প্রগতিশীল এবং দায়বদ্ধ মননশিল্পী আহমদ শরীফ সমাজ-দর্শনের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে দৃষ্টি দেন মানুষ এবং মানুষের অবদানের প্রতি। ভারতবর্ষের ইতিহাস শুধু যুদ্ধ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যানেরই হিসাব দেয়, আর সে ইতিহাসের বেশির ভাগ জুড়ে থাকে কর্তাভজা ও চাটুকারদের রচিত তোষণমূলক রাজ-পরিবার-নির্ভর গল্পে। সে-ইতিহাসে ঠাই পায় না নিরন্ন; শোফিত-বঞ্চিত মানুষ; তাতে উল্লেখ থাকে না এই ঊনজনদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতিসূচক কোনো কথার । বিশেষ করে মধ্যযুগের ইতিহাসে দেখা যায় ধর্মীয় সংস্কার আচ্ছন্ন করে রেখেছে গোটা সমাজজীবন। মানুষ অর্থাৎ নির্বিশেষ মানুষ সেখানে উপেক্ষিত। দেবতা-ফেরেস্তাদের ভুবনব্যাপী অবাধ বিচরণের দৌরাত্ম্যে মোল্লা-পুরোহিত-পাদ্রি-ব্রাহ্মণ, তথা ধর্মতন্ত্রের দাপটে সাধারণ খেটেখাওয়া অসহায় মানুষ, ভূমিহীন কৃষক অদৃষ্ট বা ভাগ্যের ত্রীড়নক হয়ে পড়ে।
মধ্যযুগ, মানেই তাই পিছিয়েপড়া জীবন—যে জীবনে স্থবিরতা, পদস্খলন, যৌনাচার এবং ধর্মের আবেষ্টনীয় বেড়াজাল বিস্তার করেছিল অক্টোপাসের মতো। দেবতা-ফেরেস্তা, মোল্লা-পুরোহিত-পাদ্রী এবং রাজা-বাদশাদের ষড়যন্ত্রে নিরন্ন মানুষ ছিল কোণঠাসা হয়ে—অদৃষ্ট, ভাগ্য, নিয়তি, পরকাল, পূজাপার্বণ, শাস্ত্রীয় বিধান, পাপ-পুণ্য-ভীতি প্রভৃতি সাধারণ মানুষকে দুর্বল করে রেখেছিল। আল্লাহ্-ভগবানের সঙ্গে আঁতাত ছিল ধর্মব্যবসায়ী ও শাসককূলের। কাজেই ধর্ম ছিল তখন শোষণের বড় হাতিয়ার।
এই মধ্যযুগীয় সমাজ-সংস্কৃতি-জীবনযাত্রা এবং এর বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে বাংলা সাহিত্যের বেশকিছু ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়েছে। সে সব গ্রন্থের অধিকাংশই (সব নয়) ভরে আছে তথ্যে ও উপাদানে, অতিমাত্রিক আগাছায় ও অতিকথনে। আহমদ শরীফই সম্ভবত প্রথম গবেষক ও লেখক, যিনি সমগ্র মধ্যযুগকে জরিপ করলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থার মূল দ্বন্দ্বটিকে মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করে তিনি সমাজের বৃহত্তর নিরন্ন গণমানব,তাদের সমাজ-সংস্কৃতির ওপর সৌধ নির্মাণ করলেন সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ-রীতির মাধ্যমে। তবে, তাঁর মধ্যযুগীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণের বেশিরভাগজুড়ে ছিল ফ্রেজারিও নৃতত্ত্ব।
মধ্যযুগের ধর্মীয় আবরণ ভেঙে ফেলার আগ্রহ তাঁর মধ্যে এতই প্রবল ছিল যে, কখনো কখনো তাকে একজন সর্বাঙ্গে উত্তপ্ত বিপ্লবী বলে মনে হয়। তিনি যুক্তিবাদী ও নাস্তিক মানুষ অর্থাৎ পরকাল তিনি মানেন না, মানেন না শাস্ত্র ও অদৃষ্টকেও। তিনি মানুষের জীবন ও লড়াইকে স্বীকার করেন, সমাজের একেবারে ভেতর থেকে প্রত্যক্ষ করেন শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি।
তিনি শাস্ত্রীয় আচার-আচরণের কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিকগুলি চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধেও চিরকাল অস্ত্র শানিয়েছেন।
