কবিতা তাঁর হাতে নিজের কৃতিত্ব দেখিয়েছিল। অথবা বলতে পারি, কবিতার আলো জন্ম দিয়েছিল যে কবিকৃতি—তার নাম শামসুর রাহমান। তিনি কেন বিশিষ্ট, এ নিয়ে অনেক কথা বলা যেতে পারে। তাঁর সমসাময়িক অনেক কবি যা পারেননি, তিনি তা করতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন, ‘বন্দী শিবির থেকে’ অঙ্কন করতে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য। শহীদ কাদরী একটি কথা সবসময় বলেন। তা হলো, যে কবি খুব বেশি পঠিত হওয়া দরকার, তিনি শামসুর রাহমান।
রাহমান মিশে আছেন আমাদের মননে, ধ্যানে। কারণ, এই যে বাংলাদেশ, এই যে গণমানুষের স্বাধিকারের চেতনা, দেশপ্রেম, নিসর্গমাখা আকুল চিত্ত—কোথায় নেই তিনি। পড়া যাক তাঁর এই পংক্তিগুলো—
[ক]
সারারাত নূর হোসেনের চোখে এক ফোঁটা ঘুমও
শিশিরের মতো জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায়
জ্বলেছে আতশবাজি সারারাত, কী এক ভীষণ
বিস্ফোরণ সারারাত জাগিয়ে রেখেছে
ওকে, ওর বুকে ঘন ঘন হরিণের লাফ,
কখনো অত্যন্ত ক্ষীপ্র জাগুয়ার তাকে
প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে জ্বলজ্বলে
চোখে খর তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে,
এতটুকু ঘুমাতে দেয়নি।
কাল রাত ঢাকা ছিল প্রেতের নগরী,
সবাই ফিরেছে ঘরে সাত তাড়াতাড়ি। চতুর্দিকে
নিস্তব্ধতা ওঁৎ পেতে থাকে,
ছায়ার ভেতরে ছায়া, আতঙ্ক একটি
কৃষ্ণাঙ্গ চাদরে মুড়ে দিয়েছে শহরটিকে আপাদমস্তক।
মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক নৈঃশব্দ্যকে
আরো বেশি তীব্র করে তোলে
প্রহরে প্রহরে, নূর হোসেনের চোখে
খোলা পথ ওর
মোহন নগ্নতা দিয়ে আমন্ত্রণ জানায় দুর্বার। অন্ধকার
ঘরে চোখ দুটি অগ্নিঘেরা
জানালা, কব্জিতে তার দপদপ করে ভবিষ্যৎ।
(বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়)
[খ]
আজ এখানে দাড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ঞপক্ষ
দিয়েছিলো সেঁটে,
মগজের কোষে কোষে যারা
পুতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত,
যারা গণহত্যা
করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক
পশু সেই সব পশুদের।
(অভিশাপ দিচ্ছি)
[গ]
স্বাধীনতা নামক শব্দটি
ভরাট গলায় দীপ্ত উচ্চারণ করে বারবার
তৃপ্তি পেতে চাই। শহরের আনাচে কানাচে
প্রতিটি রাস্তায়
অলিতে-গলিতে,রঙিন সাইনবোর্ড, প্রত্যেক বাড়িতে
স্বাধীনতা নামক শব্দটি আমি লিখে দিতে চাই
বিশাল অক্ষরে।স্বাধীনতা শব্দ এত প্রিয় যে আমার
কখনো জানিনি আগে। উঁচিয়ে বন্দুক,
স্বাধীনতা, বাংলাদেশ- এই মতো শব্দ থেকে ওরা
আমাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে সর্বদা।
(বন্দী শিবির থেকে)
[ঘ]পাগলামী করিসনে বন্ধু সুধাংশু
সময় যে পার হয়ে যাচ্ছে
এবার যে তোর পালানোর বেলা
জিদ করিসনে বন্ধু, এখনই তুই পালা।
জানি তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু
দাঁড়িয়ে হাহাকারের ছোঁয়ায় জড়ানো শ্মশানসম বাস্তুভিটায়
সেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণচঞ্চল দিনগুলো, আমাদের ছেলেবেলা
কিন্তু এবার যে তোর পালানোর বেলা, এবার তুই পালা।আমি জানি নির্বাক দাঁড়িয়ে তুই কী ভাবছিস বন্ধু সুধাংশু
সেই একপাল বন্ধুগুলো রামী, শেপু, কাকলী আরও অনেকে
প্রাণময় কোলাহলে কাটিয়েছি সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা বেলা
কিন্তু এবার যে তোকে পালাতে হবে, এবার তুই পালা।
( সুধাংশু যাবে না)
দুই.
