কবি আমিনুল ইসলাম (২৯ ডিসেম্বর)-এর কবিতা পাঠকের অন্তরে গেঁথে থাকবে বহুদিন। তার কবিতায় শব্দের যে খেলা, তা আলোড়িত করে পাঠকের মন। কেননা তার কবিতায় মানুষ, প্রেম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি, প্রত্নতত্ত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
আমিনুল ইসলামের কবিতায় ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায় নদী ও প্রকৃতিকে। তার কাব্যগ্রন্থের শিরোনামেই নদী ও প্রকৃতির ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায়। যেমন- ‘মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম’ (২০০৪); ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’ (২০০৮); ‘কুয়াশার বর্ণমালা’ (২০০৯); ‘জলচিঠি নীল স্বপ্নের দুয়ার’ (২০১২); ‘শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ’ (২০১৩); ‘জোছনার রাত বেদনার বেহালা’ (২০১৪); ‘ভালোবাসার ভূগোলে’ (২০১৭); ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’ (২০১০); ‘প্রণয়ী নদীর কাছে’ (২০১৬); ‘জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র’ (২০১৯)। এসব গ্রন্থের শিরোনাম ছাড়াও গ্রন্থভুক্ত কবিতার শিরোনামেও নদী ও প্রকৃতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা সম্পর্কে লেখক আবু আফজাল সালেহ বলেছেন, ‘প্রথাগত রীতির বাইরে এসে যে ক’জন কবি কবিতা-নির্মাণ করছেন, তাদের একজন কবি আমিনুল ইসলাম (জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩)। অবলীলায় তার কবিতায় ঢুকে পড়েছে আশপাশের শব্দাবলী, ইংরেজিই হোক বা দেশি শব্দই হোক। এত পরিমাণের ইংরেজি শব্দের ব্যবহার আমিনুলের আগে কোনো কবি ব্যবহার করেননি; করলেও পরিমাণে অনেক কম। তার প্রথম পর্যায়ের কবিতাগুলো নির্মাণ করেছেন বলে ধরে নিতে পারি। তারপর আমূল পরিবর্তন এসেছে দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিতায়। ভাঙাচোরা করে একটা স্থিরতা এসেছে। এই স্থিরতা একেবারেই শেষ নয়। বিনির্মাণ চলছে। তবে কবিতায় একটা নতুন স্বর সৃষ্টি হয়েছে। আমিনুল ইসলাম কবিতায় নিজত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করি। মনন ও মেজাজে তাই তিনি স্বতন্ত্রধারার কবি।’ (আমিনুল ইসলামের কবিতা: বৈচিত্র্যময় চিত্রকল্প, জাগো নিউজ)
শুধু তা-ই নয়, ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’, ‘সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ’ বহু বর্ণিল বিভায় দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে তার কবিতায়। তার কবিতার দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবি যখন বলেন,
তুমি আকাশ হলে
অন্ত্যমিলের মোহনায়
ঢেউয়ের কাছে জেনে দেখি
নদীর কোনো দ্রোহ নাই!
(প্রেমের কবিতা)
কবিতায় তার অভিব্যক্তিও যেন নদী ও প্রকৃতি কেন্দ্রীক। তিনি অন্যত্র বলেছেন,
অতএব এসো, আমরা দুজনে মিলে
একটা পাহাড় এবং একটি নদী কিনে ফেলি;
তখন সমুদ্রটা ফ্রি পেয়ে যাব
(আমরা দুজনকে ভালোবাসব, কেন?)
