প্রাক-কথন : আহমদ ছফা যে গাভীর বিত্তান্ত লিখেছেন, তাতে গাভী নয়, আছে ব্যক্তিত্বহীন শিক্ষকের কাণ্ড-কীর্তি। পুরুষত্বহীনতাকে বলদ বলা যেতো। কিন্তু লেখক তা না বলে, বীর্যহীনতাকে বোঝাতে গাভীকে উপন্যাসের কেন্দ্রের কাছাকাছি স্থাপন করেছেন। গাভী আমাদের আদর্শ খাবার দুধ দেয় এবং প্রবীণ বয়সে মা হওয়ার আর সম্ভাবনা না থাকলে কোরবানির মাংস উপহার দেয়। একটি আদর্শ পরিবারের জন্যও এই প্রাণীটি অতীব দরকারি। যদিও প্রতিপত্তি প্রসারে গাভী নয়, ষাঁড় প্রভাব ফেলে। আর কৃষিকাজের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় বলদ। বাজা বকনা গরুও চাষের কাজে লাগে। এখানে ছফা কি পুরুষকে গাভীর সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছেন? বিষয়টি খানিকটা খতিয়ে না দেখলে চলে না। আর তার গভীরে যেতে হলে, যে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক এই কাহিনির কেন্দ্রে অবস্থান করছেন, তার সামাজিক অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে একটি সোশিও-পলিটিক্যাল বিশ্লেষণ আবশ্যক। উপাচার্য উপাখ্যান এখানে মূল বিষয়।
উপাচার্য উপাখ্যান এবং কিছু কথা১: সম্প্রতি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে ভিসিদের কর্মকাণ্ড এবং পক্ষপাতিত্ব বিষয়ে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক আলোচনাও জমে উঠেছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ ও বাণিজ্য এবং বিশেষত লাগামহীন ছাত্ররাজনীতিকে লালন ও প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ সরাসরি ভিসিদের দিকে যাওয়ায় বর্তমান বাস্তবতা আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভালো, ভিসি নিয়োগে শতভাগ রাজনীতিকরণের ফলে এমনটি ঘটছে বলে আমাদের ধারণা। আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাচন বা মনোনয়নের নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম-কানুন নেই। সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে নির্বাচনি পরীক্ষার মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগ প্রদান করা হয়ে থাকে। সরকারি কলেজে সিনিয়রিটির ভিত্তিতে প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ পান শিক্ষকরা।
বেসরকারি স্কুল-কলেজে প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের শিক্ষকদের মধ্যে যে কোনো একজন কিংবা পরবর্তীকালে ম্যানেজিং কমিটির ইচ্ছা-অনুসারে নিয়োগ লাভ করেন প্রতিষ্ঠান প্রধান। এসব ক্ষেত্রে বর্তমানে অবশ্য রাজনৈতিক প্রভাবের চাপ অত্যন্ত স্পষ্ট। নতুন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা কিংবা সিনিয়রিটি কোনো পরিমাপক বিষয় হয়ে ওঠে না। আর কিন্ডারগার্টেন এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগে সরকারের আদতে কোনো হাত নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রোভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বত্র একরকম নিয়ম প্রচলিত নেই। চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যানেল নির্বাচনে জয়ী তিনজনের নাম চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানো হলে, তিনি একজনকে ভিসি পদে নিয়োগ দেবেন—এমন বিধান রয়েছে। কিন্তু সে প্রথাও এখন বস্তাবন্দি। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলর সরাসরি ভিসি পদে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ভিসি নিয়োগের জন্য ট্রাস্টিবোর্ডের পক্ষ থেকে চ্যান্সেলরের কাছে প্রস্তাব আকারে তিনজনের নাম পাঠানো হয়। তবে অনেকক্ষেত্রে প্রচলিত কিংবা আইনানুগ (সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন) পদ্ধতি এখন অনুসরণ করা হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিবেচনায়ই ভিসিদের নিয়োগ লাভের একটা কালচার দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে বিশেষ কোনো দলের (বিশেষত সরকার গঠনকারি রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী) আজ্ঞাবাহী শিক্ষকই নিয়োগ পাচ্ছেন ভিসি হিশেবে। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য বাণিজ্যিক ফায়দা আদায় করার জন্য এমন এমন ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করছে, যাদের ভিসি হবার মতো ন্যুনতম যোগ্যতাও নেই। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি-প্রোভিসি নিয়োগের জন্য প্রস্তাব আকারে চ্যান্সেলরের কাছে যে প্যানেল পাঠায়, তাতে সহকারী অধ্যাপক এবং লেকচারারের নামও পাওয়া যায়। বিষয়টি রীতিমতো বিস্ময়ের এবং উদ্বেগেরও বটে!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান ওই বিদ্যাপীঠের অভিভাবক। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সকলের ভালোমন্দের দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়। তিনি যদি ক্ষমতায় থাকার জন্য ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র-সংগঠনের কর্মিদেরকে ব্যবহার করেন কিংবা নানান অপতৎপরতা চালান, তাহলে আমাদের লজ্জার শেষ থাকে না। নিজের অস্তিত্ব আর ব্যক্তিত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে আর যাই হোক কোনো কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বেলায় ব্যক্তিত্বহীনতার পরিচয় মিলছে হরহামেশাই।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি বাড়তে থাকায় শিক্ষার পরিবেশ ও মান যেমন নিচের দিকে নামছে, তেমনি পাশাপাশি শিক্ষকদের পারস্পরিক সম্পর্কও দিনদিন খারাপ হচ্ছে। ফলত ক্যাম্পাসে প্রায়শই ছাত্রসংঘাত, খুন, হাতাহাতি-মারামারির মতো ঘটনা ঘটছে। ছাত্ররাজনীতির করালগ্রাস আরও আগে শুরু হলেও সাম্প্রতিককালে আরম্ভ হয়েছে শিক্ষকদের মধ্যে রেষারেষি, হাতাহাতি-মারামারি ও শারীরিক লাঞ্ছনার মতো ঘটনা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পরিবেশ এখন মারাত্মকভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে শিক্ষকদের দলীয় কোন্দলের কারণে। আর ছাত্ররাজনীতিতে নতুন কালচার হিশেবে আবির্ভূত হয়েছে ভিসিপন্থী ও ভিসিবিরোধী গ্রুপের প্রকাশ্য মহড়া ও অবস্থান। সরকার গঠনকারি দলের ছাত্র-সংগঠনের ক্ষেত্রেই এমনটি এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হিশেবে বোধ হয় কাজ করছে ক্যাম্পাসের রাজনীতি থেকে ছাত্রকল্যাণ-বিষয়ক চিন্তারাজির অভাব এবং অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভিসি নিয়োগ প্রদান। আত্মীয়-পরিজনপ্রীতিও শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে একটি বড় সমস্যা। বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের বাসিন্দা হবার বদৌলতে ক্ষমতার দাপট প্রদর্শনের ঘটনাও আজকাল দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। নিজেদের লোকদের প্রশ্রয় প্রদান ও লালন করতে গিয়ে সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা চ্যান্সেলরও জাতির পিঠে চাপিয়ে চলেছেন এক বিরাট ভার।
গাভী বিত্তান্ত : ক্যানভাস, বিষয়-আশয় ও প্রতিবেশ : উপাচার্য পদটি একসময় খুব সম্মানের এবং উঁচুমানের ছিল। কিন্তু কালক্রমে শিক্ষক-সমাজের অধঃপতনের ফলে এই পদের গায়ে লেগেছে কালিমা। করুণা আর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের উপাদান-কারণ ও কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন কোনো উপাচার্য। জীবনশিল্পী, সমাজ-বিশ্লেষক ও দার্শনিক আহমদ ছফা এই বিশেষ চিন্তার জায়গাটিতে আমাদের হাজির করেছেন। গাভী বিত্তান্ত ২ উপন্যাসের পাঠককে তিনি ভাবতে বাধ্য করেছেন, আমরা কতটা নিচে নামতে পারি! কাহিনির শুরুটি দেখে নেওয়া যাক—
