স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতার সঙ্গে পূর্ববর্তী কবিতার পার্থক্য স্পষ্ট। এ পার্থক্য রচনার একমাত্র কুশীলব ওই সময়ে আবির্ভূত কবিরাই নন; অগ্রজরাও। স্বাধীনতা-পূর্ব কালখণ্ডের প্রধান কবিরাই মূলত পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে কবিতায় স্থান দিতে গিয়ে নতুন স্বর নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। তাঁদের দেখাদেখি পরবর্তী কবিরাও মনোযোগী হয়েছেন। কিন্তু সে চেষ্টা কোনো বিশেষ সময়ের বৃত্তে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর পরিসর-ব্যাপ্তি সুবিশাল ও বিপুল। এই স্বর নির্মাণকালের ব্যাপ্তি প্রায় দুই যুগপর্যন্ত। এই নির্মাণ-সৃজনকলার প্রধান সারথীদের একজন আহমেদ স্বপন মাহমুদ। তাঁর কবিতার ভাষা-ভাব-ভঙ্গি সাবলীল। তিনি যখন নিরূপিত ছন্দে লেখেন, তখনো একটি সহজ সুর বেজে ওঠে। আবার যখন অনিরূপিত ছন্দে লেখেন তখনো।
স্বপন বক্তব্য প্রকাশে সংহত ভাব ও শব্দপ্রয়োগে মিতব্যয়ী হলেও তাঁর সৃষ্টির প্রাচুর্য লক্ষণীয়। তাঁর কবিতার সংখ্যা সুপ্রচুর হলেও অতিকথনের ভারে ন্যুব্জ নয়। প্রায় অনিবার্য শব্দপুঞ্জের অনিবার্য বিন্যাসে তাঁর কবিতার সৃষ্টি। ব্যক্তির মনের কথা বা বক্তব্য প্রকাশের মোক্ষম মাধ্যম হিসেবে স্বপন কবিতাকেই বেছে নিয়েছেন। এ কারণে সমাজে-রাষ্ট্রে সংঘটিত ঘটনা-দুর্ঘটনার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার চিত্র তিনি কবিতায়-ই তুলে ধরেন। এই আত্মপ্রকাশ-আত্মআবিষ্কারের ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান প্রবণতা বিভিন্ন ধরনের বস্তু-নির্বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় এবং এ সম্পর্কের নানা রকম সরল ও বক্ররেখা স্থাপন করা। একই সঙ্গে রেখা থেকে রঙের এবং বস্তু থেকে নির্বস্তুর ভেতর অতিক্রমণের চেষ্টা করা। এসব দিক থেকে বিচার করলে স্বপনের কবিতায় কয়েকটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১। দার্শনিক প্রত্যয়ের সঙ্গে-সঙ্গে সমাজ বাস্তবতার চিত্র অঙ্কন
২। রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে মানব-মানবীর সম্পর্ক আবিষ্কার
৩। নারী-প্রকৃতির মধ্যে অভিন্ন চিত্র কল্পনা
৪। নিরূপিত ছন্দের প্রতি ঔদাসিন্য, অনিরূপিত ছন্দে আগ্রহ
৫। শব্দালঙ্কারের চেয়ে অর্থালঙ্কারের দিক জোর
৭। ভাষার সারল্য
বিষয়গুলোর আলোকে আহমেদ স্বপন মাহমুদের কবিতা বিশ্লেষণ করলে তাঁর শক্তিমত্তা ও কবিতার মর্মার্থ উপলব্ধি সহজ হয়। তবে, তার আগে বলে নেওয়া ভালো, এই কবি সমাজ সচেতন বটে, কিন্তু স্লোগান সর্বস্ব পঙ্ক্তি রচনার তাঁর আগ্রহ নেই। সমাজের অসঙ্গতি-বিসঙ্গতি কিংবা গণদাবির প্রসঙ্গ তাঁর কবিতায় রয়েছে। তবে, তা প্রচ্ছন্নভাবে।
