কবিতা লেখাকে একটি সংগ্রাম হিসেবে মনে করি, তাই কবিমাত্রই সংগ্রামরত। একদিকে কবি তাঁর নিজের বোধ ও দর্শনকে সংহত করেন, অন্যদিকে সমাজের অন্যান্য মানুষের রুচি ও মনোভাব লেখার প্রশ্রয়ে সূক্ষ্মভাবে তা নিমার্ণ করেন। এ এক মিথস্ক্রিয়া: গ্রহণ ও বর্জন, নেওয়া ও দেওয়া, অপূর্ণ ও পূর্ণতায়। কবিতার জন্য শৈশব থেকে একাগ্র ও নিবেদিত থেকেছি। কিশোর বয়স থেকেই নিয়মিত লিখছি। শুধুই লেখার জন্য আত্মপ্রতিষ্ঠার ভিন্ন পথে যেতে পারিনি; এজন্য কোনো হতাশাবোধ নেই—আমার। এজন্য অনেক কিছুকে জীবনে সম্পাদনা করেছি। লেখার মূলধারায় নিজেকে স্থাপন করার জন্য কবিতা লেখাকে জীবনের মূল কাজ হিসেবে বিবেচনা করে এসেছি।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অন্যান্য পঠন-পাঠন ও সামাজিক বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি; এর ফলে আমার ভেতর যে বোধ রয়েছে—তা কবিতার মধ্যে দিয়ে পাঠকের বোধের মধ্যে সঞ্চারিত করতে লিখি। কবিতা নিছক আনন্দের বিষয় নয়, চৈতন্যের বহু স্তর উন্মোচিত করে। জীবনের খণ্ডখণ্ড অনুভূতির মধ্য দিয়ে জীবনের তাৎপর্য কবিতায় উন্মুক্ত করতে পারি—সেজন্যও লিখি। কবিতা মানুষকে ভাবায়, ভাবতে শেখায়, জাগিয়ে তোলে, কৌতূহল সৃষ্টি করে। কবিতা সমকালের হয়েও আগামীকালের ও চিরকালের হয়ে উঠতে পারে। ভালো কবিতার শিল্প-সৌন্দর্য স্বতঃস্ফূর্ত ও আনন্দময় অনুভূতির জন্ম দেয়। এজন্য আরও লিখি—কবি অগ্রজ্ঞান নিয়ে অগ্রগামী থাকেন, এই মর্যাদায় কবির যে দায় রয়েছে—তা পালনের জন্যও লিখি। নিছক আত্মসর্বস্ব সুখকে গুরুত্ব না দিয়ে জীবনবোধের প্রেষণায় লিখি। কবিতা লিখে যে আনন্দ, স্বাধীনতা, স্পর্ধা ও জীবনের বিভিন্ন দিক সূক্ষ্মভাবে উন্মোচনের যে অধিকার পাই, তা আর অন্য কাজে পাই না; তাই লিখি। যা কিছু অনৈতিক, অন্যায়, নৈরাজ্যপূর্ণ ও নেতিবাচকতা—তার বিরুদ্ধে এক ধরনের নিজের বিবেচনাবোধ তুলে ধরার জন্য মানুষের কণ্ঠলগ্ন হয়ে লিখি। মানুষের চেতনা ও ভাবজগৎ ছুঁয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এক ধরনের অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে লিখি। এজন্য নিজেকেও রূপান্তর করি—লেখাকেও রূপান্তরিত করি।
