বাংলা উপন্যাসের জন্ম হয় পাশ্চাত্য প্রভাবে। এর আদর্শ-ভিত্তি প্রতিষ্ঠা পায় বঙ্কিমের হাতে। রবীন্দ্রনাথের প্রথম দুটি উপন্যাস ‘রাজর্ষি’ ও ‘বউঠাকুরানীর হাট’ বঙ্কিম-প্রভাবিত। বাংলা উপন্যাস নতুন বাঁক নেয় ‘চোখের বালি’র মাধ্যমে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে যোগ করেন নতুন মাত্রা। বঙ্কিমীধারার লেখক মীর মশাররফ হোসেন। মীর মশাররফ হোসেন অসাধারণ জীবনচেতনার বৃহত্তর সমাজ কাঠামোকে উপন্যাসে আনেন। মুসলিম ঔপন্যাসিকদের যাত্রাও মূলত মশাররফ-পরবর্তী থেকেই। এ প্রবন্ধে মূলত মুসলিম লেখকদের উপন্যাসের যাত্রা ও পাঠকপ্রিয়তার ব্যাপারটিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
মুসলিম লেখক হিসেবে মীর মশাররফ হোসেন উপন্যাস রচনায় অপরিসীম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এর কারণ, মুসলমানদের উগ্রতা ও সংস্কারচেতনা বিপুলভাবে তৎকালীন আর্থ-সামজিক পরিপ্রেক্ষিতে বজায় ছিল। সেজন্য ‘বিষাদ-সিন্ধু’র মতো মহাকাব্যিক উপন্যাসও তিনি রচনা করতে পেরেছিলেন। তা জনপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী লাভ করেছিল। ভারতবষের্র মুসলমানদের বিকশিত হওয়ার পথ নানাভাবে অবমুক্ত হলেও বাঙালির অস্তিচেতনা নিয়ে তখনো গণমানুষের মধ্যে সংকট কাটেনি। এ পর্যায়টিতে তারা বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত অপেক্ষাপূর্ণ ছিলেন।
মীর মশাররফ হোসেন যেমন এগিয়েছেন স্বীয় প্রতিভাবলে। প্রকৃত অর্থে তখন সে পরিবেশটি ছিল না, সৃষ্টি হয়নি কোনো সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। ফলে মুসলমানরা জেহাদে অংশ নেয়, মফস্বলে থেকে নানামুখী বিষয়ে ইন্ধন জোগায়। একাধারে ঊনিশ শতকীয় দ্বিধা অন্যদিকে সাংস্কৃতিক শূন্যতা উপনিবেশবাদী শাসনকর্তাদের সুযোগ এনে দেয়। তাদের হাতে যা লেখা হয় তা নিছক চালচিত্র বা জীবনের সরল বৃত্তান্ত। কখনোবা তা সমাজরীতি পরিস্রুত গতানুগতিক জীবনচিত্র। একমাত্র মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন ব্যতিক্রম। কারণ, বাঙালি মুসলমানদের গতানুগতিকতার বদলে বড়শিল্পী হিসেবে তিনি জায়গা খুঁজে নেন। পরবর্তী মুসলিম লেখকদের মধ্যে অনেকেই তেমন অগ্রসর হতে পারেননি। একদিকে তাদের ব্যক্তিজীবনে যেমন ছিল অসহায়ত্ব, শূন্যতা; অন্যদিকে তেমনি সমাজেরও নির্ধারিত বাস্তবতাও ছিল; যা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। তার উদাসীন পথিকের মনের কথা, ‘গাজী মিঞার বস্তানি’নামে বিখ্যাত গদ্য রচনা। ‘রত্নবতী’ তার উপন্যাস।
মোজাম্মেল হক কবি হিসেবে পরিচিত হলেও উপন্যাস-রচনাতেও তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন। তার ‘জোহরা’ পাঠকনন্দিত উপন্যাস ছিল। ওই সময়ের মুসলিম সমাজচিত্র উপন্যাসটির প্রধান উপজীব্য। জোহরায় বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলার প্রভাবে রোমাঞ্চের আধিক্য ঘটেছে। সমাজচিত্রটিও নির্মিত হয়েছে ‘কপালকুণ্ডলা’র অনুসৃতে। একসময় মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের অভিমত বা ইচ্ছে কোনো মূল্য বহন করতো না। জোর করে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পরিবারের পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হতো। এতে নারীর জীবনে দুঃসহ বেদনার যে করুণ পরিণতির জন্ম হতো, এ উপন্যাসে সে চিত্রই উপস্থাপিত হয়েছে।