কেউ-কেউ বলেন, কবিতায় তিনি সিদ্ধান্ত প্রবণ ছিলেন না, বরং আধুনিক কবিতার সিদ্ধান্তহীনতার অস্পষ্টতা ছিলো তার কবিতায়। তবে নন্দন চর্চার অস্পষ্টতার সঙ্গে তাঁর কবিতায় সমাজ ও রাজনীতি সচেতনতা স্পষ্ট ছিল।
কথাগুলো সত্য নয়। শামসুর রাহমান ছিলেন খুবই সিদ্ধান্তপ্রবণ কবি।এই জাতি যখন ক্রান্তিকালে পতিত হয়েছে, তখন এগিয়ে এসেছে তাঁর কলম। তাঁর কবিতা শাণিত করেছে এই প্রজন্মকে। যে প্রেমিক তার প্রেমিকার ভালোবাসার কাছে অবনত হবে বিনয়ে কিংবা বিরহে- তাকে ফিরে আসতেই হবে শানসুর রাহমানের কবিতার কাছে। তাকে পড়তেই হবে রাহমানের কবিতা।
[১]
যখনই ভাবি, হঠাৎ কোনো একদিন তুমি
আমাকে ভুলে যেতে পারো,
যেমন ভুলে গেছো অনেকদিন আগে পড়া
কোনো উপন্যাস, তখন ভয়
কালো কামিজ প’রে হাজির হয় আমার সামনে,
পায়চারি করে ঘন ঘন মগজের মেঝেতে,
তখন
একটা বুনো ঘোড়া খুরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে আমাকে,
আর আমার আর্তনাদ ঘুরপাক খেতে খেতে
অবসন্ন হয়ে নিশ্চুপ এক সময়, যেমন
ভ্রষ্ট পথিকের চিৎকার হারিয়ে যায় বিশাল মরুভূমিতে।
(তুমি যদি ফিরে না আসো)[২]
এতকাল ছিলাম একা আর ব্যথিত,
আহত পশুর অনুভবে ছেঁড়াখোঁড়া।
দুর্গন্ধ-ভরা গুহাহিত রাত নিস্ফল ক্রোধে দীর্ণ,
শীর্ণ হাহাকার ছাড়া গান ছিল না মনে,
জানি প্রাণে ছিল না সতেজ পাতার কানাকানি
_এমনকি মরম্নভূমির তীব্রতাও ছিল না ধমনীতে,
স্বপ্ন ছিল না,
ছিল না স্বপ্নের মতো হৃদয়।
(কোনো একজনের জন্যে)[৩]
এ এমনই যুগ, যোগাযোগ ক্রমান্বয়ে হচ্ছে যত
সহজ ততই যোগাযোগহীন হয়ে পড়েছে মানুষ। তুমি
এ মুহূর্তে কী করছো, কোন শহরের ফ্ল্যাটে আছো?তোমার বিবাহোত্তর রূপ নিয়ে নিজস্ব সংসারে
আগেকার মতো আজো আমাকে তোমার
মনে পড়ে কিনা,-
জানি না কিছুই। আগেকার মানে কাবেকার? বলো
তুমি কি এখনো
আমাকে অত্যনত্ম ভেবে রাত্রির চিতায় জ্বলজ্বলে
যৌবন পোড়াও হে সুচেতা?’
