আলফ্রেড খোকন (২৭ জানুয়ারি, ১৯৭১)এর জন্ম গত শতকের নব্বইয়ের দশকের কবি। ইতোমধ্যে তার হাত ধরে আমরা দেখা পেয়েছি ষোলোটি বইয়ের। যার নয়টি কবিতার। প্রথম কবিতার বই ‘উড়ে যাচ্ছো মেঘ‘। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। এরপরের কবিতার বই ‘সম্ভাব্য রোদ্দুরে’, ‘ফালগুনের ঘটনাবলি’, ‘মধু বৃক্ষ প্রতারণা বিষ’, ‘সে কোথাও নেই’, ‘সাধারণ কবিতা’, ‘চল্লিশ বসন্তে’, ‘দুর্লভার দিন’, ‘মৌন তড়ুই’ এবং ‘নির্বাচিত কবিতা’। এছাড়া, রয়েছে তার গদ্যের বই ‘আলের পাড়ে বৈঠক’, ‘আমার (অ) সাধারণ বন্ধুদের প্রেম’, ‘আত্মগীতের গদ্যভঙ্গি’, ‘নগরে নিবন্ধনহীন’ এবং শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা বই, ‘মনে আসছে যা যা’।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই পাঠকের কাছে পরিচিত নাম আলফ্রেড খোকন। কারণ তার কবিতায় প্রথম থেকেই এমন একটি সুর তিনি নিয়ে এসেছেন, যেন নামটি ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আর গত ত্রিশ বছরে তার সমসাময়িক, সময়ে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেওয়া অনেকেই লেখা থেকে ছুটি নিলেও আলফ্রেড খোকন নেননি। বরং তিনি ক্রমশ নিজের সময়কে ছাপিয়ে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছেন। গত তিন দশকে পরিমাণে অল্প হলেও, নিয়মিতই তিনি তার উপস্থিতি জানান দিয়েছেন। ফলে পাঠক সমাজের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে যায়নি। তিনিও অপরিচয়ের বৃত্তে আবদ্ধ থাকেননি।
আলফ্রেড খোকন নির্ভার কবিতা লিখেছেন। মেদবিহীন কবিতা লিখেছেন। অতিকথন, অতিবর্ণনা, অতিরঞ্জনকে তিনি প্রশ্রয় দেননি।
নিজেকে প্রকাশেরও ক্ষেত্রেও তিনি কোনো দ্বিধা রাখেননি। তিনি সম্ভবনার গল্প বলেন। হতাশা থেকে উঠে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন। আলফ্রেড খোকন বেড়ে উঠেছেন এক অস্থির সময়ের মাঝে, দেখেছেন সময়ের বুকে চাপা দেওয়া পাথর। দেখেছেন নানান শৈথিল্য, যা কি-না বিশ্লেষণের বাইরে এসে নিতে নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছে সকল ঘটনাপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ। মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে সেই রুদ্ধ সময়ের, চেয়েছে সকল দুর্বলতা ঠেলে সরিয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রস্তুতি, লড়াই, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সকল অস্পষ্টতা দূর করতে। আর এর সবই নিঃসন্দেহে প্রভাব রেখেছে আলফ্রেড খোকনের কবিতা। তিনি তার ‘পা’ কবিতায় লেখেন,
আমার পায়ের নীচে কত মৃত পা
মৃত পায়ে কত কত শিড়দাঁড়া, তবু
কোথাও দাঁড়াতে পারি না। পায়ের
ভিতর বাড়ে পথ; ক্লান্ত পথিকেরা
পায়ের ভিতর আরও কতশত পা
প্রান্তরে প্রান্তরে লিখি পায়ের যন্ত্রণা।
আলফ্রেড খোকনের কবিতায় ছড়িয়ে রয়েছে অচরিতার্থ জীবনের হাহাকার। তিনি ঘটন-অঘটনের মাঝে আবেগ আর কল্পনার প্রাচুর্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন ঐশ্বর্য। সেই ঐশ্বর্যের ভেতরে চিন্তা ও প্রতিচিন্তার উপাদানের মধ্য দিয়ে তিনি পাঠককেও তার বেদনার সঙ্গী করেন। ফলে সমব্যথী হয়ে ওঠে পাঠক,