রাজনীতিবিদ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পর একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে আহমদ শরীফ মতো আর কেউ এর আগে গণমানুষের মুক্তির কথা এভাবে ভাবেননি, বলেননি [এ মন্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নানের ২৪, ২, ১৯৮৮-তে ড. শরীফের সংবর্ধনা-সভায়]। আহমদ শরীফের মধ্যযুগের সাহিত্য-জরিপ তাই বাংলা সাহিত্য-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। শুধু সাহিত্য হিসেবে নয়, একে ইতিহাস হিসেবেও পাঠ করা চলে । সাধারণ মানুষের ইতিহাস (History of the people) নির্মাণের এ-প্রয়াস নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ । মধ্যযুগ নিয়ে ড. শরীফের গ্রন্থ সংখ্যা অনেক। যদিও তার মধ্যে সম্পাদনাই বেশি, কিন্তু সে-সব সম্পাদনা-গ্রন্থের ভূমিকা ও তৎসংক্রান্ত টীকা-ভাষ্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব সম্পাদনা-গ্রন্থেও তিনি মধ্যযুগের সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি ও সাধারণ মানুষ, সামাজিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক পরিকাঠামো নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা করেছেন, যার ফলে প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারাশ্রেণীর, ড. শরীফের ভাষায় ‘গণমানবেরা’ সেখানে প্রধান হয়ে পড়েছে।
তাঁর বিচারে দেবতাদের স্বরূপ ও কূটকৌশল, ধর্মের শোষণ ও নেশাকর আফিমী-কায়দায় অবদমন, ব্রাহ্মণ্যবাদের দৌরাত্ম্য, পুরোহিততন্ত্রের শাস্ত্রীয় বিধানের মিথ্যাচার, মোল্লাতন্ত্রের ভণ্ডামী, পীরতন্ত্রের ফতোয়া, পাদ্রীদের পারলৌকিক স্বপ্ন ইত্যাদির মুখোশ খুলে যায়। ঈশ্বরের অজুহাত দেখিয়ে ব্রাহ্মণ-পুরোহিত-মোল্লা-পাদ্রীদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করে, তাদের সাহায্য নিয়ে সেখানে রাজতন্ত্র বা বাদশাহীতন্ত্র কিভাবে একশ্রেণীর অসহায় মানুষকে শোষণ ও বঞ্চিত করেছে। গৃহহীন ও ভূমিহীন করে সুখ-সমৃদ্ধি থেকে চিরকালের জন্যে দূরে রেখেছে, ড. শরীফ এসব গ্রন্থে তার বিবর্তন ও অপকৌশল দেখিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তারই কলমে, বিচারে, বিশ্লেষণে, সহানুভূতিতে, বিবেচনায় তিনি সাধারণ মানুষকেই সমাজের প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরেছেন।
সম্পাদনা ও বিচ্ছিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধরাজি বাদ দিলে আহমদ শরীফ মধ্যযুগ-সংক্রান্ত মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেছেন চারটি। যথা:
১। মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ
২। বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য (দ্বিতীয় খণ্ড: মধ্যযুগ)
৩। বাঙালীর চিন্তা-চেতনার বিবর্তনধারা
৪। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য।
এছাড়াও তিনি অভিসন্দর্ভ রচনা করেছেন মধ্যযুগের বিশিষ্ট কবি ‘সৈয়দ সুলতান: তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ’ নিয়ে। বলাবাহুল্য, বিশ্লেষণ-রীতিতে তিনি সেখানেও আপসহীন, সমাজতাত্ত্বিক। নৃতত্ত্বীয় তথ্য-প্রমাণ তাঁর উপাদান, যুক্তি ও বিশ্লেষণ তাঁর অস্ত্র।