শেখ ফজলল করিমের ‘লায়লী মজনু’ শিল্পোৎকর্ষ সমৃদ্ধ উপন্যাস না হয়েও এর ভাগ্যে পাঠকপ্রিয়তা জুটে যায়। ‘লায়লী-মজনু’ (কায়েস)-র অমর প্রেম-কাহিনি মানুষের কাছে চির পরিচিত। এর আবেদন চিরন্তন ও সর্বজনীন। যে কারণে এ উপন্যাস সহজেই পাঠকপ্রিয়তা লাভে সক্ষম হয়। পরিচ্ছন্ন ও আবেগময় ভাষার কারণেও উপন্যাসটি পাঠকের সমাদর লাভ করে।
সৈয়দ হকের উপন্যাসে স্বাধীনতা-পূর্ব এবং পরবর্তী সময়ে ক্রমবিকশিত মধ্যবিত্তের মনোজগত, বিকারগ্রস্ততা, যৌনতা, অঢ়রিতার্থতা, আত্মকূণ্ডলায়ন, স্ববিরোধিতা বিচিত্রভাবে নিরীক্ষিত হয়েছে।
উপন্যাসে প্রকৃত রূপটির জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। এক্ষেত্রে ইসমাইল হোসেন শিরাজী-র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার উপন্যাস হলো: ‘তারাবাঈ’ (১৯০৮), ‘ঈশা খাঁ বা রায়-নন্দিন ‘, ‘ফিরোজা বেগম’ ও ‘নূরুদ্দিন’। শিরাজীর উপন্যাসে সমাজের ভেদবিচারের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ। বঙ্কিমচন্দ্র অনুসরণে কিংবা প্রতিকারের ভিত্তিতে তিনি উপন্যাস রচনা করেন। এ পর্যায়ে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘তারাবাঈ’ উপন্যাসের কথা। তার উপন্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছিল ‘রায়-নন্দিনী’। বিশেষ করে সেকালের মুসলিম সমাজ এ উপন্যাসটিকে তাদের আত্মমর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করতো। শিরাজীর ভাষায় শক্তি ছিল।
শিরাজীর উপন্যাসে হিন্দু-মুসলমান বলে কিছু নয়, গুরুত্ব পেয়েছে প্রকৃত ধারার ঐতিহ্যিক আদর্শ। যেটি প্রত্যেক বড় লেখকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এভাবে প্রধানত জাতীয় চেতনার পরিপ্রেক্ষিতটিই তিনি উপন্যাসে তুলে আনেন। তবে মুসলিম নায়ক আর হিন্দু নায়িকার আন্তঃপ্রণয়ের চিত্রে তিনি মুসলমানদের গৌরবান্বিত করে তোলেন। প্রায় প্রত্যেক উপন্যাসে এরূপ প্রণয়ের চিত্র বর্ণনা করেছেন তিনি। এরূপ চিত্র একইভাবে মোজাম্মেল হকের ‘জোহরা’, শেখ মোহাম্মদ ইদরিস আলীর ‘বঙ্কিমদুহিতা’ (১৯১৭) উপন্যাসেও পরিলক্ষিত। সেখানে বঙ্কিম উপন্যাসের প্রতিক্রিয়ায় কাহিনি বিন্যস্ত করা হয়েছে।
শিরাজীর সময়কাল রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের উপন্যাসে নতুনমাত্রা হিসেবে যুক্ত হয় পর্দাপ্রথার অন্ধকারে নারীসমাজের অবরুদ্ধতা ও অশিক্ষা এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার মন্ত্রবীজ। এ চেতনাপ্রসূত থেকেই তার ‘মতিচূর’, ‘অবরোধবাসিনী’, ‘পদ্মরাগ’ প্রভৃতি উপন্যাস রচিত হয়েছে। তার সব উপন্যাসেই প্রধান উপজীব্য পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলমান নারীদের দুর্দশনার চিত্র এবং জাগরণের মন্ত্র উচ্চারণ। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের মাধ্যমেই নারী শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসের মূল মেসেজ এটি। ‘অবরোধবাসিনী’ উপন্যাসে পর্দাপ্রথার ভয়ঙ্কর অন্ধকারে নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। আর এর মাধ্যমেই আবিষ্কৃত হয় কুসংস্কারের ভয়ালরূটি, উচ্চারিত হয় নারী মুক্তির মন্ত্র উদিত হয় জাগরণের আলোকবার্তা।