ওবায়েদ আকাশ (জন্ম ১৩ জুন, ১৯৭৩) প্রায় ত্রিরিশ বছর, কবিতা চর্চায় নিবেদিত। তার এই নিবিড় ধারাবাহিকতাই যে তাকে তার সময়ে বিশিষ্ট করে তুলেছে, শুধু এমনও নয়। বরং সমকালীন বাংলা কবিতার পাঠকমহলে তিনি অনন্য হয়ে উঠেছেন তার অতুলনীয় পঙ্ক্তিমালার গুণেও। বিশুদ্ধ বর্ণনাভঙ্গি, নিবিড় পর্যবেক্ষণ আর অসম্ভব রূপদক্ষতা তাকে এগিয়ে দিয়েছে বাংলা কবিতার দূরতিক্রম্য পথে।
কবিতায় সাবলম্বী হয়ে ওঠার প্রবণতার সঙ্গে নিজের স্বতন্ত্র স্বর চেনাতেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন ওবায়েদ আকাশ। উর্দি পরা যে অস্থির সময়কে পেছনে রেখে বাস্তবের কঠিন পোড়া ভূমিতে পা রাখা, একটি শতাব্দীর পেরিয়ে যাওয়া, নতুন আরও একটি শতাব্দীকে স্বাগত জানানো, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে সৃষ্টিশীলতার পথে যে উৎসারণ, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা এবং অজানাকে উন্মোচনের সেই তুমুল প্রতিবেশে ওবায়েদ আকাশ অবিরাম বাজাতে থাকেন জীবনবোধের সুর। সেখানে কখনো প্রচ্ছন্নভাবে কখনো পরিস্ফুটভাবে সামাজিক বিবর্তন, মানুষের সংকট ও ভবিষ্যৎ সমাজের ছবি চিত্রিত করেন।
ওবায়েদ আকাশ যেমন অনুসরণ করেছেন বাংলা কবিতার ইতিহাসের ধারা, তেমনি বিবর্তনের ধারাটির স্বতন্ত্র স্বরূপ সন্ধানের মধ্য দিয়ে তিনি খুলে দিতেও চেয়েছেন সুপরিচিত গণ্ডির বাইরের ভুবন। জীবনদর্শনে তিনি কিছুটা মার্ক্সীয় চেতনায় আত্মস্থ হয়ে উত্তরণের পথ খুঁজেছেন। তার কবিতায় স্থান নিয়েছে লোকায়ত জীবন, বাস্তবতা, ব্যক্তির সংকট, ভবিষ্যতের দিকে কল্পনা ও দূরদৃষ্টি নিয়ে তাকানোর মমতার সঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খ যুক্তি। এক্ষেত্রে তার খ্যাতি সচেতন শিল্পশক্তির প্রকাশে যেমন তেমনি তার নিরীক্ষাপ্রবণতার ভেতরেও। সামাজিক সচেতনতা এবং সংবদেনশীলতার দিক থেকেও তিনি গতানুগতিক পরিমণ্ডলে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সমকাল সম্পর্কে সচেতন হলেও তার উচ্চারণে উচ্চকণ্ঠের প্রবণতা নেই।
কিছুই থাকবে না আর অবশিষ্ট বলে
পাড়ার কিশোরী মেয়ের গোপন শরমের মতো
বিস্তৃত হবে আমাদের বুকআলো নিভে যাবে, কালো মহিষেরা
জলের অতলে পাবে কবোষ্ণ আরামসাঁকো ভেঙে যাবে, দ্বিধাহত পথিকেরা
বাতাসের মুগ্ধতা নিয়ে ভেঙে দেবে জলের গরিমাযে তুমি ঘোমটা টেনছ, শরতের জোনাকিরা
রাতের আড়ালে বসে ছুঁয়ে দেবে প্রকৃত গোপনসাদা দুধভাত, ওলানের সান্নিধ্য ছেড়ে
তুলে নেবে তুলতুলে শিশুটির গাল
ঘরের যুবতী বধূর অথৈ লাবণ্য-কাণ্ডআহত শস্যের ফড়িং, ডানার ঔদ্ধত্য-ভারে
গেয়ে যাবে বাংলার আবহ-গীতি