অনুপুঙ্খরূপে ‘মধ্যযুগ জরিপেরে অভাবনীয় দক্ষ কারিগর’ পরিচয়-প্রাপ্তির মধ্যদিয়ে ড. আহমদ শরীফকে ‘মূর্তিমান মধ্যযুগ’ কিংবা ‘আলখাল্লাধারী একজন প্রাচীন-পন্থী’ বলে সাধারণত অনেকেরই ভ্রম হতে পারে–আসলে ড. শরীফ কিন্তু তার উল্টো। তিনি মনেপ্রাণে আধুনিক. যুক্তিবাদী, নাস্তিক, মননধর্মী, আবেগপ্রবণ, মানবতাবাদী এবং সাধারণ অভিন্ন দরদী নেতা। মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ গ্রন্থে তিনি মধ্যযুগের ধর্মসাহিত্য, নীতিশাস্ত্র, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে তৎকালীন সমাজের জীবন-জীবিকা, শ্রেণীদ্বন্দ্ব এবং সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও তার বিকাশের চিত্র তুলে ধরেছেন।
এ দেশের মাটি-মানুষের একেবারে শিকড় থেকে তিনি সন্ধান করেছেন সাংস্কৃতিক ও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব, ঐক্য ও সমন্বয়ের। তিনি-শতকের প্রচুর পুথিজাতীয় আকর গ্রন্থ থেকে তিনি উপাদান সংগ্রহ করে শুধু এর চিত্রই নির্মাণ করেননি, নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণের আলোকে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার অবয়ব তিনি বদলে দিয়েছেন। তিনি আঘাত হেনেছেন মধ্যযুগের ধর্মভিত্তিক অসার জীবন-জিজ্ঞাসা ও বিশ্বাসের দুর্গে; কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, অজ্ঞতা এবং যুক্তিহীনতাই বিশ্বাসের জন্ম ও লালনভূমি। তাই যেসব বিশ্বাস উন্নতির, আধুনিকতার, প্রগতির ও সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার পথে অন্তরায়, তিনি সেগুলির মর্মমূলে আঘাত হেনেছেন। তিনি শাস্ত্রীয় আচার-আচরণের কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিকগুলি চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধেও চিরকাল অস্ত্র শানিয়েছেন।
এই গ্রন্থেও প্রগতির অস্ত্র তাঁর হাতিয়ার; বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি-মেধা ও যুক্তি তাঁর পোষাক এবং নৈষ্ঠিক বিশ্লেষণ তাঁর বর্ম। উল্লিখিত গ্রন্থটি উনিশটি পর্ব ও উপপর্বে বিন্যস্ত। তাঁর মধ্যযুগচর্চার সর্বাংশই বলতে গেলে এই গ্রন্থে বিশেষভাবে ধারণকৃত হয়েছে। তিনি এখানে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যে-যুক্তি এবং শাস্ত্র-বিরোধিতারূপ অর্গল ভাঙার সাহসিকতা দেখিয়েছেন, তারমধ্য দিয়েই তাঁর প্রতিবাদী সত্তার পরিচয় মেলে। তিনি এই পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ের প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে, মুসলমানেরা এদেশ জয় করেছে, বহু হিন্দু মুসলমান হয়েছে, বিদেশী কিছু মুসলমান এ-দেশে বাস করেছেন; হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মীয় সমন্বয় হয়েছে—বহু মুসলমান যেহেতু পূর্বেই হিন্দু ছিল, তাই তাঁদের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাবও পড়েছে জীবনাচরণে। অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ড. শরীফ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি, সমন্বয় ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের কথা বলেছেন।
তিনি মধ্যযুগের শাস্ত্রীর আচার-আচরণে নয়, নিরন্ন হিন্দু-মুসলমানের জীবন-সমন্বিত জীবন-চেতনা ও লোকাচার-মূলক অনুষ্ঠানেই ‘মধ্যযুগের সংস্কৃতির মৌল উপসৌধ নির্মিত ও বিকশিত’ বলে মনে করেন। পরবর্তী অধ্যায়ে ‘বাঙালীর মৌল ধর্ম’ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন:
