‘সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭)’র মাধ্যমে ঔপন্যাসিক হিসেবে যাত্রা শুরু আহমদ ছফার। চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বরগুইনিপাড়ের গ্রামীণ মানুষের যাপিত জীবনের চিত্র এ উপন্যাসে উপস্থাপিত। পাশাপাশি ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন-যাপন অভ্যাস, ধর্মীয় মূল্যবোধের আড়ালে ঔপন্যাসিক যেন ধর্মবিভক্ত রাষ্ট্রের কুৎসিত রূপ উন্মোচন করেছে। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসেবে একটিমাত্র অঞ্চলের চিত্র উঠলেও বাস্তবে যেন তা পুরো বাংলাদেশের চিত্র। বরগুইনিপাড় যেন পুরো বাংলাদেশেরই প্রতিধ্বনি। দেশভাগ পূর্ব-উত্তর হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত একটি পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের নামে শোষণ-অপমান, গ্রামীণ মানুষের মধ্যবিত্ত-মাতব্বর শ্রেণীর অন্যায় দাপুটে অত্যাচারের বর্ণনার পাশাপাশি শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রবল আকাক্সক্ষা উপন্যাসে বিদ্যমান।
ছফা এই উপন্যাসের বিষয় হিসেবে হিন্দু ও মুসলিম অধ্যুষিত বরগুইনি পাড়ের পাশাপাশি দুটো গ্রাম গাছবাড়িয়া-সাতবাড়িয়া অঞ্চলের সাম্প্রদায়িকতা, গ্রামীণ মধ্যবিত্ত ও মাতব্বর শ্রেণীর অন্যায় দাপটে সাধারণ মানুষের করুণ জীবনের আলেখ্য নির্মাণ করেছেন।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বসাধনা ও জীবন সংগ্রামের গতিশীল রূপ বিন্যস্ত হয়েছে আহমদ ছফার ‘সূর্য তুমি সাথী উপন্যাসে’। সংলাপে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ সত্ত্বেও এ উপন্যাস সমগ্র বাংলাদেশের সমাজবিবর্তনের মৌল বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত হয়েছে। জীবন নির্বাচন ও রূপায়ণের প্রশ্নে আহমদ ছফা ব্যক্তিজীবনের পূর্ণবৃত্ত ছককে গ্রহণ করেননি। বিশেষ ভৌগোলিক কাঠামোর জীবনসমগ্রতা উন্মোচনের প্রয়োজনে তিনি একাধিক চরিত্রের অন্তর-বাহিরকে অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কৃষিভিত্তিক জীবনের ধ্বংসস্তূপের মাঝ থেকে তিনি শ্রমজীবী মানুষের মর্মন্তুদ জীবনস্বরূপ এবং তার সম্ভাবনার সূত্র সন্ধান করেছেন। (রফিকউল্লাহ ২০০৯ : ১২৮)
আহমদ ছফা লিখেছেন,
প্রথম উপন্যাসটি আমি লিখেছি বাজী ধরে ‘সূর্য তুমি সাথী’। যখন মানিকের উপন্যাসে আমরা পড়লাম ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’- আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারের ছেলে, তখন আমার দাড়ি গোঁফ ওঠেনি। তো, লিখাটা লিখলাম তখন বাজী হলো যদি লেখাটা ‘সংবাদ’ এ ছাপতে পারি একশো টাকা দেবে আমার বন্ধু জামাল খান (ছ. সা. ১৯৯৬ : ৭০)
আহমদ ছফার ভাতিজা নূরুল আনোয়ার লিখেছেন, সূর্য তুমি সাথীকে আহমদ ছফার প্রথম প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু আমার জানামতে তার আগে তিনি আরও একটি বই লিখেছিলেন এবং তা প্রকাশিতও হয়েছিল। বইটির নাম ছিল ‘বরুমতির আঁকে বাকেঁ।’ বইটি আমাদের এলাকায় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এখনও বইটি অনেকের মুখে মুখে। বরুমতি নদীর দুপাড়ের মানুষ নিয়ে বইটি রচিত হয়েছিল। বর্তমানে বইটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ছফা কাকাকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বলেছিলাম, আপনি বরুমতির আঁকে বাঁকে একটি বই লিখেছিলেন। মনে পড়ে? তিনি একগাল হেসে জবাব দিলেন, লিখেছিলাম তো। কিন্তু সে তো আগের কথা। এ রকম লেখা খুঁজলে আহমদ ছফার অনেক পাওয়া যাবে। (নূরুল ২০১০ : ৫৮)
নূরুল আনোয়ার উল্লেখ করেছেন বরুমতির আঁকে বাঁকে বইটি আহমদ ছফার প্রথম বই হলে তার দ্বিতীয় বই তানিয়া। তানিয়া বইটি তিনি অভাব-অনটনের কারণে অনুবাদ করেছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে বিএ প্রাইভেট পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকা যোগাড় করার জন্য তিনি দুই দিনে তানিয়া বইটি অনুবাদ করেছিলেন। ‘সূর্য তুমি সাথী’ তারও পরের রচনা।
ঔপন্যাসিকরা সমাজ সচেতন উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে তাতে বাস্তবধর্মী চরিত্র উপস্থাপনে সচেষ্ট হন, এটাই সাধারণত ধারণা করা হয়। কিন্তু আহমদ ছফা উপন্যাসে লেখক কিছু চরিত্র উপস্থাপন করেছেন যা বাস্তবধর্মী নয়, বরং একেবারেই বাস্তব। চরিত্রগুলোর নামগুলো তিনি পরিবর্তন করেননি।
সূর্য তুমি সাথী বিষয়ে আহমদ ছফা বলেছেন :
এটার কাহিনীগুলো প্রায় আমাদের পরিবারের সংলগ্ন কাহিনী। যে চরিত্রগুলো, ও আল্লাহ এখানে এক খলু মাতব্বর আছে। যে মারা গেলো একশ বিশ বছর বয়সে ক’দিন আগে, সে আমার খালাতো বোনের জামাই। (নাসির ২০১৩ : ৭৭)
ক. পায়ে পায়ে শোষণ
ধর্মীয় বিধি-নিষেধের আড়ালে উপন্যাসটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘ছোটলোকের চাইতে ছোটলোকের’ নানা শোষণের কথা। আহমদ ছফা উপন্যাসটির শুরু করেছেন তপ্ত প্রকৃতির বর্ণনা দিয়ে। এই তপ্ত প্রকৃতি যেন তপ্ত মানুষের প্রতিচ্ছবি। যে মানুষেরা প্রতিনিয়ত শোষণের শিকার হচ্ছে। একসময় তারা মুক্তির পথ খোঁজে, শোষণ থেকে বাঁচতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। বিরূপ প্রকৃতির বর্ণনার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক কাহিনীর বিরূপতার দিকে প্রবেশ করেছেন ধীরে ধীরে। প্রকৃতির রুদ্রমূর্তির মধ্যে মানুষের আসন্ন বিদ্রোহী চেতনার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আহমদ ছফা হয়ত একটি অসাধ্য সাধন করতে চেয়েছিলেন উপন্যাসের মৌলবস্তু উপস্থাপন করে। তিনি প্রয়োজন অনুধাবন করেছিলেন এভাবে চলতে পারে না। তিনি বাঙালি মুসলমানের জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তন চেয়েছিলেন। আহমদ ছফা এই সাধনার পথেই এগিয়েছেন।
আহমদ ছফার বিশ্বাস, দুবছরে কিংবা চারবছরে হয়তো এ অবস্থার অবসান ঘটানো যাবে না, কিন্তু বাঙ্গালি মুসলমানের মনের ধরন-ধারণ এবং প্রবণতাগুলো নির্মোহভাবে জানার চেষ্টা করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়তো পাওয়া যেতে পারে। (ছফা ২০০৬ : ৩৬)