প্রকৃতি ও নদীর জন্য কবির যে আকুতি, তা তার কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। এমনকি তার শিল্পিত সংযম স্মরণীয়। তাই তো তার কবিতার প্রবর্তনা সম্পর্কে প্রাবন্ধিক গাউসুর রহমান বলেছেন, ‘আমিনুল ইসলাম ভালো করেই জানেন যে, বাকস্পন্দের বৈচিত্র্য ও স্থিতিস্থাপকতা ছাড়া কবিতায় শিল্পিত সংযম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বলাবাহুল্য, আমিনুল ইসলামের কবিতায় এই শিল্পিত সংযম রক্ষা করার সচেতন প্রয়াস লক্ষ করা যায়। আমিনুল ইসলাম জানেন- প্রকৃতির সবকিছুই সময় বা গতির অধীন। কিন্তু এই সময় ও গতিকে ব্যবহার করে বিকল্প প্রকৃতিবিশ্ব রচনা করতে কবি অঙ্গীকারবদ্ধ।’ (আমিনুল ইসলামের কবিতার প্রবর্তনাসমূহ, গাউসুর রহমান, প্রতিদিনের সংবাদ)।
কিন্তু হৃদয়ের অর্ধেকটা নদীকে দিয়ে দিলেও বাকিটা কবি রাখতে চান প্রকৃতির অনন্য সুন্দর জিনিসগুলোর জন্য। স্বদেশের প্রতিটি নদী যেন তাকে মায়ায় জড়িয়ে রাখে, বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় তিনি অনেক জ্বালা-ই ভুলতে পারেন। তার রোমাঞ্চকর বর্তমানেও আছে নদী।
একই প্রবন্ধে প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি এ-ও বলেছেন, ‘তার কবিতার আবহমান বাংলার প্রকৃতি ও নিসর্গের রূপপ্রভার অন্তরালে রয়েছে এক ধরনের কাতরতা, এক ধরনের নিভৃতি অথচ গভীর বিষণ্নতা, এক ধরনের কোমলতা। কবিতায় কবি নিজেকেই অনাবৃত করেন নিজের কাছেই। তার কবিতায় যে গূঢ়তা আছে, তার উৎস হচ্ছে অতিগোপন রোজনামচার রস। নিজের সঙ্গে যেন নিজের কথোপকথন।’ (আমিনুল ইসলামের কবিতার প্রবর্তনাসমূহ, গাউসুর রহমান, প্রতিদিনের সংবাদ)। কবি কখনো কখনো স্মৃতিতাড়িত হয়েছেন। নাগরিক জীবনের ভিড়েও খুঁজে ফেরেন হারানো অতীত। যাবতীয় স্মৃতি আগলে ধরে বেঁচে থাকতে চান। কবিতার ভাষায়,
তার চেয়ে চলো যাই ফেলে আসা বটের ছায়ায়
স্বোপার্জিত তৃণে বাঁধি ভালোবাসার দুইচালা ঘর।
ভুল হলে আছে তো বাবুই-নিসর্গের কনসালট্যান্ট
আয়োজিত উৎসবের জারজ কথার চেয়ে
বেহেতর অনেক মুখরিত হয়ে শোনা
শ্যামাদোয়েলের কণ্ঠে মুক্ত কবিগান।
(তন্ত্র থেকে দূরে)
তবে কাব্যের বিচিত্র সুর, সংগীত ও ব্যঞ্জনার পরিসরের বাইরেও আমিনুল ইসলামের কবিতার বিষয়বস্তু বিচিত্র। এ বিষয়ে কবি ও প্রাবন্ধিক কুমার দীপ বলেছেন, ‘আমিনুল ইসলামের কবিতার বিষয়বস্তু বিবিধ এবং বৈচিত্র্যময়। নদীমাতৃক বাংলার ছবি যেমন তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয়, তেমনি বিস্তীর্ণ পটভূমিকায় উঠে এসেছে শস্য-শ্যামল বাংলাদেশের প্রকৃতি ও মানুষের কথা। শহুরে জীবন ও জীবনের ক্লেদ, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের কুটিল মানুষ ও তাদের প্রতারণাপূর্ণ জীবনবৈশিষ্ট্য… এসবও তাঁর কবিতার পঙক্তিতে পরিণত হয়েছে। বাদ পড়েনি বাংলার ইতিহাস-সংস্কৃতি-পুরাণ প্রভৃতি শেকড়ের বার্তাও।’ (আমিনুল ইসলামের কবিতা : বিস্তৃত ভূগোলে শেকড়ের সন্ধান, কুমার দীপ, এনটিভি অনলাইন)
তাই তো ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’ কাব্যের ‘পিপাসার জল’ কবিতায় তিনি বলেছেন,
পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ের রাখালদাশ পেয়েছিল
স্রোতেলা শ্রাবণ;
জনারণ্য ভেঙে আমিও পেয়েছি
স্বর্গ হতে নেমে আসা নদী।
আবার ‘নদীর গল্প’ কবিতায় নদীর গতিপথ নিয়ে নিজস্ব বয়ানে তৈরি করেছেন এক রোম্যান্টিক আখ্যান,
আমাদের পাড়ায় বেড়ে উঠেছিলো দুটি নদী; গ্রামবাসীরা আদর করে
নাম রেখেছিলো পদ্মা যমুনা। কানামাছি খেলতে খেলতে কখন যে
তারা বউ বউ শিখেছিলো, পড়াশি বৃক্ষলতা ছাড়া আর কেউ তা লক্ষ
করেনি। কোনো এক শুক্লাতিথিতে জোছনার পরী এসে চিরকুট দিয়ে
গেলে শুরু হয় সম্মিলিত সমুদ্রগামিতা। পদ্মা গান আর যমুনার নাচে
মেতে ওঠে বাতাস; ঝড়ের রাতে তারা মিথুনরত পায়রা হয়ে যায়।…
বাংলার নদীর স্রোত চিরায়ত উপাদান। এই স্রোতের ভয়ঙ্কর রূপেরও একটি চিত্র পাওয়া যায় ‘কুয়াশার বর্ণমালা’ কাব্যের ‘স্রোত ও ঢেউ—এক’ নামের কবিতায়। কবি বলেছেন—
সর্পিল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে
শেওলা-কচুরি-শাপলা
ভেসে যাচ্ছে জীর্ণশীর্ণ খড়কুটো
ভেসে যাচ্ছে অগলিত আধাগলিত লাশ
ভেসে যাচ্ছে স্বর্ণসূত্র রোদ
ভেসে যাচ্ছে মসলিন জোছনা
ভেসে যাচ্ছে সুলতানী বজরা
ভেসে যাচ্ছে মরণজয়ী কলার মান্দাস
ভেসে যাচ্ছে মাঝিহীন ধুলু মাঝির নাও
ভেসে যাচ্ছে সুজনের তালপাতার বাঁশি
ভেসে যাচ্ছে নুসাইবাবার তালপাতার ঘর
ভেসে যাচ্ছে নির্বাচনি নৌকা
ভেসে যাচ্ছে পাড়ভাঙা মাটি
ভেসে যাচ্ছে নদীমাতৃক শপথের লাশ।
কবি আমিনুল ইসলাম বগুড়ার মহাস্থানগড়ের ঐতিহ্যবাহী ‘বেহুলার ভিটা’কে নিয়ে লিখেছেন। যেন অতীত-বর্তমানের সেতুবন্ধন। কবি বলেছেন—
মহাকালের বুকে ধূসর আঁচলে আবৃত স্তন
স্তন হতে চুয়ে নামা দুধ—
ঝরনার মতো মিশে যায়—
কালের করতোয়ায়
সেই জল পান করে দুইতীরে বেড়ে ওঠে শিশুরা
তাদের পরনে ইস্কুল-ড্রেসের মতো ভালোবাসার ইউনিফর্ম।
ফলে আমিনুল ইসলামকে আমরা প্রকৃতির কবি বলতেই পারি। কোনো কোনো প্রাবন্ধিক তাকে এ অভিধা এরইমধ্যে দিয়েছেনও। প্রাবন্ধিক ম্যারিনা নাসরীন তার লেখায় উল্লেখ করছেন, ‘‘প্রকৃতির কবি আমিনুল ইসলাম। তার কবিতায় নৈসর্গিক প্রকৃতির নতুন এক রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। এই প্রকৃতির মধ্যে নদী আর বৃষ্টির সঙ্গে তার নাড়ির যোগ। যা বারবার তার কবিতায় সচেতন বা অসচেতনভাবেই উঠে এসেছে। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘যে কোন অর্থেই আমি জলের সন্তান—কোন জনমে জলদাস ছিলাম কি না জানি না। নদী আমার জন্মদাত্রী থেকে খেলার সাথি হয়ে প্রথম যৌবনে প্রেমিকার স্থান দখল করে।’ স্থানের বিচারে আমিনুল ইসলামের কবিতার ক্যানভাস বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে দূর থেকে বহুদূর, বিশ্বব্যাপী। আবার সময়ের ক্ষেত্রে প্রাচীন বা প্রস্তর যুগ, মধ্যযুগ অথবা ডিজিটাল সমকালকে ছাড়িয়ে সামনের দিকে আরও বহুকালে তার কবিতার বিচরণ।’’ (ম্যারিনা নাসরীন, আমিনুল ইসলামের কবিতা জীবনবোধের কাব্যিক নির্যাস, আমাদের সময়)
এবার এই প্রকৃতির কবির উল্লেখযোগ্য কবিতার কিছু পঙ্ক্তি পড়ে নেওয়া যাক—
১.