আবু জুনায়েদের উপাচার্য পদে নিয়োগপ্রাপ্তির ঘটনাটি প্রমাণ করে দিল আমাদের এই যুগেও আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ফ্যাকাল্টির সদস্যবৃন্দ আবু জুনায়েদের উপচার্যের সিংহাসনে আরওহনের ব্যাপারটিকে নতুন বছরের সবচাইতে বড় মজার কাণ্ড বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আবু জুনায়েদ স্বয়ং বিস্মিত হয়েছেন সবচাইতে বেশি। আবু জুনায়েদের বেগম নুরুন্নাহার বানু খবরটি শোনার পর থেকে আণ্ডাপাড়া মুরগির মত চিৎকার করতে থাকলেন। তিনি সকলের কাছে বলে বেড়াতে লাগলেন যে তার ভাগ্যেই আবু জুনায়েদ এমন এক লাফে অত উঁচু জায়গায় উঠতে পারলেন। কিন্তু মানুষ অভিনন্দন জানাতে আবু জুনায়েদের বাড়িতে এসেছিলেন। নুরুন্নাহার বানু তাদের প্রায় প্রতিজনের কাছে তার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর থেকে কী করে একের পর এক আবু জুনায়েদের ভাগ্যের দুয়ার খুলে যাচ্ছে সে কথা পাঁচ কাহন করে বলেছেন। অমন ভাগ্যবতী বেগমের স্বামী না হলে, একদম বিনা দেন-দরবারে দেশের সবচাইতে প্রাচীন, সবচাইতে সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদটি কী করে আবু জুনায়েদের ভাগ্যে ঝরে পড়তে পারে! যারা গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই মুখে কিছু না বললেও মনে মনে মেনে নিতে দ্বিধা করেননি যে একমাত্র স্ত্রী-ভাগ্যেই এরকম অঘটন ঘটতে পারে।
‘গোবেচারা’ টাইপের লোক এই আবু জুনায়েদ। তিনি ‘মাঝে-মধ্যে ফজরের নামাজ পড়তেন’। স্ত্রীর ধারণা অন্য নারীর প্রতি আসক্তির ব্যাপারে তার সন্দেহকে ভুল প্রমাণ করতে স্বামী এইরকম নামাজের আশ্রয় গ্রহণ করছেন। ডিপার্টমেন্টের অবিবাহিতা শিক্ষিকা দিলরুবার প্রতি ছিল তার গভীর সন্দেহ। নুরুন্নাহার বানু কোনো কোনে রাতে বিছানায় ‘বাসি পাউরুটির মত থলথলে শরীরখানা মেলে ধরে’ সাড়া না পেয়ে পরস্ত্রীসান্নিধ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। অবশ্য জুনায়েদেরে চরিত্রের সবচেয়ে বড় সার্টিফিকেট প্রদান করেন লেখক স্বয়ং। তিনি বলছেন—
আবু জুনায়েদের দৈনন্দিন জীবনযাপন পদ্ধতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করে আমরা তার মধ্যে সামান্য পরিমাণ দোষও আবিষ্কার করতে পারিনি। নুরুন্নাহার বানুর মৌন সন্দেহটুকুকে ধর্তব্যের মধ্যে আনাও উচিত নয় মনে করি। তার সবটাই কাল্পনিক। মেয়ে মানুষ ঘরে বসে থাকলে এবং নিজেকে ক্লান্ত করার প্রচুর কাজ না থাকলে, মাথার উকুনের মত মনের মধ্যে সন্দেহের উকুন বাসা বাঁধতে থাকে।
আবার স্ত্রী নুরুন্নাহার যে সবসময় স্বামী সম্পর্কে একই ধারণা পোষণ করে, তা নয়। কাজে ব্যস্ত এই মানুষটির প্রতি তার মমতাও জেগে ওঠে কখনো কখনো। ‘বোকাসোকা’ এই লোকটিকে খুব সহজেই ঠকানো যায় বলে তার ধারণা। কখন যে কোন ধুরন্ধর তাঁকে বিপদে ফেলে দেয়—এই আশঙ্কায় কাতর হয়ে উঠতে দেখি নুরুন্নাহারকে। তিনি মনে করেন—‘জীবনে যত জায়গা দেখেছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জায়গা’।
আহমদ ছফা বর্তমান উপন্যাসে ‘মেন্দা মারা মানুষটির’ উত্থানের গল্পের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনার দিকে সচেতন সমাজের অভিনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। তিনি উপন্যাসে বর্ণিত বিশ্ববিদ্যালয়টির গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ তুলেছেন, মহান ভাষা-আন্দোলন এবং মুক্তি-সংগ্রামের জ্বালামুখ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি এর ক্রমপতনের দুঃখকথা লিপিবদ্ধ করেছেন। বিশেষ করে শিক্ষকদের রাজনীতি, বিভিন্ন দলে-গ্রুপে তাদের বিভক্তি, সিনেট ভিসি প্যানেল প্রভৃতি নির্বাচনে রাজনীতির লেজুরবৃত্তি, প্রশাসনে রাজনীতি ও স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস এসব কারণে যে শিক্ষার অভিলক্ষ্য ও সৌন্দর্যহানী ঘটছে, সে দিকে তাঁর দৃষ্টি অত্যন্ত সজাগ। উপন্যাস থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি—