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার কৃতিত্বপূর্ণ অবস্থান। উপন্যাস-সাহিত্যেও তার পদচারণা রয়েছে। তিনি ‘নদীবক্ষে’ উপন্যাস লেখেন। মননশীল প্রবন্ধের লেখক হিসেবে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান খ্যাতি অর্জন করলেও তিনি বেশ কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছেন। তবে মোহাম্মদ নজিবর রহমান এক্ষেত্রে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পীরপ্রথা বা পীরদের ক্ষমতা, কৌশল বা আধিপত্য নিয়ে তিনি বেশকিছু উপন্যাস রচনা করেছেন। তার ‘গরীবের মেয়ে’, ‘পরিণাম’ ও ‘প্রেমের সমাধি’ উপন্যাসে পীরের মর্যাদার প্রশ্নটি উঠে এসেছে। এ লেখক প্রভূত জনপ্রিয়তা পেয়ে যান এসব উপন্যাস রচনা করে। প্রাসঙ্গিকভাবে নিশ্চয়ই ‘আনোয়ারা’র কথা বলতে হয়। এসব উপন্যাসে ধর্মচর্চা, মুসলিম রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, আদেশ-উপদেশ-নির্দেশ অনুপঙ্খভাবে উপস্থাপন করেছেন। এসব উপন্যাসে ধর্মচর্চার বিষয় পারিবারিক জীবনাগ্রহে ব্যক্ত করেছেন। এভাবে মুসলিম ঔপন্যাসিকদের উপন্যাসে জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রটি রচিত হয়।
এম.এ হাশেম খানের ‘আলোর পরশ’ জনপ্রিয়তার বিচারে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটি উপন্যাসের একটি। মোহাম্মদ কোরবান আলীর ‘মনোয়ারা’ও পাঠকনন্দিত উপন্যাস। এ উপন্যাসটি ‘আনোয়ারা’-প্রভাবিত হয়েও ব্যাপক পাঠকের আনুকূল্য লাভ করেছিল।
কাজী নজরুল ইসলামেরও প্রধান খ্যাতি কবি হিসেবে। ‘বিংশ শতকে মুসলমানদের মধ্যে একাধিক বিস্ময়কর প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল, নিঃসন্দেহে নজরুল ছিলেন তাঁদের মধ্যে সেরা।’ কাজী নজরুল ইসলাম এ সময়পর্বে উপন্যাস লিখে জনপ্রিয় না হলেও যে বিপ্লব চেতনার প্রতীক রূপে তিনি প্রতিষ্ঠিত হন সেটাই গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে তার উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে। ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে নর-নারীর প্রেম ও ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবকে একই সঙ্গে তুলে ধরে পাঠকের বিশেষ আগ্রহ তৈরি করতে পেরেছিলেন। নজরুলের পত্রোপন্যাস ‘বাঁধন-হারা’ উপন্যাসে আবেগদীপ্ত ভাষা প্রেম ও প্রত্যয়ের দীপ্তিতে প্রকটিত। নজরুলের উপন্যাসের জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে তার অবিসংবাদিত কবিখ্যাতি যুক্ত ছিল। নজরুলের জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে যেমন তার অবিশ্বাস্য কবিখ্যাতি, ঔপন্যাসিক হিসেবে জসীমউদ্দীনের জনপ্রিয়তা লাভের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি প্রায় একইধারায় পর্যবসিত। জসীমউদ্দীনের উপন্যাস ‘বোবাকাহিনী’ প্রকাশের বহু আগেই তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান। ‘বোবাকাহিনী’ রচিত হয়েছে মুসলমান কৃষকদের জীবন-কাহিনি নিয়ে। উপন্যাসটিতে অত্যন্ত দরদের সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে গ্রাম-জীবনের সামগ্রিক চিত্র।