অথচ এই তো সেদিন—আমি সবে উত্তীর্ণকৈশোর,
তুমি জলের যুবতী ডেকে নিতে উন্মাতাল
যৌবনের প্রথম শিহরে (মনে আছে!) উড়িয়ে দিয়ে
ভরাবুকে ঢেউয়ের আঁচল! ভুলে ডাঙার ভ্রূকুটি
ঝাঁপ দিয়া জলে কতদিন ভেসে গেছি নগ্নবক্ষ গাঙচিল!
ইচ্ছে হলে নিতে পারতে ভাসিয়ে অকূলে
ওই অষ্টাদশীর জলাবর্ত তোমারও তো ছিল
আর আশৈশব আমিও তো জলপাগলই ছিলাম!
(পাঙ্গাশমারী/ জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র)
২.
শরৎ ছুঁতে চায় হেমন্ত; আমনের ক্ষেতে আঁচল উড়িয়ে
ভোরের হাওয়ায় ভাসে বাংলাদেশ।
আত্রাইয়ের জল এসে আলতো হাতে ধুয়ে দেয় তার প্রত্নরাঙা পা।
(ভোরের হাওয়ায় ভাসে বাংলাদেশ/ মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম)
৩.
আমরা ঘুরছি মালয় হয়ে মেলবোর্ন-সিডনি-সুমাত্রা
আমাদের বুকে পদ্মাপাড়ের কয়েকগুচ্ছ বরেন্দ্রদিন।
নীলপর্বতের বাঁশি বাজায় সাইমন নামের আদিবাসী
চোখমুখে তার খুঁজে পাওয়া যায় আমাদের চোখমুখ
মইষাল ভাইয়ের এমন বাঁশি আমরাও ভালোবাসি
সাইমন আজ খুলে দিলো বন্ধ-থাকা সেই উৎসমুখ।
(ব্লু মাউন্টেইনে দাঁড়িয়ে/ পথ বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি)
৪.
ও নদী, তুমি তো আমার ভূগোল হবে না,
তাই বলে শূন্য হাতেও যাবো না
যেমন যায়নি আমার পূর্ববর্তীগণ।
(পিপাসার জল/ কাব্য সমগ্র)
৫.
বায়ুস্পর্শে পর্ণমোচীর পাতায় হলদে শিহরণ;
নন্দিনীর কোমরে হাত দিতে দেখি:
নদী নেই,
পার্কে খালে ঘুরে মরে স্রোতেলা অস্তিত্ব;
হয়তোবা মৌসুমও এসে যায় মেনোপজে!
আর শ্যামলীকে চাঁদকানা করবে—
এমত প্রকল্পে
উত্তরের হাওয়া ওড়ায় লাল ইটের গুঁড়ো।
তবু এই ঘোরলাগা সন্ধ্যায়
জোছনা কুড়াবো বলে
‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে’
মাইক্রো-ক্রেডিটের মতো মন বিছিয়েছি।
(শেষ হেমন্তের জোছনা/ শেষ হেমন্তের জোছনা)
প্রকৃতির আবহেও তার কবিতায় প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য উঠে আসে অবলীলায়। ড. মিল্টন বিশ্বাস এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘আমিনুল ইসলামের কবিতায় প্রকৃতি এসেছে নানাভাবে, নানাপর্যায়ে, ভাবের আবেগে এবং দ্বৈরথেও। প্রকৃতির এক প্রধান রূপকার হচ্ছে নদী। আমাদের তৃষ্ণা, অভিমান ও কান্না বারবার ছুটে যায় নদীর কাছে। নদীর সঙ্গে মানুষের নাড়ির যোগাযোগ আছে বললে ভুল বলা হয় না। নদী এক প্রিয় বিষয় কবিদের। কবি নিজেই বলেছেন, নদী নিয়ে অনেকগুলো কবিতা লিখেছেন তিনি। ‘শেষ হেমন্তের জোছনা’ কাব্যগ্রন্থে বেশ কয়েকটি কবিতা নদীকে নিয়ে। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের নামকরণও নদীকে ঘিরে ‘মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম’। ‘কুয়াশার বর্ণমালা’ বইয়েও ঠাঁই পেয়েছে বেশ কটি নদীর কবিতা।’’ (আমিনুল ইসলামের কবিতার ভুবন, মিল্টন বিশ্বাস, ইত্তেফাক)