সাম্প্রতিককালে প্রায় বার জন ঝুনো প্রফেসর ডোরাকাটা দলের সমর্থক। তাদের প্রত্যেকেই মনোনয়ন পেতে ভীষণ রকম আগ্রহী। সকলেই মনে করেন, তার মত যোগ্য প্রার্থী পূর্বে কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। প্রায় সকলেই মনে করেন বিশ-পঁচিশ বছর ধরে শিক্ষকতার মহান ব্রতে নিযুক্ত আছেন, অবসর নেওয়ার পূর্বে উপাচার্যের চেয়ারটিতে একটু পাছা ঠেকাতে পারলে নিঃস্বার্থ জ্ঞান সেবার একটা স্বীকৃতি অন্তত মিলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এইসব রাজনীতিকরণের খবর আজ সর্বত্র প্রচারিত। শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক সকলেই এর প্রভাবের অসহায় শিকার। এ-প্রসঙ্গে একজন সাংবাদকর্মীর একটা পর্যবেক্ষণ এখানে তুলে ধরছি—
বাংলাদেশের কোনো কিছুই রাজনীতিমুক্ত থাকলো না। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা লাল, নীল, সাদা, হলুদ, বেগুনি নানা রঙে বিভক্ত হয়ে গেছেন। তারা শুধু নিজেরা এই রঙকে ধারণ করছেন না বরং ছড়িয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীর মধ্যে। এ দেশে এমন কোনো পাবলিক ভার্সিটি নেই যেখানে রাজনীতি নেই। হ্যাঁ, দু-একটিকে দাবি করা হয় আউট অব পলিটিকস্। যেমন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু নানা ফোরাম আর সামাজিক সংগঠনের নামে সেখানেও রাজনীতির চর্চা চলছেই। তাতে কোনো সমস্যাও ছিল না, সেই রাজনীতি যদি ছাত্রদের কল্যাণে হতো। শিক্ষক নির্বাচন নিয়ে রীতিমতো এলাহি কাণ্ডকারখানা অবস্থা। অনেক সময় এ নির্বাচন জাতীয় বির্নাচনে রূপ নেয়। মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষকরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যান।৩
ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়া ভিসির বাসভবনে বিস্তর জমি ফাঁকা পড়ে আছে। আছে গাছ-গাছালি, বাগান, খোলা জায়গা। আগে পাখ-পাখালির আনাগোনা। পোকামাকড়ের ইতঃস্তত ঘোরাঘুরি। হঠাৎ ভিসি-দম্পতির মনে এলো এখানে। একটা গাভী পালন করা যেতে পারে। যে-ভিসিকে নিয়ে কাহিনিকার এই গাভী বিত্তান্ত সাজিয়েছেন, ‘এই গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনও তাঁর বন্ধু নেই, সেই নিষ্ঠুর সত্যটি তিনি দাঁত তোলার মত বেদনা দিয়ে অনুভব করেছেন’। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অসহায়তা ও অধঃপতনের বাস্তবতা তুলে ধরতে কাহিনিকার একটা কার্য-কারণের কথা উল্লেখ করেছেন—
ফুটন্ত গোলাপের মত তাজা টগবগে তরুণেরা শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর হনন কারখানার ধারে কাছে বাস করতে করতে নিজেরাই বুঝতে পারেন না কখন যে তারা হনন কারখানার কারিগরদের ইয়ার দোস্তে পরিণত হয়েছেন। তাই জাতির বিবেক বলে কথিত মহান শিক্ষকদের কারো কারো মুখমণ্ডলের জলছবিতে খুনি খুনি ভাবটা যদি জেগে থাকে তাতে আঁতকে ওঠার কোন কারণ নেই। এটা পরিবেশের প্রভাব।
২০১২ সালে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি-নিয়োগের নাটক৪ কিংবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভিসির অনৈতিক৫ বক্তৃতা হাল-আমলে অনেকের নজরে এসেছে। সত্যিকার অর্থেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক একটি নরকে পরিণত হয়েছে। অন্য একটি গল্প থেকে খানিকটা প্রাসঙ্গিক পাঠ গ্রহণ করছি—