শিল্পী সমাজের দশজন সাধারণ মানুষে কিংবা সমাজকর্মী কিংবা রাজনৈতিককর্মীর মতো স্লোগান কণ্ঠে তুলে নেন না। এমনকি তিনি সব সময় গণরুচিকে সমর্থনও করেন না। বরং স্বতন্ত্র রুচি নির্মাণের দিকে মনোনিবেশ করেন। এভাবেই সমাজের আর দশজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর চিন্তা-কর্ম-আচরণ আলাদা হয়ে যায়।
স্বপনের কবিতার প্রধান প্রবণতা দার্শনিক সত্য উপস্থাপন। এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করে নেন, সমাজবাস্তবতার নানা দিকও। ফলে তার কবিতায় দর্শন ও সামাজিক তত্ত্ব-বাস্তবতা একই পঙ্ক্তিতে উদ্ভাসিত হয়। তিনিও সমাজকর্মী থেকে দার্শনিকতার দিকে যাত্রা করেন। এই ধারার একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হলো ‘রেখা’। এ কবিতায় তিনি বলেন, ‘রেখা বিস্তীর্ণ হলে বর্ণ ক্রমাগত নীল হয়।’ একই কারণে তিনি বর্ণসমেত ক্রম করেন ‘যাত্রা রেখাপথে।’ অর্থাৎ তিনি যে সমাজে বসবাস করেন, সেখানে ব্যক্তির মনোবাসনা ও সমাজের কানুন পরস্পর সমান্তরাল নয়। কখনো-কখনো বিপরীতমুখীও হয়ে পড়ে। ফলে তীব্র বাসনা সত্ত্বেও অবদমিত থাকতে হয়। আবার নিজের শক্তির চেয়েও মনের গতি বাড়িয়ে দিয়ে, সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হয়। অন্তত টিকে থাকার সাধনায় মগ্ন হতে হয়। প্রায় একই উপলব্ধি তাঁর ‘রাতঘুম’ কবিতায়ও প্রকাশ করেছেন। সমাজ-সংসারে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছেন—‘আকাঙ্ক্ষার ডানায় ভর করে রাতের গভীরে ঘুম পায়।’ আবির্ভাব ও আত্মপ্রকাশ সম্পর্কে তার রয়েছে নিজস্ব দর্শন। তিনি মনে করেন, সব কিছুর আধার মূলত বীজ। ওই বীজ থেকেই মূলত সব কিছুর সৃষ্টি। ‘অশেষ যাত্রা’য় স্পষ্ট জানান দেন—‘আমি এসেছি আঁধারের বীজ ভেঙে ভূমিদেশে।’ সৃষ্টিতত্ত্ব এবং মানবজাতির ক্রমবিকাশের ইতিহাস ও মিথ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সৃষ্টির পূর্ববর্তী মুহূর্ত তীব্র বেদনাদায়ক। আর পরবর্তী মুহূর্ত প্রবল আনন্দের। তাই তাঁর কাছে নগর এক ধরনের নৈরাশ্যের নাম। যেখানে ‘ঘরে ঘরে শূন্যতা’ দেখেন তিনি। প্রাণী মাত্রই মৃত্যুর মুখাপেক্ষী—এটি কেবল দার্শনিক প্রত্যয় নয়—একইসঙ্গে বৈজ্ঞানিক-ধর্মীয় সত্যও বটে। প্রাণী, মানে প্রাণীই। সে অতি সুন্দর বুদ্ধিহীন প্রজাপতি হোক, আর অতিকায় ডায়নোসরই হোক, কিংবা হোক মহাজ্ঞানী মানুষ—সবাইকেই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হয়। কিন্তু কবির প্রশ্ন হলো—‘জীবিতদের কে কে ভাবছেন মরণের কথা!’ কবি এখানে ধার্মিকের মতো, দার্শনিকের মতো আত্মজিজ্ঞাসার ছলে সামাষ্টিক জিজ্ঞাসায় নিজেকে মেলে ধরেন।