কারণ আমিনুল ইসলামের কবিতায় সেই নদী শুধু নদী থাকে না। সেটি হয়ে ওঠে ঘটনার সমীকরণ, হয়ে ওঠে জীবনের অন্য রূপ, হয়ে ওঠে নারী। কিন্তু হৃদয়ের অর্ধেকটা নদীকে দিয়ে দিলেও বাকিটা কবি রাখতে চান প্রকৃতির অনন্য সুন্দর জিনিসগুলোর জন্য। স্বদেশের প্রতিটি নদী যেন তাকে মায়ায় জড়িয়ে রাখে, বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় তিনি অনেক জ্বালা-ই ভুলতে পারেন। তার রোমাঞ্চকর বর্তমানেও আছে নদী।
সুতরাং আমিনুল ইসলামকে নিয়ে আলোচনার ব্যাপ্তী বিশাল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ প্রবন্ধে শুধু তার প্রকৃতি ও নদী চেতনার সঙ্গে কাব্যভাষাকে যুক্ত করেছি। আমার মনে হয়, তিনি আরও বিশদভাবে আলোচনার যোগ্য। তিনি বহুল পঠিত হবেন। বহুল আলোচিত হবেন। কবির শুভ জন্মদিনে এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।
তার কবিতায় নতুনত্ব আছে। কখনোই চর্বিত চর্বন মনে হয় না। পাঠককে ধরে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা আছে। শব্দের কারুকাজ আছে। বক্তব্যে দ্যোতনা আছে। বাক্যের পরতে পরতে ব্যঞ্জনা লক্ষ্য করা যায়। তার কবিতায় নদী স্পর্কে প্রাবন্ধিক সমীর আহমেদ বলেছেন, ‘আমিনুল ইসলাম কবিতার এই বন্ধ্যা সময়কে প্রবহমান বা ফলবতী করার জন্যই যেন ড্রেজারমেশিনরূপী একখানা কলম হাতে তুলে নিয়েছেন। চর্বিত চর্বন নয়, নতুন আস্বাদে, নতুন ভাবনায়, নতুন কবিতা লেখার জন্য তার রয়েছে আজন্ম অনন্ত পিপাসা। যা কোনোদিন কেউ লিখেনি, জীবনানন্দ দাশের মতো সেই কবিতা লেখার স্বপ্ন দেখেন তিনি। তার বিশ্বাস এ কাজে তিনি ব্যর্থ হবেন না। নদীকে দেখেছেন সমকালের প্রতীক, সেই সমকালের একজন হয়ে, মহাকালের সাথে যুক্ত হতে চান তিনি।’ (আমিনুল ইসলামের কবিতায় নদী, সমীর আহমেদ, ভোরের কাগজ)
আপনারা হয়তো অবাক হতে পারেন, কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এত প্রাবন্ধিকের উদ্ধৃতি টেনে আনছি কেন? আমি মূলত তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে প্রবন্ধজুড়ে বিভিন্ন জনের অভিমত উল্লেখ করে আমিনুল ইসলামের সাহিত্যচর্চার বিস্তৃতিকেও তুলে ধরার চেষ্টা করছি। যে কারণেই হয়তো কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন বলেছেন, ‘আত্মবান ও সত্যসন্ধ আমিনুল ইসলাম প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ-প্রেম ও স্মৃতির অনুষঙ্গে আরো গভীর চেতনার আয়োজনে নবমূল্যায়িত হবেন প্রত্যাশা করি।’ (প্রতীকী প্রতিবাদের কবি: আমিনুল ইসলাম, রেজাউদ্দিন স্টালিন, অন্তর্ভেদী অবলোকন)
কেননা এক মহত্তম নৈঃশব্দ আমিনুল ইসলামের কবিতায় অনুরণিত। ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, শ্লেষ আর কৌতূহলে ভরা তার জগৎ। তার পথ চলার একটি মৌলিক উত্তরাধিকার আছে, যাকে নবায়িত করি নিজ অস্তিত্বের অনিবার্যতায়, প্রতীকী প্রতিবাদে।