‘নিরপেক্ষতাবাদ’ চিন্তাধারায় প্রবলভাবে বিশ্বাসি প্রভাষক কিসমত আলির অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে তো আর কম সঞ্চয় হয়নি; অন্তত আটত্রিশ বছরে দেড়শতাধিক ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাক্ষী সে [ন্যাক্কারজনকই বা বলি কেন, কারণ এগুলোকে তো স্বপ্নের পর্যায়েও অনায়াসে ফেলে দেওয়া চলে]। দাবি আয়াদের জন্য উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে কিংবা তাকে অফিসকক্ষে বসে থাকতে বাধ্য করে শক্তির দামামা বাজিয়েছেন; অল্পকাল পড়েই তারা ওই উপাচার্যের তল্পির রশির বাণ্ডিলের গিট খুলেছেন, নীরবে ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে; হাত কচলাতে কচলাতে তালুর তক রক্তিম পর্যন্ত করে ফেলেছেন বিনাবাক্যব্যয়ে—এমন লোকদের বদলে-যাওয়া চরিত্রও দেখেছেন [অবশ্য তাদের পিছনে তার কিছুটা সমর্থনও সর্বদা উন্মুক্ত ছিল!]। কেরানি কিংবা অধঃস্তনদের পিছনে পিছনে হাঁটতে দেখেছেন অনেক কলিগকে। পদ-পদবিকে, ক্ষমতার দৌড়কে কাজে লাগিয়ে স্বতন্ত্র অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন কেউ কেউ। কেবল প্রভাষক কিসমত আলির কিছু হলো না—না অফিসের কোনো উঁচু চেয়ারে বসা, না কোনো অ্যাপার্টমেন্ট কিংবা সোনার খণ্ড জমির মালিক হওয়া; না কোনো অফিসের এমডি বা ডিরেক্টর হওয়া।৬
গাভী বিত্তান্ত ধারণ করেছে ভিসির ক্ষমতা ব্যবহার ও অপ-প্রয়োগ, ছাত্র-সংঘর্ষ—হত্যা, পুলিশি নির্যাতন থেকে শুরু করে নানাবিধ সামাজিক-রাষ্ট্রীয়, প্রশাসনিক বিষয়-আশয়। উপাচার্যের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের খারাপ সময়ের ছবিও আছে। শিক্ষকদের ফলাফল জালিয়াতির ঘটনাও বাদ পড়েনি। উপাচার্যের অফিস ও বাসভবন ঘেরাও কিংবা ভাঙচুরের শৈল্পিক বিবরণও মেলে এখানে।
কদর্য এশীয় এবং… : কদর্য এশীয়৭ গ্রন্থে কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ভার্সিটির ভিসির চরিত্র উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। বাঙালি যে কালচারালি আন-কালচার্ড, তা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাসঙ্গিক দাবি ও বিক্ষোভ এবং প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর দেশি-বিদেশি শাসক ও নিয়ন্ত্রকদের জুলুম-অন্যায়ের ছবিও ওয়ালীউল্ল¬¬াহ্ এঁকেছেন এই উপন্যাসে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে। সরকারের কোনো দায়িত্বশীল (ক্ষমতাশীলও নিশ্চয়) ব্যক্তির বক্তব্যের সমালোচনা করার জন্য সংবাদকর্মির ওপর অবিচারের খড়গ চাপানোর যে দৃশ্য আমরা আজও অবলোকন করি, আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের সে রকম পরিস্থিতির কথাই লেখক আমাদের সামনে হাজির করেছেন। ‘নতুন সরকার দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির যে কোনো রকম ষড়যন্ত্র কঠোর হাতে গুঁড়িয়ে দেবে’ মর্মের বাণীকে বিবেচ্য রেখে কাহিনিকার তাঁর পাঠককূলকে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অবস্থান, সুবিধাভোগী ও তাবেদার উপাচার্য ও পুলিশ বাহিনির নির্লজ্জতা—নির্বিচারে গুলি ও হত্যা, আর প্রতিবাদী ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষার্থী ও প্রচারমাধ্যমকর্মির দিনলিপি-রাতপঞ্জির বাস্তবতার ছায়াছবির ভাষ্য ও চিত্রাবলি। কয়েকটি উদ্ধৃতি থেকে আমরা বুঝতে পারবো দেশের প্রতি নিমগ্ন মানুষের অসহায়তা, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের অস্পষ্ট অবস্থান, সচেতন মানুষের বিভ্রম আর বিভ্রম-উত্তরণ-ভাবনার কথামালা—
ক) ‘বিকেলে ছাত্ররা জড়ো হলে তিনটি ভ্যানবোঝাই বেয়নেটধারী পুলিশ নীরবে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বাইরে অবস্থান নেয়। স্তব্ধ ও অশুভদর্শন খাকি পোশাকের সশস্ত্র পুলিশ দেখে কিছু যুবকের মনে ভীতি সঞ্চারিত হয়, বাকিদের মনে পোস্টার-কথিত রহস্য আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে। এরপর আর পিছু হটা চলে না।’