বলে দেবে, শস্যের সুষম ভাষাউড়ে যাবে সাদা পারাবত, আর আমার
মায়ের ঐশ্বর্য পাবে
স্নেহশীলা পৃথিবীর যে কোনো অরণ্য-প্রহরে
(আর আমার মায়ের ঐশ্বর্য)
গ্রাম-বাংলার সঙ্গে একাত্ম হয়ে, আত্মমগ্নতার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর জীবন পরিসরকে চিত্রিত করার অঙ্গীকার বরাবরই কবি ওবায়েদ আকাশের কবিতার প্রাণ। তিনি সকল সংকটকে অনিশ্চিতিবোধের ভুবন থেকে টেনে এনে, উদ্ধার করে আস্থা স্থাপন করেন প্রকৃতিতে। সকল সর্বনাশ ও বেদনার্ততাকে, সকল শূন্যতা ও অপহৃত সময়কে পরাভূত করার মধ্য দিয়ে তিনি কবিতাকে ধারণ করেন। এক্ষেত্রে একরৈখিকতা থেকে বেরিয়ে তার কবিতা আশ্রয় খোঁজে ব্যক্তিমনের ভেতরে। তার কবিতা কোনো দুর্বোধ্য ও দূরূহতম অধ্যায় রচনা না করেই তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। তিনি কোনো অসচেতন শিল্পভাষ্য নির্মাণেরও চেষ্টা করেননি। বরং তার কবিতা সচেতন মানসেরই পরিচয় বহন করে। যেখানে বিকাশমান নাগরিক সংস্কৃতির সঙ্গে গ্রাম ও গ্রামের অনুষঙ্গের মেলবন্ধনের মধ্য দিয়ে নির্মাণ করেন কল্পনা ও বাস্তবের বিশাল ভুবন।
এই বসলাম। অন্ধকার ঝিঁঝিদের বনে হেঁটে গেছি কাল
আমি ও খোকন মাহমুদ। পদ্যের সখিরা মিলে
কত রাতে ঘরমুখো হওয়া-সেগুনবাগিচা থেকে
আরও কিছু … অক্ষরবৃত্তের ব্যাঙ… এইসব নির্বিঘ্ন করে
তোমাদের আরণ্যক ঘরে মুখোমুখি বসলাম তবেধীমান মেধাবী আলোয় শূন্যতা এত! নদীপাড় ভেঙে
বান্ধবযুগল মুখরতা বয়ে আনে বলে
অমন অরুণাময় আমাদের ভিড়ে প্রখরতা হয়ে গেলেআর গভীরতা… গ-ভী-র-ত-র রাত্রি
তোমাদের জন্যে কি একাকিত্বের নাম এই মফস্বলে?
(আড্ডা : শহরে প্রান্তর)
ওবায়েদ আকাশ তার চিন্তার বিস্তার ঘটিয়েছেন, অনুভবগুলো-যা নাগরিক জীবনে ম্রিয়মান হয়ে থাকে, তাকে একটানে আমূল তুলে এনে স্থাপন করে দিয়েছেন বিস্তীর্ণ পরিবেশে। তার কবিতায় আবেগ রয়েছে, যা কবিতার অনিবার্য উৎস। তার সঙ্গে নিজের শিল্পভাষ্য জুড়ে শুদ্ধ স্বপ্নের জগৎ রচনায় তিনি নিযুক্ত, সেখানে তার প্রকাশভঙ্গি, বর্ণনার কলাকৌশল, আবেগের দক্ষ রূপায়ন, ভাষার তীক্ষ্মতা এবং বক্তব্যের প্রাঞ্জলতা তার কবিতাকে এনে দেয় বিশিষ্টতা। সেখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে চিরায়ত জীবন। ব্যক্তিগত এই স্ফূরণে তিনি যেমন হৃদয়ের ব্যবহার করেছেন, তেমনি কখনও কখনও কাব্যভাষার সঙ্গে গদ্যভাষাকেও অতুলনীয় শক্তি দিয়ে প্রাণময় করে তুলেছেন। তার শিল্পদক্ষতা, কখনো কখনো গদ্যাত্মক কবিতার ভেতর দিয়ে প্রোথিত হয়ে উঠেছে কবিতার আভা। কবিতায় আত্মসন্ধানের ভেতর দিয়ে তিনি সতত সামাজিক আয়তন স্পষ্ট করতে সচেষ্ট হয়েছেন।