সিকান্দার আবু জাফর কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ। তার ‘মাটি আর অশ্রু’, ‘নতুন সকাল’ সাড়া জাগানো উপন্যাস। আবুল ফজলের ‘চৌচির’ উপন্যাসে মুসলিম জীবনাগ্রহের পরিচয় বিধৃত। মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও সমাজতন্ত্রের আবির্ভাবের কথা আছে তার ‘জীবন পথের যাত্রী’ উপন্যাসে। এ-উপন্যাসে বৃহত্তর সামাজিক পটভূমি অনুপস্থিত, ব্যক্তি মানুষের উপলব্ধি বাস্তবায়নের পথ ধরে উপন্যসটির কাহিনি নির্মিত হয়েছে। তার অন্য উপন্যাস ‘রাঙ্গাপ্রভাত’র পটভূমি দেশবিভাগের বিক্ষুব্ধ সময়কাল। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা উপন্যাসে বিস্ময়কর প্রতিভা। তার ‘লালসালু’ এক অসামান্য সৃষ্টি। ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’ বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে নতুন বাক ঘটিয়ে দিয়েছিল। পাঠকের মনে-মননে-চিন্তায় শাণিত স্রোতের মতো এসব উপন্যাস আঘাত করেছিল।
বাংলা উপন্যাসে জনপ্রিয়তার ধারায় ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন গুরুত্বপূর্ণ। সমাজজীবনের বিভিন্ন সমস্যাকে একজন সুদক্ষ শিল্পীর মতো তিনি তার উপন্যাসে এঁকেছেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর নেতাদের চরিত্রচিত্রণের প্রেক্ষাপটে তিনি উপন্যাস রচনা করে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ‘অবাঞ্ছিত’, ‘কী পাইনি’, ‘দু’দিনের খেলাঘরে’, ‘দুষ্টক্ষত’, ‘নতুন পৃথিবী’, ‘মেঘ বিজলি বাদল’ তার বিখ্যাত উপন্যাস। আকবর হোসেনের উপন্যাসগুলো জনপ্রিয় হওয়ার অন্য কারণ উঠতি নগরের মধ্যবিত্ত জীবন তার উপন্যাসে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে।
বিভাগ-উত্তর পূর্ব-বাংলায় তথা বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ বাগদাদের পটভূমিকায় উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠলেও প্রচ্ছন্নভাবে লেখকের রাজনৈতিক চেতনার এক চমৎকার উদ্ভাসন এখানে নজরে পড়ে। শওকত ওসমান প্রতীকী এ উপন্যাসে হারুনুর রশীদের প্রতীকায়নে পাকিস্তানের একনায়ক স্বৈরশাসক আইয়ুবের চিত্র অঙ্কন করে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদকে তাতারীর মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ‘জননী’ উপন্যাসও বাংলা সাহিত্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। উপন্যাসটিতে মাতৃত্বের অনবদ্য ও চিরকালীন মাতৃসত্তার পরিচয়বিধৃত। জীবনের থেকেও সন্তানই যে জননীর কাছে বড়; সে সত্য এখানে শিল্পগুণে উপস্থাপিত হয়েছে। সেকারণে বাঙালি পাঠকের কাছে জননী বিশেষ গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস চারটি। ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’, ‘নেকড়ে অরণ্য’, ‘দুই সৈনিক ও জলাঙ্গী’। উপন্যাসগুলো পাঠকসমাদৃত। এছাড়া ও তার ‘বনী আদম’, ‘পতঙ্গ পিঞ্জর’, ‘রাজসাক্ষী’, ‘পিতৃপুরুষের পাপ’ প্রভৃতি বাংলা উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তার উপন্যাসে পাকিস্তানের দুঃশাসন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতির ভেতর-বাহির, সমাজের দগদগে ঘা বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়েছে।