খ) কাসেমকে এখানে-সেখানে সাইকেল থামাতে হচ্ছে, বারবার নাবতে হচ্ছে, কারণ অন্যদের মতো উইন্ডশিল্ডের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে পেশাগত পরিচয়পত্র মেলে ধরার সামর্থ্য তার নেই, এ জন্য যখন সে মন্ত্রীর কক্ষের করিডোরে পৌঁছায়, ততক্ষণে সেখানে বেশ বড়সড় ভিড় জমে গেছে।… একজন কর্মকর্তা সবার হাতে একটি করে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে যায়। তাতে বড়জোর দশ-বারটি বাক্য লেখা। তারা যতোক্ষণে পড়ে, মন্ত্রী তাঁর কাজ চালিয়ে যান। কর্মকর্তাটি অন্ধকার কোণে মিশে যায়। কাসেম দ্রুত দশটি লাইন পড়ে ফেলে, তারপর পৃষ্ঠা উল্টে দেখে উল্টোপিঠে কিছু আছে কি না, তারপর দেয়ালের দিকে চেয়ে বসে থাকে।… তথ্যবিবরণীতে একটি ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে, ষড়যন্ত্রটি পাকিয়েছে কতিপয় রাষ্ট্রবিরোধী পক্ষ ও রাজনীতিবিদ, যারা ‘চিহ্নিত বিদেশী শক্তির’ পক্ষ হয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালায়।’
গ) উপাচার্য নিজে পুলিশকে দায়মুক্ত করেছেন। বলেছেন, পুলিশ ভুল করেনি।’
বিরাট ক্যানভাসের এই উপন্যাসটিতে মর্যাদার সাথে উপস্থাপিত হয়েছে ভিনদেশি উন্নয়নসংস্থার লক্ষ্য ও কার্যাবলি, তাদের কাজ সম্বন্ধে দেশের মানুষের ভাবনা ও মত-প্রকাশে অংশগ্রহণ; প্রসঙ্গত, স্পষ্টভাবেই, রূপলাভ করেছে লেখকের অভিপ্রায়। কথানির্মাতা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ধারণা শিক্ষা-সমাজ-কৃষি এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ইচ্ছার কথা বলে, দূরদেশ (বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) থেকে আগত, যে সকল সমাজকর্মি ধর্মপরায়ণতা-মানবপ্রেম-কর্তব্যজ্ঞানকে আশ্রয় করে আমাদের দেশে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কাছে সহানুভূতি ও সহযোগিতা কামনা করে, তারা মূলত ওই জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করতে চায়। এ রকম আস্থা বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পলিসি প্রচারের সাথে মারাত্মতভাবে জড়িত; এমন চিন্তাও লেখকের ভাবনারাজিকে আন্দেলিত করে; তিনি এমন তথ্যও পরিবেশন করেছেন যে, এই সমাজ-উন্নয়নকর্মিরা সরকার এবং নির্বাচন-ব্যবস্থার সাথেও নানানরকম আঁতাত করে, আমজনতাকে প্রকৃতপক্ষে তারা ভালোবাসে না। তাই, তিনি তৈরি করছেন এমন এক আবহ, যাতে করে দরিদ্র এই দেশটির পিছিয়ে-থাকা মানুষগুলো তাদের অধিকার ও মর্যাদা সম্বন্ধে সতর্ক হতে শেখে। একজন স্থানীয় প্রশাসক আর বিদেশ-আগত একজন এনজিও কর্মির কথোপকথনের মাধ্যমে কাহিনিকার সেই সম্ভাবনার ইঙ্গিতই রচনা করছেন বলে মনে হয়। তিনি লিখছেন—
“জেলা কর্মকর্তা পূর্ববৎ চিন্তাচ্ছন্ন হন। ঘরে গভীর নিস্তব্ধতা নামে। এন্ড্রুর অস্থিরতা কাটে না।
‘আপনারা এমন একটি জিনিস (আস্থা) দাবি করছেন, যা দেওয়া কঠিন’, প্রবীণ ভদ্রলোক অবশেষে বলেন, ‘আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, কিছুই চাওয়ার নেই মনে করে কাজ করে যান। যদি সত্যি প্রত্যাশা ত্যাগ করতে পারেন, আরও ভালো।’এন্ড্রুর চোখমুখের কোণ ঈষৎ কুঞ্চিত হয়। শান্ত ভঙ্গিতে সে জিজ্ঞাসা করে, ‘তাহলে আমরা কাজ করব কেন?’
‘সেটি তো আপনাদের সিদ্ধান্ত।’
এন্ড্রু কিছুক্ষণ বসে থেকে একসময় উঠে পড়ে। করমর্দনের সময় সে জেলা কর্মকর্তার দিকে তাকায় না।