লিখছি তিন দশকের অধিককাল। কবিতা ছাপা হয়েছে অনেক। ছাপা হয়েছে সকল উল্লেখযোগ্য পত্রিকা-সাময়িকীতে এবং উল্লেখযোগ্য সম্পাদকের হাত দিয়েই। অনেক উল্লেখযোগ্য সংকলনেও আমার কবিতা গ্রহণ করা হয়েছে। এসবও একদিক থেকে অর্জন বলে আমি মনে করি। তবে, আরো ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বহুরৈখিকভাবে আমার অর্জন বা ব্যর্থতা কতটুকু—তা মূল্যায়ন করবেন পাঠক-সমালোচক ও অন্যরা। তবে নিজের প্রতি সমালোচনা রয়েছে ও বিচার-বিবেচনাও রয়েছে, তা এক ধরনের আত্মসমীক্ষাও বলা যেতে পারে। যত কবিতা লিখেছি—বিভিন্ন বিষয়ে ও বিভিন্ন নিরীক্ষাসমেত লিখেছি; তা সমালোচক ও অন্যদের কাছে সেভাবে উপস্থিত বা তাঁদের চোখে পড়েনি। সে কারণে সেভাবে মূল্যায়িত হইনি। এজন্য অপেক্ষা করা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, সকল প্রকৃত কবিকেই অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষার জন্য কঠিন নীরবতা সহ্য করা প্রকৃত কবির জন্য শ্রেয়। আমার ব্যর্থতা কী, আর কতটুকু তা বিভিন্নভাবে নিজের কাছে মূল্যায়ন করি। নিজের কড়া সমালোচক নিজের কাছে হতেই হয়। আমার অতৃপ্তি আছে; এখনো কাঙ্ক্ষিত কবিতা লিখতে পারিনি, তা লিখতে এখনো সচল আছি।
অধিভুক্ত হই আবারও মুক্তিযুদ্ধে ।। গোলাম কিবরিয়া পিনু
এই এক দেশ—যেখানে রক্তাক্ত হাইড্রোজেনের ভেতর
মেঘজমাট বেঁধে সৃষ্টি হয়েছিল
. —এক চন্দ্রধারা
সেই চন্দ্রধারার নামই দেদীপ্যমান মুক্তিযুদ্ধ।
সৃষ্টির সময়ে ছিল
. এক একেকটি আগুনের গোলক
. যার সমবেত নাম বিদ্রোহী-জনতা
যেন এক আগ্নেয়গিরির যাদুঘর
টকবক হয়ে ফুটেছিল—দিগন্তরেখায়
. উড়ছিল ধোঁয়ার কুণ্ডুলি
. ঘনমেঘ—নীরদপুঞ্জ
. কুড়–লে মেঘ—আঁধিঝড়
তার মধ্যে থেকে উপচে উঠলো আমাদের স্বপ্নভূমি !বিস্ময়কর রাসায়নিক মিশ্রণে
. মরিয়া হয়ে উঠেছিল জনগণ
পাথরখণ্ডে সপ্তমুখী জবা ফুটলো
অসীম সাহসে—
. একেকটি বরফের চাঁই গলে গলে
. ফল্গুধারা তৈরি হলো !রঙের ভিন্নতা ছিল না—
শরীরের যেকোনো স্থানে—মুখমণ্ডল, গলা, কাঁধ
. হাত, পা, বুক অথবা পিঠে
সকল ধমনিতে একই রক্তের ধারা প্রবাহিত হয়েছিল
মস্তিষ্কের নিউরণে একই বাদ্যের দ্রিমি-দ্রিমি তাল ছিল
. আমাদের দৃষ্টিহীনতা ছিল না
এমন কি আমরা একচক্ষু হরিণও ছিলাম না
. আমাদের রক্ত জমাট বাঁধেনি
বিপন্ন সময়ে আমরা পরস্পর থেকে দূরে সরে থাকেনি
. —শিরদাঁড়া উঁচু ছিল
আমাদের ছিল না পতঙ্গ-পতন !রক্তক্ষরণের মধ্যে দিয়েও রক্তের প্রবহমানতা
. —আন্তঃনদী হয়ে জেগেছিল !
হৃদয়তন্ত্র কোন্ মন্ত্র নিয়ে জেগে উঠেছিল সেদিন ?
