কবি নিজ সমাজের যেমন বাসিন্দা, তেমনি বিশ্বনাগরিকও। আপন সমাজচৈতন্যকে আলোড়িত করার সঙ্গেসঙ্গে বিশ্বে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনাবলিও তাকে সমানভাবে ভাবায়। সংবেদনশীল কবি মাত্রই বৈশ্বিক সমাজের চলমান স্রোতধারায় নিজেকে একাত্ম করেন। আর কবির সমগ্রতাও অর্জিত হয় ব্যক্তিসত্তা ও সমাজসত্তার সম্মিলনেই, সে-সমাজ দৈশিক ও বৈশ্বিক উভয়ই। বাংলা কাব্যে তিরিশোত্তর কবিবৃন্দ রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর সময়ে সচেতনভাবে এই আন্তর্জাতিকতা নিয়ে আসেন, তবে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক চেতনা চল্লিশের দশকে সক্রিয় ও বিস্তৃত হয়; সমকালীন বিশ্বের সাথে মানসিক যোগযোগ গড়ে তোলেন। বিশেষভাবে বিশ্বের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ও জোয়ারের পটভূমিকায় সমাজতান্ত্রিক মনোভাবের অধিকারী কবিবৃন্দ এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখে, বায়ান্নোত্তর কবিরাও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক চেতনা ধারণ করে কবিতা লেখেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাউত্থান ঘটার ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহু মেরুপ্রবণতা ও বহুকেন্দ্রিকতার অবসান ঘটিয়ে সূচিত হয় দ্বিমেরুপ্রবণ রাজনীতিক ধারা। আগে সমাজতান্ত্রিক জোট সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে এবং পশ্চিমে পুঁজিবাদী জোট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দুটি প্রভাব-বলয় গড়ে ওঠে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের কালে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ এ প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে অর্থাৎ উপনিবেশবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহে পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্বর্ণযুগের এই তিন মহাদেশে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রের আধিপত্যের বিস্তার ঘটে। ফলে সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর অনেকগুলোই তখন শৃঙ্খলার বন্ধনে বন্দী হবার পথে, তারই একটি প্রকাশ ছিলো মার্কিনপন্থী সামরিক অভ্যুত্থান। আবার একই সময়কালে সাম্রাজ্যবাদ ও সামরিক বা অন্য ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপক ব্যাপ্তি লাভ করে। জনগণের মধ্যে মার্কিনবিরোধী মনোভাব চাঙ্গা হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র পর্যায়েও তখন মার্কিনবিরোধী বিভিন্ন জোট গড়ে ওঠে। সমাজতান্ত্রিক জোটের পাশাপাশি গড়ে ওঠে জোট নিরপেক্ষ জোট। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান নিয়ে মিশরের জালাল আবদেল নাসের, আলজেরিয়ার হুয়ারি বুমেদিন, ইন্দোনেশিয়ার সুকার্নো, লিবিয়ার গাদ্দাফি এবং বিপ্লবী নেতা হিসেবে চীনের মাওসে তুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চে গুয়েভারা, কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা, তানজানিয়ার জুলিয়াস নায়ারেরে বিশ্বের সমস্ত বিপ্লবীদের কাছে শুধু নয়, সাধারণভাবে তরুণদের কাছে একেক জন চিহ্নিত হতে থাকে নায়ক হিসেবে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা বিপ্লবের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে এক নামে উচ্চারিত হয়।
আল মাহমুদ মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নে বারবার চেতনাকে জাগ্রত এবং প্রতিবাদী ভূমিকায় নিজেকে অবতীর্ণ করেন। এক্ষেত্রে নিজ জন্মভূমি ও ভিন্ন দেশের মানুষের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য বিবেচনায় আনেননি। ফলে পৃথিবীর যে প্রান্তেই মানবাধিকার লংঘন এবং স্বাধীনতা বিপন্ন হয়েছে সেখানেই কবি কবিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। কেননা তিনি রুশোর মতো বিশ্বাস করেন, মানুষের প্রজন্ম জন্মগতভাবে স্বাধীন। তাদের স্বাধীনতা, তাদের নিজেদের অবিচ্ছেদ্য সত্তা। সে-সত্তাকে প্রদান করার অধিকার তাদের নিজেদের ব্যতীত অপর কারোরই হতে পারে না। অপর কারুর স্বাধীনতাকে বিনষ্ট করার অধিকার প্রাকৃতিক বিধানেরই বিরোধী। (জাঁ জ্যাক রুশো: সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট) আল মাহমুদ তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে অঙ্গীকারবদ্ধ।