বৈশাখের শেষ। আধা বছর জুড়ে বিশাল নীলাকাশে সূর্যের রুপোলি আক্রোশ-সহস্র শিখায় শ্যামল পৃথিবীতে আগুন ঢেলেছে। অগ্রহায়ণের শেষাশেষি একদিন আসমানের চার কোণে জমাট বাঁধা কালো মেঘ কালো গাইয়ের ওলানের বরণ ধরেছিল। বজ্রেরা চিৎকার করে ফেটে পড়েছিল। মেঘের বুক চিরে চিরে বিজুলির শাণিত ছুরি ঝিকঝিকিয়ে জেগেছিল।…আসমানের বিশাল ভয়ঙ্কর শুভ্র শিখার কুণ্ড কুণ্ড লক্ষ লক্ষ আগুন রসনার তাপে পলকে পলকে ধরিত্রীর রূপরস শুষে নিচ্ছে, গোলাকার প্রসারিত খোলের তলায় গলানো রুপোর মতন শিখারা ঝিলিমিলি খেলা করে। ডাইনে-বাঁয়ে-সামনে-পিছে যতদূর যায় চোখ আগুন, আগুনের হলুদ শিখা। মাঠে আগুন, গাছে আগুন, ফসলে আগুন। (সূর্য: ১৭)
আহমদ ছফা বোধ করি ইঙ্গিত দিলেন পরিবর্তনের। প্রকৃতির এই বর্ণনা নিছক বর্ণনা নয়, প্রকৃতির আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ এক সমাজের আখ্যান। যে আখ্যান ছোটলোকের চেয়ে ছোটলোকদের। এরপর লেখক ইঙ্গিত দিলেন আগুনের। সবদিকে আগুনের বিস্তার, মাঠে আগুন, ফসলে আগুন। মানে হলো শোষণের নাগপাশ ছিন্ন তখনই সম্ভব যখন প্রতিশোধের আগুন, অধিকারের আগুন জ্বলজ্বল করে ওঠে, অধিকার আদায়ের আগুন ছড়িয়ে পড়ে পারিপার্শ্বিক মণ্ডলে।
প্রকৃতির এই বর্ণনার পর নায়কচরিত্র হাসিমের আগমন। হাসেম চরিত্র উপস্থাপনের বেলায়ও আগুনের বর্ণনা। মানে এই হাসিম চরিত্রের মধ্যেই লেখক তার ‘বিপ্লবের’ স্বপ্ন দেখার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। পাঠককে আস্তে আস্তে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন শোষিত মানুষের প্রতিনিধি এক চরিত্রের সঙ্গে যে কি না মুক্তির স্বপ্নে গ্রাম ছাড়বে, গন্তব্য যার অজানা কোনো পথে।
আগুনের জোয়ার ফোলা সাগর সাঁতরে যেন এল হাসিম। তার বুকে-পেটে, চোখে-মুখে আগুন। ধূঁকে ধুঁকে বান্যা পুকুরের বটতলায় এসে কাঁধের লাকড়ির ভারখানা নামাল। বটগাছ যেখানে শীতল ছায়া মেলে দিয়েছে সেখানেই ছায়ার কোলে আধাসেদ্ধ শরীরখানা এলিয়ে দিল। লাকরির ভারের ওপর পা আর মাটির ভাপে শুকিয়ে যাওয়া ঘাসের ওপর বাদবাকি শরীরখানা রেখে চোখ বুজে রইল। … চোখ বুজে থাকতে পারে না আগুনে পোড়া অর্ধদগ্ধ শরীরের চেতনায় কী এক অনুভূতি জেগে উঠতে চায়। সূর্যের ধারালো নখের বুকের ভেতর যেখানে কলজে, সেখানে তপ্ত গরম ছ্যাঁকা দিয়েছে। (সূর্য : ১৮)
হাসিম যে সমাজে বসবাস করে নিচু শ্রেণির হিন্দু থেকে তার পূর্বপুরুষ মুসলমান হলেও যথাযথ মর্যাদা পায়নি হাসিম। কী মুসলমান, কী হিন্দু কোথাও হাসিমের জন্য সহানুভূতি নেই। তাকে পথে পথে লাঞ্ছিত হয় বেনের জাত বলে। বান্যার পুকুরে মাছ ধরার সময় অধরবাবুর কাছে হাসিম অপমানিত হয়।
সম্প্রদায়গত আচরণ ও অন্তরঙ্গতাগত দূরত্বই নয়, গ্রামীণ উচ্চবিত্ত জমিদার-মাতব্বর শ্রেণির সঙ্গে সাধারণ মানুষ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অতলান্ত ব্যবধানও এ উপন্যাসে চিত্রিত। হাসিম, তেজেন, হরিমোহন, ছতুর মা, কবীরের বাপ দারিদ্র্যসীমার প্রান্তরেখায় বসবাস করলেও তাদের প্রতি ধনীরা সাহায্যের হাত প্রসারিত করে না। এদের অভাব, নির্যাতন, উপন্যাস লেখকের অন্তরকে ব্যথিত করে। তাই তেলিপাড়া তেজেনের মৃত্যুতে লেখক পাপ হিসেবে দেখেন না, বরং তেজেনের বিষণ্ন দুই চোখের জিজ্ঞাসার মাধ্যমে যেন সমগ্র বাংলাদেশের নির্যাতন আর নিপীড়নকেই তুলে ধরেন। (মোমেনুর ২০১১ : ১৭৪)
হাসিমের দিকে চোখ পড়তেই অধরবাবুর হাসি-হাসি মুখখানা গম্ভীর হয়ে যায়। কপালে স্পষ্ট ঘৃণার কুঞ্চিত রেখা জাগে। থু করে একদলা থু থু হাসিমের পানে ছুড়ে দেয়। তারপর জালের সঙ্গে মাছটা জড়িয়ে চোখের কোনো তাকে বিদ্ধ কওে বিলে নেমে হাঁক দিল : ‘আয় গনেশ্যা চলি আয়’ (আয়, গনেশ চলে আয়)’
কেবল অধরবাবু নয়, মুসল্লি ছতুর বাপও হাসিমকে ছাড়েনি। গ্রামীণ এক দোকানে হাসিমকে দেখে ছতুর বাপ তার জাত তুলে কথা বলে,
বান্যিয়ার পুত, তুই এডে ক্যা? নামাজ-কালাম কিচ্ছু নাই, শুক্কুরবারেও জুমাত ন আইয়স ক্যা (বেনের ছেলে তুমি এখানে কেন? নামাজ-কালাম কিছু নেই, শুক্রবারের মসজিদে আস না কেন?)
হাসিম জবাব দেয় না। জবাব না পেয়ে ছতুর বাপের শান্ত শীল কণ্ঠস্বরে একটু উত্তাপ জাগে। অধিকতর দৃঢ়কণ্ঠে বলল :
‘কাইলত্থুন মসজিত ন দেখিতে পাড়াত থাকিতে ন পারিবি। সম থাকতে কই দিলাম। মুসলমানের পাড়া (কাল থেকে মসজিদে না দেখলে পাড়ায় তাকতে পারবে না, আগে বলে দিলাম। মুসলমানের পাড়া) (সূর্য : ২৩)
কে এই হাসিম, কেন এই নির্যাতন। হাসিমের দৃষ্টিকোণ থেকেই বাবার পরিচয় উঠে এসেছে। গোকুল ধরের কনিষ্ঠ সন্তান হরিমোহন কাজী বাড়ির মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। কাজী রহমত আর কানা আফজালের প্ররোচনায় দীর্ঘদিনের ধর্মীয় সংস্কার বিসর্জন দিয়ে মুসলমান হয়েছিল। হরিমোহনের নতুন নামকরণ হয় মুহম্মদ ইসমাইল খান। কথা ছিল কাজীর মেয়ে জরিনার সঙ্গে বিয়ে হবে। কিন্তু না কাজী রহমত নিজ মেয়ে জরিনাকে বিয়ে দিলেন অন্য জায়গায়। জরিনার জায়গায় বিয়ে হলো এক দাসীর সঙ্গে। সেই দাসীর গর্ভেই হাসিমের জন্ম। হাসিমের মনেব্যক্তি প্রকাশ পায় এভাবে :
তার মা দাসী, বাপ বেনে। জন্মসূত্রে কপালে যে সিলমোহর পড়েছে তার থেকে এ জন্মে আর নিষ্কৃতি নেই। তাকে লোকে ঘৃণা করবে, বিদ্রূপ করবে, অবজ্ঞা করবে। মানুষের মর্যাদা তার ভাগ্যে নেই। কোনোদিন উদার চোখে পাড়ার মানুষ তার দিকে চাইবে না। তেমন বিরাট প্রসারিত মন এদের কই। (সূর্য : ২৫)
প্রসারিত মন না থাকা মানুষের তালিকায় থাকা একজন হলেন কানা আফজাল। ধুরন্ধর চিন্তা, ক্ষমতার অপব্যবহার আর শোষণপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজের তথাকথিত মান্যগণ্য ব্যক্তিতে আসনে চেপে বসেন। কাজী রহমতের ‘ঘাড়ে পা দিয়েই’ কানা আফজালের মতো পরগাছা একসময় মহীরূহে পরিণত হয়।
