বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রবাদপ্রতিম গবেষক-প্রাবন্ধিক-চিন্তাবিদ আহমদ শরীফ (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২১- ২৪ ফেব্রুয়ারি১৯৯৯)। সাহিত্যিক মাত্রই কালসচেতন। তিনি যুগের যাতনা, সমস্যা-সংকটকে পাঠকের সামনে তুলে ধরবেন, এটাই সাহিত্যের মূল। ফলে সাহিত্য হয়ে ওঠে সমাজের দর্পণ। আর আহমদ শরীফ মুসলিম সাহিত্য সমাজের অন্যতম কর্ণধার। ফলে বাঙালি মুসলমানদের কদর্য-সংকীর্ণ মানসিকতায় করাঘাত করতেই এই শ্রেণীর সৃষ্টি। তারা সমাজকে দেখতে চেয়েছিলেন গোড়া থেকে। তখন সমাজের বিধ্বংসী রূপের পরিবর্তন হয়ে পড়েছিল অবশ্যম্ভাবী। তাই এই শ্রেণি সেই ধ্বংসমূলে আঘাত হেনেছিলেন। যদিও আজও কিছু সমস্যা তিমিরেই রয়ে গেছে। কিঞ্চিৎ পরিবর্তন সূচিত হলেও আপামর নারী আজও বঞ্চিত-নির্যাতিত-নিপীড়িত। আহমদ শরীফ তাঁর ‘নারী নির্যাতন: এর শেকড়ের সন্ধানে’ প্রবন্ধে আবহমান নারীর প্রকৃতি, নির্যাতন-নিপীড়নের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষক। তিনি এই প্রবন্ধে খতিয়ে দেখতে চেয়েছেন নারীর হীন-পরিণতি কিভাবে, কেন, কবে থেকে নারীর এমন ভাগ্য বিড়ম্বনার সৃষ্টি।
যেই নারী সমাজের স্তম্ভ সেই নারীর প্রতিই এ সমাজ বারংবার আঘাত হানে। ক্ষতবিক্ষত করে তাদের হৃদয়। তবে এর মর্মমূলে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক শোষণ মানসিকতা। যার সূচনা মানব সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকেই। নারী তার হৃদয়ের উষ্ণতায় পুরুষকে আগলে রাখলেও পুরুষ সমাজ কখনোই নারীর যোগ্য মর্যাদা দেয়নি। বরং নারীকে স্রেফ ভোগের সামগ্রী করে তুলতেই তাদের যত জল্পনা-কল্পনা! সময় বদলেছে,তবু মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেনি।
আজকাল শহুরে শিক্ষিত লোকেরা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তবে সেই কথকতায়ও বিরাট ফাঁক। বাইরের রাখ-ঢাক বজায় রাখলেও নিজের ঘরেই অধিকাংশ পুরুষ নারীর অধিকার রক্ষায় সচেতন নয়। যার যেমন রুচি-বুদ্ধি-জ্ঞান-ন্যায়বোধ, তিনি তেমন করুণ ও জটিল কথার বাকজাল সৃষ্টি করেন। তবে এই নির্যাতনের পেছনে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক-সামাজিক-কালিক রীতি রেওয়াজ। যার আদৌ কোনোই পরিবর্তন ঘটেনি। যুগ অনুযায়ী ভোল পালটে গেলেও নির্যাতনের মাত্রা কোনো অংশেই কমেনি।
এভাবেই নারীর জীবন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে শুরু করে। তবে পুরুষ সবসময় ভোগ করেছে। এই ভোগের মধ্যে দিয়ে নারীকে শাসনের বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে৷