আমাদের কাঙ্ক্ষিতত আকাঙ্ক্ষা ছিল—
পরাধীনতার শৃংখলে—পরশাসিত থাকবো না
. বশংবদ থাকবো না
দাসানুদাস হয়ে—পরনির্ভর থাকবো না
মেহনতি, শ্রমজীবী, কৃষিজীবীর ইশতেহার নিয়ে
শোষকশ্রেণির কব্জা থেকে বের হয়ে
. —নিজের চারণভূমিতে
বৈষম্যহীন অবস্থায় সংহত হয়ে বেঁচে থাকবো !অহিংস পথ দিয়ে আমরা যেতে চেয়েছিলাম
তবে সে পথে যেতে পারিনি—
রক্তাক্ত যুদ্ধের পথেই যেতে হয়েছিল !
ক্ষমতালোভী, সমরবণিক, যুদ্ধবাজ, ধর্মান্ধ-কালজ্ঞ শক্তি
ও সামাজ্যবাদ—
. সোনার খাঁচায় আমাদের আটকে রাখতে পারেনি
আমরা হয়েছিলাম বালিহাঁস
. ডাকপাখি
. নীলকণ্ঠ
. সোনাচড়াই !বীতরাগ থেকে
নিস্পৃহতা ভেঙে আমরা জেগে উঠেছিলাম,
দ্বিধাহীনতা থেকে
অকুণ্ঠচিত্তে গীতি-নৃত্যে জেগে উঠেছিলাম,
মায়ামুগ্ধ থেকে
নিজের কোকিল সুরে জেগে উঠেছিলাম,
মনস্তাপ থেকে
ধ্যানমগ্ন হয়ে জেগে উঠেছিলাম,
ভয়গ্রস্ত থেকে
দুঃসাহসে জেগে উঠেছিলাম,
শোকবিহ্বল থেকে
প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে জেগে উঠেছিলাম!
আর এখন—
আমরা কোন্ বিনষ্টির মধ্যে ?
আর এখন—
আমরা কোন্ কপটভাষ্যের মধ্যে ?
আর এখন—
আমরা কোন্ স্বভাবদোষের মধ্যে ?আর এখন—
আমরা কোন্ অশ্রুলোচনের মধ্যে ?
আমাদের অলোকসামান্য মুক্তিযুদ্ধ
আমাদের দেদীপ্যমান মুক্তিযুদ্ধ
. ম্রিয়মান হয়ে যাবে ?
. হারাবে তার স্বভাব-সৌন্দর্য
. হারাবে তার উজ্জ্বলন
. ও আকাশদিউটি !যারফলে আমাদের দৃষ্টি জ্বালানোর পিলসুজ পর্যন্ত থাকবে না ?
. এত অকুঞ্চিত অন্ধকার
. এত ছায়া-প্রচ্ছায়া
. এত অন্ধকূপ
ধূপ জ্বালানোর লতাগৃহ নেই—
. রাত্রি নামে—তমসাবৃত দিন !চলো—অধিভুক্ত হই আবারও মুক্তিযুদ্ধে
চলো—কুণ্ঠামুক্ত হই আবারও মুক্তিযুদ্ধে
চলো—নবাঙ্কুর হই আবারও মুক্তিযুদ্ধে
চলো—প্রসববন্ধন হই আবারও মুক্তিযুদ্ধে।
আশির দশকের কবি হিসেবে আমি চিহ্নিত হলেও এই দশকের কবি হিসেবে বিশেষ কী ধরনের বৈশিষ্ট্য উচ্চকিত কিংবা উজ্জ্বল; তা পাঠক-সমালোচকরা বিবেচনা করবেন বা করে থাকেন। তবে আমি কবি হিসেবে বহু ধরনের কবিতা লিখেছি এবং সেগুলো বিভিন্ন নিরীক্ষাপ্রবণতায় সংশ্লিষ্ট বলে মনে করি। এক ধরনের সরলতা ও রাজনীতি সচেতনতা আমার কিছু কবিতায় থাকলেও তা কবিতার শিল্পশর্ত বা প্রাণ ক্ষুণ্ন করেনি। কবিতা বহুবিধ শৈলীর সমন্বয়ে অভিজ্ঞতা-অনুভূতি-আবেগ নিয়ে প্রাণ পায়। আর সেজন্য কবি মাত্রই জানেন—ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর বহুবিধ অলঙ্কারের তাৎপর্য। আমিও তা অনুসরণ করি।