আল মাহমুদ ষাটের দশকের শেষার্ধে দেশে সামরিক আগ্রাসন ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যেমন প্রতিবাদী; তেমনি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও আক্রমণের বিপক্ষে সোচ্চার। ভিয়েতনাম, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক ও কাশ্মীরে পরিচালিত সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং মানবাধিকারের সপক্ষে তাঁর কলম ঝলসে ওঠে। তিনি বরাবরই যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে ও কোরিয়ায় পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে তার ধ্বংস ও আগ্রাসনের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। লক্ষ লক্ষ মার্কিন সৈন্য ভিয়েতনামে নিয়ে যাওয়া হয়, সর্বাধুনিক মানব ও পরিবেশ বিধ্বংসী অস্ত্র প্রয়োগ করা হতে থাকে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় ভিয়েতনাম। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভিয়েতনামে মার্কিন রাজনৈতিক ও সামরিক ক্রিয়াকলাপের উদ্দেশ্য ছিল একটি বৃহৎ শক্তি বা পরাশক্তি হিসেবে আধিপত্য বা প্রভাব বলয় বিস্তার করা, বিশ্বে অন্যতম সেরা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক বা বাণিজ্যিক স্বার্থ সংরক্ষণ বা প্রসার করা এবং এ সবের কারণেই এ অঞ্চলে বিপ্লবী আশা-আকাঙ্ক্ষা বা সাম্যবাদ ভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেওয়া। কবি এই সময়ে সাম্যবাদী বিপ্লবের জন্যে স্বদেশে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত; অন্যদিকে ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হওয়ায় প্রতিবাদী কণ্ঠ।
এই তো অবসর, যখন কোনো দৃশ্যই আর গ্রাহ্য নয়।
পলকহীন চোখ যেন উল্টে যাচ্ছে। যেখানে থরে থরে সাজানো আছে
ঘটনার বিদ্যুচ্চমক। না, কাউকে ধমক দিতে চাইনা।
কোনো কর্তব্য আমার জন্যে নয়। বরং হৃদয়ের ভেতর
যে ব্রহ্মাণ্ডকে বসিয়ে রেখেছি তার গোলক
দ্রুত আবর্তিত হোক।
ভিয়েতনামে বোমা পড়ছে। আমি তার প্রতিবাদ করি।
(উল্টানো চোখ: সোনালি কাবিন)
কবি ভিয়েতনামে দেখেছেন মানববিরোধী ধ্বংসযজ্ঞ। মানবতা, মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা সবকিছুকেই পরাশক্তি ভূ-লুণ্ঠিত ও বিনাশ করেছে। মানুষের অপমানে কবি নীরব থাকতে পারেননি; বিবেকবোধে উজ্জীবিত হয়ে কবি মনুষের পক্ষে কলম ধরেছেন দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কণ্ঠস্বরের সঙ্গে কবিতাশিল্পের যৌগিক রসায়নে পাঠকের মুখে নয়া স্বাদ অনুভূত হয়।
এক দীর্ঘস্থায়ী ও রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম ফিলিস্তিনী ভূ-খণ্ডে এখন পর্যন্ত অব্যাহত। ফিলিস্তিনে দীর্ঘ ৪৪ বছরের ইসরাইলি দখলদারিত্ব মানব সভ্যতার জন্য চরম লজ্জাজনক বিষয়। ১৯৬৭ সালের ইহুদি আগ্রাসনের পর থেকে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে অত্যন্ত অমানবিকভাবে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। ইসরাইল পাখি শিকার করার মতোই টার্গেট করে করে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে বহু ফিলিস্তিনি নেতা ও সাধারণ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছ। পরবর্তীকালে ইসরাইলি সৈন্যরা হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে লিফিস্তিনিকে গণহত্যা করেছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের রক্তে এখনো প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনের মাটি রঞ্জিত হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগে এসেও ফিলিস্তিনিরা তাদের ন্যায্য অধিকার, নিজেদের বসতভিটা, নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ফিরে পাচ্ছে না।
ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই রাষ্ট্রটি মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদের এক শক্ত খুঁটি হিসেবে এ পর্যন্ত কাজ করে আসছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যে অনেক পানি গড়িয়েছে, আশির দশকে শুরু হয়ে তিন বার ফিলিস্তিনিরা ইন্তিফাদার জন্ম দিয়েছে। নতুন ফিলিস্তিনি প্রজন্ম স্বাধীনতার জন্য আরও লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ আন্দোলনের সঙ্গে-সঙ্গে ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের আপসহীন ও অপ্রতিরোধ্য মুক্তির উত্থান ঘটেছে। ১৯৯৩ সালের অসলো শান্তিচুক্তির টোপ দিয়ে ফিলিস্তিনিদের আয়ত্তে আনা যায়নি। আরাফাতের ফাতাহর পর হামাস জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা তা মেনে নেয়নি। এখন ফিলিস্তিনে ফাতাহ ও হামাস দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি। এই দুই শক্তি চায় ১৯৬৭ সালে অধিকৃত সব ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড সরিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, পশ্চিম তীরের সব ইহুদি বসতি অপসারণ, ইসরাইলি কারাগারে আটক ১১ হাজার ফিলিস্তিনির মুক্তি এবং সব ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুর নিজ বাসভূমিতে ফিরে আসার অধিকারের স্বীকৃতি। আল মাহমুদ ইতিহাসের এই ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিক্রিয়ায় ইহুদি জাতির প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশিত; সঙ্গে সঙ্গে দোসর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিও।
ক
সকালে সংবাদপত্র, রাজনীতি, ক্ষুব্ধ খোঁচাখুঁচি
যা কিনা রক্তাক্ত শার্টের মতো পরে আছে আমাদের ভয়ার্ত শতক–
এসবের ঊর্ধ্বে আজ বিনাবাক্যব্যয়ে
কী করে থাকেন?