শৌখিন শিশুটির কাছে একগুচ্ছ ফুলের মালা পড়ে আছে
ফুল নিয়ে আমদের ধারণা অনেক
একঝুড়ি কাগুজে ফুলে কত কী সম্বন্ধ হয়ে যায়
আনমনে ভাবি, আকালের সম্পর্কগুলো
এই ভাবে, রূপ-অন্ধ মানুষের ভেতর সুখ্যাত বেশফুলেদের পরস্পর সম্বন্ধগুলো রটে আছে পুরাকাল হতে
এ গল্প জানে না কোনো শিশু প্রজাপতিআমাদের মহত্ত্বগুলো আলোয় বিবর্ণ হয়ে ঝরে গেছে কাগুজে ফুলে
কেবল শিশুটির পাশে বিস্তর পড়ে থাকেপ্রকৃত গোলাপ, মালতি
(এ গল্প জানে না কোনো শিশু প্রজাপতি : ওবায়েদ আকাশ)
আব্দুল মান্নান সৈয়দ তার ‘এক বছরের কবিতা : ১৯৮২’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “একজন কবি পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি কি নব্বই বছর বাঁচেন। ‘শিল্প বিশাল, আয়ু অতিশয় হ্রস্ব।’ তার মধ্যেই তাঁকে তাঁর আরদ্ধ কাজ সম্পন্ন করতে হয়। তার মধ্যেই তাঁকে সমস্ত পৃথিবীর ইতিহাস ও ভূগোল পরিক্রম করতে হয়। সময়ের যে একটি ছকের ভিতরে তিনি অকষ্মাৎ এসে পড়েছেন, তাকে ভিত্তি করেই তাঁকে ডালপালা মেলতে হয় নক্ষত্রে। সমাজ-রাজনীতির যে-বিশিষ্ট পরিমণ্ডলের মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়, তাকে স্বীকার ও অঙ্গীকার ক’রেই তাঁকে জানতে হয় মহাসময়ে ভ্রাম্যমান সসারটিকে। একমাত্র ঐ পরিমণ্ডলকেই সর্বস্ব ও চূড়ান্ত মনে করলে মুশকিল।
বস্তুর বহিরঙ্গে ম’জে থাকলে কবির মুক্তি নেই, কবিকে প্রবেশ করতে হয় বস্তুর মর্মে। কাজেই এক-জীবনেই কবিকে পাড়ি দিতে হয় সহস্র বৌদ্ধিক জন্মে-জন্মান্তরে।’ জীবনের স্বল্পায়ুর ভেতরেই একজন কবির এই যে জন্ম-জন্মান্তরে ঘুরে বেড়ানো, বস্তুর মর্মে প্রবেশের সাধনা, সেই দুঃসাধ্য শ্রমভারাক্রান্ত পথটিতেই ওবায়েদ আকাশের অভিযান। দুঃসাধ্য ও দুঃসাহসিক এই ভ্রমণে প্রবলভাবেই তার অস্তিত্বের প্রকাশ স্পষ্ট। শিল্প-তথা কবিতার অস্থির বাহনে সওয়ার হওয়া কবিকে প্রায়ই পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে কবিতা দ্রুত হারিয়ে যায়। একজন কবির জন্য এই ট্র্যাজেডিকে অতিক্রম করা সহজ নয়। দশকে দশকে খুব কম সংখ্যক কবির ভাগ্যেই কবিতার পিঠে সওয়ার হয়ে দীর্ঘ ভ্রমণের আনন্দ জোটে। ওবায়েদ আকাশ তীক্ষ্ম ও সচেতন কবিতা রচনার মধ্য সেই আনন্দের সঙ্গী হয়ে উঠছেন। সযত্নে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন চালাকি মিশ্রিত কবিতার চৌহদ্দি। গভীরভাবে কবিতার ধারাকে স্পর্শ করায় তার কবিতায় মনস্থির করা সহজ। নিজের সময়ের সজীব ও সক্রিয় কবিদের অন্যতম ওবায়েদ আকাশ, প্রবল ও স্পষ্টভাবে কবিতায় যে স্বাচ্ছন্দ্য, যে গতি সঞ্চার করেছেন, তা তাকে তর্কাতীতভাবেই পাঠকের দিকে এগিয়ে দেয়।