ঠিকানা মোহাম্মদপুর, কাটাসুর লেন
ইতিহাস কী করে জানবে এতসব ঘটনা
দুজন দু’ধারে থাকি;
মাঝখানে অনেক রটনা, এই লেন-ই হাইফেন।
(সম্পর্ক)
বুদ্ধদেব বসু তার ‘লেখার ইস্কুল‘ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘সমস্ত জীবনই লেখকের কাঁচা মাল; কিন্তু জীবন বিশৃঙ্খল ও স্বেচ্ছাচারী, সেই উত্তাল আবর্ত থেকে কোন সময়ে কতুটুকু তিনি নেবেন, এবং কী-ভাবে সেটা ব্যবহার করবেন, তার জন্যে নিজের রুচি ও বিচারবুদ্ধি, তাছাড়া স্বোপার্জিত শিক্ষার উপরেই, তাঁকে নির্ভর করতে হবে। ভাষা ও কলাকৌশলের উপর মোটামুটি দখল না-জন্মালে লেখক হওয়া যাবে না; কিন্তু জীবনকে কে কত ব্যাপক ও গভীরভাবে দেখতে পেরেছেন, এবং তার প্রকাশই বা কতটা সত্য হয়েছে, লেখকের আপেক্ষিক মূল্যের এ-ই হয়তো মানদণ্ড।’ সেই মানদণ্ড যে আলফ্রেড খোকন উৎরে গেছেন, তা তার কাব্যভাষা যেমন, তেমনি কবিতার বিষয়েও স্পষ্ট। তিনি কখনোই নির্বিকার ভূমিকা, দর্শকের ভূমিকা পালন করেন না। যত ক্ষুদ্রক্ষরই হোক, যতো নির্মোহভাবেই সাধারণের, মধ্যবিত্ত অনুভূতিকে খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে তুলতে চান। প্রকৃতই সুনজরে আনতে চান তার নিজস্ব উপলব্ধিকে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে হাজির করছি, তার কবিতা ‘কোন এক হেমন্তে নোটবুক থেকে’,
একজন মা’কে দেখলাম গতকাল
নারীর মত শুয়ে আছে সংসদ ভবনের গাছতলায়
বকুল গাছ না কি যেন;
তার বুকের একপাট স্তনে
দুধের বাচ্চাটা চোখ বুজে পান করছে জীবন
মায়ের আরেকটি স্তন রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা চাইছে।
(কোন এক হেমন্তে নোটবুক থেকে)
আলফ্রেড খোকন তার কবিতায় বরাবরই কিছু দৃশ্য উপস্থাপন করেন। সেই দৃশ্যে থাকে চিত্রময়তা, থাকে কল্পনাও। দৃশ্যকে যখন তিনি একটি নতুন ভঙ্গি দেন, দৃশ্যের ভেতরে থেকে আরও একটি দৃশ্যকে যখন আলাদাভাবে দেখিয়ে দিতে চান, তখন সেখানে উপস্থিত হয় দার্শনিকতাও। নব্বইয়ের দশকের কবিতায়, জীবনের যান্ত্রিকতা এবং জটিল গোলকধাঁধা থেকে অবসাদ ছুঁয়ে গেছে। সেই ছুঁয়ে যাওয়া অবসাদের প্ররোচনায় এ দশকের অনেকেই তাদের কবিতায় প্রশ্রয় দিয়েছেন অবসাদ। কিন্তু আলফ্রেড খোকনা কবিতায় অবসাদকে অনুসরণ করনেনি। তিনি দুঃখজাত উপলব্ধিকে শক্তিতে রূপান্তর করেছেন। নেতিকে ইতির কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। সেখানে যে বোধের উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তাকে উপেক্ষা করা যায় না। তাকে এলোমেলো উপস্থাপন হিসেবেও দেখানোর সুযোগ নেই। বরং বিষণ্ন পরিবেশকেও শব্দের পারঙ্গমতা আর হৃদয়িক উপলব্ধির গাঁথুনিতে তিনি ভিন্ন মাত্রা দেন।
