একজন কবি যত প্রতিভাবান হোন না কেন, তিনি কখনোই তাঁর দেশ ও জাতির স্বপ্নের থেকে বড় নন। কারণ কবি হয়ে ওঠেন তাঁর ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাস ও মানুষের মাধ্যমে সেই মানুষের জন্য, যাদের অব্যক্ত কণ্ঠস্বর কবিকণ্ঠে ব্যক্ত হয়। বাংলাদেশের কবিদের ক্ষেত্রে একথা আরও বেশি প্রযোজ্য, কারণ পাকিস্তান নামক ঔপনিবেশিক ধর্মরাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, বহু লক্ষ মানুষের আত্মদানের মূল্যে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই যেসব কবিরা এই রক্ত ও অশ্রুর অভিব্যক্তিকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা পরিত্যক্ত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
ব্রিটিশ শাসনের অবসানে, দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাজনের পর, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবাদর্শে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে তমুদ্দিনি ধারার যে-কাব্যচর্চা শুরু হলো, তার পুরোধা ছিলেন কবি ফররুখ আহমদ। যদি পাকিস্তান একটি নিপীড়ক ও জাতিবিদ্বেষী (বিশেষত বাঙালি বিরোধী) রাষ্ট্র না হয়ে, কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে ফররুখ আহমদ বাঙালি মুসলমানের জাতীয় কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতেন বলে ধারণা করা যায়। কিন্তু সুবিধাবাদী, ধর্মকেন্দ্রিক মতাদর্শে অর্জিত পাকিস্তান রাষ্ট্র যে-ব্যর্থ হবে, সেটা তার জন্মলগ্নেই সূচিত ছিল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ বাঙালি কবিদের মনোজগতে যে-বিপুল পরিবর্তন সূচিত করে, তার ফল বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত আধুনিক কাব্যধারা যা নতুন চিন্তা-দর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রবহমান। অতুলনীয় কাব্যপ্রতিভা সত্ত্বেও, কবি ফররুখ আহমদ এবং তাঁর অনুসারীরা বাংলাদেশের আধুনিক কাব্যধারায় অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন। কারণ তাঁরা জাতির স্বপ্ন ও হৃৎস্পন্দনকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।
পঞ্চাশের দশকে যে-কবিদের হাতে এই আধুনিকতার সূত্রপাত, তাঁদের মধ্যে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী, সিকান্দার আবু জাফর, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আল মাহমুদ, সায়ীদ আতিকুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রমুখের সঙ্গে পূর্ববর্তী দশকের আবুল হোসেন ও আহসান হাবীব অন্তর্ভুক্ত হন অভিন্ন কাব্যাদর্শের কারণে। পরে ষাট ও সত্তরের দশকে এই ধারায় আবুল হাসান, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ, আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবিদ আজাদ, কামাল চৌধুরী প্রমুখ কবি এসে মিলিত হয়েছেন। উল্লিখিত কবিদের মধ্যে শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের নাম যুগ্মভাবে হিসেবে উচ্চারিত হয় সম্ভবত তাঁদের কাব্যপ্রতিভার বিচারে, যদিও চিন্তা-দর্শন ও কাব্যপ্রকরণে তাঁদের অবস্থান মেরু দূরত্বে।
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে বাংলাদেশের আধুনিক কবিতায়, দুটো ধারা শুরু থেকেই স্পষ্ট ছিল: একটি হচ্ছে তিরিশের আধুনিকতা প্রভাবিত নগরাশ্রয়ী কাব্যধারা এবং অপরটি গ্রামীণ জীবন ও ঐতিহ্যলগ্ন ধারা। শামসুর রাহমান যদি প্রথম ধারার নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন, তাহলে আল মাহমুদ দ্বিতীয় ধারার। কিন্তু যে-কবি বিসম্বাদকালে কালে প্রখর হয়ে উঠলো, তার কারণ নগর ও গ্রামের বিরোধ নয়, তা হচ্ছে চেতনাগত: প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা বনাম ধর্মকেন্দ্রিক অলীক জাতীয়তাবাদী ধারা। বাংলাদেশে শুধু রাজনীতি নয়, শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে-দ্বন্দ্ব আমরা প্রতিদিন দেখছি, এটা তারই