প্রাবন্ধিক আহমদ শরীফ নারী নির্যাতনের শেকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে প্রথমেই দেখিয়েছেন কেন বিয়ে প্রথার চালু হলো। মূলত সমাজের অরাজকতা কমিয়ে আনতেই বিয়ের সৃষ্টি। কাড়াকাড়ি, হানাহানি, মারামারি থেকে মানব জাতিকে একটি সুষ্ঠু-সুন্দর ছায়াতলে নিয়ে আসতেই বিয়ের সৃষ্টি। কারণ মানুষ যতই সভ্যতার আড়ালে এসেছে, ততই তাদের লজ্জা-সংকোচ বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু পুরুষের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য নারীর প্রয়োজন। ফলে পুরুষের কামবাঞ্ছা পূর্ণ করতে গিয়ে নারী জীবনের প্রকৃত স্বরূপ খুঁজে পায়। এ লক্ষ্যে প্রাচীনকালেই মানুষের ধারণা জন্মে, ‘সে পুরুষই সম্ভোক্তা এবং নারী সম্ভোগ্য মাত্র। এ ধারণা এ যুগেও প্রবল।’
পূর্বে নারী যখন শুধু পুরুষের ভোগ্য ছিল তখন মায়ের ওপরই সন্তানের লালন-পালনের সম্পূর্ণ ভার ছিল। এমনকি সে সমাজে মায়ের পরিচয়ই ছিল সন্তানের পরিচয়। তৎপরবর্তীকালে এই মাতৃকেন্দ্রিক যৌথজীবনে দ্রৌপদী-বিয়ে চালু হলো। অর্থাৎ এক নারীকে সব ভাইয়ের স্ত্রী করে উপভোগ প্রথা চালু হয়। সেই নারী অনেকটা মক্ষীরানির মতো হয়ে ওঠে৷ ফলে এই নারী এবং সন্তান কারও একার ছিল না বলে কর্তৃত্বও ছিল না। নারী ছিল স্বাধীন। আবার এমনও দেখা গেছে, এক পরিবারের সব বোনের একজন স্বামী! উনিশ শতক পর্যন্ত হিন্দু সমাজে কিঞ্চিৎ এই প্রথা চালু ছিল। ফলে নারী নির্যাতন-নিগ্রহের সূচনা সমাজে আবহমান কালের। নারীকে উপভোগ্য করে তুলতে পুরুষের শুধু ভোল পাল্টাছে। কিভাবে কোন প্রকারে নারীকে সম্ভোগ করা যাবে, পুরুষশ্রেণি শুধু সেদিকেই মনোনিবেশ করে এসেছে। এর ফলস্বরূপ নারীর আজন্ম লালিত কষ্ট তাকে তিলে তিলে গ্রাস করলেও তা প্রথায় পরিণত করেছে এ সমাজ!
পরবর্তীকালে নিরুপদ্রব-নির্ন্দ্বন্দ্ব সম্ভোগের লক্ষ্যে বিয়ে প্রথার চালু। তখন এক পুরুষের বাহুবল ও খাদ্যসংগ্রহ শক্তি অনুসারে বহুপত্নী গৃহীত হতে থাকে। তখন নারী হলো পুরুষের সম্ভোগ পাত্রী। পুরুষের কর্তৃত্ব স্বীকৃত হলো। নারীর পায়ে শেকল পরিয়ে দিয়ে পুরুষ তাকে যথেচ্ছ ভোগে উন্মত্ত হয়। চিন্তা-কর্ম-আচরণ-অভিভাবক-নিয়ন্ত্রক-নিয়ামক হয়ে ওঠে পুরুষ। যার মধ্যে দিয়ে নারী হয়ে ওঠে দাসী। ভোগপণ্য। এভাবেই নারীর জীবন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে শুরু করে। তবে পুরুষ সবসময় ভোগ করেছে। এই ভোগের মধ্যে দিয়ে নারীকে শাসনের বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে৷
নারী শিক্ষা, স্বাবলম্বী হওয়া এবং চিন্তার প্রাগ্রসরতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। যা নারীর প্রকৃত মুক্তির পথে অন্যতম সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সাহায্য করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