‘বাঙালীর ধর্মতত্ত্বে পাপ-পুণ্যের কথা বেশী নেই । অনেক করে রয়েছে জীবন-রহস্য জানবার ও বুঝবার প্রয়াস। লোকজীবনে সে-প্রয়াস আজো অবিরল। মনে হয় দারিদ্র্যক্লিষ্ট লোকজীবনের যন্ত্রণামুক্তির অবচেতন অপপ্রয়াসে অসহায় মানুষ অধ্যাত্মতত্ত্বে স্বস্তি ও শক্তির মাহাত্ম্য প্রলেপে বাস্তব জীবনকে আড়াল করে ও তুচ্ছ জেনে মনোময় কল্পলোক রচনা করে এই নির্মিত ভুবনে বিহার করে আনন্দিত হতে চেয়েছে দুঃস্থ ও দুঃখী মানুষ। আজো গরীব ঘরের প্রতারিত প্রবঞ্চিত সেই মানুষ উদারকণ্ঠে সেই উদাস গান গায়। [পৃ. ৬৪]
বাঙলার নিরক্ষর কিংবা স্বল্প-সাক্ষর, নিরন্ন সর্বহারা, অর্থনৈতিক দিক থেকে শোষিত-বঞ্চিত নির্বিশেষ হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক শিকড় এ দেশেরই মাটির গভীরে। কিন্তু চরম দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ ইহলৌকিক কষ্টকে লাঘব নয়, ভুলে থাকার ব্যর্থ চেষ্টায় পারলৌকিক সুখ-স্বপ্নময় জগতে প্রলুব্ধ হয়ে তাতে নিমগ্ন থেকেছে। সমাজের শোষকশ্রেণীর তৈরি এই পারলৌকিক-সুখ-সমৃদ্ধ স্বর্গ-রাজ্যের প্রতি লোভই সর্বহারাকে প্রতারণা করেছে। ড. শরীফ এভাবেই ধর্মের বস্তুতান্ত্রিক বিশ্লেষণ করে প্রথাবদ্ধ বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছেন।
এই গ্রন্থে লেখক দেখিয়েছেন, সর্বাহারাশ্রেণীর একজন হিন্দু, মুসলমান কিংবা বৌদ্ধের আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়ে কোনো বিভেদ নেই। মধ্যযুগের বাংলাদেশে মুসলমান সামজে উর্দু ভাষার ব্যবহার যে বহিরাগত মুসলমানের দ্বারা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আরোপিত একটি অবদান মাত্র, এ কথা তিনি তথ্যপ্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই আরোপিত সাম্প্রদায়িক বিভেদনীতি ছিল মূলত হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরানোরই অপপ্রয়াস।
‘বাঙলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা ও বিদ্বেষ’ প্রবন্ধে তিনি জানিয়েছেন:
‘সাধারণভাবে বলতে গেলে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বাবধি ১৯২০ খ্রি: একশ্রেণীর বাঙালী মুসলমান উর্দু-বাঙলার, দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এদের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষিত এবং জমিদার অভিজাতরাই ছিলেন বেশি। বাঙালী মুসলমানের অশিক্ষার সুযোগে উনিশ শতকে এবং বিশ শতকের প্রথম তিন দশক অবধি স্ব-আরেপিত (Self assumed) অবাধ নেতৃত্ব পেয়েছিলেন নবাব আবদুল লতিফ, আমির হোসেন (বিহারী), সৈয়দ আমীর আলী, নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নবাব আলী প্রমুখ বহিরাগত মুসলিমের উর্দুভাষী বংশধরগণ। তাঁরাই বাঙালী মুসলমানের মুখপাত্র হিসেবে উর্দুকে বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষারূপে চালাবার স্বপ্ন দেখতেন। পাকিস্তান-উত্তর যুগে তাঁদেরই বংশধর বা জাতিত্বলোভীরাই উর্দুকে বাঙালীর ওপর চাপিয়ে দেবার প্রয়াসী ছিলেন; আজো একশ্রেণীর শিক্ষিত লোক, বাঙলার আরবী ফারসী শব্দের বহুল প্রয়োগ দ্বারা উর্দুর স্বাদ পাবার প্রয়াসী। (পৃ: ৮৬-৮৭)