প্রতিফলন। কাব্যযাত্রার শুরুতে আল মাহমুদ প্রথম ধারাতে অবতীর্ণ হলেও, পরে নিশানা পরিবর্তন করে দ্বিতীয় ধারায় অবস্থান নেন এবং তাঁর কর্মকাণ্ড সেভাবে চলতে থাকে যা নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও অঙ্গীকারের পরিপন্থী বলে তিনি অচিরেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এটা প্রগতিপন্থীদের ষড়যন্ত্র নয়, এটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া; যেভাবে ফররুখ আহমদ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দু’জনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে : ফররুখ আহমদ সুবিধাবাদী ও আদর্শচ্যুত কবি ছিলেন না, তিনি যা বিশ্বাস করতেন শুরু থেকে জীবনের শেষাবধি সেটা অনুসরণ করে গেছেন; একটা জাতির এত বড় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম দেখেও তাঁর চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন ঘটেনি, তিনি অন্তরে পাকিস্তান লালন করতেন এবং সঙ্গত কারণে স্বাধীন বাংলাদেশে উপেক্ষিত থেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। আল মাহমুদ ঠিক তাঁর বিপরীত; কোনটা যে তাঁর সত্যিকারের আদর্শ ও বিশ্বাস, কোনটা তাঁর মিথ্যাচার ও সুবিধাবাদ, জাগতিক প্রাপ্তির জন্য ভোল পাল্টানো তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। তাঁর এসব আচরণ ও পাশ পরিবর্তন বাংলাদেশের কাব্যজগতে ক্ষতি করেছে, কারণ তিনি প্রতিভাবান ও প্রভাব সঞ্চারী ছিলেন।
আল মাহমুদ তাঁর আবির্ভাবের প্রথম এক দশকে যেসব কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, ‘লোক-লোকান্তর’ [১৯৬৩], ‘কালের কলস’ [১৯৬৬], ‘সোনালী কাবিন’ [১৯৭৩]; সেখানে তিনি অনন্য। কে না স্মরণ করবে ‘সোনালী কাবিন’-এর সেই অবিস্মরণীয় পঙ্তিমালা : ‘সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী/ যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,/ আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি’ […] পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;/ দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।’ কিন্তু আল মাহমুদ ‘আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ’ প্রভূত পরিমাণে সঞ্চয় করেছেন, কবির অহংকার ধরে রাখতে পারেননি ও পরাজিত হয়েছেন। এই আত্মবিক্রয় ও পরাজয় এমন শক্তির নিকট করেছেন, যারা স্বাধীনতা বিরোধী ও অন্ধকার মৌলবাদী শক্তি। প্রগতিশীল বাঙালির আপত্তি এখানেই।
ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ এবং তাঁদের অনুসারীরা এখানেই ব্যর্থ। তাঁরা আধ্যাত্মিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারেননি।
১৯৭৫ সালে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যে-উল্টোপথে যাত্রা শুরু হলো, আল মাহমুদের কাব্যে সে প্রতিফলন ধরা পড়ল। পরবর্তী এক দশকে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নামগুলো পড়লে যে-কেউ এই পরিবর্তন দেখতে পাবেন: ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ [১৯৭৬], ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ [১৯৮০], ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ [১৯৮৫] এবং এই তালিকা ক্ৰমবৰ্ধমান। তাঁর ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবিতা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করি :
মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে
মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;
আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।
[…]
না, এখনও সে শিশু। মা তাকে ছেলে-ভোলানো ছড়া শোনায়।
বলে, বালিশে মাথা রাখো তো বেটা। শোনো
বখতিয়ারের ঘোড়া আসছে।
আসছে আমাদের সতেরো সোয়ারি।
হাতে নাঙ্গা তলোয়ার।
[…]
সে ভাবে সে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়দৌড়। বলে, কে মা বখতিয়ার?