সমকালীন কি না, তা জানি না; তবে আমার কবিতায় জীবন আছে, সমাজ আছে, প্রকৃতি আছে, মানুষ আছে, দেশ-সময়কাল আছে এবং আছে প্রতীকের ব্যঞ্জনাও। আছে রূপক, আছে ছন্দের বিভিন্নমুখী ব্যবহার, অনুপ্রাসের নতুনমাত্রা, মিলবিন্যাসের নীরিক্ষা ও অন্যান্য সূক্ষ্ম কারুকাজ। একেক কাব্যগ্রন্থ একেক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জ্বল বলে আমি মনে করি। প্রথম কবিতার বই ‘এখন সাইরেন বাজানোর সময়’ থেকে ‘সূর্য পুড়ে গেল’ কিংবা ‘কে কাকে পৌঁছে দেবে দিনাজপুরে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার বিষয়-আঙ্গিক ও বোধের জায়গা বদলিয়েছে, আবার ‘আমরা জোংরাখোটা’ কাব্যগ্রন্থ পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। ‘সুধা সমুদ্র’ কাব্যগ্রন্থ লেখা হয়েছে মানুষের অন্তর্গত জীবন ও প্রবণতা নিয়ে, যেখানে প্রেম ভিন্নমাত্রা ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর হয়ে ধরা দিয়েছে। ‘ও বৃষ্টিধারা ও বারিপাত’ পুরো কাব্যগ্রন্থটি বর্ষা-বৃষ্টি-প্রকৃতির অনুসঙ্গ ভিন্ন আঙ্গিকে ও ছন্দে ভিন্ন ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘উদরপূর্তিতে নদীও মরে যাচ্ছে’ কাব্যগ্রন্থটি পূর্বের কাব্যগ্রন্থগুলো থেকে পুরো আলাদা, ভিন্ন আঙ্গিক ও ভিন্ন বিষয়-চেতনার ভিত্তিতে সচেতনভাবে লেখা হয়েছে। ‘ফুসলানো অন্ধকার’ নামের কাব্যগ্রন্থে রয়েছে বেশ ক’টি দীর্ঘ কবিতাসহ ভিন্নধারার কবিতা। ২০১৫ সালে বের হয়েছে ‘নিরঙ্কুশ ভালোবাসা বলে কিছু নেই’ কাব্যগ্রন্থটি, এই কাব্যগ্রন্থে রয়েছে ব্যক্তি অনুভবের বিভিন্ন মাত্রার কবিতা। ২০১৬ তে বের হয়েছে—‘কবন্ধ পুতুল নাচে’ কবিতার বইটি। এই বইতে বর্তমান সময়ের বিবেকতাড়িত উচ্চারণ রয়েছে। ইতোমধ্যে ১৫টি কাব্যগ্রন্থ বের হয়েছে। উল্লিখিত কাব্যগ্রন্থসমূহের অবস্থান নিয়ে বলব, সচেতনভাবেই আমার কাব্যপথ চলা বিভিন্ন সময়ে বাঁক নিয়েছে; একরৈখিক থাকেনি, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়েই সম্মুখবর্তী হয়েছে। আমার কাব্যের মানচিত্রটি হয়তো কারও চোখে পুরো দৃশ্যমান নয়, হয়তো কারও চোখে খণ্ডিতভাবে ধরা দিয়েছে, হয়তো কারও চোখে হঠাৎ এক দৃশ্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে; সেইসব কারণে সরলরৈখিকভাবে কেউ কেউ আমাকে টেনে নিয়ে কোনো এক ঘরে বসিয়ে এক ধরনের পোশাক পরিয়ে রাখতে চান—তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত ভেবে দেখার বিষয়! একজন কবিতার পাঠক ও কবি হিসেবে আমার কবিতার প্রতি আমারও মূল্যায়ন রয়েছে, পর্যবেক্ষণ রয়েছে; ঠিক তেমনি অন্য কবি ও কবিতার প্রতিও। তুলনামূলক বিবেচনা আছে বলেই আমি জানি আমার কবিতা কোনখানে দাঁড়িয়ে আছে। আরও জানি আমার কবিতার নিজস্ব শক্তি কী? কতটা ব্যতিক্রম ও বহুবর্ণিল। তা হয়তো অনেকের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েনি।
এখন কেন পুড়ে যাচ্ছি ।। গোলাম কিবরিয়া পিনু
এত সহজে পুড়ে যাচ্ছি !