কবিকেও কখনো-কখনো প্রাজ্ঞদর্শী দার্শনিকের দায় পালন করতে হয়। তাঁকেও বলে দিতে হয় নিজের জাতি, রাষ্ট্র ও স্বগোত্রের আচরণের ইতিহাস ও ইতিহাসের পরিণতি। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ কবিতায় স্বপনও তাই বলেন, ‘বুদ্ধি লুপ্ত হলে হলে অভিজ্ঞতা গান হয়ে ওঠে।’ আহমেদ স্বপন মাহমুদ সমাজের প্রচলিত বিশ্বাসে পুরোপুরি আস্থাবান নন। তাঁর সংশয় ও সন্দেহ প্রতিষ্ঠিত বিষয়ের দিকেই বেশি। তাই প্রচলিত বিশ্বাস, ‘ফুল পবিত্রতার প্রতীক’—বাক্যে তিনি আস্থা রাখেন না। ‘ফুলেদের মতো আমাদের মেয়েরা’ কবিতায় ফুলকে তিনি আবিষ্কার করেন বহুগামিতার শিকার ও দ্বিচারিতার মধ্যে। একই সঙ্গে সমাজের চিত্রও দেখেন একই আয়নায়। এ কারণে মানবসমাজের অবক্ষয় ও মানবতার আর্তনাদ কবিকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। কবি যে নারীকে ঘ্রাণময় ফুলের মতো আকর্ষণীয় মনে করতেন, সে-ই নারীকেই আবার কাগুজে ফুলের মতো লাঞ্ছিত হতে দেখেন। তবে একই সঙ্গে মানবসমাজকে একটি মর্মান্তিক প্রশ্নের মুখোমুখিও দাঁড় করিয়ে দেন। বলেন—‘আমরা কি চাই ফুলেদের গন্ধ হারিয়ে কাগজের রূপ বেঁচে থাক/ ফুলেদের মতো আমাদের মেয়েরা এভাবেই গন্ধহীন বেদনা ছড়াক!’ উত্তর হয়তো অনেকেরই জানা। কিন্তু কবি বিস্ময় প্রকাশ করেই থেমেছেন। উত্তর দেননি। এ রকম দর্শনময় আরও কিছু পঙ্ক্তি—
১। মরণ জীবনে থাকে না দীর্ঘকালব্যাপী (সম্পর্ক)
২। শিশুটি কেবল ফুল আর কবর দেখে! (গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ফুটে ওঠো)
৩। মহাজীবশূন্যতার পারে/ একা আমি মহাঘোরে (স্বপ্নসমুদ্রস্মৃতি ও অগ্নিসিম্ফনি)
৪। প্রার্থনার মতো প্রেমের আগুন গলে ঢলে। (আগুন)
৫। তোমার চোখে তখনো কি লেগেছিল মোহের আগুন! (আনন্দ বাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল)
৬। আমি বহুদিন পাইনি জল, তুমি টলমল কেন থাকো চোখে। (টলমল)
৭। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর বুঝতে পারছি/ নেমে আসা সহজ নয় (সিঁড়ি)
মানুষ একইসঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব—এটি বহুল চর্চিত সত্য। আপাতত এই সত্য নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তোলার প্রয়োজন নেই—যতক্ষণ পর্যন্ত এর বিপরীত কোনো জোরালো সত্য কেউ উপস্থাপন করছেন। মানুষের অধিকার আদায় কিংবা সম্মানজনকভাবে সমাজে-রাষ্ট্রে বেঁচে থাকার জন্য রাজনৈতিক বিষয়াবলি চর্চিত হয়ে আসছে। রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরেই মানুষ নিজেদের জন্য নিয়ম তৈরি করে, শাসন করে, শোষিত-শাসিত হয়। এর ভেতরেই কেউ কানুন তৈরি করে অন্যকে শাস্তি দেয়, একই অপরাধে নিজেকে বাঁচানোর জন্য করে কসরত। এটাই মানবপ্রবৃত্তি। তবে, মানবপ্রবৃত্তির সবচেয়ে জটিল বিষয় হলো—সে ছলেবলে কৌশলে নিজের প্রভূত্ব অন্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চায। আর এ জন্যই সে প্রথমে অর্থবিত্তের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। অর্থবিত্তই