এই মন্তব্যে, ভাষাগত বিদ্বেষ বা দ্বেষণা এবং ভাষাগত শোষণ ও তার উৎস নিরীক্ষণের প্রয়াস রয়েছে। দেশের নিরন্ন মানুষ কেবল অর্থনীতি, ধর্মীয় সংস্কার ইত্যাদির দ্বারাই শোষিত নয়, এই শোষণকে ত্বরান্বিত করার মানসে উর্দুভাষী মুসলিম জমিদারদের বংশধরগণ দেশীয় শিক্ষিত বাঙালিদের মাধ্যমে গরীব মুসলমানদের, তথা বাঙলার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়।
ড. শরীফের বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়, এই ভাষাগত বিদ্বেষও জমিদারতন্ত্র, বৈদেশিক শোষণ, উঠতি শিক্ষিত বুর্জোয়া শ্রেণীর দেশের সর্বাহারা বাঙালির দুটি ভিন্ন প্রতিপক্ষে দণ্ডায়মান হবার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। লেখক প্রগতিশীল দৃষ্টি নিয়েই লক্ষ করেছেন এবং ওই প্রবন্ধে তিনি স্পষ্ট করে বুঝিয়েছেন বাংলাদেশে উর্দু-বাঙলার যে দ্বন্দ্ব, ভেদাভেদ ও রাজনৈতিক পরিণতি, তার উৎস মূলত মধ্যযুগের ভাষাগত বিদ্বেষেরই ফল।
শুধুমাত্র বর্ণনায় নয়, বিশ্লেষণের নিরিখে তিনি শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও শ্রেণীসম্পর্ককে আরো স্পষ্ট করে তুলেছেন। এখানে লেখকের দৃষ্টিভিঙ্গি সার্থকতা প্রমাণিত হয়ে যায়।
তিনি মধ্যযুগের বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ, বাঙালি, অবাঙালি, দেশী-বিদেশীর মধ্যে শাসক ও শাসিত, তথা শোষিতজনের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ ও সমন্বয় লক্ষ করেছেন। তৎকালীন শ্রেণীদ্বন্দ্বের স্বরূপ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে আমরা হিন্দু-বৌদ্ধ, দ্বৈব-শক্তি -বৈষ্ণবে, বাঙালী -অবঙালিতে ও বিদেশী বিজাতি-বিধর্মী-তুর্কি-মোগল শাসকদের প্রতি শাসিতজনের এমনকি আঞ্চলিক অবজ্ঞা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব-কোন্দল ও সংঘর্ষ-সংঘাতের সংবাদ নানা সূত্রে পাই।’ [মধ্যযুগের জাতিবৈর ও তার স্বরূপ, পৃ.৯০]
ড. শরীফ এ প্রবন্ধে শুধু দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের চিত্রই দেননি-একজন সদর্থক সমাজবিজ্ঞানীর মতো সমাজের অভ্যন্তর অনুসন্ধান করে দ্বন্দ্ব -সংঘর্ষের পাশাপাশি সীমিত মাত্রায় হলেও, সমন্বয়, ঐক্য ও সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু তা শাস্ত্র-সমাজ- সংস্কৃতি ও সরকারকে প্রভাবিত করেনি। তাই ‘মন ও মত বাঁচিয়ে গাঁয়ে-গঞ্জে আজকের মতোই সমস্বার্থে সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলমান মাঠে-ঘাটে- হাটে ব্যবহারিক ও বৈষয়িক জীবনে সহোযোগিতা ও সদ্ভাব রেখে সহাবস্থান করতো’। [ঐ, পৃ. ১০৪] মধ্যযুগের দেশ-জাত-বর্ণ-গোত্র দ্বেষণাকে তিনি মানবিক বৃত্তি বলে মনে করলেও, একথা স্বীকার করতেই হবে যে, এর পশ্চাতে মূলত শ্রেণীশোষণ ও বহুদিনের বঞ্চনা-অবজ্ঞার, সামাজিক ঘৃণার, সম্প্রদায়গত অবহেলার গৌত্রিক ও ধর্মীয় ভেদনীতি বিদ্যমান ছিল ও আছে। তিনি এ গ্রন্থ রচনার সময়ে তা এড়িয়ে গেলেও আটের দশকে এসে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তা মেনে নিয়েছেন।
