ্যম, যা দিয়ে দেবতারা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।
কবিতায় গল্প বলার দক্ষতা কয়েক শতকে ধরে সমাজের সাংস্কৃতিক প্রবাহকে ছড়াতে ও বিকাশ করতে এবং দর্শনের নীতি ও মূল্যবোধ সমগ্র মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্বে কবিতা মানবজাতির বৌদ্ধিক বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। শৈল্পিক সৃষ্টির যেকোনো রূপের মতো কবিতাও মানবতার অন্যতম একটি স্তম্ভ। সংবেদন ও অনুভূতির পথ অনুসরণ করে কবিতা জ্ঞান ও মানবিক মূল্যবোধকে সঞ্চারিত করে। এক্ষেত্রে কানাডার তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী স্টিভ পিংকার যুক্তি দিয়ে দেখান যে সাহিত্যের নৈতিক শক্তি রয়েছে, সেইসঙ্গে এটি মানুষের দেহ এবং আত্মাকে রূপদান করে। তবে, আজকের যুগে আমাদের কাছে কবিতা শব্দ দিয়ে চিহ্নিত হয়, একসময় কবিতা বাদ্যযন্ত্রের সহযোগে সুরের মধ্যে চিহ্নিত হতো। যেমন, প্রাচীন গ্রিসে এডি জাতির ব্যবহৃত তারের বাদ্যযন্ত্র লিটির মতো সুর, মধ্যযুগে ফিউডালদের ব্যবহৃত চতুষ্কোণ বীণা বা সেল্টসের দ্রুডিক বীণার মতো বাদ্যযন্ত্রের সুরে কবিতা ও তার ভাব উঠে আসতো। লুটি, বাঁশী, থিয়োর্বো ও তারপরে আধুনিক কালে তারের যন্ত্রগুলোতে সুর সৃজন করে কবিতাকে সংগীতের মতো প্রকাশ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। ইউজিনিও মান্তালে যেমন বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালে সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে দেওয়া তার নোবেল প্রাপ্তির ভাষণে, ‘কবিতা সম্ভবত আদিম সংগীতের তালকে কণ্ঠের শব্দে যুক্ত করার প্রয়োজন থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল’। আমরা লক্ষ করি, অনেক পরে, লেখন পদ্ধতি লিপি আবিষ্কারের পর থেকে শব্দ দিয়ে কবিতা এবং সংগীত রচনার প্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে আলাদা হয়ে যায়। সুতরাং, লিখিত কবিতার আলাদা চেহারা ও স্বরূপ গড়ে উঠলেও সংগীতের সঙ্গে কবিতার সাধারণ সম্পর্কটি এখনো অনুভূত হয়।
আজকের কবিতা অবশ্য গান-রচয়িতাদের হাত ধরে সুরকারের মাধ্যমে একক বাদ্যযন্ত্র বা পুরো অর্কেস্ট্রা দ্বারা গানে পরিণত হয়ে ওঠার ঘটনা। কবিতাটি গান হয়ে উঠলে রেডিও, টেলিভিশন ও রেকর্ডিংয়ের যেকোনো উপায়ে প্রচার ও সম্প্রসারণ পাচ্ছে। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো, অষ্টম শতক পর্যন্ত পশ্চিমা সাহিত্যের মধ্যে গ্রিসের এডি জাতিদের রচিত শ্লোকগুলো গান আকারে গাওয়া হতো, পরে সেগুলো লিপি আকারে লেখা হয়। তবে ১৫ শতকের মাঝামাঝিজুড়ে গুটেনবার্গের উদ্ভাবিত মুদ্রিত বইয়ের প্রচারের সঙ্গে-সঙ্গে কবিতা গানের পথ ছেড়ে আত্মনির্ভরশীল হতে শুরু করে। এই পর্যায়ে কবিতা পাঠ ক্রমশ নীরব, চাক্ষুষ ও একটি ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে ওঠে। তবে কবিতা অধিক সংখ্যক মানুষের উপলব্ধির সঙ্গী হয়ে উঠতে থাকে এবং গণমানুষেও এর প্রচার ও প্রসার ঘটে ব্যাপক হারে।
আলেকজান্ডার পোপও মনে করতেন, সংগীত ও কবিতা সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে ঘটেছে।১৯১৩ সালে তিনি কবি হিসেবে নোবেলজয়ী হয়েছেন তার ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য; যে গ্রন্থটি গানের সংকলন হিসেবে আমাদের কাছে বিবেচ্য।