কানা আফজালেরা মাথা তুলছে। কানা আফজল এখন আলহাজ্ব আফজল আহমদ চৌধুরী। মান্যগণ্য ব্যক্তি, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। ‘চেহারাতে চেকনাই লেগেছে। পোশাকে রুচি ফিরেছে। কিন্তু স্বভাবটা ঠিক আগের মতো আছে।’ ধর্মীয় শোষণ, সামাজিক শোষণ, অর্থনৈতিক শোষণ সব শোষণের নাগপাশের মধ্যেই হাসিম বেড়ে উঠেছে। হাসিম এই নাগপাশ ছিন্ন করতে চায়। ভেতর থেকে এক ধরনের বিদ্রোহ জেগে ওঠে তার। কেননা এই হাসিম সমগ্র নির্যাতিত মানুষের প্রতীক মনে করে নিজেকে।
‘সূর্য তুমি সাথী’ উপন্যাসের চরিত্রগুলোর ধরন, গতিপ্রকৃতিতে আমরা তিন প্রকারে বিন্যস্ত করতে পারি। এক শ্রেণী কেবল ধর্মের নামে শোষণ করে চলেছে, এরা কৃষককে ঠকিয়েছে জবরদস্তি করে, মুখে এরা শান্তির কথা বললেও এদের পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে স্বার্থবাদিতা। কাজী রহমত, কানা আফজাল, জাহেদ বকস, খলু মাতব্বর, অধরবাবু, কাদির মিয়া এরা শোষণের যন্ত্র। এরা ক্ষমতার প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে নিম্নবিত্তের মানুষের মাঝে চালায় শোষণের হাতিয়ার।
দ্বিতীয় শ্রেণীর চরিত্রের মধ্যে রয়েছে হাসিম, হাসিমের বউ সুফিয়া, খলু মাতব্বরের ভাতিজি জোহরা এবং হাসিমের বৃদ্ধা দাদী শৈলবালা। এরা শোষক শ্রেণির কাছ থেকে নানাভাবে নির্যাতন-শোষণের শিকার হয়েছে। হাসিম জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে অর্থনৈতিক শোষণ, জাতিগত শোষণের শিকার হয়েছে, মাতব্বরের বাড়িতে চাল ধার করতে গেলে সুফিয়া লাঞ্ছিত হয়েছে, তাকে অপমান করা হয়েছে।
মাতব্বর বলে, এই বান্যিয়ার পুতের বউ, আর তোর ঘরের কাছে পিছে দেহিলে ঝুড়া কাডি লইয়াম। (এই বেনের বউ, আবার তোকে ঘরে দেখলে খোঁপা কেটে নেব।) সূর্য : ৩৫
জোহরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে তার চাচার হাতে। জোহরা যেন অধিকার আদায়ের সৌভাগ্য নিয়ে আসা কোনো নারী নয়, এখানে সে কেবল অত্যাচার সয়ে যাওয়া মৃত মানব সত্তা। যে কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। সামাজিকভাবে তো বটেই তাকে ধর্মের দোহাই দিয়েও শোষণ করা হয়েছে। এমনকি মৃত স্বামীর মুখ দেখতে দেওয়া হয়নি জোহরা। সর্বশেষ মামলায় জেতার জন্য, পুলিশি ঝামেলা থেকে বাঁচতে দারোগার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। জোহরা শেষ পর্যন্ত তার পেটে দারোগার ঔরস ধারণ করে।
হাসিমের বৃদ্ধ দাদি নির্যাতনের শিকার হয়েছে সামাজিকভাবে-ধর্মীয়ভাবে। ধর্মীয় পরিচয়ে হাসিম মুসলমানের ছেলে হলে বৃদ্ধামন তাতে সায় দেয়নি। সে নিজেকে হাসিমের দাদি বলেই প্রচার করতে সান্তান লাভ করে। অন্যদিকে হিন্দু সমাজের ভয়ে অশীতিপর বৃদ্ধাকে সমাজ সমঝে চলতে হয়ে। নাতি অধরবাবুকে জমের মতো ভয় পায় বৃদ্ধা শৈলবালা।
শোষক-আর শোষিতের মাঝে আরেক শ্রেণির চরিত্রকে উপস্থাপন করা হয়। এরা হলো কৃষক সমিতির কয়েকজন সদস্য, যার নেতৃত্বে রয়েছেন মনির আহমেদ। এরা শোষক গোষ্ঠীর কাছে আতঙ্ক আর নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কাছে এরা আলোকবর্তিকা।
কেবল হাসিম নয়, হাসিমের মতো নির্যাতিত উপন্যাসের অন্যতম এক চরিত্র জোহরা। খলু মাতব্বরের ভাতিজি জোহরা। তাকে ধর্মের শোষণে বন্দি করেন খলু মাতব্বর। সাতবাড়িয়ায় তৃতীয়বার কবীর নামে এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয় জোহরার। খলু মাতব্বরের কূটকৌশলে জোহরার সংসার ভাঙে। খলু মাতব্বর আশ্রয়দাতার ভূমিকার পরিবর্তে জোহরার স্বপ্ন প্রতিনিয়ত ভঙ্গ করেছে। ফতোয়া দিয়ে তাকে স্বামীর মৃতমুখ দেখতে দেওয়া হয়নি।
খলু মাতব্বর বলেছে, ‘আইনমতে জোহরা কবীরকে কাজীর অফিসে গিয়ে তালাক দিয়েছে। সুতরাং কবীর এখন বেগানা পুরুষ। শরীয়তমতে বেগানা পুরুষের মরা মুখ দেখাও হারাম।’ এবার ঔপন্যাসিক জোহরা আদ্যোপান্ত তুলে ধরছেন :
আরো-দু’ দুবার বিয়ে হয়েছে জোহরার। মাতব্বর মামলাবাজ, দাঙ্গাবাজ মানুষ। আগের দু-খসমের মধ্যে একজনের জমি মামলা করে নিজের চাষে নিয়ে এসেছে এবং অন্যজনের নামে অলঙ্কার ও খোরপোশের নালিশ করে সবকিছু আত্মসাৎ করেছে। তৃতীয়বার সাতবাড়িয়ার কবীরের সঙ্গে জোহরার বিয়ে হয়েছিল, গেল ফাল্গুনের আগের ফাল্গুেেন। জোহরা শ্বশুরের জমি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা চলছিল। জোহরা অশান্তিতে আছে এ অজুহাতে নাইয়র এনে তার শ্বশুরাড়িতে যেতে দেয়নি। কাজীর অফিসে গিয়ে জোহরাকে দিয়ে কবীরকে তালাক দিতে বাধ্য করে তিন কানি জমি দখলের ফন্দি করেছে। তালাক দেয়ার পরেও কবীরের প্রতি জোহরার টানের কথা মাতব্বর বিলক্ষণ জানত। জমি জোহরার নামে। মেয়েমানুষের মনের গতি কি বোঝা যায়! কথায় বলে বারো হাত কাপড় পরেও ন্যাংটা থাকে। এখন কবীর মরছে। আপদ বিপদ চুকেবুকে গেছে। জমি নিজের চাষে নিয়ে আসার পথ নিষ্কণ্টক। সে আনন্দে খলু মাতব্বর বগল বাজাচ্ছে। (সূর্য : ৩৪)
এ ছাড়া কৃষিভিত্তক সমাজের কূটকৌশলী চক্রের মোকদ্দমায় জেতার হাতিয়ার হয়েছে জোহরা। পুরুষতন্ত্র কেবল জোহরাকে প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে, স্বার্থবাদী গোষ্ঠী জোহরার মনের আবেগকে বুঝতে পারেনি কিংবা বোঝার চেষ্টাও করেনি। কৃষিভিত্তিক সমাজে শক্তি-দ্বন্দ্বের প্রধান উৎস জমি। জমিসংক্রান্ত দাঙ্গায় বরগুইনি পাড়ের পাশাপাশি দুটো গ্রামে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সাতবাড়িয়ার কাদের মিয়ার সঙ্গে গাছ-বাড়িয়ার খলু মাতব্বরের দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে।
দুপক্ষে যথারীতি খবর চালাচালি হয়ে গেল। আগামী সোমবার দাঙ্গার দিন ধার্য হয়েছে। দুদিন ধরে সারা গ্রামের কারো চোখে ঘুম নেই। কিরিচ শানাচ্ছে। কামারবাড়িতে পিটিয়ে বর্শার মুখ ছুঁচালো করে আনছে। মেয়েরা রাত জেগে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে মরিচের মিহি গুঁড়ো তৈরি করছে। বাঁশঝাড় থেকে লাঠি কেটে জুতসই করছে। খলুর মেটে দেওয়ালের বৈঠকখানায় দিনে-রাতে মিটিং চলছে। নতুন নতুন পরামর্শ হচ্ছে। কৌশলের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। রোববার দিন বিকেলবেলা খলুর বড় ছেলে হাজারীহাটে গিয়ে একটা গোটা গরুর গোশত কিনে নিয়ে এল। আগামীকাল দাঙ্গা করতে যাবার আগে লেঠেলদেরকে গোশত দিয়ে ভাত খাওয়াবে। ( সূর্য : ৪৬)
ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। মনির আহমদ, হিমাংশু ধর, মান্নান প্রভৃতি চারজন মাতব্বরকে ডাকতে ডাকতে বৈঠক খানায় এলো। এরা কৃষক সমিতির মানুষ। এই কৃষক সমিতিই প্রথমেই উচ্চারণ করে শান্তির বাণী। তারা সামাজিক স্থিতিশীলতা আর শান্তির স্বার্থে মাতব্বরকে আহ্বান জানায়।
কৃষক সমিতির নেতা মনির আহমদ বলে :
‘হুইনলাম খলু চাচা, তোঁয়ারা দাঙ্গা গরিবার লাই তৈয়ার অইয়ো। আঁরা আস্যিদে মীমাংসার লায়। কী লাভ চাচা মারামারি কাডাকাডি গরি? তারথুন মীমাংসা বউত ভালা। তারপরে কোর্ট কাচারিতে দৌড়ন লাগিব। তিনকানির লায় দশাকানির টেঁয়া খরচ গরন লাগিব।’ (শুনলাম খলু চাচা, তোঁয়ারা দাঙ্গা করবার জন্য তৈরি হয়েছ। আমরা এখানে এসেছি মীমাংসার জন্য। মারামারি কাটাকাটি করে কী লাভ? তার চেয়ে মীমাংসা ভালো। কোর্ট-কাচারিতে দৌঁড়াতে হবে। তিন কানির জন্য দশকানির টাকা খরচ করতে হবে।) (সূর্য :৪৬)
কৃষক সমিতি সমাধানের উদ্যোগ নিলেও ভেস্তে যায়। খলু মাতব্বর ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে ‘তোঁরার সমিতি ভরি আই মুতি, দুত্তোর সমিতি। মীমাংসার কথা কইলে কইব চেয়ারম্যান’ (তোদের সমিতিতে আমি প্রস্রাব করি, দুত্তোর সমিতি। মীমাংসার কথা বললে বলবে চেয়ারম্যান।)
ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। কাদের মিয়ার সঙ্গে খলু মাতব্বর পরাস্ত হয়। তারপক্ষের লাঠিয়ালরাই বেশি জখম হয়। দারোগা পুলিশের উপস্থিতিতে প্রকম্পিত হয় জনপদ। আইনি ঝামেলা থেকে বাঁচতে খলু মাতব্বর নিজের ভাতিজি জোহরা তুলে দেয় পুলিশের দারোগার হাতে।
হাসিম বেরিয়ে আমগাছটার কোলভরা অন্ধকারের ভেতর আত্মগোপন করে রইল। দেখল, জোহরাকে জোরে জোরে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে দরজার কাছ অবধি নিয়ে যাচ্ছে। কাঁদছে জোহরা। কাঁদবার পালা তার। খলু তাকে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শেকল তুলে দিল। এমনও হয়? এমনও হয়? চিন্তা করতে পারে না হাসিম। আপন চাচা নিজের ভাইয়ের মেয়েকে জোরে-জব্বরে দারোগার কাছে ঠেলে দিতে পারে? হাসিম কী দেখছে? পৃথিবীটা কাঁপছে কেন? আকাশ-বাতাস টলছে কেন? বোধশক্তি সে হারিয়েছে ফেলেছে। নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চেষ্টভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। তার দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই আধখানা সোনার থালার মতো সুন্দর চাঁদ ডুবে গেল। চরাচরের জীবন্ত পিচের মতো অন্ধকার। হেঁটে আসছে কে একজন। সেদিকে এগিয়ে গেল হাসিম। তাকে দেখে হেঁটে আসা মূর্তি থমকে দাঁড়ায়। হাসিম জিজ্ঞেস করে। কিন্তু ফ্যাসফ্যাসে গলায় স্বর বেরোয় না।
‘হেইভা কন?’ (তুমি কে?)
ছায়ামূর্তি কথা কয় না। এগিয়ে আসে। কেঁপে কেঁপে হাসিমের হাত ধরে। জড়িয়ে ধরে কাঁপতে থাকে। হাসিমও কাঁপে। কেন কাঁপে? জোহরা সংজ্ঞা হারিয়ে হাসিমের গায়ে ঢলে পড়ে। অন্ধকারের নির্মম চক্রান্ত চারদিকে। এ অন্ধকারেই ঢলে পড়ল নির্মমভাবে ধর্ষিতা জোহরা।
খলু মাতব্বরের সংসারে জোহরার যেন কোনো জীবন্ত অস্তিত্ব নেই, তার স্বাধীনতা নেই। জোহরাও হাসিমের মতো নির্যাতিত। সে অধিকারের কথা বলতে পারে সে কোনো বেদনার কথা কাউকে বলতে পারে না :
জোহরার শরীরে হাড়-মাংস নেই। আগুনও লাগে না, কালিও হয় না। কারণ তার যাওয়ার জায়গা নেই কোথাও। যাবে সে কার কাছে? চাচার বিরাট সংসারের সকলের মন যুগিয়ে চলতে হয়। সকলে ব্যথা দেয়, আঘাত করে; কাউকে ফিরিয়ে সে আঘাত দিতে পারে না। আঘাতের মাত্রাটা ইদানিং তীব্রতর হয়ে উঠেছে। আঘাত, নিরাশা আর দ্বন্দ্বের তাড়নায় তার হৃদয় ভেঙে শত টুকরো হয়ে গেছে। আর সইতে পারছে না সে। উষ্ণ নিশ্বাস বুকের ভেতরে জমে জমে উত্তপ্ত বাষ্পের সৃষ্টি হয়েছে। আগে মানিয়ে নিত সকলের সঙ্গে। সকলের খুশির অনুপাতে নিজেকে ছোট করে নেয়ার শিক্ষা তার আজন্মের। দারোগার কাছে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার পর সে উৎসাহ তার মরে গেছে। কাজকর্মে প্রেরণা পায় না। চাচির খুব কষে গালাগাল দিলে ড্যাবড্যাবে কালো দুচোখ মেলে চেয়ে থাকে। কী জবাব দেবে ভেবে পায় না। (সূর্য: ৭৬)
খ. শৃঙ্খল ভাঙার সাহস
হাসিমের ইতবৃত্ত তুলে ধরে ঔপন্যাসিক সমাজসত্যের গভীরে প্রবেশ করেছেন। দিনমজুর হাসিম পিতৃপরিচয়ে গ্লানি ভুলে নিজেকে পরিচয় দেয় মুসলমান হিসেবে। কিন্তু ধর্ম-সমাজ তাকে সে পরিচয়ের স্বীকৃতি দেয়নি। তাকে গালি দেওয়া হয়ে ‘বাইন্যার পুত’ বলে। সমাজে ধর্মভিত্তিক পরিচয়ে বসবাসকারী মানুষের অসারতা, তাদের সংকীর্ণতা হাসিমের নির্যাতনের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন আহমদ ছফা। হাসিম কেবল একজন নির্যাতিত মানুষ নয়, হাসিম গ্রামবাংলার অগণিত নির্যাতিত মানুষের প্রতিনিধি। লোকবিশ্বাস, প্রথাগত, ধমীয় পরিচয়, লোকের গঞ্জনা সয়ে হাসিম চরিত্র সামনের দিকে অগ্রসর হয়। একসময় সে আলোকশিখায় পরিণত হতে চায়।
মনের গভীর সঙ্গোপনে ক্ষীণ স্পষ্ট একটি আলোক শিখা জেগে ওঠে। এই চেতনাই তার হাতিয়ার। এরই আলোকে পথ দেখে দেখে অত্যাচার অবিচার সয়ে সয়ে সে এত বড়টি হয়েছে। হাসিম স্পষ্ট দেখতে পায়, মানুষের নীচতা, ক্ষুদ্রতা আর ভণ্ডামির সীমা কতদূর। নিজেকে সমগ্র নির্যাতিত মানব-জাতির প্রতীক বলে মনে হয়। চেতরা শিখা আরো প্রোজ্জ্বল, সন্ধানী রশ্মি আরো তীক্ষèতর হয়। আষ্টেপাষ্টে জড়ানো শৃঙ্খলকে চোখের সামনে তুলে ধরে। নিজের অস্তিত্বের চারপাশের দেয়ালটাকে আরো স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। শরীর উত্তেজনায় আন্দোলিত হয়, মাথায় ছলাৎ ছলাৎ রক্ত ওঠে। সে চিৎকার করে ওঠে : ‘এই দেয়াল আঁই ভাইঙ্গম (এই দেয়াল আমি ভাঙব)’
লেখক কেবল ব্যক্তির দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা, জীবন সংক্রান্ত তুমুল জিজ্ঞাসা। সমাজের এ অসঙ্গতির বিরুদ্ধে লেখক হাসিমকে দাঁড় করিয়ে দেন সংঘবদ্ধ শক্তির অন্তর্ভুক্ত অপর শক্তি হিসেবে। যে হাসিম নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত হয়েছে সেই হাসিমই এক সময় নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের পক্ষে কাজ করে। বিদ্যমান যে সমাজ অসাম্যের রীতি নিয়ে বছরের পর বিকশিত-বিবর্তিত হচ্ছে একই ধাঁচে, হাসিম সেখানে এগিয়ে যায় সাম্যবাদী মানসিকতায়।