এতটা আজ—দহনযোগ্য ?
এত সহজে পুড়ে যাচ্ছি !
এতটা আজ—সহজদাহ্য ?আগুনতাপে পুড়ে যাচ্ছি
তুষআগুনে পুড়ে যাচ্ছি
ছাইআগুনে পুড়ে যাচ্ছি
বনআগুনে পুড়িনি
বজ্রপাতে পুড়িনি
তড়িৎকোষে পুড়িনি
গ্যাসআগুনে পুড়িনি
এখন কেন পুড়ে যাচ্ছি ?
এখন কেন পুড়ে যাচ্ছি ?আগে ছিলাম আলোকশক্তি
আগে ছিলাম সূর্যশক্তি
আগে ছিলাম বিদ্যুৎশক্তি
এখন কেন পুড়ে যাচ্ছি ?
এখন কেন পুড়ে যাচ্ছি ?
অধঃপতনে শেষসীমায়
ছোবড়া কিবা খড়ের প্রাণ ?
পুড়ে যাচ্ছি !সাহস নেই বুকের মাঝে
তালপাতার রোগা-সেপাই ?
পুড়ে যাচ্ছি !
নিজের ভর হারিয়ে ফেলে
শিমুল-তুলো উড়ে বেড়াই ?
পুড়ে যাচ্ছি !উদাসীনতা আপন ভোলা
লাইলনের সুতো কাপড় ?
পুড়ে যাচ্ছি !
জোড়াতালিতে পথ পাই না
তুলট কিবা ছেঁড়া কাগজ ?
পুড়ে যাচ্ছি !আগে ছিলাম ইউরেনিয়াম
আগে ছিলাম প্লুটোনিয়াম
আগে ছিলাম অনির্বাণ
এখন কেন পুড়ে যাচ্ছি ?
এখন কেন পুড়ে যাচ্ছি ?
এখন কেন পুড়ে যাচ্ছি ?
এখন কেন পুড়ে যাচ্ছি ?
আমার সব কবিতাতে ‘রাজনীতি’ আসেনি, তবে ‘রাজনীতি’ খুব সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে কবিতার আলোচনার ক্ষেত্রে অনেক সময়। রাজনীতি সচেতনতা ও রাজনীতি কবিতায় আসা দোষের নয়, বরং আধুনিক কবির জন্য তা এক অপরিহার্য বিষয়ও। আমার কবিতায় ভৌগোলিক-সামাজিক এবং জীবন বাস্তবতার অনুরণন অনুভব করা যায় তা ঠিক, পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনের বহুবিধ অনুষঙ্গ ও মূর্তমান বহুবিধ ছবিও আমার কবিতায় পাওয়া যায়; বরং এক্ষেত্রে সরলকথন নেই। আমার কবিতায় আধুনিক জীবনদৃষ্টিভঙ্গির রসায়নে জীবন-জিজ্ঞাসা, নৈতিকতা-দর্শন, কাক্সিক্ষত জীবনের স্বপ্ন, মানব-মানবীর সম্পর্ক ও ব্যক্তিজীবনের অন্তর্গূঢ় বিষয়াদি এসেছে বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে আমার কবিতার প্রতি আরো মনোযোগ দিলে ও বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতার কাছে গেলে আমার এই বক্তব্যের সমর্থন মিলবে। খুব ভাসা-ভাসাভাবে আমার কবিতাকে স্পর্শ করলে তা হয়তো বোঝা যাবে না; অনুসন্ধানমূলক দৃষ্টিতে আমার কবিতা স্পর্শ করলে তা হয়ে উঠতে পারে বহু বর্ণের ছবি, ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যজাত কাব্যরূপের দিগন্ত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা লিখেছি, অগ্রসর চিন্তাকে কবিতায় টেনে এনেছি, কবিতায় মধ্যযুগীয় সংকীর্ণ জীবন-দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করেছি, দেশ ও কালকে ধারণ করার চেষ্টা করেছি; এসব কারণে যদি ‘রাজনীতি’ নামের তকমা সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হয়, তাহলে বলার কিছু নেই। প্রচলিত কাব্যালোচনা পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়, আর এ কারণে সহজেই একেক কবিকে একেক প্রচলিত ছকে বেঁধে চিহ্নিত করার পথ; শর্টকাট পথ বলেই তা মনে হয়। কারো বৈঠকী সংকীর্ণ উদ্দেশ্যমূলক কথা কখনো কখনো আমরা ধরে নিয়ে, কারও কারও সম্পর্কে মূল্যায়ন করি। এদেশে অনেক ক্ষেত্রে আড্ডা আর বিভিন্নজনের কথা চালাচালির মধ্যে দিয়ে কবির ইমেজ তৈরি হতে দেখা যায়। আবার কেউ কেউ কৌশলে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মিডিয়া নির্ভর প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে কবির ইমেজ বাড়ান বা ক্ষুণ্ন করেন। এসব প্রবণতা আছে বা থাকবে। তবে, প্রকৃত কবিকে এ সবের মুখোমুখি হয়ে বিচলিত হলে চলবে না। প্রকৃত কবি ও কবিতার জন্য আরও মনোযোগ, অনুসন্ধান ও আবিষ্কারের উদ্যোগ সবসময়ের জন্য দাবি করে।
আমি কত ধরনের কবিতা লিখেছি—কত বিষয়ের ওপর। ব্যক্তির বিভিন্ন দিক আমার কবিতায় যেমন উন্মোচিত হয়েছে, তেমনি সমাজের বিভিন্ন অনুসঙ্গ ও অনুরণন বহুভাবে ধরা পড়েছে। প্রকৃতি এসেছে, মানুষের সম্পর্কজাত টানাপড়েন-ভালোবাসা-স্বপ্ন সেগুলোও এসেছে। আর জীবনের বহুবিধ জিজ্ঞাসা ও প্রতিক্রিয়া আমার কবিতায় মূর্ত হয়েছে, বিভিন্ন বোধের বিভিন্ন রূপসৌন্দর্য কবিতায় ধারণ করতে পেরেছি বলে আমার মনে হয়। একেক কবিতার বইয়ে একেক বৈশিষ্ট্য এবং আঙ্গিক-বৈচিত্র্য সম্পর্কিত হয়েছে।
অনুপ্রভা ।। গোলাম কিবরিয়া পিনু
অনুপ্রভা তোমার কি দহনক্ষমতা
এখনও আছে? গাছে তোমার কী পুষ্প?
আগুন লাগানো অগ্নিপাত্র
ধরেছিলে কাছে! পাছে পুড়ি—ভয় ছিল!ছাই-ভস্ম হয়ে খাক হব
হইনি তখনো! এখনো জ্বলছি তোমার উনুনে!