শহীদ আশরাফ একসময় বেশ জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ছিলেন। তিনি প্রায় বিশটি মতো উপন্যাস লিখেছেন। তার ‘অপরাজিতা’, ‘মন মহুয়া বন’, ‘হারানো সুর’, ‘শিল্পী’, ‘গোপন চারিনী’, ‘প্রেম পিয়াসী’ প্রভৃতি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। পূর্ব-বাংলার ভাষা আন্দোলন নিয়ে জহির রায়হানের আরেক ফাল্গুন জনপ্রিয় উপন্যাস। এর প্রধান উপজীব্য রাজনীতি। এ-উপন্যাসে লেখকের ভাষাগুণে যে আঙ্গিক নির্মাণ হয়েছে, তা প্রজন্মান্তের রাজনীতির বার্তাকে যেমন বিবেচনায় এনেছে তেমনি শিল্পক্ষুধাও মেটাতে সক্ষম হয়েছে, সন্দেহ নেই। জহির রায়হানের অন্য উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘আর কতদিন’, ‘তৃষ্ণা’ ও ‘কয়েকটি মৃত্যু’।
জহির রায়হানের অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সার পেশাগত জীবনে সাংবাদিক হলেও উপন্যাস লিখে তিনি কালজয়ী শিল্পশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। ‘সারেং বৌ’ ও ‘সংশপ্তক’ তার বিখ্যাত দুটি উপন্যাস। ‘সারেং বৌ’ জনপ্রিয় উপন্যাস। জনপ্রিয়তার কারণও স্পষ্ট। ‘কদম সারেং’ ও ‘নবিতুনের প্রতিজ্ঞাপ্রসূত প্রেম’ উপন্যাসে যা সারাক্ষণই বাধাগ্রস্ত হয়েছে ভোগবাদী শক্তির দ্বারা। একইসঙ্গে নবিতুনও প্রতিরোধে হয়ে উঠেছে সর্বসংহা শাশ্বত নারী।
আবদুল গাফফার চৌধুরী উপন্যাসে জীবনের নানা বৈচিত্র্য এনে উপন্যাসে নতুন প্রাণ দিয়েছেন। তার উপন্যাস ‘রজনীর চাঁদ’, ‘নীল যমুনা’। শামসুদদীন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’ বহুলপঠিত উপন্যাস। আবুল মনসুর আহমদের ‘জীবন-ক্ষুধা’ উপন্যাসে আর্থ-সামাজিক-রাজনীতির অনুপম এক চিত্র ফুটে ইঠেছে। জোবেদা খানমের উপন্যাস প্রেম-প্রকৃতি ও রোমান্সনির্ভর। তার ‘দু’টি পাখি দু’টি তারা’, ‘অনন্ত পিপাসা’, ‘অভিশপ্ত প্রেম’ নর-নারীর স্বাভাবিক প্রেম-প্রণয় পারিবারিক-সামাজিক ঘাত প্রতিঘাতের ছবি। সাধারণ পাঠকের মনকে যা সহজেই স্পর্শ করতে পেরেছিল। রশিদ করিমের ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’ পাঠক হৃদয়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করা উপন্যাস।
সৈয়দ শামসুল হক সব্যসাচী লেখক হলেও উপন্যাস রচনায় তিনি অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। তার অনেক উপন্যাস পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে। ‘এক মহিলার ছবি’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’ পাঠকনন্দিত উপন্যাস। তিনি অসংখ্য উপন্যাসের শ্রষ্টা। সৈয়দ হকের উপন্যাসে স্বাধীনতা-পূর্ব এবং পরবর্তী সময়ে ক্রমবিকশিত মধ্যবিত্তের মনোজগত, বিকারগ্রস্ততা, যৌনতা, অঢ়রিতার্থতা, আত্মকূণ্ডলায়ন, স্ববিরোধিতা বিচিত্রভাবে নিরীক্ষিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পরে সেলিনা হোসেন জনপ্রিয় হন। তার উপন্যাসের প্রধান অনুষঙ্গ রাজনৈতিক চেতনা। কাহিনি ও চরিত্রের মধ্যে সময়ের একটি বিবেচনা সারাক্ষণ কাজ করে। লেখক রাজনীতিকে জড়ান সময়ের ভেতরের মানুষগুলোকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি অসংখ্য অসামান্য উপন্যাস লিখেছেন। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘যাপিত জীবন’, ‘গায়ত্রীসন্ধ্যা’, ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’, ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’, ‘খুন ও ভালোবাসা’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা টানাপড়েন’, ‘মর্গের নীল পাখি’ প্রভৃতি তার অসামান্য সৃষ্টি। তার উপন্যাস পাঠকসমাজে যেমন বহু পঠিত, তেমনি সমাদৃত ও চেতনায় অগ্নিকা বারুদ জ্বালিয়ে দেয়। তার উপন্যাসের শক্তিটাই বিশেষ রকমের।