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের নৌবিহারের আমোদে আড়ালে লেখক স্থাপন করেছেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চোরাগলি আর দুর্বল সরকারকে উৎখাত করার জন্য সেনা অফিসারদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারাদি; দেখিয়েছেন এশীয় এই দেশটির মানুষের মাত্রাতিরিক্ত আতিথেয়তার ঐতিহ্য, তথ্য-পরিসংখ্যানের দিক থেকে ভয়ানকভাবে পিছিয়ে থাকার বাস্তবতা আর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বাড়াবাড়ির কিছু প্রসঙ্গ। জাদরেল ব্যবসায়ী ইদ্রিসের আমন্ত্রণে, তারই বিলাসবহুল নৌযানে, নদীভ্রমণে রাষ্ট্রদূত হথর্ন, এমন সময় খবর পেলেন নতুন এই দেশটিতে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র প্রায় গুছিয়ে এনেছে; তাকে সংবাদটি দিয়েছে এ দেশের গোয়েন্দাসংস্থার আধুনিকায়ন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা (অবশ্য তার অবস্থান কূটনীতিকদের কাছে গভীর রহস্যময়) হ্যারি রাইট। হথর্ন এ ধরনের সংবাদে সন্দেহ পোষণ করেন। কেননা, তাঁর জানা মতে—‘পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির অধিকাংশ নেতা কারাবন্দি। ছাত্র বা শিক্ষকরাও বেশি কিছু করতে পারবে না, কারণ শুধু যে বিঘ্নসৃষ্টিকারীরা কারারুদ্ধ তা-ই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলিও সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
সেনাবাহিনির ‘কতিপয় তরুণ লেফটেন্যান্ট সরকারকে উৎখাত করতে’ পারবে বলে তাঁর মনে হয না; আর যদি তা ঘটেও, তাতে মার্কিনমুলুকের তেমন কিছুই যায়-আসে না। কারণ, প্রত্যেক সেনাসদস্যের ‘প্রতিটি পালিশ করা বোতামের ঔজ্জ্বল্যে মার্কিন ডলার ঝিকমিক করে’ আর ভাবনার অতলে থাকা ‘নিরপেক্ষবাদ’ তারা কখনোই প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। অন্যদিকে ষড়যন্ত্র প্রতিফলিত হবার আগেই যখন তা আবিষ্কৃত এবং তা মার্কিনিদের হাতেই, কাজেই আর কোনো শঙ্কা নেই। আরেকটি বিষয়ও ভেবে নেন রাষ্ট্রদূত হথর্ন। তা হলো—বোকামিঘেরা আদর্শবাদের তাড়নায় অবাস্তব দ্রুত গতিতে দেশের উন্নয়ন ঘটানোর চিন্তায় কিংবা তাড়াহুড়ো করে পদোন্নতি নেওয়ার লোভে তারা এ রকম ষড়যন্ত্রের পথে হাঁটতে পারে; কিন্তু মার্কিন পলিসির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস এই সেনাবাহিনীর নেই।
বাঙালির বিদেশ-নির্ভরতা ও গরু-গিরি : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যেমন তাঁর উপন্যাসে এশীয়দের মার্কিন-নির্ভরতা কথা তুলেছেন, তেমনই আহমদ ছফার এই গাভী বিত্তান্ততে দেখতে পাই সুইডিশ রাষ্ট্রদূতের সাথে উপাচার্যের সাক্ষাৎকার আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সিরিজ বক্তৃতার লোভনীয় দুর্দন্ত অফারের কথা। ভিসি অফিসে অপেক্ষারত রাষ্ট্রদূতের দিকে হাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানানোর পর জুনায়েদের সাথে ঘটে-যাওয়া পুরো সাক্ষাৎকারটি আমরা এখানে তুলে দিচ্ছি—
— ইউর এক্সেলেন্সি আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি, দেয়ার ইজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট ইন মাই হাউস!
রাষ্ট্রদূত ভদ্রলোক উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বললেন :
— সো ইউর ওয়াইফ ইজ সিক, ইজ শি?
— ইউর এক্সেলেন্সি নট এক্স্যাক্টলি মাই ওয়াইফ, বাট মাই কাউ।
— হোয়াট? কাউ? সো ইউ আর কিপিং এ কাউ?
— ইয়েস ইউর এক্সেলেন্সি, ভেরি গুড, ভেরি বিউটিফুল কাউ অ্যান্ড ইঁস মাদার ইজ এ সুইডিশ কাউ, এ কাউ অফ ইউর বিউটিফুল কান্ট্রি। দ্যাট কাউ সিক।
রাষ্ট্রদূত ভদ্রলোক একটু অবাক হয়ে গেলেন। কিছু জিনিস জানার জন্য রাষ্ট্রদূত ভদ্রলোকের কৌতুকের জন্ম নিল। তিনি বললেন :
— মি. ভাইস চ্যান্সেলর আই হ্যাভ টু কোয়োরিস। দ্য ফার্ষ্ট ওয়ান ইজ আই হ্যাড দ্য আইডিয়া দ্যাট হিন্ডুস ওঅরশিপ কাউস। বাট মুসলিম আর বীফ ইটার নেশন লাইক আস, ইজ নট দ্যাট?
আবু জুনায়েদ বললেন :
— ইউর এক্সেলেন্সি ইজ পারফেক্টলি রাইট হিন্ডুস ডু ওঅরশিপ কাউ অ্যান্ড উই পিপল ইট বীফ। বাট ইট ইজ অলসো ট্রু উই লাভ কাউ ভেরি মাচ।
রাষ্ট্রদূত ভদ্রলোক হাসি সংবরণ করে বললেন :
— নাউ মাই সেকেন্ড কুয়েরি উড বি হাউ ডু ইউ রিলেট কাউ কিপিং অ্যান্ড য়্যুনিভার্সিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন?