(তোমার কুশল)[৪]
সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ
ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর
জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল
কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে
অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন
ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন
সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,
ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে
আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে
অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি না
এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।
(কখনো আমার মাকে)
এমনভাবেই প্রেম প্রেরণা হয়ে জেগে আছে রাহমানের সৃষ্টির সীমানা ছুঁয়ে। প্রেমের প্রত্যয় ও সৃজনের পথ পরস্পরের সঙ্গে মিলে গিয়ে হৃদয়ের ব্যাকুল কথাগুলোকে বাঙ্ময়তা দিয়েছে নতুন মাত্রায়। তার অক্ষরের সঙ্গে হাজারো নবীন কবিহৃদয়ও জেগেছে ভালোবাসার পালকের সঙ্গেই। তা মাতৃপ্রেম হোক, আর দেশপ্রেমই হোক। শামসুর রাহমান ১৯৫০ পরবর্তী সময়ে নির্মাণ করেছেন আমাদের নান্দনিক কাব্য রুচি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষির কাছে তিনি ক্রমশ হয়ে উঠেছেন উল্লেখযোগ্য কবি। তাঁর লেখার এক একটি ভাষ্যের মধ্য দিয়ে, বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষার প্রধান চারণভূমি। এই কৃতিত্ব তাঁকে দিতেই হবে।
কবিতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন সমকালের অসাধারণ চিত্র হিসেবে। কবিতাকে তিনি করেছেন প্রতিবাদী চেতনা প্রকাশের সুদৃঢ় হাতিয়ার। তাঁর অসাধারণ কাব্যভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়েছে পাঠক। ব্রিটিশ শাসনকে সরাসরি উপলব্ধি করতে না পারলেও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন দেশভাগের ভয়াবহতা, বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ঘাতক-দালাল-মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি থেকেছেন পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।
তিন.
শামসুর রাহমান মারা যাওয়ার পর সেই সময়ের রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর মরদেহে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেননি। এতে তাঁর কিছুই যায় আসেনি। আমি তাঁর সঙ্গে কয়েকবারই অন্তরঙ্গ আড্ডা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি বলতেন, সমাজে যারা আত্মপরিচয় লুকিয়ে রেখে স্বার্থ হাসিল করে, এরাই প্রধানত সমাজের মূল শত্রু। তিনি তাঁর বিশ্বাসে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অটল থেকেছেন। শামসুর রাহমান সক্রিয় রাজনীতিক ছিলেন না। কিন্তু বারবারই তাঁকে আমূল নাড়িয়ে গেছে বাঙালির শোষণ-পীড়ন ও বঞ্চনার বিভিন্ন ঘটনাক্রম। রাজনীতির দানব বাঙালির ওপর যতবার হামলে পড়েছে, ততবার তিনি অস্থির হয়ে উঠেছেন। জনগণের পক্ষে সাড়া দিয়েছেন। তাঁর এ সাড়া এসেছে অধিকাংশ সময়ই কবিতার মাধ্যমে। কখনো কখনো তিনি নেমে এসেছেন রাজপথে। সমাজ জীবনে যান্ত্রিক জটিলতা, আত্মিক তৃষ্ণার প্রলোভন, বাণিজ্যকৌশল ও রাজনৈতিক কূটচাল প্রতিহত করেছেন তিনি কবিতায়। শুভবোধ ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিরন্তর লড়ে গেছেন। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য প্রীতি ও দায়িত্বের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে তাই তার কবিতার ভাষ্যগুলোর বিবেচনা ও মূল্যবোধ আমাদের চমৎকৃত করে।
আমি যখন নিউইয়র্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম শামসুর রাহমানের কবিতার মূল্যায়ণ বিষয়ে, তখন সুনীল অকপটে স্বীকার করেছিলেন—শামসুর রাহমান তাঁদের সময়ের শ্রেষ্ঠতম কবি। বলেছিলেন, রাহমানের সমস্ত রচনাতেই আছে আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া। ওঁর রচনা বিশ্ব সাহিত্যের যেকোনো সিঁড়িতেই উজ্জ্বল। আর তা রচিত হয়েছে বাংলার সোঁদামাটির ছায়ায়।
২৩ অক্টোবর শামসুর রাহমানের জন্মদিন। ১৯২৯ সালের এই দিনে তিনি ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর জন্ম বাঙালিকে আলোকিত করেছে। এই প্রজন্ম তাঁর কবিতা পড়ে জানবে আধুনিক কবিতার বিবর্তনের ধারা। হ্যাপি বার্থ’ডে-ডিয়ার পোয়েট !