তার সব নয়, এসব টিকিয়ে রাখার জন্য তার দরকার পড়ে ক্ষমতার। ক্ষমতাকে নির্ঝঞ্জাট করার জন্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেই বেছে নেয়। নিতে হয়। এই রাজনীতি-ক্ষমতায় আরোহণের জন্য কেউ বেছে নেয় গণতন্ত্র, কেউ রাজতন্ত্র, কেউ একনায়কতন্ত্র। মোদ্দা কথা হলো, যে যে-ই তন্ত্রই বেছে নিক, শেষপর্যন্ত নিজেকে শাসকরূপে দেখতেই সে পছন্দ করে। শাসক-শাসিতের সম্পর্ক প্রায় দ্বন্দ্বমুখোর হয়।
এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত যত প্রকট হয়ে ওঠে, ততই মানবতা লাঞ্ছিত হতে থাকে। কবি সেই মানবতার লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠেন। যদিও কবির পক্ষপাত, বিদ্রোহ সবসময় সমাজে তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলতে পারে না। কিন্তু যখন প্রভাব ফেলে তখন ক্ষমতার মসনদ পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদের কবিতায় রাজনৈতিক ব্ক্তব্য সরাসরি নেই। কিন্তু মানুষের রাজনৈতিক অধিকার, চিন্তাধারার বিষয়টি প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে সমাজে অনেক সময় শ্রেণীভেদ শুরু হয়। তখন কোনো-কোনো মানুষ নিজেকে সমাজের জন্য বোঝা মনে করেন, কেউ-কেউ নিজেকে সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হন। তখন বেছে নেন আত্মহননের পথ। এ রকম একটি কবিতা ‘আত্মহত্যা’’। কবিতাটি ক্ষুদ্র। পুরোটাই এখানে তুলে দিচ্ছি।
মেয়েটি উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আছে
প্রতিবেশে অগ্নিময় জলের রেখা
ওপরে অসংখ্য ডানার মতো
মেয়েটি পাখির প্রেমিক, জলের।
প্রপাতের রেখায় অজস্র আঁধার
সবুজ ছড়ালো আগুন হীনমন্যতার
বরফের অশান্ত চুম্বনে, মেয়েটি
জলের কুমারী ঝাঁপ দিল
জীবনের সুতোর ওপারে।
উপত্যকায় বেজে যায় মর্মের করুণ সংগীত।
কবিতাটি মাত্র দশ পঙ্ক্তির, তিনস্তবকের। প্রথম স্তবক চার পঙ্ক্তি, দ্বিতীয় স্তবক পাঁচ পঙ্ক্তির এবং শেষ স্তবক মাত্র এক পঙ্ক্তির। প্রথম স্তবকে প্রস্তাবনা, দ্বিতীয় স্তবকে জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিণতি। শেষ পঙ্ক্তিতে ওই পরিণতির ফলে বেদনার আবহ পরিস্ফূট। স্বপন দেখিয়েছেন, সমাজে রাজনৈতিকভাবে অবেহিলত হলে, মানুষ পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নিগ্রহের শিকার হয়। একপর্যায়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এবং এই আত্মহননের ফলে সমাজে তার তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না। কিন্তু প্রকৃতিতে থেকে যায় এর করুণ রেশ। সমাজে অবহেলিত হতে হতে মানুষের মনে বিষণ্নতা বাসা বাঁধে। সেই বিষণ্নতাই তাকে টেনে নিয়ে যায় আত্মহননের দিকে। এই উপলব্ধিজাত আরও কিছু পঙ্ক্তি