টুকরো টুকরো ঘটনা, টুকরো টুকরো দৃশ্যকে বারবার তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, সেইসব দৃশ্যের সমন্বয়ে তৈরি হয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কবিতা। অস্থিরতা এবং চারপাশে ছড়িয়ে থাকা উপাদানকে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আলফ্রেড খোকন যে পরিবেশ নির্মাণ করেন, তা কোনো কৌশল নয়। তিনি শব্দকে শুধু তার অর্থের খাতিরেই প্রকাশ করেন না। শব্দের ভেতরের অর্ন্তহিত অর্থও চমকপ্রদ হয়ে ধরা দেয় পাঠকের মনে। তার কবিতার অর্থউদ্ধারে পাঠককে বিচলিত হতে হয় না, তার কবিতা না বোঝার মতো দূরূহ অবস্থাও তৈরি করে না। বরং তার কবিতা পাঠককে ভাবনার খোরাক দেয়। অভিভূত ও আলোড়িত করে।
নানামুখী বিচার ও বিশ্লেষণ এবং গতিমুখের উৎসসন্ধানের পরেও শেষ বিবেচনায় পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নেবার মধ্য দিয়েই কবি পরিণতি পান, দেখা পান স্থায়ীত্বের। এই পথ তৈরিতে প্রত্যেককেই বেছে নিতে হয় শব্দ। শব্দই এক্ষেত্রে ব্রহ্মাস্ত্র। এই অস্ত্রকেই নানাভাবে, নানারূপে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কবি তার নিজস্ব পথ তৈরি করেন, পাঠক হৃদয়ে কিউপিডের মতো তীর বিদ্ধ করেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কবি হিসেবে আলফ্রেড খোকন কি রোমান্টিক? প্রশ্নটিকে যদি আমরা রোমান্টিকতার আর্থরিক অর্থে বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, রোমান্টিকতার যে মূল প্রতিপাদ্য যুক্তিহীনতা, কল্পনা, স্বতঃস্ফূর্ততা, আবেগ এবং দৃষ্টিভঙ্গির স্বতন্ত্রতা, যেখানে বলা হয়, এ ধারার সাহিত্যে সাদা খাতা সামনে রেখে মনে যা আসে তা-ই লিখে রাখা যায়। তাহলে কিন্তু আলফ্রেড খোকনের পাঠক একবাক্যে স্বীকার করবেন, তিনি যুক্তিহীন শুধু কল্পনানির্ভর সাহিত্য করেননি। তিনি রোমান্টিক নন। বরং আলফ্রেড খোকন সাহিত্যের উৎস হিসেবে অবেচতন মনের চেয়ে চেতন মনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তার কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে জীবনের রূঢ় দিকগুলো। তিনি প্রতিবাদও করেন সকল কুশ্রীতার বিরুদ্ধে। তবে হ্যা, তিনি কবিতাকে সরাসরি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেননি। কবিতাকে আক্রমণাত্মক করে তোলেননি। তিনি ব্যক্তির সংকটকে যেমন তেমনি সামাজিক সংকটকেও সামানে নিয়ে এসেছেন, তবে এক্ষেত্রেও রয়েছে তার নিজস্ব ভঙ্গি। তারও রয়েছে নিজস্ব দায়বোধ,
তখন কস্তুরীঘ্রাণে আসে দু’হাজার দুই সন
আমাদের কেউ ঝর্ণা কেউ চূড়াপ্রার্থী মন;
গাছপালাদের ধূসর দুঃখসমেত
তোমার বাড়ি থেকে আরেকটু অজানার দিকে
এক বিরাট স্তব্ধ ধানক্ষেত,
নুয়ে পড়ে দেখছিল নিঃশব্দতার বিরল ব্যাপার
তোমার গল্প করে একখণ্ড মেঘের মত
সরল বৃষ্টিপাত কেনার আগে
তাদের প্রত্যেকের জন্য জরুরি ছিল অথবা গরমভাত
তারা জানতো; তোমার গল্পের ক্ষেত্রে আমি এক দুর্বলচরিত্র
ক্রমশ নুয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করি, ‘তারপর’?
এমন গল্পের পরে পৃথিবীতে চিরকাল সন্ধ্যা নেমে আসে
কাহিনী অসমাপ্ত রেখে বাড়ি ফেরে ডোরাকাটা প্রেম
আবারও সম্ভাব্য দিন ধার্য করি;
এই হচ্ছে পদ্মার পাড়ে জ্যোৎস্নাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
তৃতীয়জন জানতে চাইল, ‘এর মধ্যে ভাঙন কোথায়,
কোথায়ই বা পদ্মার পাড়?’