হঠাৎ অনেকগুলো ঘটনার আকস্মিক আলোকসম্পাতে তার দৃষ্টিশক্তিতে অনেক তীক্ষ্ণতা এসে গেছে। জীবনের একটা অর্থ ধীরে ধীরে রূপময় হয়ে তার চোখে জেগে উঠেছে। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের আচার-আচরণের অন্তরাল যে মহাসত্য সক্রিয় হাসিমের চেতনায় তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে দিনে দিনে। হাসিম অহরহ দগ্ধ হয়। বুকের চিন্তার আগ্নেয় রশ্মি মাঝে মাঝে বিদ্যুতের মতো ঝলসে ওঠে। সে আলোকে জগৎ জীবনের সমস্ত রহস্যকে বিচার করা যায়, বিশ্লেষণ করা যায়। মানুষ তাকে অবজ্ঞা করে কেন? কেন ঘৃণা করে? হাসিমের ধারণা তার কেন্দ্রবিন্দুতে হাত দিতে পেরেছে সে। সে এক নিষ্ঠুর সর্বভুক অনল।’
গ্রামের ওলাওঠা রোগে একের পর এক মানুষ যখন মরেছে। গ্রামের মানুষের আতঙ্ক কাজ করলেও সংঘবদ্ধ শক্তির আতঙ্ককে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে আর্তমানবতার সেবায়। হাজের মরা ছেলেকে দাফন করতে আসার সময় হাসিমের সঙ্গে পরিচয় হয় কৃষক নেতা মনিরের। এর আগের ঘটনা লেখক তুলে ধরেছেন এভাবে-
হাজেরার মরা ছেলেকে দাফন করতে পাড়ার কেউ আসেনি। সেই সকালবেলা মরেছে। মরা ছেলের শিয়রে বোবা হয়ে বসে আছে হাজো। তার চোখের পানির ধারা শুকিয়ে গেছ। পাতার নিচে চোখের পানির মরা খালটি এখনো জেগে আছে। শোকের চেয়ে আতঙ্কটাই এখন হাজেরার বেশি। ওলাউঠার রোগী যদি কবর দিতে না পারে? খলুর দাঙ্গায় জান দিতে মানুষের অভাব হয় না। জাহেদ বকসুর ছেলের বিয়েতে বেগার খাটতে মানুষের অভাব হয় না। অভাব কেবল হাজেরার ছেলেকে কবর দেওয়ার বেলা। একা কী করতে পারে হাসিম। (সূর্য : ৫৭)
খবর পেয়ে ছুটে আসে কৃষক সমিতির নেতারা। দেরি করে আসায় সমিতির নেতা মিনতি প্রকাশ করে করজোরে হাজেরার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। কৃষকনেতা মনির বলে-
‘আগে খবর ন পাই। হেই কথার লায় দেরি অইয়েদে বইন। কী গইররম, পাড়ার মানুষ ন আগায় ডরে। যুগী পাড়াত একজনরে পোড়ন পড়িল। আরেকজনের কবর দিলাম। (আগে খবর পাইনি তাই দেরি হয়ে গেল বোন। কী করব পাড়ার মানুষ ভয়ে এগিয়ে আসে না। যুগী পাড়ার একজনকে পুড়তে হলো, আরেকজনকে কবর দিলাম।) (সূর্য : ৫৮)
সেদিনই মনির আহমেদ ও কৃষক নেতাদের অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে হাসিমের প্রথম পরিচয়। মোহিত হয়ে গেল হাসিম। হাসিমের জিজ্ঞাসা প্রবল হয় কৃষক সমিতির নেতাদের ঘিরে। মানুষের অন্তরে এত দয়ামায়া থাকতে পারে? কলেরার সময় গাঁ ছেড়ে পালাচ্ছে ডরে মানুষ। এক বাড়িতে কারো কলেরা লাগলে বাড়ির মানুষ উধাও। আর এরা সারাটা ইউনিয়ন ঘুরে ঘুরে দেখছে, কোথায় মানুষ মরে আছে, কোথায় মৃতের সৎকার হচ্ছে না। তারা হিন্দু? তারা মুসলমান? তারা কোন জাত?
কৃষক সমিতির নেতা মনির আহমেদ বাস্তবের একটি চরিত্র। যা আহমদ ছফা নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে এই চরিত্র নির্মাণ করেছেন বিশেষভাবে। গাছবাড়িয়া কলেজ গেইট থেকে এশিয়ান হাইওয়ে বেয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হলে পাওয়া যাবে কলঘর এলাকা। সেই এলাকা থেকে একটা আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ (এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সংযুক্ত) সোজা পূর্ব দিকে চলে গেছে। এই পথ বেয়ে কিছুদূর অগ্রসর হলেই চোখে পড়বে ‘মজহার বাড়ি।’ মনির আহমেদের জন্মস্থান বা নিবাসস্থল ছিল এখানেই। কৃষকদের জন্য তিনি আন্দোলনে রত ছিলেন।
ছফা গবেষক শামসুল আরেফিন উল্লেখ করেছেন,
সূর্য তুমি সাথীতে মনির আহমদ চরিত্রটি অঙ্কনের পর ছফা তাঁর কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাতে লেখা ছিল, আপনি গরিব দুঃখীদের বিশেষ করে কৃষকদের আর্থিক উন্নতি তথা সার্বিক উন্নতির জন্য যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাতে আমি অত্যন্ত খুশি। আমার আশা এবং বিশ্বাস আপনি ভবিষ্যতে তাদের জন্য আরো অনেক কিছু করবেন বা করতে পারবেন। আপনার মতো মানুষ সত্যিই দুর্লভ। এ ধরনের মানুষ সমাজে প্রচুর সংখ্যক প্রয়োজন। আমার সূর্য তুমি সাথী নামে একটা উপন্যাস স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে বেরিয়েছে। সেই উপন্যাসে আমি আপনাকে না জানিয়ে আপনার চরিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। অপরাধ নেবেন না। (শামসুল ২০০৪ : ৪৬)
মনির মুগ্ধ হয় কৃষক সমিতির নেতাদের আচরণে-কর্মকাণ্ডে। কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িত আহমদ ছফার ব্যক্তিগত জীবন-অভিজ্ঞতার ছায়া পড়েছে এ উপন্যাসে। এ উপন্যাসে কমিউনিস্ট আন্দোলনের গন্ধ রয়েছে।
গ্রামের হাইস্কুলের মাঠে আয়োজিত কৃষক সমিতির সমাবেশে হাসিম প্রথমেই উচ্চারণ করে বিদ্রোহের কথা। প্রথমে হাসিমের গলাটা কেঁেপ উঠল। জিহ্বায় কেমন যেন জড়তা, কিসের যেন আওয়াজ একসঙ্গে সমুদ্রের মতো ফেটে পড়েছে। কোত্থেকে হাসিমের বুকে সাহস এ। গলা ফাটিয়ে ঘোষণা করল, ‘জালেম গোষ্ঠী ধ্বংস হোক, চাষি মজদূর ভাই ভাই/ অন্ন চাই বস্ত্র চাই, লাঙ্গল যার জমি তার।’
আন্দোলনকারীর লাঙ্গল যার জমি তার ঘোষণা দিয়ে বাঁচার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। হাসিম এ কৃষক সমিতিতে যোগ দিয়ে বুঝতে পারে যে, তার নিজেরও একটা পরিচয় আছে। মহামারিতে কৃষক সমিতির পাশে থেকে কাজ করতে গিয়ে হাসিম অনুধাবন করতে পারে যে, হিমাংশু, মনির আহমেদের মতো পৃথিবীতে এখনো মানুষ আছে যারা বিত্তবানদের দিকে তাকায় না, মানুষকে মানুষ বলে গ্রহণ করে। হাসিমের উপলব্ধিতে ধরা দেয় লেখকের নিজস্ব বিশ্বাস :