‘মধ্যযুগের নীতিশাস্ত্র’, এ-রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানগুলিতে প্রতিফলিত সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-শ্রেণীসম্পর্ক ও শ্রেণীদ্বন্দ্বের স্বরূপ তিনি এ- গ্রন্থে উদঘাটন করেছেন। নীতিশাস্ত্রবিষয়ক গ্রন্থগুলিতে তিনি মধ্যযুগের নৈতিক ও দর্শনভিত্তিক জীবনবোধ, সমাজ-সংস্কৃতিতে লোকাচারের ভূমিকা, দারিদ্র্য, সামন্তব্যবস্থা, যুদ্ধচিত্র প্রভৃতি এবং প্রণয়োপাখ্যানগুলি থেকে সে যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার চিত্র বিশ্লেষণ করেছেন৷ সত্য-কলি-বিবাদ-সম্বাদ, নীতিশাস্ত্র বার্তা, তোহফা, প্রভৃতি মধ্যযুগের সাহিত্যে জীবন ও সমাজ-সংস্কৃতির রূপ ছিল মূলত ধর্মাশ্রিত। ধর্মের বেড়াজাল ছিল নারীর আব্রুর মতো। সত্য-কলি-বিবাদ-সম্বাদ-এর নীতিকথায় শাস্ত্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেই, আছে সামাজিক কুসংস্কার, তুকতাক, মন্ত্র, বাণ-উচাটনের মতো লোকাচার, Black-magic। আর সেইসঙ্গে শোষণ ও দারিদ্র্য। নীতিশাস্ত্র বার্তা’য় আছে কুসংস্কারের আধিক্য এবং গৃহনির্মাণের কথা। ‘শরীয়ত নামা’য় সন্ধান মেলে ‘কবির সমকালে চালু ইসলাম-বহির্ভূত অনেক বিশ্বাস সংস্কার আচার পার্বণের।’ উক্ত গ্রন্থে কবির বর্ণনা থেকে জানা যায়: সেকালে মুসলিম সমাজব্যবস্থায় পর্দাপ্রথা তেমন মানা হতো না; দরিদ্র ও নিম্নবর্ণের মুসলিম মহিলারা স্ব-স্ব বৃত্তি অনুসারে যেমন কাঠ কাটা, মাছধরা, দোকানদারী প্রভৃতিতে অভ্যস্ত ছিল, তামাক সেবনে কোনো জাতিভেদ ছিল না: মুসলিম সমাজে, হিন্দু পুরোহিতের প্রভাব ছিল। এখানে লক্ষণীয় যে, সে সমাজে নারীর স্বাধীনতা ছিল যথেষ্ট, পর্দানশীলতার মতো ইসলামী অনুশাসন ছিল না, নারী স্বাধিকারেই বৃত্তিজীবী ছিল, তামাক সেবনে জাতপাতের প্রশ্ন ছিল না। এ চিত্র সে-কালের সর্বহারা বাঙালি মুসলমানের চিত্র, সেখানে হিন্দু-পুরোহিতরাও সৌহার্দ্যের সঙ্গে পাশাপাশি বাস করতো, জলচলও নিষিদ্ধ ছিল না। এ প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ বলেছেন :
‘বিদেশী-দীক্ষিত মুসলমানেরা এসব আচর-সংস্কার সাতাশ’ বছর ধরে মেনেছে। বিদ্বানেরা একেই ‘লৌকিক বা স্থানিক ইসলাম’ নামে অভিহিত করেন। গত শতকে ওহাবী-ফরায়েজী আন্দোলনের ফলেই উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বিশ্বাস ও আচার -সংস্কার মুসলমানরা ঘরোয়া ও সামাজিক জীবনে পরিহার করে চলতে প্রয়াস পায়’। [পৃ. ১৫৪]
এই লৌকিক মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত শাস্ত্রীয় ইসলামের অনুশাসন নেই। এ-দেশীয় নিম্নবর্গের হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলেও সে সময়ের যেসব লোকায়ত সংস্কৃতি ও লোকাচার ছিল, তা তাঁরা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, সে-সব কিছুকেই জীবন ও সমাজের উপযোগী করে ঢেলে সাজিয়ে তাঁরা তাকে যেভাবে ধর্মীয় রূপ দিয়েছেন, তাঁর নামই ‘লৌকিক ইসলাম’। অনুমান করা যায় দেশীয় সর্বহারা মুসলমানদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরবর্তীকালের সৃষ্ট ধনিকশ্রেণীর বিধিনিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ এসে লৌকিক ইসলামের পায়ে শাস্ত্রীয় বিধিজালের বেড়ি পরিয়ে দেয়।