আমি বখতিয়ারের ঘোড়া দেখবো।
মা পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাসেন,
আল্লার সেপাই তিনি দুঃখীদের রাজা।
যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি। খিলজির শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।
দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে
দ্যাখো,দ্যাখো।
মায়ের কেচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে বালক
তুলোর ভেতর অশ্বখুরের শব্দে স্বপ্ন তার
নিশেন ওড়ায়।
[…]
আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা
মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।
বারুদই বিচারক। আর
স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।
এই কবিতার ব্যাখ্যা মনে হয় নিস্প্রয়োজন ! আল মাহমুদ যে-স্বপ্ন শিশুর মস্তিষ্কে রোপণ করে দিচ্ছেন সেটা মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুখচ্ছবি নয় যার জন্য বাঙালি একাত্তরে সমস্বরে গর্জে উঠেছিল, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি’ স্লোগানে। আল মাহমুদ রক্তক্ষয়ী জেহাদের আহ্বান করে পরাজিত পাকিস্তানের মতো একটি ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বাসনাই প্রকাশ করেছেন, যা রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, তিনি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী জাসদের পত্রিকা ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’-এর সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আন্দোলন আসলে কী ছিল এবং তার পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকেছিল, সে আলোচনায় নাই বা গেলাম। যদিও তাঁর রচিত বিখ্যাত পঙ্ক্তি, ‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,/ পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ো ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ’, [সোনালী কাবিন] হয়তো এখনো অনেকে তাদের স্মৃতি থেকে উচ্চারণ করেন।
‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু সরকারের অনেক সমালোচনা হতো (কিছু হয়ত প্রাসঙ্গিক ছিল), সেজন্য তিনি বঙ্গবন্ধুর কৃপালাভে বঞ্চিত হন নি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয় সনদ না থাকা সত্ত্বেও, বঙ্গবন্ধু আল মাহমুদকে শিল্পকলা একাডেমিতে সহকারী পরিচালক পদে চাকরি দিয়েছিলেন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিশিয়ারি জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি শিল্পকলা একাডেমি থেকে অবসর গ্রহণের পর জামায়াতের মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের অঙ্গসংগঠন ছাত্র শিবিরের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা, তাদের বিভিন্ন সভা-সমিতিতে প্রধান অতিথির পদ অলংকৃত করে বিতর্কিত বক্তব্য প্রদান করা সাহিত্য মহলে তীব্র হতাশা ও বিতর্কের জন্ম দেয়। একাত্তরে পশ্চিমা পাকিস্তানি সৈন্যের সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশে গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন, ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ’-এর কাছ থেকে তিনি ২০০৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয় গণহত্যার সহযোগী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার মাস্টার-মাইন্ড জামায়াতের আমির, গোলাম আযমের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। গোলাম আযমের জীবনীসহ আরও কিছু গ্রন্থ রচনায় সহযোগিতা করেন। এ প্রসঙ্গে গোলাম আযম তার জীবনীগ্রন্থে আল মাহমুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লেখেন, ‘বন্ধুবর কবি আল মাহমুদের পরামর্শেই আমি লেখা সংক্ষেপ থেকে বিরত রয়েছি। প্রাণ খুলে লিখছি। তিনটি বই সম্পর্কে সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করে আমাকে প্রেরণা দান করেছেন এবং বই-প্রসঙ্গের বাইরে একটি বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আমি কেন আমিরে জামায়াতের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলাম, এর ব্যাখ্যা দাবি করেছেন।’