আমি শুধু টের পাই নিঃশব্দতা একটি বিরল ব্যাপার।
(একটি বিরল ব্যাপার)
আমাদের পারিপার্শ্বিকতা, আমাদের দৈনন্দিন জীবন, আমাদের আটপৌরে সাধারণ সাদামাটা জীবন, আমাদের এড়িয়ে থাকার প্রবণতা, আমাদের লুকিয়ে রাখার প্রবণতা, চোখ বন্ধ করে থাকার বিপরীতে আলফ্রেড খোকন খুব স্বচ্ছন্দ্যে চড়া সুরকে এড়িয়ে সম্পূর্ণরূপে নিজের করেই বলার ভঙ্গিটি রপ্ত করেছেন। যেখানে রয়েছে তার স্বাতন্ত্র্য, রয়েছে তার নিজস্ব স্বর ও রূপ। অনুকরণকে এড়িয়ে তিনি সময়কে ধরতে চেয়েছেন সময়ের ভেতরে থেকেই। সময়, সমাজ ও প্রতিবেশকে তিনি এড়িয়ে যেতে চাননি। আধুনিকতা শব্দটির মোহে ভুলে থাকতে চাননি নিজের উপলব্ধিকে। ভুলিয়ে ভালিয়ে পাঠকের হাতে শুধু কল্পনা-আশ্রিত শব্দরাজি তুলে দিতে চাননি। আর এই না চাওয়া থেকেই তিনি সমসাময়িকদের থেকে নিজেকে আলাদা করে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। উত্তেজনাকে বশ করে, শুধু বিষয়কে অবলম্বন করেই তিনি প্রতিবাদ করেছেন, যেখানে শক্তির অপব্যয় হয়নি। বরং পাঠক দেখেছে কবিতা ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের অপূর্ব সমন্বয়।
আমি ও তুমি মিলে এই সন্ধ্যার কুয়াশা
দ্রুততম বিএমডব্লিউ বাপাশ দিয়ে উড়ে গেল
বাংলামোটর মোড়ে
এলোমেলো হলো আমার রিকশার ভাষা
পথ তো সুদূর
প্রত্যেকেরই যেতে হবে আরও
কিছুটা দূর;
তুমি, আমি ও আশা
সুদূর পথের মত
প্রতিদিন খুঁজেছি তার ভাষা
যেমন শেখা হয়নি আজও পাখিদের গান
যেমন সারাদিন তোমার সঙ্গে থেকেও
পৃথক পালঙ্কে ঘুমিয়েছি আমরা দুজন
আমিও তুমি মিলে গাঢ় হল প্রেম
দুজন দুদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর
অন্ধকারের হাত ধরে যা ছুঁয়েছি তাতেই
(ট্যাবু ও টোটেম)
কাব্যের লক্ষ্য এক, তার গতিপথও একমুখী। সেই পথ-পাঠকের কাছে পৌঁছানো। পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া। নানামুখী বিচার ও বিশ্লেষণ এবং গতিমুখের উৎসসন্ধানের পরেও শেষ বিবেচনায় পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নেবার মধ্য দিয়েই কবি পরিণতি পান, দেখা পান স্থায়ীত্বের। এই পথ তৈরিতে প্রত্যেককেই বেছে নিতে হয় শব্দ। শব্দই এক্ষেত্রে ব্রহ্মাস্ত্র। এই অস্ত্রকেই নানাভাবে, নানারূপে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কবি তার নিজস্ব পথ তৈরি করেন, পাঠক হৃদয়ে কিউপিডের মতো তীর বিদ্ধ করেন। সে তীরে থাকে অলঙ্কার, ছন্দ। থাকে উপমা, উৎপ্রেক্ষাসহ নানান সাজসজ্জা। তারও উদ্দেশ্য এক, পাঠকের হৃদয় জয় করা। এইসব নানা অস্ত্রের সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে নিজস্ব পথ ও স্বর তৈরিরও উদ্দেশ্য, শেষ লক্ষ্য পাঠক। আলফ্রেড খোকন সেই লক্ষ্য থেকে কখনোই সরে যাননি। শব্দ, ছন্দ এবং অলঙ্কারে তার ছুড়ে দেওয়া ব্রহ্মাস্ত্র আমাদের মনকে আলোড়িত করে, অভিভূত করে।