ইসলামে সঙ্গীত চর্চা গুনাহ, বা পাপ কিনা, এ নিয়ে সমাজের একশ্রেণী ধর্মব্যবসায়ী মাঝে মাঝেই ফতোয়া দিতেন এবং এখনও দিয়ে থাকেন। ইসলামে সঙ্গীত চর্চা নিষিদ্ধ নয়। মধ্যযুগের ইতিহাস থেকে জানা যায়: ঐ সম্ভ্রান্তপ্রভুরা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অবদান রাখতে না পারলেও তাঁরা সঙ্গীতবিমুখ ছিলেন না। সংস্কৃত গ্রন্থের অনুসরণে মুসলমানেরা বাঙলা সঙ্গীতের রাগ-তালবিষয়ক বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। পর্দাপ্রথাও সেকালে ছিল না। পরবর্তীকালে আরোপিত হয়েছে। একালে এ-সব তথ্যের প্রাসঙ্গিকতা যে সূদুরবিস্তৃত এবং অপরিহার্য, ড. শরীফ কালের গর্ভ থেকে এ সব তথ্য টেনে এনে সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন।
এরই পাশাপাশি আবার ‘নবীবংশ’-এ রয়েছে সমাজের ধনীকশ্রেণীর সমাজব্যবস্থার চিত্র। সৈয়দ সুলতানের এই নবীবংশ গ্রন্থ থেকে জানা যায়: ক. মুসলিম সমাজে পণ ও যৌতুক প্রথা চালু ছিল; খ. পর্দাপ্রথা ছিল কঠোর, পরপুরুষের সঙ্গে নারীর বাক্যালাপ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল; গ. নারী-শিক্ষা ছিল; ঘ. সমাজে বলবত ছিল কৌলীন্য-চেতনাও; এবং ঙ. এছাড়া সমাজে বাঈজী নাচ ও বারবনিতার অবস্থান নিন্দনীয় ছিল না। এদের পোষণ ছিল আভিজাত্য ও বিত্তবত্তার পরিচায়ক।
এ চিত্র থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সমাজে নিরন্ন ধনিকশ্রেণী, উভয়েরই বাস ছিল। ধনিকশ্রেণীর তুলনায় সর্বহারা সমাজ ছিল অনেকাংশে ঢিলেঢালা–সেখানে জীবিকার সংগ্রাম ছিল, স্বভাবতই তাই পর্দা ছিল না; নিরন্নদের বড় শত্রু ছিল দারিদ্র্য ও ক্ষুধা, তাই হিন্দু তাদের কাছে শত্রু নয়, পুরোহিতদের কাছেও তারা অস্পৃশ্য ছিল না, ছিল না তামাক সেবনে ভেদনীতি বা জাতপাতের বালাই। এখানে নিম্নবর্ণের স্বল্প-সাক্ষরের লৌকিক ইসলাম ও লোকায়ত সমাজ সংস্কৃতির অঙ্গনে সম্প্রীতি ছিল, ছিল সমন্বয়ও। অন্যদিকে ধনিকশ্রেণী শাসিত সমাজব্যবস্থায় পণপ্রথার মতো ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি ছিল, ছিল পরপুরুষের সঙ্গে নারীর বাক্যালাপ নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে নারী বাক্-স্বাধীনতাহরণ, পর্দা-প্রথার নেপথ্যে সামাজিক অবরোধ। কিন্তু পুরুষের বংশ মর্যাদা ও কৌলীন্য পুরোমাত্রায় ছিল। কিন্তু নারী ছিল পুরুষের শোষণে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা, সেখঅনে না ছিল প্রেম, না ছিল ভালোবাসা–ওরা ছিল এক অবরুদ্ধ অন্তঃপুরের বন্দিনী বাসিন্দা, পুরুষের অবহেলিত পণ্য, ভোগ্য সামগ্রী, আর তাদের রক্তচক্ষুর ভয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত প্রাকৃতিক সূর্যালোকও যেন ওদের ওই অন্তঃপুরে সন্তর্পণে পা ফেলে।
ড. আহমদ শরীফ মধ্যযুগের বিভিন্ন পুথি বিশ্লেষণ করে তৎকালীন সমাজ, শ্রেণীদ্বন্দ্ব, জাতপাত, নারীর বঞ্চনা, দারিদ্র্য, সর্বহারার স্বাধীন সমাজ, সহাবস্থান-সংঘর্ষ এবং পরস্পরবিরোধী সমাজব্যবস্থা, শাস্ত্রীয় বনাম লৌকিক ইসলাম, সর্বহারা বনাম ধনীশ্রেণীর সমাজ-কাঠামোর দৃশ্যপট ইত্যাদি নির্মাণ করেছেন। শুধুমাত্র বর্ণনায় নয়, বিশ্লেষণের নিরিখে তিনি শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও শ্রেণীসম্পর্ককে আরো স্পষ্ট করে তুলেছেন। এখানে লেখকের দৃষ্টিভিঙ্গি সার্থকতা প্রমাণিত হয়ে যায়।