এখনো বিদ্যুৎবাহী তুমি? বাজপড়েও—
কিবা বজ্রপাতে—রাতে পুড়ে ছাই হওনি?ইলেকট্রিক-শক নিয়েও আমি আছি
দূরে-ভগ্নস্তূপে। কূপে পড়ে নিবু নই।
বিদ্যুল্লতায় আবারও
সামনের শীতে। নিতে চায় দ্যাখো বিদ্যুতের পরিবাহী প্রাণ।
আমাকে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি—হয়েছে যৎসামান্য; আমিও তা স্বীকার করি। আমার অর্জনের সামান্যই তা স্পর্শ করেছে; তাও ঠিক। তবে আমি আলোচনার দিকে না তাকিয়ে থেকে নিবেদিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। তা সমালোচক বা অন্যের দ্বারা মূল্যায়ন হোক বা না হোক; সেদিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করিনি। তবে, কারও কারও অভিমত পাই, পাঠকেরও প্রতিক্রিয়া পাই কবিতা লিখে, তাতে এক ধরনের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পাই। সেটাও কম না। আর কিছু কবিতাপ্রেমিক নিজ উদ্যোগে আমার কবিতার আলোচনাও করেছেন, বইয়েরও। তাঁদের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তবে, আলোচনা কম হওয়ার জন্য বেদনা হয়তো আছে, কিন্তু মর্মাহত হইনি; মুষড়ে পড়িনি কখনো। আমিও আমার পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা থেকে জানি এবং বুঝি—প্রকৃত কবির কবিতা এক সময়ে আলোচনায় আসবে, হয়তো বা তা দেরিতে। আমি এজন্য খুব ভাবিত হইনি। এমনিতে এদেশে কবিতার সমালোচকের অভাব, তার মধ্যে সৎ-সমালোচকের আরও অভাব। শুধু কবিতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে নৈর্ব্যক্তিকভাবে আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার বিষয়টি এখনো অনেক কম। এসব জেনেও আমি আশাবাদী। আমি আমার সম্মান খুইয়ে আত্মমর্যাদা বন্ধক রেখে কখনো কাউকে দিয়ে আমার কবিতা বা সাহিত্য নিয়ে আলোচনার জন্য উদগ্রীব হই নি, কিংবা এমন কোনো কূটকৌশলের উদ্যোগ গ্রহণ করিনি। তবে সবসময়ে ভেবেছি লেখাটা কবির মুখ্য হওয়া উচিত। প্রকৃত সমালোচকরা কবিকে আবিষ্কার করেন, কবিকে চিহ্নিত করেন, টেনে তোলেন কবিকে অন্ধকূপ থেকে, দেদীপ্যমান করেন নতুন আলোয়। অন্য কোনো ব্যক্তিলোভে আর সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হিসাবে ‘তথাকথিত সমালোচনা’ ব্যবহার করেন না, কোনো সৎ-সমালোচক। উদ্যোগী ও সৎ-সমালোচক, সম্পাদক আমাদের মধ্যেই আছেন বলেই আমরা বহুদিন হলো সাহিত্যচর্চা করে আসতে পেরেছি, এই প্রতীতি আগেও ছিল, এখনো আছে। আমি মনে করি, আবিষ্কারমূলক প্রণোদনায় আলোচক-সমালোচক যতই এগিয়ে আসবেন ততই রুদ্ধদ্বার খুলবে ও কৃত্রিম পরিখাও ভেঙে পড়বে।
এই প্রসঙ্গে বলতে চাই—বাংলা কবিতা শুধু নয়, বিশ্বের অন্যান্য ভাষার কবিতাও ধারাবাহিকতা নিয়ে উজ্জ্বল হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা প্রবহমানেরই নামান্তর। কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর পরিধি বেড়েছে, তবে তার মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক ও সাযুজ্য থেকেই যায়। মানুষের জীবনও চলছে চেতনার প্রবাহ নিয়ে, এ প্রবাহ বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন পরিধিতে ব্যপ্তি লাভ করলেও অনেক ধারণা, কাল পরিবর্তনের পরও একই থেকে যায়। কবিতার ক্ষেত্রেও এ ধরনের অপরিবর্তনীয় বিষয় ও শিল্পশর্ত লক্ষণীয়। যদি বলি, চর্যাপদ থেকে বাংলা কবিতার যে বিকাশ, সেই বিকাশের ধারায় সমকালীন বাংলা কবিতার অস্তিত্ব ও উজ্জ্বলতা। আর এই কারণে বাংলা কবিতার যে সম্ভাবনা তা অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বাংলা কবিতার যে বৈশিষ্ট্য ও ব্যঞ্জনা রয়েছে, সেই প্রবহমান শক্তিকে ধারণ করেই সমকালীন বাংলা কবিতার সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করতে হবে।