বিয়ে প্রথা কার্যকর হলে নারী হয়ে ওঠে একমাত্র কাম্য৷ পুরুষের চিত্ত বিনোদন, রতিরমণের জন্য সুন্দরী-সুশ্রী নারীকে ছিনিয়ে নিতে বীরত্ব প্রদর্শিত হলো। জ্ঞান, বুদ্ধি, সাহসের সঙ্গে যে নারীকে পুরুষ ছিনিয়ে আনতে পারতো, ওই নারী তারই গলায় মালা পরাতে বাধ্য হলো। আর সতীত্ব রক্ষায় নারীকে বাল্যবিবাহ দিয়ে পুণ্য অর্জন করতে সচেষ্ট হলো পরিবার। সেখান থেকে আবারও শুরু হলো সতীদাহ, বিধবাবিবাহ, অভিভাবকত্ব, স্বামীর পদসেবা। নারী চিরন্তন অবহেলার শিকার। প্রতিপদে নারীকে করে তোলা হলো ভোগ্যবস্তু। নারী মানেই পুরুষের আজ্ঞাবহ দাসী। যার প্রবল প্রচণ্ড প্রতাপ আজ অবধি নারীকে ছিঁড়েছুটে খাচ্ছে! নারীর যন্ত্রণা শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়লেও নারী সমাজ আজও বাকরুদ্ধ জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে। এই মানস চেতনার পরিবর্তন আজও সমাজে ঘটেনি।
আহমদ শরীফ তাঁর প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন নারী নির্যাতনের সেই বিভীষিকাময় চিত্র। তিনি বলেছেন, ‘এ শৈশব বাল্যবিবাহ থেকেই শ্বশুর – শাশুড়ি ও স্বামী-ভাসুরের অভিভাবকত্বের, কর্তৃত্বের তথা শাসনের নিয়ন্ত্রণের হুকুম-হুমকি-হামলা চালানোর, পিটানোর, বেঁধে রাখার, অনাহারে রাখার অধিকার প্রয়োজনীয় বা জরুরি হয়েছিল। এভাবেই স্বামী হল নারীর মর্ত্যজীবনের ঈশ্বর, ভগবান, মালিক, পূজা, তার পায়ের তলায় তার স্থান তথা স্বামীর কাছে আত্মা ও আত্মসমর্পণ করেই, সত্তার স্বাতন্ত্র্য বর্জন করেই, দেহ-মন-চেতনা স্বামীর অনুগত করেই নারীজীবন সার্থক ও ধন্য করতে হয়। দুনিয়ার সব ভাষাতেই স্বামীবাচক শব্দগুলো প্রভুত্বজ্ঞাপক। পত্মীমাত্রই সেবিকা। এ জন্যে দুনিয়ার সব ধর্মশাস্ত্রে ও নীতিশাস্ত্রে নারীর স্থান পুরুষের নিচে। নারীর অভিভাবকত্ব পুরুষের তথা পিতার, স্বামীর ও সন্তানের অধিকারে। নারী হচ্ছে পিতা-স্বামী ও সন্তান পাল্য ও পোষ্য অবলা-অকেজোপ্রাণী, যদিও উৎপাদন-নির্মাণনির্ভর গোড়া থেকেই শ্রম দিচ্ছে, ব্যতিক্রম কেবল শাহ-সামন্ত-সদাগর-শাসক ঘরেই লভ্য।’
নারীর এই রূপ আবহমানকালের। যে শেকল ছিঁড়ে নারী এ যুগেও বেরুতে পারিনি। নারী সমাজের মুক্তি ঘটাতে হলে পুরুষ সমাজের আবহমানকালের নিয়ম-নীতি-নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। স্বামী সম্ভোগ্য বলেই নারীকে উচ্ছিষ্ট-অকেজো ভেবে পুড়িয়ে মারা হতো। আজও পুরুষ স্পৃষ্টা বলে নারী অবহেলিত। অভয়-আশ্রয় জননী নিপীড়নের শিকার। সমঅধিকার, সমকক্ষতা, সহযোগিতা এবং সহাবস্থানের ফলেই আবহমানকালের নিগৃহীত নারী সমাজে তার সুষ্ঠু অধিকার ফিরে পেতে পারে। প্রাবন্ধিক আহমদ শরীফ ‘নারী নির্যাতন : এর শেকড় সন্ধানে ‘ নারীর চিরন্তন অবহেলার কথা বলতে গিয়ে এ সমাজের অন্যায়ের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন। নারীর যাতনাকে মুছে দিতে তিনি নারীর প্রতি সহমর্মি হয়েছেন। নারী শিক্ষা, স্বাবলম্বী হওয়া এবং চিন্তার প্রাগ্রসরতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। যা নারীর প্রকৃত মুক্তির পথে অন্যতম সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সাহায্য করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।