১। আমরা সংগীত শ্রবণরত মৃত্যুমুখে যাব! (মুমূর্ষু)
২। গভীর বিষাদে থেমে যায়/ যাবতীয় আলোকের গান। (ক্রমে দূরবর্তী হও)
৩। মরণ জীবনে থাকে না দীর্ঘকালব্যাপী! (সম্পর্ক)
৪। তুমিও কি আগুনের সহোদরা, সচিত্র গেঁথে আছ তারার পতনে! (ইতিহাস)
তবে তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞান প্রকাশের সুক্ষ্ম রুচিবোধের প্রকাশ ঘটেছে ‘সুবর্ণভূমি’তে। এ কবিতায় রাজনৈতিক অভিজ্ঞান-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও স্থানিক বিষয়ের অনিবার্য সম্মিলন ঘটেছে। মূলত নারী ও প্রকৃতির মেলবন্ধনের চিত্র এ কবিতা। কবি দেখেন পৃথিবীতে ক্রমাগত নেমে আসছে অন্ধকার। চারিদিকে হাহাকার, নৈরাশ্য। পৃথিবী ভয়ে উঠছে প্রেমহীনতায়। কারণ এখানে ‘লালসার নিচে পড়ে আছে সুর্ব্ণকন্যার সকল গভীর অভিলাষ।’ দেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকে, কিংবা বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ হয়ে আসে, তখন শিল্পীরাও রূপক-প্রতীকের আশ্রয়ে মনোভাব প্রকাশ করেন। ‘আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল’ সেই প্রতীকী প্রতিবাদের স্বাক্ষর। এখানে যেমন রাজনৈতিক বিষয়ের বর্ণনা আছে, তেমনি রয়েছে দার্শনিকপ্রত্যয়ও। কবির মনে হয়, ‘মৃত্যু তামাশা মাত্র’। কেননা, রাজনৈতিক অস্থিরতার যুগে মানুষই হয় এর বলি। মানুষই মানুষকে খুন করে। কারণ, মানবসমাজে যখন মানবিকতা তুচ্ছ হয়ে পড়ে, তখন মানুষে মানুষে হানাহানি বেড়ে যায। শুরু হয় প্রাণঘাতী সংঘাত। মানুষের সভ্যতা ও রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি বড় অধ্যায় রক্তরঞ্জিত। ক্ষমতার লড়াইয়ে সাধারণ মানুষই বলি হয়—এই ইতিহাস পুরনো। কবিও বলেন, ‘‘মানুষের সাথে রক্তের চলাচল নিবিড়/ আর তোমাদের পায়ে পায়ে মৃত মানুষের দাগ।’ আর এই অস্থিরতা নৈরাশ্যের ভেতর কবি তবু আশার আলো খুঁজে চলেন। কথাটা একটু ঘুরিয়ে বলেন, ‘আমি তবু আবর্জনায় খুঁজে বেড়াই সোনার মমতা।’
নারীকে নদীর সঙ্গে তুলনা পুরনো রীতি। কিন্তু স্বপনের ব্যবহার নতুন তাৎপর্যে উপস্থিত। স্বপন নদীর প্রবহমতা কিংবা জলরাশির সঙ্গে নারীর সৌন্দর্য কিংবা কর্মগতির সাদৃশ্য কল্পনা করেন না। তিনি নারীসত্তায় নদীর উন্মত্ততা যেমন প্রত্যক্ষ করেন, তেমনি আবিষ্কার করেন নদীর জোয়ারভাটার মতো নারী মনের গতিপ্রকৃতিও। একইসঙ্গে তার প্রাণচাঞ্চল্য-হৃদয়বৃত্তিও। কেবল নদী নয়, আকাশ, মাটি, অরণ্যও তার কাছে কখনো কখনো নারী প্রতিরূপ। পাশাপাশি সেই রূপের ভেতর দিয়ে তিনি বাউল সাধকদের মতো, আধ্যাত্মসাধনাও করেন। ‘রূপ’ কবিতায় উচ্চারণ করেন, ‘‘কোন রূপে তুমি এলে, কার নামে জপ করি, সাঁই, তোমার নাম, স্বরূপে তাকাই!’ এই উচ্চারণে আত্মজিজ্ঞাসা যেমন আছে, তেমনি রয়েছে আত্ম-আবিষ্কারের চেষ্টাও। প্রায় একই অনুভূতির চাষ তিনি করেন, ‘‘আমাদের লাল-নীল আকাশে’ও। বলেন, ‘‘কী এমন ভেদ লালে আর নীলে/ প্রেম নিষ্পত্তি হলে আমরা ভিন্ন ভিন্ন সংকুচিত হই, ভুলের মাশুলে।’ কিন্তু কী সে ভুল, সে উত্তর কবি রাখেন না। আবার ‘চিত্র’ কবিতায় তিনি যখন বলেন, ‘শীতের নূপুর পরে রাত্রি এসেছে’,’ তখন পাঠকের কানে বাজে ঘন কুয়াশা আর শিশির ঝরার মৃদুশব্দ। এটা আপাতত একটি অনুভবযোগ্য চিত্রকল্প মাত্র নয়। এখানে মানুষের গভীর বেদনার কথাও লুকিয়ে আছে। শ্রমজীবী মানুষের কাছে এ চিত্র কাব্যের অলঙ্কারের সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় না। তারা বরং জীবিকার তাড়নায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে বেড়ায়। বিশেষত নারীরা। তাদের জীবন সংগ্রাম বড়ই মর্মান্তিক। কোনো কোনো নিজেকে শেষ পর্যন্ত ভোগের উপকরণে পরিণত করতে বাধ্য হয়। আরেক দিকে চলে ভোগের উৎসব। সমাজে এই শ্রেণীবিভাজন মানুষে মানুষে দূরত্ব সৃষ্টি করে। তাই কবি দেখেন, ‘‘শীতের মেয়েরা রাতভর জেগে থাকে জীবিকায়/ উৎসবের মেয়েগুলো রাঙা আপেলের মতো ঘুম যায়।’ জীবনের চরম পরিহাসের এ চিত্র। প্রকৃতির সঙ্গে মানব স্বভাবের চমৎকার চিত্র রয়েছে ‘সাক্ষ্য’ কবিতায়। কবি যখন বলেন, ‘‘ফুলেদের যত গুণ যত আছে গ্রাণ/ ফুলেফলে মিশে প্রেম গাছেদের প্রাণ’, তখন কবির ভেতর যে সর্বপ্রাণবাদী মানুষটি বসবাস করেন, তার স্বরূপ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ‘প্রেম মৃত্যু ও প্রার্থনা’য় তিনি দেখেন, ‘তুমি হাসতে থাকো কবরের প্রশান্তি হয়ে।’
চিত্রকল্প নির্মাণে কবির স্বকীয়তা উজ্জ্বল। তাঁর উপমাও আলাদা বার্তা দেয় পাঠককে। ভাষা সহজ, সরল ও মানুষের নিত্যদিনের ব্যবহৃত শব্দসমেত হওয়ায় তার কবিতার মর্মে প্রবশে অনেক সহজ। কিন্তু যে তার ভাষা সহজ সরল, সে অর্থে বিষয়ের ব্যাপ্তি সহজ নয়। সহজ ভাষায় তিনি অনেক গুরুবিষয়কে বর্ণনা করেছেন। নিরূপিত ছন্দে তিনি উল্লেখযোগ্য কোনো কবিতা রচনা করেননি। কিন্তু অনিরূপিত ছন্দের অভাব অনেকটাই পূরণ হয়ে যায়। পঙ্ক্তি বিন্যাসের ক্ষেত্রে কখনো পর্ব ও পর্বান্তের সাম্য রক্ষা করেননি। কখনো টানা গদ্যে লিখে গেছেন। তবে সে টানাগদ্যে রেখেছেন অক্ষরবৃত্তের গাম্ভীর্যপূর্ণ চাল। এমনকি মাঝেমাঝে স্তবক বিন্যাসেও দেখিয়েছেন, স্বেচ্চাচার। তবু তাঁর কবিতায় আঙ্গিকের বিপর্যয় ঘটেনি; বরং বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে।
শেষপর্যন্ত আহমেদ স্বপন মাহমুদের কবিতা প্রেমময়। প্রার্থনার মতো তার প্রণয়ের সবক। তার কবিতায় রাজনৈতিক-সামাজিক বিষয়ের গভীর রয়েছে ইতিহাস চেতনা। ভৌগলিক সীমারেখার জন্য ইতিহাসচেতনা-ঐতিহ্য মিলেমিশে তাঁর কবিতাকে দিয়েছে স্বাতন্ত্র্য। প্রেম-দর্শন-আধ্যাত্মচেতনার মিথস্ক্রিয়ায় তার কবিতা হয়ে উঠেছে রূপকথার মতোই অন্তহীন রহস্যময়!