একসময় নাকি সমাজের সকলে সমান ছিল। সকলে সমানভাবে স্বাধীন ছিল। দাস ছিল না কেউ কারো। সকলে সমানভাবে পরিশ্রম করত, সমানভাবে ফল ভোগ করত। কেউ বড় কেউ ছোট ছিল না। মানুষ মানুষের মেহনত চুরি করে মানুষকে দাস বানিয়ে রেখে। কৃষক-শ্রমিকের বুকের খুন-ধরা মেহনত চুরি করে ধনী হয়েছে মানুষ। মেহনতি মানুষের বুকের তাজা রক্তে তাদের বাগানে লাল লাল গোলাপ হয়ে ফোটে। সহস্ররকম পদ্ধদিতে বুকের রক্ত শুষে নিচ্ছে। হাসিম যেন চোখের সামনে শোষণের নলগুলো দেখতে পেল। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে এ শোষণের পথ বন্ধ করতে হবে। সে জন্য দরকার সমিতি। (সূর্য : ৬১)
হাসিমের বোধ আরো শাণিত হয়ে ওঠে। সে কৃষক সমিতির সাহচর্যে নিজের অধিকার আদায়ের পথ খুঁজে পেয়েছে। হাসিম তো শ্রমিক, হাসিম বুঝতে পারে তার শ্রম চুরি করা হয়েছে, তার অধিকার চুরি করা হয়েছে। এতক্ষণে সে ধরতে পেরেছে অধরবাবু, কানা আফজল আর খলুদের সঙ্গে তার তো মানুষদের তফাতটা কোথায়। এতদিন হাসিম কেবল নিজের দুঃখকে বড় করে দেখেছিল। এখন হাসিমের উপলব্ধির জগৎ খুলে যায়। হাসিম বুঝতে পারে কেবল সে একা নয়, তার মতো অগণিত মানুষ আছে, যারা নিপীড়িত-নির্যাতিত; তাদের জন্য এবার হাসিমের কাজ করতে হবে।
গ. আলোকবর্তিকা হাতে একদল মানুষ
কলেরা রোগে মরছে গ্রামের পর গ্রাম। প্রাচীন কুসংস্কারে বিশ্বাস থাকায় গ্রামীণ সমাজের অন্ধ মানুষেরা কলেরা রোগকে অভিশাপ মনে করে। কোনো না কোনো বাড়িতে প্রতিদিনই লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে। এগিয়ে আসে কৃষক সমিতি। জাত-পাত বিভেদ ভুলে তারা নিরলসভাবে আর্তমানবতার সেবায় নিজেদের নিয়োগ করেন।
আহমদ ছফা আর্তমানবতার এমন সেবার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে : দলাদলা মানুষ মরছে। মাটি দিতে হচ্ছে, পোড়াতে হচ্ছে। জাত বিচারের সময় নেই। জাত বিচার করলে যে মৃতের সৎকার হয় না। এ পর্যন্ত ছেলে-বুড়ো- জোয়ান সব মিলিয়ে মরেছে একশো পঁচিশ জন। মনির আহমদে শহওে গিয়ে ওপরে দরখাস্ত করে ডাক্তার আনিয়েছে, পুকুরের পানিতে ওষুধ ছড়িয়ে দিয়েছে।
মরছে মানুষ তবুও তারা এক ঐশ্বরিক করুণায় চেয়ে থাকে ধর্মনির্ভর গ্রামবাসী-এলাকাবাসী। একদল মানুষ আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে এলেও মূর্খ মানুষেরা তাদের চিনতে পারেনি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কিংবা চিকিৎসাসেবার নানা পদ্ধতি আবিষ্কার হলে এ সব মানুষ তাদেও কুসংস্কারের পুরনো রীতি আঁকড়ে জীবনযাপন করতে চায়। এভাবে জীর্ণ জীবনযাপন তারা বয়ে নিতে চায় যেন অনাদিকাল।
গ্রামের মানুষ টিকা নিতে চায় না। তাতে নাকি ঈমান চলে যায়। এ কথা শুক্কুরবারের জামাতে ফয়েজ মস্তান মুসল্লিদের বলে দিয়েছে। কাজীপাড়া এবং ফকিরপাড়ার সকলে একযোগে ফয়েজ মস্তান জহির মৌলবিকে নিয়োগ করেছে। ছাগল জবাই করে শিরনি দিয়েছে। কোরআনের আয়াত পড়ে পাড়া বন্ধ করে দিয়েছে। মাটির সরায় সুরা লিখে গাছে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে যাতে ওলাওঠা পাড়ায় ত্রিসীমায় ঘেঁষতে না পারে। দিনেরাতে শোনা যায় আজানের ধ্বনি। জীবনে যারা নামাজ পড়েনি ওলাউঠার ডরে তাদের মাথায়ও টুপি উঠেছে। রাতের বেলায় ফয়েজ মস্তান আর জহির মৌলবি জেগে থেকে সমস্ত পাড়াময় ঘুরে বেড়ায়। (সূর্য : ৬৩)
কেবল প্রথাগত ধর্মীয় রীতিতে এদের বিশ্বাস না, এরা পীরবাদেও বিশ্বাসী। ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসে ধর্মীয় বিভিন্ন বিশ্বাসের শাখা-প্রশাখাকে উপস্থাপন করেছেন ঘটনা বর্ণনায় :
মাইজভাণ্ডারের কোনো কামেল পীর নাকি স্বপ্নে দেখেছে দুনিয়ার মানুষের গুনাতে দুনিয়া ভরে গেছে। সে জন্য আল্লাহ বান্দার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে কলেরা, হাম, বসন্ত প্রভৃতি সাতবোন পাঠিয়ে গজব নাজিল করেছে। ওরা সুন্দরী মেয়েলোকের বেশ ধরে দেশ হতে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ায়। যে-পাড়ায় আল্লাহর কালামের কোনো নিষেধের গণ্ডি থাকবে না, ভেতর দিয়ে হুড়হুড় করে ঢুকে পড়বে। হেটে গেলেই শুরু হবে রোগ। তারপর মৃত্যু…কান্নাকাটি ইত্যাদি। এরই নাম আসমানি মুসিবত। (সূর্য : ৬৩)
ধর্মের নাম ভাঙিয়ে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকামী ভণ্ড মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় উপন্যাসে। ওলাউঠা রোগে মানুষ মরছে, চারদিকে বিপদ আর এ সময় জহির মৌলবির মতো মানুষ নিজের প্রচার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিজেকে কামেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মানুষের কাছে মুখরোচক গল্প করে বেড়ায় :
এই আসমানি মুসিবতেরও আসাসি আছে আল্লাহর কালামে। একবার জহির মৌলবি নাকি জোয়ারা গ্রামে রাতের অন্ধকারে এক বোনের মাথার লম্বা চুল জারুল গাছের সঙ্গে পেঁচিয়ে বেঁধে খড়ম দিয়ে ছেঁচতে ছেঁচতে মুচলেকা আদায় করেছিল। আল্লাহর হুকুম নেই, নয়তো ধরে দিত। এ কথা জহির মৌলবি যত্রতত্র বলে বেড়ায়। আর সে জন্য কলেরার সময় জহির মৌলবির এত দাম। (সূর্য : ৬৩)
গ্রামের সবাই বিশ্বাস করলেও হাসিম এসব বিশ্বাস করে না। হাসিম নিজের অন্ধবিশ্বাসের চেতনা বিসর্জন দিয়ে সে এখন আলোর পথে, যুক্তির পথে আসতে শুরু করেছে। মানবমুক্তিকে ব্রত হিসেবে নেওয়ার পর থেকে খুলে দেখে হাসিমের চোখ। হাসিম তার পারিপার্শ্বিক জগতে কেবল অন্ধকারের তীব্র ঘনত্ব দেখতে পায়। হাসিম এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পেয়েছে। হাসিমের মনোজগতে পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা ধরা পড়ে এভাবে :
একমাস আগে হাসিম এসবে মোটেও অবিশ্বাস করত না। কিন্তু আজকে তার কেবল হাসিই আছে। এরকম সুন্দও সুন্দর গল্প বানাতে পারে বলে মোল্লারা খেতে পায়। ওসব খিছু নয়, ভাঁওতা। মুরগির রান খাওয়ার আর মেহনতকে ফাঁিক দেওয়ার জন্য এ সব মোল্লারা বানিয়েছে। (সূর্য : ৬৫)
ঘ. মাতৃত্বের জয়জয়কার