উল্লেখ্য যে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠিত হয়, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত আজম তখন আমিরের পদ থেকে অব্যাহতি নেন। এতসব কিছুর পরেও ২০০৮ সালে দু’জন লেখককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ মিথ্যাবাদী রাখালের মতো বলেন, ‘একমাত্র আমি ছাড়া কোনো মুক্তিযোদ্ধা লেখক বাংলাদেশে নাই।’ তাঁর দাবি যে-ভিত্তিহীন ও স্ববিরোধী, সেটা আল মাহমুদের আত্মজীবনী ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ পড়েই জানা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের পরিবারকে দেশে ফেলে রেখে, উচ্চপদস্থ এক আমলার সহযোগিতায় তিনি কলকাতায় চলে যান ও সেখানে বিলাস বহুল জীবন যাপন করেন, আনন্দবাজার গোষ্ঠীর খ্যাতিমান কবি-লেখকদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে নিজের কাব্যখ্যাতির প্রসার ঘটান। তাঁর সম-সাময়িক অনেক কবি, লেখক যখন সরাসরি অস্ত্রহাতে রণাঙ্গনে অথবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন, তিনি তখন যুদ্ধ সংক্রান্ত কোনো কিছুতে জড়িত হওয়া দূরে থাক, কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কোনো রেডিও প্রোগ্রামেও অংশ নেন নি। কানাডা প্রবাসী লেখক ফরিদ আহমেদ একটি অনলাইন পত্রিকায়, ‘আল মাহমুদ কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?’ শীর্ষক তাঁর কলামে এসব নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। [sylhettoday24, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩]
ওপরের আলোচনা থেকে সংক্ষিপ্তভাবে হলেও, আল মাহমুদ কেন প্রগতিশীল লেখক, পাঠকের মনোযোগ হারিয়েছেন বা উপেক্ষিত হচ্ছেন তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অতি আল মাহমুদপ্রেমী এবং দেশের একটা বিশেষ বুদ্ধিজীবী-সাহিত্যগোষ্ঠী এটা মানতে নারাজ। এই গোষ্ঠীর বিভিন্ন লেখালেখি, চিন্তা-ভাবনা এবং সামাজিক মাধ্যমে তৎপরতা লক্ষ করলে সচেতন পাঠকরা বুঝতে পারবেন যে, তারা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শিল্প-সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতির বিকাশকে বিরোধিতা ও বাধাগ্রস্ত করতে তৎপর। তারা আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের ধারণাকে ফের উসকে দিচ্ছেন। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন, বিশ্ব-ক্ষমতার মেরুকরণ ও ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান (বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এর সহিংস বিস্তার) বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইসলামের পাশাপাশি, বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদকে নতুন শক্তিতে আত্মপ্রকাশ করতে সাহায্য করেছে। এর কুশীলবরা বাঙালির ঐতিহাসিক অর্জন, যুগস্রষ্টা মনীষী ও বিভিন্ন আইকনকে ধর্মের ছুরিতে বিভক্ত করছে।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলও ক্ষমতার স্বার্থে মৌলবাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আঁতাত করেছে। এই প্রেক্ষাপটে আল মাহমুদকে দেশের প্রধান কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর হয়েছে বিশেষ গোষ্ঠী যারা মাহমুদের মৌলবাদ ঘনিষ্ঠতাকে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে খারিজ করতে চায় এবং দেশবরেণ্য অসাম্প্রদায়িক কবি, লেখকদের প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্ন করে থাকে। তাদের দাবি যে আল মাহমুদ ধার্মিক এবং তাঁর কবিতায় ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন অনুষঙ্গ আসায়, নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষী প্রগতিশীলরা মাহমুদের বিরোধিতা করেন। তাদের এই অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা। আল মাহমুদের প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থে, ইসলাম যখন বাঙালি মুসলমানের প্রাত্যহিক জীবন-যাপনের অনুষঙ্গ ও লোকজ ধর্মবিশ্বাসের সৌন্দর্যে প্রতিভাত হয়েছে, সেসব নিয়ে কোনো বিতর্ক প্রগতিশীল মহল থেকে ওঠেনি। তিনি যখন লেখেন, ‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে,/ চুল খোলা আয়েশা আক্তার’ অথবা ‘বধূবরণের নাম দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল/ গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল’; তা নিয়ে কে আপত্তি করেছে? আপত্তি উঠেছে তখনই, যখন তাঁর কবিতায় মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে, তিনি একগ্রন্থের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস এবং রাজনৈতিক ইসলামে আস্থা স্থাপন করে মৌলবাদের পথে অগ্রসর হয়েছেন।