জানিনা, দেশের খবর কিছু পান কিনা,
কী ঘটবে এশিয়ায়–এ নিয়ে তর্ক করে আপনার যাওয়ার পর
পৃথিবীর সবকটি শাদা কবুতর
ইহুদি মেয়েরা রেঁধে পাঠিয়েছে মার্কিন জাহাজে।
(আত্মীয়ের মুখ : সোনালি কাবিন)খ
অনিষ্টকর অন্ধকারে যখন পৃথিবী
আচ্ছন্ন হয়ে যায়। চারদিকে ডাইনীদের
ফুৎকারের মতো হাওয়ার ফিসফাস,
আর পাখিরা গুপ্ত সাপের আতঙ্কে
আশ্রয় ছেড়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দেয়
ঠিক তখুনি, ইহুদিরা হেসে ওঠে।
…ইহুদিরা হাসুক,
তবু সম্পদের সুষম বণ্টন অনিবার্য।
ইহুদীরা নাচুক, তবু
ধনতন্ত্রের পতন আসন্ন। আর
মানুষ মানুষের ভাই।
(ইহুদিরা : অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না)
কবি এখানে ধনতন্ত্রের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদকে এক কাতারে নিয়ে আসেন। ধনতন্ত্রের ফলেই যে সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারিত ও আগ্রাসী থাবা বিস্তারে সক্রিয় তার যেমন ইঙ্গিত দিয়েছেন, তেমনি এর পতনের কথাও বলেছেন। ফিলিস্তিন সম্পর্কে অ্যাডওয়ার্ড সাঈদের ভাষ্য হচ্ছে: ‘এ একক অদ্ভুত ধরনের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা’। কেননা, ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সত্য ছিলো ফিলিস্তিন বলে কিছু নেই। তাকে মুছে ফেলা হয়েছে; কিন্তু জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্পের মাঝে ফিলিস্তিন ছিলো স্মৃতি, ধারণা এবং রাজনৈতিক ও মানবিক অভিজ্ঞতা হয়ে। যার বিনাশ অসম্ভব; সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের লড়াই এই কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাম্রাজ্যবাদ ফিলিস্তিনের মানচিত্র মুছে ফেলতে এবং তাদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছে; কিন্তু অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সংগ্রামের পথে তারা এগিয়ে চলেছে, যার নেতৃত্বে ইয়াসির আরাফাতের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। কবি তার আহ্বানে উজ্জীবিত হয়েছেন।
আর বক্তৃতা করতে উঠে দাঁড়িয়েই বললো, এই পার্বত্য উপত্যকার
প্রতিটি পাহাড়চূড়ো ও পবিত্র স্তম্ভগুলোর শপথ, শপথ
পবিত্র কাবা তাওয়াফকারী এখানে উপস্থিত প্রতিটি
নর-নারীর। যদি দলবদ্ধভাবে একবার, শুধু একবার। এমনকি
নিরস্ত্রভাবেও একবার। যদি
আমার দেশ প্যালেস্টাইন। শত্রু অধিকৃত একটা শহর। আপনাদের
প্রথম কেবলা। একবার যদি ভাইগণ।
আল কুদসের দিকে মুখ ফেরান, একবার।
হাতে হাত। এহরামের শ্বেতবস্ত্র সেলাইবিহীন। একবার। শুধু
হাঁটতে হাঁটতেও চলে যান। তবে
সামনেই জেরুসালেম, আমার প্রিয়নগরী,
বিজয়।
(মীনার প্রান্তরে ইয়াসির আরাফাত: একচক্ষু হরিণ)
কবি এই মহান নেতার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। হারানো জন্মভূমি ফিরে পাবার লড়াইয়ে দীর্ঘকালব্যাপী সংগ্রামরত একটি জাতির মানসচেতনার সঙ্গে কবি অঙ্গিভূত; তাদের নেতার কণ্ঠস্বর আর কবির কবিতা একাকার হয়ে মিশে গেছে। ইয়াসির আরাফাতের উদাত্ত আহ্বান এবং বিজয়ের ব্যাপারে অকুণ্ঠ আশাবাদে কবি উজ্জীবিত। কারণ কবিও স্বদেশের মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন; অধিকৃত জন্মভূমি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে দীপ্ত ভূমিকা রাখেন। এজন্যে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মুক্তি-সংগ্রামের সঙ্গে কবি একাত্ম হয়ে যান।