আহমদ ছফা সূর্য তুমি উপন্যাসে কেবল ধর্মীয়-সামাজিক অর্থনৈতিক শোষণকে বড় প্রধান বিষয় হিসেবে তুলে ধরেননি তিনি মাতৃত্বের জয়জয়কার দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন। ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির নিগড় ছিন্ন কওে উকি দেয় মাতৃত্বের অঙ্কুরিত চারা। এই কারণে হাসিমের দাদি বৃদ্ধ শৈলবালার কাছে ধর্ম বড় নয়, তার কাছে সন্তানের প্রতি স্নেহ, হাসিমের পরিবারের প্রতি মায়া, দায়িত্ব পালন করা প্রভৃতি বড় হয়েছে। যে হাসিম ধর্মের শৃঙ্খলকে ভাঙতে পারেনি, শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেনি এতদিন হাসিমের দাদি সেখানে প্রতিবাদ করেছে। সে ধর্মীয় রীতিনীতি, প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অনাস্থার দুঃসাহস দেখিয়ে মানুষের অচলায়তন ধর্মীয় বিশ্বাস আর গোড়ামির মর্মমূলে আঘাত হেনেছে।
সন্তান প্রসব করার সময় হাসিমের স্ত্রী সুফিয়া মারা গেলে বৃদ্ধা শৈলবালা হাসিমের পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রথমে লোকলজ্জা আর সামাজিকতার ভয় থাকলে বৃদ্ধার মাতৃস্নেহ সেই ধর্মীয় সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে মনে করিয়ে ধর্ম নয়, মানুষের মধ্যে মানুষের আন্তঃসর্ম্পকই শ্রেষ্ঠ।
ছেলে হরিেেমাহন কাজী বাড়ির মেয়ের প্রেমে ধর্ম বিসর্জন দিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে বুড়ি শৈলবালার সঙ্গে সামাজিকভাবে বিচ্ছেদ ঘটে। হয়ত মায়ে-সন্তানের জন্য সেই বিচ্ছেদ হয়। এই বিচ্ছেদ ছিল সামাজিকভাবে, এই বিচ্ছেদের সীমানা দেয়াল এঁকে দিয়েছিল মানুষে মানুষে ধর্মের বিভেদ। হারাধনের মৃত্যুকালীন ঘটনা আবহ উপস্থিত হয়েছে বুড়ির মনোজগৎ :
হাসিমের বুড়ো দাদি আপন গর্ভজাত ছেলের মরামুখ দেখতে পায়নি। যে-ছেলে মেয়েমানুষের মোহে পড়ে বাপ-পিতামহ চৌদ্দ পুরুষের ধর্ম ছেড়ে যেতে পারে, আপন ছেলে হলেও তার মুখ দেখা যে পাপ। পাপবোধের বিরাট বাধা জননীর অন্তরের প্রবল শোকাবেগের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিল।…বুড়ি শৈলবালা বাড়ির পেছনের পুকুরের পশ্চিমপাড়ে গিয়ে দেখল তার কনিষ্ঠ সন্তান হীরাধরের নিষ্প্রাণ দেহ শাদা চাদরে ঢেকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কবরখানার দিকে। তারা তার ছেলের দেহ মাটিচাপা দিল। তাজা কবরের দিকে চেয়ে বুড়ির মনে কী যে ব্যথা উথলে উঠেছিল সে খবর কেউ জানে না, কেউ না। (সূর্য: ৮৭)
যত দিন যায় ছেলে হারানোর ব্যথা বুড়ির বুকে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। মুসলমান হয়ে যাওয়া ছেলে হারানোর শোকে বুড়ির হৃদয় মুচড়ে পড়ে। বেদনায় ছেয়ে যায় সমস্ত অন্তর। কারো কাছে প্রকাশ করতে পারেনি। পারবে না কোনোদিন। কেউ সমবেদনা দেখায়নি, দেখাবে না। বরং হরিমোহনের মৃত্যু যেন সমাজের মানুষের কাছে ধর্মত্যাগের দণ্ডবিশেষ।
বুড়ির মনেও দেবতার ভয় কম নয়। কিন্তু মনের কতটুকু তার নিজের এখতিয়ারে। সমুদ্রের মতো গভীর তলদেশ থেকে নোনা ঢেউ উঠে ছেয়ে যায় মন। দেবতা, স্বর্গ, ধর্ম সবকিছুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অবেচতন মন। কখন যে হরিমোহনের ধর্মান্তরকে নিজের অজান্তে মাফ করে দেয়- নিজেও বলতে পারে না। মনে মনে হরিমোহনের পক্ষ সমর্থন করে অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে লড়তে লেগে যায়। (সূর্য : ৮৮)
ছেলে হরিমোহনের মৃতদেহ দেখতে পারেনি তাই বলে হাসিমের স্ত্রীর মৃতদেহ একবার হলেও চোখে দেখতে পারবে না তিনি? কোনো আগাপিছু না ভেবে বুড়ি সুফিয়াকে দেখতে যায়। জোহরা যখন সুফিয়ার নবজাত ছেলেকে বুড়ির কোলে তুলে দেয়। বুড়ি তখন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। বুড়ি আঁচলের খুঁটে দুচোখ মুখ মুছে নবজাতকের দিকে তাকায়। বুড়ি নবজাতকের মুখের আদলে ছেলে হরিমোহনের প্রতিছাপ খুঁজে পায়।
বুড়ির দৃষ্টিকোণ থেকে ঔপন্যাসিক উল্লেখ করেন :
সেই চোখ, সেই মুখ, সেই নাক অবিকল তেমনি। হরিমোহন যেন আবার শিশু হয়ে ফিরে এসেছে। বুড়ি চেয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে আশা মেটে না। এ কি হরিমোহন নয়? তার কনিষ্ঠ ছেলে হরিমোহন কী আবার ফিরে এলো?… বুড়ির মনে হচ্ছে হরিমোহন যেন বলছে, ‘মা হিন্দু হই, মুসলমান হই আমি তো তোরই সন্তান, কোলে তুলে নে।’ শিশু কাদছে ওয়াঁ ওঁয়া। কিছুতেই কান্না থামে না।
বুড়ি একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলে তিনি হাসিমের ঘরে এসে ফিরে যাননি। এ নিয়ে হিন্দু-মুসলমান পাড়ায় নানা কথা হলেও বুড়ি তােেত কর্ণপাত করেনি। হাসিমের নবজাতক ছেলেকে দেখে বুড়ি ফিওে যেতে চায় সোনালি এক অতীতে। হাসিম কে ডেকে বুড়ি বলে :
‘অ সোনা নজর মেলি চা। একেবারে তোর বাপের নাহান। তোর বাপও কাইনতো। ভালা গরি চা, হেই মুখ, হেই কান, হেই নাক।’ ( সোনা, একবারে তোর বাপের মতন। তোর বাবাও এমনি করে কাঁদত। ভালো করে দেখ। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই নাক, সেই কান।) (সূর্য : ৯৫)
হাসিমের ছেলেকে কাছে পেয়ে জোহরার ভেতরের মাতৃরূপ সজাগ হয়ে ওঠে। মাতৃরূপ প্রবল বলেই তো পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চাপ থাকার পরও জোহরা সন্তানকে গর্ভপাত করেনি। খলু মাতব্বর জোহরার মাতৃত্বের কাছে পরাজিত হয়। এবার হাসিমের ছেলেকে দেখে জোহরা মাতৃত্বেও স্বরূপ উন্মোচন করে। জোহরা হাসিমের ছেলের মুখ নিজের স্তনে লাগিয়ে দেয়।
হাসিমের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকাশ পেয়েছে জোহরার মাতৃরূপ। সেইসঙ্গে হাসিম অনুভব করে জোহরার প্রতি এক ধরনের সম্পর্কেও প্রয়োজনীয়তা।
হাসিম সন্ধ্যাবেলা বাজার থেকে ফিলে এসে দেখে ভেতরে জোহরা। কোলে শিশু। ব্লাউজের বোতাম খুলে স্তনের বোটাটি শিশুর মুখে পুড়ে দিচ্ছে। আপনাআপনি হাসিমের পথচলা থেমে যায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। ডান স্তন টেনে নিয়ে বাম স্তন মুখে পুরে দেয়। আশ্চর্য দুটি স্তন জোহরার। বাতির আলোকে দেখা যায় ঈষৎ রক্তিম, শিরাল, শেষ রেখাটি পর্যন্ত ভরে উঠেছে মাংসে। কালো জামের মতো কালো দুটি কলি। হঠাৎ হাসিমের বুকের রক্তধারা নেচে ওঠে। (সূর্য : ১০০)
ঙ. নতুন যাত্রা