— ইউর এক্সেলেন্সি। আই হ্যাভ মাই ওন ইনডিভিজুয়াল মেথড টু ম্যানেজ বোথ।
রাষ্ট্রদূত ভদ্রলোক বললেন :
— থ্যাঙ্ক য়্যু মি. ভাইস চ্যান্সেলর, আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি অ্যান্ড গ্ল্যাড টু মিট ইউ।
কী কাণ্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তা! এমন উপাচার্য দিয়ে চলে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়? গরু, ভারতের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উগ্রতা, কাজের প্রতি মানুষের ডেটিকেশন বিষয়ক চিন্তাকে ঔপন্যাসিক যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে তাঁর মুন্সিয়ানাই প্রকাশ পায় মাত্র। হাসির ছলে ছফা এখানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয়কে আমাদের বিবেচনার সামনে এনেছেন। আমরা নিজেদের দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে কীভাবে পরিবার ও ব্যক্তির সুবিধা নিয়ে জীবন-যাপন করি, সরকারের ও রাষ্ট্রের বিপুল সুযোগ-সুবিধাকে আমরা কী নির্লজ্জভাবে ব্যক্তিগত আবেগ ও ছেলেপনার কাজে ব্যবহার করি, তার একটা খতিয়ানও হাজির করেছেন এই উপন্যাসে। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, আর বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি শিক্ষা প্রদান ও গ্রহণের সবচেয়ে উঁচু জায়গা বলে আমরা বিবেচনা করি, তাহলে আমরা জাতির কী মেরুদণ্ড তৈরি করছি, তা ভার্সিটি প্রধানের দৈনিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে প্রমাণিত হয়।
শেষকথা: তখন ১৯৯৮ সাল। আমার শিক্ষকতা জীবনের আনুষ্ঠানিক অধ্যায়ের সূচনাকালের একটি অভিজ্ঞতা এখানে শেয়ার করতে চাই। ঢাকার একটি প্রাইভেট কলেজে জয়েন করেছি প্রভাষক পদে। অল্পদিন পরেই দেখলাম কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে একটি পক্ষ সোচ্চার হচ্ছে। অভিযোগ : স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক অনিয়ম। কলেজ তোলপাড়। অধ্যক্ষের চাটুকাররা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যতিব্যস্ত। প্রায় প্রতিদিন মিটিং-সিটিং। ক্যাম্পাসের বাইরে চলছে ‘ষড়যন্ত্র’। এরকম কোনো একটি ফরমাল সভায় ইংরেজির শিক্ষক শামীম আহসান বললেন—‘আমরা তো শিক্ষক নই। একেক জন মেজর, কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। শিক্ষক হতে গেলে এমন হতে হবে জানলে আমি অন্য অনেক বন্ধুর মতো সেনাবাহিনীতে যোগ দিতাম, এখানে আসতাম না।’—আজ প্রায়শই ভাবি, শামীম ভাই কি তখন গাভী বৃত্তান্ত পড়ছিলেন! প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হুমায়ূন আজাদ মনে করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতে গেলে যতোটা নিচে নামার যোগ্যতা থাকতে হয়, তা তাঁর নেই। সত্যিই তো, এদেশে তাহলে কারা ভিসি হয়? আবু জুনায়েদদের পৃষ্ঠপোষক কারা? কী স্বার্থ এদের? আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-ই বা কী?
তথ্যসূত্র
১। ফজলুল হক সৈকত, ‘উপাচার্য উপাখ্যান এবং কিছু কথা’, ভাষাচর্চা ও শিক্ষা-পরিকল্পনা, (ঢাকা : কথামেলা প্রকাশনী, ২০১৩), পৃ. ১২০-১২২ লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক যায়যায়দিন-এ)
২। প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫। গ্রন্থটির উৎসর্গ পত্র এ রকম : ‘ফাদার ক্লাউস ব্যুয়েলে : আমার বন্ধু এবং শান্তিপথের যাত্রী’।
৩। আমিরুল মোমেনীন মানিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় স্টুপিড শিক্ষক, (ঢাকা : কালো, ২০১৬), পৃ. ২৩-২৪
৪। বিস্তারিত দেখুন : ফজলুল হক সৈকত, ‘জাবির জবরদস্ত নির্বাচন এবং শিক্ষাস্বপ্নের নির্বাসন’, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও বর্তমান বাংলাদেশ, (ঢাকা : নবরাগ প্রকাশনী, ২০১৩), পৃ. ১৫৮-১৬১ লেখাটি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ প্রথম প্রকাশিত)
৫। তিনি মনে করেন, চাকুরি পাওয়ার প্রধান যোগ্যতা হলো—সে ছাত্রলীগ করেছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা।
৬। ফজলুল হক সৈকত, ‘প্রভাষক কিসমত আলীর অবসরগ্রহণ’, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় : বিভ্রান্তি ও বাস্তবতা, (ঢাকা : নবরাগ প্রকাশনী, মার্চ ২০১০), পৃ. ১৫৮ লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক যুগান্তর-এ)
৭। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, কদর্য এশীয়, অনুবাদ : শিবব্রত বর্মণ, (ঢাকা : অবসর, ২০০৬); গ্রন্থটি তাঁর ইংরেজি রচনা দ্য আগলি এশিয়ান (রচনাকাল : ১৯৭১)-এর বাংলা ভাষান্তর। এটি লেখকের চতুর্থ উপন্যাস।