রাবেয়া খাতুন বাংলা উপন্যাসে এক নতুন প্রবাহ তৈরি করেছেন। মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি; আর্থসামাজিক অবস্থা, মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী অবস্থা, স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ তার উপন্যাসের বিশেষ দিক। তার অসংখ্য উপন্যাস পাঠকনন্দিত। ‘মন এক শ্বেত কপোতী’, ‘ই ভরা ভাদর মাহ ভাদর’, ‘বায়ান্ন গলির এক গলি’, ‘ফেরারী সূর্য’, ‘জীবনের আর এক নাম দিবস রজনী’ প্রভৃতি।
তবে বাঙালি মুসলমান নয় বাংলাদেশের জাতি ধর্মবর্ণ গোত্র নির্বিশেষে লেখকরাই এ ধারায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সাফল্যও পেয়েছেন।
মধ্যবিত্ত জীবনের বহুমুখীনতা ও বহির্মুখিনতাকেন্দ্র করে শহীদ আখন্দ লিখেছেন ‘পান্না হলো সবুজ’, ‘ভালোবাসার বসবাস’, ‘দুদণ্ড শান্তি’ প্রভৃতি। দিলারা হাশেম প্রথম উপন্যাস ‘ঘর মন জানালা’ লিখেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার অন্য উপন্যাসগুলোও পাঠককে বেশ আকৃষ্ট করেছে। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে আহমদ ছফা বিশেষ একটি নাম। ‘ওঙ্কার’, ‘সূর্য তুমি সাথী’, ‘মরণবিলাস’, ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস। শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ ভিন্ন ধরনের উপন্যাস। এটি সিরিয়াস রচনা হলেও বেশ জনপ্রিয়।
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ ইতিহাসের পৃষ্ঠে বাধা কিছু মানুষের রাজনৈতিক চেতনার পুনর্মূল্যায়ন। চলমান সময় ও সমাজবাস্তবতায় লেখকের এ প্রবণতা একদিকে যেমন জীবন অনুষঙ্গি অন্যদিকে তেমনি নতুন পথের বার্তাবাহী।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ বাংলাদেশের তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস। মঞ্চেও প্রতিষ্ঠিত। জনপ্রিয়ও বটে। তার অন্য উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’। এই উপন্যাস লিখে তিনি উঁচুমাপের শিল্পদক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। হাসান আজিজুল হক-এর ‘আগুনপাখি’ একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় উপন্যাস। চরিত্র-কাহিনি-বিষয়বস্তুতে এক নতুন ধারা এ উপন্যাসে লক্ষণীয়। পাঠককে যা বিশেষভাবে টানে।
মাহবুব তালুকদারের ‘আরেকজন আমি’, ‘পলাশ ও শিমুলের গল্প’, ‘ক্রীড়নক’ উপন্যাস। তার উপন্যাসে মধ্যবিত্ত জীবনের আবেগকে কাহিনী করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
বাংলাদেশের উপন্যাস-সাহিত্যে এ ধারা অব্যাহত আছে। ক্রম-বিস্তৃতিও ঘটেছে অনেকদূর। সামাজিক বৈষম্য, বংশাভিমান, ভেদবিরোধী ব্যাপার, পীরপ্রথা, রোমাঞ্চকর অলৌকিকত্ব, ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃতি, অস্পৃশ্যতা, ধর্মন্ধাতা, অবরোধ, নারীনির্যাতন, করপোরেট পুঁজি ও অন্তর্জালবিষয়ক জটিলতা এ শতকে বাঙালি লেখকরা নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সমাজচিন্তায় শৈথল্য এসেছে। সংস্কৃতি পাল্টেছে। একুশ শতকের উপন্যাস এখন আরও জটিল বাস্তবতামুখর। এতে ধর্মান্ধতা, মনস্তত্ত্বও ভিন্ন মাত্রায় উপন্যাসে যুক্ত হয়েছে। ফলে জনপ্রিয়তার ক্ষেত্র উপন্যাসের কমেনি। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ এ ক্ষেত্রে উল্লেখনীয় দৃষ্টান্ত। তিনি বাঙালি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রাখতে পেরেছিলেন। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগারে, শ্যামল ছায়া, কোথাও কেউ নেই, শ্রাবণ মেঘের দিন, এইসব দিনরাত্রি, আগুনের পরশমণি, জোছনা ও জননীর গল্প প্রভৃতি ব্যাপকভাবে পাঠকনন্দিত উপন্যাস। অসংখ্য উপন্যাস-গ্রন্থেও স্রষ্টা ইমদাদুল হক মিলনের নামটিও এক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে বিচিত্ররকম মানুষকে কাহিনীতে এনেছেন তিনি। গ্রাম ও নগরের জীবনাচার গভীর দৃষ্টিচেতনায় প্রোথিত করে তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। কয়েক দশক ধরে এদেশের পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তিনি ধরে রেখেছেন। তাঁর সুদীর্ঘ কলেবরে রচিত নূরজাহান একটি অসামান্য উপন্যাস হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। ইমদাদুল হক মিলনের নূরজাহান গুণগতমান, শিল্পমূল্য ও পাঠকপ্রিয়তায় বাংলা সাহিত্যে এক অমর সৃষ্টি। এ উপন্যাসে নারীর রূপান্তরিত বিদ্রোহীসত্ত্বা কাঠামোবন্দি হয়েছে।
শহিদুল জহির শক্তিশালী ঔপন্যাসিক। তার সে রাতে পূর্ণিমা ছিল বিখ্যাত উপন্যাস। আনিসুল হক এই সময়কালে পাঠকপ্রিয়তায় একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। মা তার বিশেষ উপন্যাস। এ ছাড়াও তাঁর অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস রয়েছে। অরুণ চৌধুরীর ছায়াবন্দী, আবদুল মান্নান সৈয়দের ক্ষুধা প্রেম আগুন, আলাউদ্দিন আল আজাদের তেইশ নম্বর তৈলচিত্র, অন্ধকার, হরিপদ দত্তের অজগর ও জন্ম জন্মান্তর, তসলিমা নাসরিনের অপর পক্ষ ও লজ্জা, মঞ্জু সরকারের প্রতিমা উপাখ্যা, আতা সরকারের একদা অনঙ্গ বউ, তিতুর লেঠেল, সোনাই সরদারের ঢাকা অভিযান, মঈনুল আহসান সাবেরের পাথর সময়, কেউ জানে না, আদমের জন্য অপেক্ষা, আগামী দিনের গল্প, রকিবুল হাসানের ভাঙন, অহনা বউ, ছায়াবন্দি প্রভৃতি উপন্যাস এখনো পাঠকের আগ্রহের বিষয়। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ইসহাক খান, জুলফিকার মতিন, ওয়াহিদ রেজা, আফসান চৌধুরী, হাসনাত আবদুল হাই, বুলবুল চৌধুরী, সামস্ রাশীদ, রাজিযা মজিদ, রফিকুর রশীদ, মহসিন শস্ত্রপাণি, মাফরুহা চৌধুরী, মালিহা খাতুন, মঈনুদ্দীন কাজল প্রমুখ-এর উপন্যাসও পাঠকমহলে সমাদৃত। এছাড়া, এই নিবন্ধে উল্লিখিত ঔপন্যাসিকদের বাইরেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখক রয়েছেন। তাদের উপন্যাসও পাঠকের আগ্রহ তৈরি করেছে।
আধুনিক সমাজে অনেক মুসলিম লেখক নানাবিধ সমস্যা নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। এবং এখনো লিখছেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনদের পদচারণাও লক্ষ করার মতো। উপন্যাসের জনপ্রিয় এ ধারাবাহিকতায় এখন ক্রমপ্রবহমান এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে, এ নিয়ে ভিন্ন পর্যবেক্ষণের উপন্যাসও লেখা হচ্ছে। তবে বাঙালি মুসলমান নয় বাংলাদেশের জাতি ধর্মবর্ণ গোত্র নির্বিশেষে লেখকরাই এ ধারায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সাফল্যও পেয়েছেন।