কবি আমিনুল ইসলামের কাব্যভাষায় (শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা) একধরনের নিজস্বতা বা প্রাতিস্বিকতা আছে বলে মনে হয়। আমিনুল ইসলাম লিখেছেন বহু বিষয়ে বহুমাত্রিক ভাবে। তার কবিতায় উঠে এসেছে নদী, পাখি, হাট-ঘাট, মাঠ-প্রান্তর, ইতিহাস-ঐতিহ্য, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ভূগোল, রোমান্টিকতা, ভালোবাসা প্রভৃতি। ফলে তিনি বহুবিধ উপাধিতে আখ্যায়িত হতেই পারেন। তাই তো কথাসাহিত্যিক ও শিল্পসমালোচক হাসনাত আবদুল হাই বলেছেন, ‘একজন কাব্যপ্রেমিককে ‘জাতকবি’, ‘নিবেদিতপ্রাণ’, ‘নিভৃতচারী’ এসব অভিধায় বর্ণনা করা যায়। কিন্তু তাঁর কবিতা পাঠ করলে বোঝা যায় তিনি একজন মৌলিক কবি। তিনি কবিতা লেখার জন্য নিজস্ব ভাষা নির্মাণ করেছেন যা একইসঙ্গে নাগরিক এবং বাস্তবতামণ্ডিত। দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা শুধু তাঁর অনেক কবিতার বিষয় হয়নি, সেখানে ব্যবহৃত অনেক নতুন শব্দ তিনি অনায়াসে এবং শিল্পিত ভঙ্গিতে ব্যবহার করেছেন। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁকে ‘আধুনিক’ বলতে দ্বিধা হয় না। তিনিই ডিজিটাল যুগের প্রথম কবিতা রচয়িতা, একথা বলা হলে অত্যুক্তি হবে না।” (আমিনুল ইসলামের কবিতা, হাসনাত আবদুল হাই, বাংলাদেশ প্রতিদিন)
কবিতার উল্লেখযোগ্য উপাদান হচ্ছে রূপ, রস, ছন্দ, অলঙ্কার, রূপক, উপমা, প্রতীক ইত্যাদি। এ সবের সমন্বিত, সুসঙ্গত, কুশলী ও নান্দনিক ব্যবহারে কবিতা যথার্থ হয়ে ওঠে। সাহিত্য ও ভাষা চর্চার সমন্বিত ব্যবহারে শব্দের কুশলী প্রয়োগে উৎকৃষ্ট মানের কবিতার জন্ম হয়। সুতরাং কবি আমিনুল ইসলাম জানেন, কীভাবে কাব্যভাষা তৈরি কওে নিতে হয়। আগেও বলেছি, আমিনুল ইসলামের একটি নিজস্ব স্টাইল আছে। তিনি সত্যিকারের শিল্পশ্রমিক। কেননা তিনি শব্দ তৈরিতেও সফল। তার কিছু কবিতার বিষয়, বলার ধরন, উপমা-উৎপ্রেক্ষা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, তিনি শক্তিশালী ও নান্দনিক কাব্যভাষা তৈরি করতে পেরেছেন।
আমরা তার মুখেও কিছু শুনে নিতে পারি। ‘উৎকৃষ্ট কবিতা বিষয়ে আত্মকথন’ প্রবন্ধে কবি আমিনুল ইসলাম বলেছেন, “শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যেতে পারে-কবিতা হচ্ছে সুন্দর করে কথা বলা; কোনোকিছুকে নান্দনিক সৌন্দর্যে উপস্থাপন করা।” ফলে তার কবিতায় শব্দালঙ্কার, রূপক, উপমার কুশলী প্রয়োগ লক্ষ্য করা গেছে। কবি বলেছেন—
তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চণ্ডীদাস
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন
তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম।
(হুমায়ুন আজাদ)
