এক সময় ছিল শ্রুতিকাব্যের যুগ। কবি মুখে-মুখে পদ রচনা করে শ্রোতাদের শোনাতো। সেই যুগ এখন আর নেই। যে নাটকের নাম ছিল দৃশ্যকাব্য অর্থাৎ নাটক রচনাই করা হতো মঞ্চায়ন করার জন্য এখন সেই নাটকও পড়ার বিষয় হয়ে গেছে। তো যা বলছিলাম, মন থেকে কবিতার ঠাঁই হলো গাছের পাতায়, বাকলে, প্রস্তরে। এরপর কাগজ এলো, ছাপা মেশিন এলো। সাহিত্য প্রকাশের মাধ্যমটাও আস্তে আস্তে পরিবর্তন হয়ে গেলো।
আঠারো শতক ও উনিশ শতকের গোড়ায় সাময়িক পত্র ছিল সাহিত্যের ধারক। এলো লিটলম্যাগ। সাহিত্যের জগতে বিশাল একটি প্লাবন নিয়ে। লিটলম্যাগ এক আন্দোলনের নাম। লিটলম্যাগের একটি মূল বৈশিষ্ট্য ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। যারা দৈনিকের সাহিত্য পাতায় লিখতে স্বস্তিবোধ করতো না কিংবা কোনো কারণে ঠাঁই পেতো না কিংবা দৈনিকের সাহিত্যপাতা যেসব লেখা ধারণ করার সাহস পেতো না, লিটলম্যাগ ছিল সেসব লেখার আশ্রয়। লিটলম্যাগ তারুণ্যের প্রতীক। জীবন খরচ করে, কাউকে তোয়াক্কা না করে সত্য কথাটি, নতুন সুরটি তরুণ ছাড়া আর কারাই বা বলতে পারে?
কিন্তু বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে পট অনেকটাই বদলে গেছে। ওয়েবম্যাগগুলোর সহজলভ্যতার কারণে বেশিরভাগ লেখকই এদিকে ঝুঁকছেন। পাশাপাশি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। লিটলম্যাগ কমার একটি কারণ এর পেছনে অর্থ, শ্রম একটু বেশিই দিতে হয়। তবে লিটলম্যাগের জায়গা এখনো অনলাইন সাহিত্য দখল করে নিতে পারেনি। হয়তো নিকট ভবিষ্যতেও পারবে না।
ওয়েবম্যাগ স্বতন্ত্র একটি মাধ্যম। সহজলভ্য, যা আগেই বলেছি। একটি লিটলম্যাগ প্রকাশের খরচ অনেক যা অনলাইনে এতটা নয়। তাই অনেকেই এই মাধ্যমের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। তবে একটা জিনিস লক্ষণীয়, কেউ কেউ অনলাইনে কোনো সংখ্যা করার পরও তাকে আবার প্রিন্টেড আকারে প্রকাশ করছে। অর্থাৎ প্রিন্ট কপির আবেদন এখনো ফুরায়নি। যা সহজে নিঃশোষিতও হবে না। এ কথার জের ধরেই বলা যায়, যদিও বর্তমান প্রজন্ম সামাজিক মাধ্যম বা অন্যান্য কারণে আগের তুলনায় বইবিমুখ। তবে, সত্যিকারের পাঠক কিন্তু কাগজের বইকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। নানা কারণেই দেয়।
দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা, লিটলম্যাগ, ওয়েবম্যাগের পাঠক তিন রকমের, তাদের আবেদনও ভিন্ন। এমন নয় যে দৈনিক পত্রিকার পাঠক সে লিটলম্যাগ বা ওয়েবম্যাগ পড়ে না। তবে, পাঠকের রকমফের আছে। দৈনিকের নির্দিষ্ট সংখ্যক পাঠক আছে। সেটা লিটলম্যাগের তুলনায় বেশি। যারা খুবই সাধারণ। আমার মতে, তাদের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম দৈনিকের সাহিত্যপাতা। আবার লিটলম্যাগের পাঠক সংখ্যায় কম হলো তারা রুচিশীল, বিদগ্ধ পাঠক। ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিষ্ঠিত বা তরুণ লেখক, সাহিত্যিক। তাদের কাছে পৌঁছাতে হলে লিটলম্যাগের বিকল্প নেই। আর ওয়েবম্যাগ হলো, স্বল্প সময়ে দেশবিদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার একটি মাধ্যম। তাই সুসম্পাদিত সাহিত্যপাতা, লিটলম্যাগ বা ওয়েবম্যাগ যেটাই হোক, লেখা প্রকাশিত হলে আনন্দ হয়। আবারও বলি, সেটা সুসম্পাদিত হতে হবে। মান বজায় রাখতে হবে। যদি সুসম্পাদিত না হয়, মানসম্মত না হয়, ওসব জায়গায় সেটা যে মাধ্যমই হোক, প্রকাশ করার চেয়ে নিজের কাছে রেখে দেওয়াকে শ্রেয় মনে করি।
সবশেষে বলা যায়, সময়ের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ওয়েবম্যাগের সংখ্যা আরও বাড়বে। সেটাই স্বাভাবিক। এর ফলে লেখা প্রকাশের অন্যান্য মাধ্যমগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়লেও নিশ্চিহ্ন হবে না। ছাপার অক্ষরে লেখা পড়ার আনন্দ মানুষ এত সহজে ত্যাগ করতে পারবে বলে মনে হয় না।