যে কৃষক সমিতির সদস্যরা কোম্পানির জবরদখলের প্রতিবাদে জনমত গড়ে তোলে, গ্রামের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেই তারা একসময় ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়। কৃষক সমিতির সদস্যরা ওপরে দরখাস্ত পাঠিয়েছে। পত্রিকার কাগজে লেখালেখি করেছে কীসব। কোম্পানির সার্ভেয়ার জমি পরিমাপ করতে এলে সংঘবদ্ধ কৃষকশক্তি কোম্পানির লোকগুলোকে তাড়িয়ে দেয়। কোম্পানি আইনের আশ্রয় নেয়। কৃষক সমিতির সদস্য, গ্রামের প্রতিবাদী বেশ কয়েকজন কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা ঢুকে দেয় কোম্পানি। কানা আফজল, অধরবাবু জাহেদ বকসু এরা কোম্পানির পক্ষের সাক্ষী হয়। পুরের দিন পুলিশ এসে মনির আহমদ, হিমাংশুবাবু আর মান্নাকেসহ কয়েকজনকে পুলিশ পিঠমোড়া করে বেঁধে থানায় চালান দিল।
উপন্যাসে উল্লেখ আছে :
অন্যান্য আসামিরা আগে খবর পেয়ে পালিয়েছে। তাদের ধরার জন্য পুলিশ আস্তানা গাড়ল। বরগুইনিপাড়ার একশটি ঘরে একজন পুরুষমানুষও নেই। যারা আসামি নয়, তারাও ভয়ে দূরের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে গেছে। পুলিশ চৌকিদার সারা গাঁয়ে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মুরগি ওর খাসি জবাই করে দুবেলা ভক্ষণ করছে। (সূর্য : ৯৯)
সমিতির নেতাদের গ্রেফতারের খবর জানতে পেরে হতাশ হয় হাসিম। হাসিমের দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে এসেছে হাসিমের মনের ভেতরের তোলপাড়ের বাস্তবতা :
হঠাৎ হাসিমের মনে হলো মটমট করে তার অনেক পাঁজর একসঙ্গে ভেঙে গেছে। সে যেন আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারছে না। পৃথিবীটা তার জন্য মিথ্যা হয়ে গেল। হাসিমের মতো সমাজহারা পরিচয়হারা একজন মানুষকে সমিতির কর্মীরা ভাই বলে গ্রহণ করেছিল। তারা জেলে গেল। হাসিম এখন কার কাছে যাবে? (সূর্য : ১০০)
এদিকে বৃদ্ধ দাদিকে নিয়ে গেছে অধরবাবু। কথা শুনে হাসিম বসে পড়ে। দু হাতে মাথাটা চেপে ধরে। সুফিয়া মারা গেছে। মনির আহমদ, হিমাংশুবাবু, মান্নান জেলে চলে গেছে। স্নেহ-মমতার ভিত্তিতে হাসিমের যে একখানা জগৎ গড়ে উঠেছিল সে আবেগের মূল্য পেতে সবকিছু যেন চোখের সামনে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। সমিতির সদস্যদের জামিন চেষ্টা করেও ব্যর্থতা এসেছে। হাসিমের সহযোদ্ধা কেরামত জানান, এই তো অত্যাচারের সবেমাত্র শুরু। জালেমরা বনের বাঘের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে, আর মজলুমেরা সকলে একজোট হয়ে যতদিন না রুখে দাঁড়াচ্ছে কোনো প্রতিকার নেই। মনির আহমেদ হিমাংশুবাবু তো শুধু নয়, এমনি হাজার হাজার মানুষ বিনা অপরাধে জেল খাটছে।
এমন অবস্থায় হাসিম কী করবে। হাসিম তো স্বীকার করেই নিয়েছে তার পাঁজর যেন ভেঙে গেছে, উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। হাসিম পালিয়ে যেতে চায়। এই পালিয়ে যাওয়া একা নয়, জোহরাকে নিয়ে যেতে চায়। রাতের অন্ধকারে জোহরা আত্মহননের পথ বেছে নিতে চাইলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় হাসিম। কথা হয় সোমবার তারা পাড়ি দেবে। হাসিম কালুরঘাটের মিলে কাজ করবে।
হাসিমের প্রস্তাবে রাজি হয়। লেখকের বর্ণনা : ‘অল্প জোসনায় তাকে রহস্যময়ীর মতো লাগে। জোছনার তন্তুতে গড়া যেন সমস্ত শরীর। শাড়ির কাধের থেকে এলিয়ে পড়েছে। আধখোলা ব্লাউজের ফাঁকে এক ফালি জোসনা এসে লেগেছে। বাম স্তনের অর্ধাংশ চকচক করছে। হাসিম দুহাতে জোহরাকে জড়িয়ে ধরে। জোহরা গভীর আশ্রয়ের নিশ্চিত খুঁিটটিকে আঁকড়ে থাকে। অনেকক্ষণ, অনেক্ষণ।’
সোমবার সূর্য ওঠার অনেক আগেই রওয়ানা দেয় দুজন। হাসিম আর জোহরা সামনের পথে পা ফেলাচ্ছে আর অতীত হয়ে আসছে বরগুইনি পাড়া। স্মৃতিপটে খণ্ডাংশ স্মৃতি হাসিমকে কাতর করে তোলে :
‘হে বাপ, ঘুমিয়ে থাকো, হে মা ঘুমিয়ে থাকো, প্রিয়তমা সুফিয়া, তুমি একটিবার পাশ ফেরো ঘুমের ঘোরে; বিদায় তোমাদের বিদায়। কুয়াশা-ঢাকা সবুজ মাঠ, তোমাকে বিদায়। কাজী বাড়ির দাসত্ব তোমাদের বিদায়। বাপের মা দাদি তোমাকেও বিদায়।’ (সূর্য : ১০৫)
একসময় তারা ট্রেন স্টেশনে এসে পৌছায়। কিছুক্ষণ পর ট্রেন চলতে আরম্ভ করে। জানালা দিয়ে পূবদিকে তাকায়। রাঙিয়ে যাচ্ছে পূবদিক। রাঙিয়ে যাচ্ছে হাসিমের সমস্ত চেতনা। শেষ পর্যন্ত নতুন দিনের নতুন একটি সূর্য চলে হাসিম-জোহরার সঙ্গে। সূর্যটাই তাদের চিরসাথী।
হাসিম এখন কৃষি সমাজ ছেড়ে কলকারখানার শ্রমিক হয়েছে। শহরে এসে তার পেশার বদল ঘটেছে। কিন্তু পেছনে যে বরগুইনি-সাতবাড়িয়া-গাছবাড়িয়া রেখে এসেছে, রেখে এসেছে অগণিত মানুষ তাদের ভাগ্যের কতটুকু পরিবর্তন হলো, ঘুণেধরা সমাজটির পরিবর্তন কতটুকু হলো? হাসিম তো সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল, বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল; কোথায় গেল সে বিপ্লব। হাসিম কি তাহলে পরাজিত এক সৈনিক। পালিয়ে আসায় ছিল কি তার একমাত্র নিয়তি!
কোনো কোনো সমালোচক হাসিমের নিরুদ্দেশ গন্তব্যে পাড়ি জমানোকে বাংলাদেশের নতুন গন্তব্যের ইঙ্গিত বলে মনে করেন। কিন্তু আমাদের মতে আপাতত একটি ব্যর্থ বিপ্লবের করুণ ইতিহাস রেখে গেল হাসিম। হয়ত ভেতরে তার পরিবর্তনের আকাঙক্ষা এখনো বিরাজমান। এই আকাঙক্ষার পথ ধরেই একদিন সমাজের কোনো না কোনো পরিবর্তন আবশ্যিক হয়ে ধরা পড়ে। সেই কাক্সিক্ষত বিপ্লবের জন্য হয়ত আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে হাসিমের কিংবা বরগুইনিবাসীর কিংবা সমগ্র দেশবাসীকে।
তথ্যসূত্র
১। রফিকউল্লাহ খান, বাংলাদেশের উপন্যাস : বিষয় ও শিল্পরূপ, বাংলা একাডেমি, প্রথম পুনর্মুদ্রণ, ঢাকা ১৯৯৭
২। নূরুল আনোয়ার, ছফামৃত, খান ব্রাদাস অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, ২০১০
৩। নাসির আলী মামুন, আহমদ ছফার সময়, শ্রাবণ প্রকাশনী, চতুর্থ মুদ্রণ, ঢাকা, ২০১৩
৪। শামসুল আরেফিন, আহমদ ছফার অন্দরমহল, বলাকা প্রকাশনী, চট্টগ্রাম, ২০০৪
৫। আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন, ঢাকা ২০০৬
৬। মোমেনুর রসুল, আহমদ ছফার উপন্যাসে সমাজ ও রাজনীতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ, সাহিত্য পত্রিকা, বর্ষ ৪৯, সংখ্যা : ১, ২০১১।
৭। সলিমুল্লাহ খান, আহমদ ছফার উপন্যাসসমগ্র, ভূমিকা, মাওলা ব্রাদার্স, তৃতীয় মুদ্রণ, ঢাকা, ২০১২