আমিনুল ইসলামের কাব্যভাষা সম্পর্কে প্রাবন্ধিক জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘‘কবিতা একটি শব্দ প্রধান শিল্প এবং তাকে শিল্পের নানা শর্ত পূরণ করে ‘কবিতা’ হয়ে উঠতে হয়। পাঠকের কাছে পৌঁছানোর এবং পাঠককে বিনোদিত করার ক্ষেত্রে কবি যদি যথেষ্ট প্রতিভাবান না হন তাহলে তাকে ফাপরে পড়তে হতে পারে। এই শৈলী পীড়িত ও প্রকরণশাসিত সময়ে কবি আমিনুল ইসলাম ঝুঁকি নিয়েই লিখলেন এ দীর্ঘ কবিতা। তিনি জানেন শব্দ প্রয়োগের কৌশল, জানেন পাঠকের কাছে পৌঁছানোর রাস্তা। আর তাই সরল ও সরাসরি শৈল্পিক শব্দের গাঁথুনিতে তিনি বাজিমাত করেছেন।’’ (আমিনুল ইসলাম: কবিতার ভূগোলে ইবনে বতুতা, জিল্লুর রহমান, যোগসূত্র)
আমিনুল ইসলামের কবিতায় রূপকল্প, শব্দ ও বাক্য বিন্যাসের স্বতন্ত্র নান্দনিক ব্যবহার ফুটে ওঠে। তার কবিতার কথা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প অবারিত বৈচিত্র্য ও মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায়। তার কবিতার সংখ্যা কম নয় এবং বিষয়গত বৈচিত্র্যও ব্যাপক। বদলে যাওয়া সময় ও বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি শব্দ ও ভাষার কারুকার্যেও নান্দনিক কাব্যভাষা তৈরি করেন। কাব্যভাষা বিচারে আমিনুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে একটি স্থায়ী জায়গা করে নিবেন, তা বুকে হাত দিয়েই বলা যায়। তাই তো কবি ও প্রাবন্ধিক বীরেন মুখার্জী বলেছেন, ‘‘আমিনুল ইসলাম কবিতায় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী। এরপরও তিনি নান্দনিক শব্দের সমাহারে কবিতার শরীরে শিল্পসুষমার শেষ আঁচড় টানেন। আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও সতর্ক। তার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ-সমবায় অর্থের বহুমাত্রিকতা নির্দেশক। আবার ব্যঙ্গাত্মক, পরিহাস এবং তীর্যক স্তবকও তিনি রচনা করেছেন। কবির এ প্রবণতা বিশ্বায়নের সঙ্গে ইতিবাচক যোগসূত্র স্থাপনেরই ফল বলে মনে করা যেতে পারে।’’ (আমিনুল ইসলামের কবিতা: শিল্পপ্রজ্ঞা ও বিশ্বায়নের মিথষ্ক্রিয়া, বীরেন মুখার্জী)
সবশেষে ড. সফিউদ্দিন আহমেদের মন্তব্যটি পড়লে বুঝতে পারবেন, ‘‘আমিনুল ইসলাম আমাদের কাব্যসাহিত্যে মননে ও প্রকরণে, চিত্রকল্প ও রূপকে, উপমা ও উৎপ্রেক্ষায় এবং বাণীবিন্যাস ও নান্দনিক অভিব্যক্তিতে অনেক সূর্যের বৈভবে একজন স্বতন্ত্র মেজাজের কবি। তাকে এক অর্থে মৌলিক কবিও বলা যায়। তিনি বক্তব্য ও বাণীবিন্যাসে নিজের ভুবনে একটি বলয় তৈরী করে আপনার আলোতে আপনিই দ্যুতিমান। এবং লিখতে গিয়ে অন্য কারও মডেল বা আদর্শকে সামনে না রেখে নিজের পথে বহমান।’’ (আমিনুল ইসলাম: শিকড় বৈভবের কবি) সুতরাং আমিনুল ইসলামকে নিয়ে আলোচনার ব্যাপ্তী বিশাল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ প্রবন্ধে শুধু তার প্রকৃতি ও নদী চেতনার সঙ্গে কাব্যভাষাকে যুক্ত করেছি। আমার মনে হয়, তিনি আরও বিশদভাবে আলোচনার যোগ্য। তিনি বহুল পঠিত হবেন। বহুল আলোচিত হবেন। কবির শুভ জন্মদিনে এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।