প্রসঙ্গত বলা প্ৰয়োজন যে বাংলাকাব্যে ঐতিহ্যগতভাবে বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন,মত ও পথের সমাহার আমরা দেখেছি যা প্রাচীন চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের বৈষ্ণব ও মঙ্গলকাব্য হয়ে বাউল সহজিয়াদের সমন্বয়ধর্মী মানবিকতার জয়গানে মুখর। রবীন্দ্রনাথ আস্তিক ছিলেন কল্পিত জীবনদেবতার অনুধ্যানে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সংস্কার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার; নজরুল কখনো নাস্তিক কখনো আস্তিক, ভগবান বুকে পদচিহ্ন এঁকে কিংবা আল্লাহর আরশ ছেদ করে পরক্ষণেই ইসলামী গজল ও শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন। কিন্ত প্রগতিশীল মহল তো তাঁদের প্রত্যাখ্যান করেনি; কারণ তাঁরা অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসী ছিলেন না, ধর্ম দিয়ে মানুষের মধ্যে বিভাজন করেন নি, ধর্মের ভিত্তিতে তাঁরা জাতিগত পরিচয় ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বাসনা করেন নি। ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ এবং তাঁদের অনুসারীরা এখানেই ব্যর্থ। তাঁরা আধ্যাত্মিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারেননি।
যারা আল মাহমুদের ব্যাপারে অত্যুৎসাহী, তারা একই কাল পরিধিতে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মোহাম্মদ রফিক, সৈয়দ শামসুল হক, ওমর আলী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রমুখ কবির গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলোর দিকেও একটু নজর রাখতে পারেন, তাতে গ্রামীণ জীবনের ঘ্রাণ ও আস্বাদ পেতে বিকল্পের সন্ধান মিলবে।
একজন মানুষের গ্রহণযোগ্যতার মাত্রা তার কৃতকর্মের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এমন নয় যে মৌলবাদ সংশ্লিষ্টতার জন্য আল মাহমুদকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে হবে। তাঁর যেসব রচনাবলী বাংলাভাষার সম্পদ, মানবিকতার স্পর্শে উজ্জ্বল সেসব আমরা নিশ্চয়ই পাঠ করব, লালন করব। কিন্তু যেসব রচনা ও কর্মকান্ডে তিনি বিপদজনকভাবে প্রতিভাত, সেসব সমালোচনা করা ও বর্জন করা আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থে জরুরী। আমার এই লেখায় মাহমুদের প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল, উভয় ধারার সামান্য কিছু নমুনা উপস্থাপন করেছি (যা বিস্তৃত করার অবকাশ আছে)। বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে আমার একাধিক প্রবন্ধে আমি মাহমুদের কবিতার উদ্ধৃতি ও সমালোচনা সহ তাঁর প্রাপ্য অবস্থান নির্ণয় করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যে-বিশেষ গোষ্ঠি তাঁকে বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে, তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণীত এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হলেও, পরিত্যক্ত তমুদ্দিনী ধারার পুনরুত্থানে সক্রিয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের কিছু কবি যারা বাংলাদেশের দ্বন্দ্বমুখর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে জানেন না বা জানার জন্য আন্তরিকভাবে সচেষ্ট নন এবং মাহমুদের মৌলবাদ সংশ্লিষ্টতার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অজ্ঞাত।