কবিতা এবং সংগীত হলো সেই শিল্প, যা মহত্ত্ব(sublime) বিবেচনায় একে অন্যের খুবই নিকট আত্মীয়। এদের এক অনিবার্য সংযোগ রয়েছে। উভয়ই ছন্দবদ্ধ শব্দ এবং নান্দনিকতার চেতনা ছড়িয়ে কল্পনার আবেশ আর সুরের ইন্দ্রজাল রচনায় পারঙ্গম। কবিতায় রয়েছে শব্দের ধ্বনি, ঠিক যেমন গানের কথায় থাকে সুর এবং কবিতার কথাকে ঠিক গান হিসেবে শোনা যায় অকপটে। একটি কবিতা নিঃশব্দে পড়া যেতে পারে, তবে আবৃত্তি করলে এর শক্তি ও সৌন্দর্য বেড়ে যায়। উচ্চস্বরে কবিতা পড়লে মানুষ কবিতার শব্দগুলো শুনতে এবং এর মেজাজ, অনুভূতি ও সংবেদন অনুভব করতে পারে। গানের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়, গান নির্দিষ্ট শব্দপুঞ্জকে একটি নির্দিষ্ট মেজাজ বা অনুভূতি প্রদর্শনে ব্যবহৃত হয়। গান ও কবিতায় একটি প্রাকৃতিক প্রবাহ রয়েছে, যা কথা ও সুরে মানুষের অনুভূতির গভীরে নাড়া দেয়।
প্রায়শই গান এবং কবিতায় শব্দ ও বাক্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে, পাঠক বা শ্রোতার হৃদয়ে সুরের প্রবাহকে ছুঁয়ে দিতে। কোনো শব্দ ছাড়াই সংগীত আবেগ এবং মেজাজ প্রকাশ করতে পারে না, ঠিক যেমন কোনো কবিতাও পারে না। বাদ্যযন্ত্র কবিতা ও গানে সুর ও ছন্দ তৈরি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
২০১৬ সালে সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারটি গীতিকার বব ডিলানকে দেওয়া হয়েছিল। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কারণ সংগীত আর কবিতা দুটি দূরবর্তী গোলার্ধের বাসিন্দা নয়, বরং সংগীত আর কবিতা আন্তসম্পর্কে নিবিড় এবং একে অন্যের মিথস্ক্রিয়ায় আরও উন্নত হয়ে ওঠে। উভয় শিল্পই অনন্য। দান্তে তার ‘কমেডি’ দিয়ে আমাদের দেখিয়েছেন, কিভাবে সংগীত ব্যবহার করে কবিতা ‘ভালো শোনাতে’ পারে এবং ইতালির নোবেলজয়ী কবি মান্তালে তার ‘Creacks’ কবিতাগুচ্ছে কবিতা ও সংগীতকে একাকার করে এক অভেদাত্মক রূপ তৈরি করেছিলেন। সংগীতের উচ্চাঙ্গ ধারাটি বিরল এবং গুরুমুখী, তবে তা সুরের সঙ্গে এখনো কবিতার চরণকে সঙ্গে রেখেছে। গান সুরের পাশাপাশি কবিতাকে ছেড়ে যায়নি; কারণ সুরকে কবিতার কথায় না ফেলে গায়কেরা সংগীত করতে পারে না। আলেকজান্ডার পোপও মনে করতেন, সংগীত ও কবিতা সাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে ঘটেছে।১৯১৩ সালে তিনি কবি হিসেবে নোবেলজয়ী হয়েছেন তার ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য; যে গ্রন্থটি গানের সংকলন হিসেবে আমাদের কাছে বিবেচ্য।
‘সংগীত ও কবিতা’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত তুলে ধরে এই লেখার সমাপ্তি টানছি। ‘আমাদের ভাবপ্রকাশের দুটি উপকরণ আছে–কথা ও সুর। কথাও যতখানি ভাব প্রকাশ করে, সুরও প্রায় ততখানি ভাব প্রকাশ করে। এমনকি, সুরের উপরেই কথার ভাব নির্ভর করে। একই কথা নানা সুরে নানা অর্থ প্রকাশ করে। অতএব ভাবপ্রকাশের অঙ্গের মধ্যে কথা ও সুর উভয়কেই পাশাপাশি ধরা যাইতে পারে। সুরের ভাষা ও কথার ভাষা উভয় ভাষায় মিশিয়া আমাদের ভাবের ভাষা নির্ম্মাণ করে। কবিতায় আমরা কথার ভাষাকে প্রাধান্য দিই ও সংগীতে সুরের ভাষাকে প্রাধান্য দিই। যেমন, কথোপকথনে আমরা যে-সকল কথা যেরূপ শৃঙ্খলায় ব্যবহার করি, কবিতায় আমরা সে সকল কথা সেরূপ শৃঙ্খলায় ব্যবহার করি না–কবিতায় আমরা বাছিয়া বাছিয়া কথা লই, সুন্দর করিয়া বিন্যাস করি–তেমনি কথোপকথনে আমরা যে-সকল সুর যেরূপ নিয়মে ব্যবহার করি সংগীতে সে সকল সুর সেরূপ নিয়মে ব্যবহার করি না, সুর বাছিয়া লই, সুন্দর করিয়া বিন্যাস করি। কবিতায় যেমন বাছা বাছা সুন্দর কথায় ভাব প্রকাশ করে, সংগীতেও তেমনি বাছা বাছা সুন্দর সুরে ভাব প্রকাশ করে। যুক্তির ভাষায় প্রচলিত কথোপকথনের সুর ব্যতীত আর কিছু আবশ্যক করে না। কিন্তু যুক্তির অতীত আবেগের ভাষায় সংগীতের সুর আবশ্যক করে। এ বিষয়েও সংগীত অবিকল কবিতার ন্যায়। সংগীতেও ছন্দ আছে। তালে তালে তাহার সুরের লীলা নিয়মিত হইতেছে।’