অন্যদিকে আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন নয়া সাম্রাজ্যবাদী হামলায় বর্তমান পৃথিবীতে মানবতা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ধর্ম-সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং ইতিহাস পর্যন্ত বিপর্যস্ত। সেজন্যে কবি চরম হতাশা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে একদা পুঁজির শত্র“ রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং জাতিসংঘের তীব্র সমালোচনায় মুখর হন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী এই আগ্রাসী, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশ যে বিশ্বের সমস্ত শান্তি, নিরাপত্তা, প্রেম, শুভবুদ্ধি, স্বপ্ন, কল্যাণ ও সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যে মূর্তিমান হুমকি হয়ে উঠেছে তার বিরুদ্ধে কবিকণ্ঠ দৃঢ়ভাবে উচ্চারিত। এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী একক কাব্য হিসেবে ‘উড়ালকাব্য’ বাংলা কাব্যে অনন্য মাত্রা সংযোজন করেছে। ‘ঈগল থাকবে ইতিহাস থাকবে না’, ‘কানা মামুদের উড়ালকাব্য-১, ৩’, ‘নির্বেক পৃথিবীর ওপর এ কার পতাকা’, ‘এক গুঞ্জরিত কবির আত্মা’ কবিতাবলিতে এই মনোভাব স্বাক্ষরিত। সাম্রাজ্যবাদী এই আগ্রাসন মোকাবেলায় কবি ‘ফিঙে’ কবিতায় ‘ফিঙে’র প্রতীককে ‘ঈগল’ প্রতীকের বিপরীতে স্থাপন করেন। পৃথিবীর আকাশে ঈগল, বাজ ও শকুনের চিরস্থায়ী রাজত্বের বিরুদ্ধে ‘একটি কালো উড়ন্ত প্রতিবাদ’ হলো ফিঙে। কবির কাছে তাই ফিঙে হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্যবাদী জুলুম, খুন, স্বাধীনতা ও মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে ‘একটি সম্বৎসর যুদ্ধের প্রতীকী উড়াল মাত্র’। উপস্থাপনা ও প্রতীকের নতুনত্বে কবিতাটি এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মরণীয়। কবি এইসব যুদ্ধ ও তার প্রতিক্রিয়ায় মানবতার বিনাশ দেখে সামগ্রিকভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন:
এই তো পৃথিবী।
তারা কি জানে কোটি কোটি যুবক যুবতীতে কলরবমুখর
এই গ্রহের প্রতিটি অপেক্ষার স্থানে প্রাণের মিছিল নিয়ে
বসে আছে অফুরন্ত মানুষ, মারমুখী।
হে দাস প্রথার উদ্ভাবনকারীরা, পৃথিবীর সর্বশেষ
যুদ্ধের মীমাংসা আসন্ন
মানুষের ঘূর্ণাবর্তে তোমরা শৃঙ্খলিত
কোথায় পালাবে
অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল মানুষ মুখচ্ছবির
ভিতর থেকে উচ্চারিত হচ্ছে তোমাদের প্রতি ঘৃণা।
(আমি উচ্চারণ করি ঘৃণা: বারদগন্ধী মানুষের দেশ)
যুদ্ধবিরোধী ও মানবতাবাদী কবি যুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে সকল কালের মানুষের সঙ্গে এক সারিতে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্যে সকলের সাথে কবিও প্রস্তুত। তাদের প্রতি সম্মিলিত ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। কেননা যুদ্ধবাদীরা মানুষ-মানবতা-পৃথিবীর শত্রু। কবি তাই তাদের অত্যসন্ন পতন দেখতে পেয়েছেন। এই সাহসী ও প্রতিবাদী ঘোষণার মাধ্যমে কবি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিমান কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন অসামান্য শিল্প সফলতায়।