বাংলাদেশের যে-গোষ্ঠী নয়া উদ্যোগে আল মাহমুদকে নিয়ে ঢাকায় ঘটা করে কবিতা উৎসব করছেন, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের অনেক কবি আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নিয়েছেন এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ আবেগাপ্লুত হয়ে সভায় এমন দাবিও করেছেন যে কেন আল মাহমুদকে বাংলাদেশের প্রধান কবি ঘোষণা করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের এই বিশেষ গোষ্ঠী পাকিস্তানে ফররুখ আহমেদকে দিয়ে যা সম্ভব হয়নি, সেটা তারা স্বাধীন বাংলাদেশে আল মাহমুদকে দিয়ে করতে চান এবং মাহমুদকে দিয়েই কবি শামসুর রাহমানকে প্রতিস্থাপন করার দুঃস্বপ্ন দেখেন। ব্যক্তিভেদে কাব্যরুচির পার্থক্য হয়, কারও পাঠে আল মাহমুদ বেশি প্রিয় হতে পারেন, কিন্তু তা দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হয় না। শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হয় একজন কবির সামগ্রিক রচনার পরিমাণ, বৈচিত্র্য ও উৎকর্ষের নিরিখে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও তার মনোসন্ধিক্ষণের উপলব্ধিতে, জাতির আত্মপরিচয় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে ভাষাদানের সক্ষমতায় এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে। এসব বিবেচনায় শামসুর রাহমান এযাবৎকাল পর্যন্ত বাংলাদেশের যেকোনো কবির তুলনায় তিনি এগিয়ে আছেন। আধুনিক বাংলা কবিতার ভাষা নির্মাণে তিনি অগ্রগণ্য, বিশেষত দেশভাগোত্তর শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় অপেক্ষাকৃতভাবে পিছিয়ে থাকা পূর্ববঙ্গের কাব্যসাহিত্যকে পশ্চিমবঙ্গের সমান্তরালে স্থাপন করার কৃতিত্ব শামসুর রাহমানের। তিরিশের আধুনিকতা দ্বারা প্রভাবিত হলেও, রাহমান পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত বাঙালির মনোজাগতিক ক্যানভাস ও ভাষা আন্দোলনের অভিঘাতকে ধারণ করে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত কাব্যভাষা সৃষ্টি করেন। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে তিনি লিখেছেন অজস্র অবিনশ্বর কবিতা যা বাঙালির অগ্রযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল মাহমুদ যখন ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ লিখে প্রতিক্রিয়াশীলতাকে স্বাগত জানাচ্ছেন, শামসুর রাহমান তখন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ লিখে জাতিকে মৌলবাদের পদধ্বনি সম্পর্কে সতর্ক করছেন।
মাহমুদ যখন গোলাম আযমের জীবনীগ্রন্থ লেখায় সহযোগিতা করছেন, রাহমান তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাজপথে মিছিলের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, মৌলবাদীদের চাপাতির আক্ৰমনের শিকার হয়ে একপ্রকার গৃহবন্দি রয়েছেন এবং জাতির প্রগতিমুখী অভিযাত্রায় আপসহীন থেকেছেন। এসবই রাহমানের শ্ৰেষ্ঠত্ব বিচারের একমাত্র মাপকাঠি নয়, তাঁর কাব্যের বিচিত্র বিষয়, সময়ের পরিবর্তন ও নতুন চিন্তা-দর্শনের সঙ্গে তাঁর কবিতার সংযোগ ও বিভেদহীন মানবিক চেতনায় নিরন্তর যাত্রা তাঁকে শ্রেষ্ঠ কবির আসন অর্পণ করেছে। কোনো মৌলবাদী ষড়ষন্ত্র বা নেতিবাচক প্রচারের দ্বারা সেটা খারিজ হওয়ার নয়।
গ্রামীণ জীবন ও ঐতিহ্যলগ্নতার কারণে আল মাহমুদকে যে-বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়, সেটা একটু ওভার রেইটেড। কারণ এক্ষেত্রে মাহমুদের পূর্বে জীবনানন্দ দাশ এবং জসীমউদ্দীন বাংলাকাব্যে স্বর্ণ ফলিয়েছেন। আল মাহমুদকে নিবিড়ভাবে পাঠ করলে একথা বোঝা কষ্টকর নয় যে তিনি মূলত তাঁর পূর্বসূরি জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন এবং ফররুখ আহমেদের এক সম্মিলিত রূপ। দুভার্গ্য এই যে তিনি জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদ্দীনের প্রজ্ঞা ও মানবিকতার আলো গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং ফররুখ আহমেদের কানাগলিতে ঢুকে পড়েছেন। যারা আল মাহমুদের ব্যাপারে অত্যুৎসাহী, তারা একই কাল পরিধিতে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মোহাম্মদ রফিক, সৈয়দ শামসুল হক, ওমর আলী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন প্রমুখ কবির গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলোর দিকেও একটু নজর রাখতে পারেন, তাতে গ্রামীণ জীবনের ঘ্রাণ ও আস্বাদ পেতে বিকল্পের সন্ধান মিলবে।
এ আলোচনা আরও দীর্ঘ হতে পারে বিষয় ও বিশ্লেষণের আলোকে, আরও উদাহরণ ও তথ্যের সমাবেশে। আপাতত সে ইচ্ছা সম্বরণ করি, ভবিষ্যতে আরও বিস্তারের সম্ভাবনায়। বাংলা কবিতার জয় হোক!