আমি ও আমার সতীর্থরা লিখতে আসি মোটামুটি মধ্য-আশি থেকে। সেটা এমন একসময়, যখন আমাদের মূলধারার কবিতা পুনরুক্তিপূর্ণ ভাষ্যে, ধ্রুবপদের যথেচ্ছ ব্যবহারে আর তালিকাবয়নের আতিশয্যে হয়ে পড়ছে একঘেয়ে, ক্লান্তিকর। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে প্রবর্তিত সেই বাগ্বহুল ন্যারেটিভ কাব্যধারাটির ভেতর তখন ক্রমে-ক্রমে জমে উঠেছে জীবনের এবং যাপনের উপরিতলের ফেনা, শ্যাওলা ও খড়কুটা। কবিতা হয়ে উঠেছে চটপট-করে-ফুটতে-থাকা পপকর্নের মতো ফোলানো-ফাঁপানো এবং উদ্বায়ী।
লজিকের বিপর্যয়ের বদলে কবিতার পদে-পদে লজিকের শৃঙ্খল (অবশ্যই বেশ কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদে)। এ ছাড়া, বাংলাদেশে তখন চলছে স্বৈরশাসনবিরোধী জোরদার আন্দোলন। টালমাটাল একটা সময়—দ্রোহ ও উত্তেজনায় কাঁপা। স্বাভাবিকভাবেই কবিতাও হয়ে উঠেছে সোচ্চার। দ্রোহের কবিতা তো বটেই, প্রেম, বিরহ, এমনকি যৌনতার কবিতাও হয়ে উঠেছে সোচ্চার ও বাগ্বহুল।
একটা উদাহরণ দিয়ে বলি—
যদি তুমি ফিরে না আসো,
গরুর ওলান থেকে উধাও হবে দুধের ধারা,
প্রত্যেকটি রাজহাঁসের পালক ঝরে যাবে,
পদ্মায় একটি মেয়ে ইলিশও আর ছাড়বে না ডিম।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
ত্রাণ তহবিলে একটি কনাকড়িও জমা হবে না,
বেবিফুডের প্রত্যেকটি কৌটায় গুঁড়ো দুধ নয়
কিলবিল করবে শুধু পোকামাকড়।[ যদি তুমি ফিরে না আসো: শামসুর রাহমান]
এ রকম পুনঃপুনঃ আবর্তনময়, তালিকাবহুল, বর্ণনাধর্মী কাব্যভাষার প্রতাপ তখন। বলছি না যে এগুলো খারাপ কবিতা, তবে সত্যি বলতে কি, আমরা অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম এ ধরনের কবিতায়। কারণ, আমাদের কাছে মনে হয়েছে—পঞ্চাশ-ষাটের দশকে প্রবর্তিত সেই প্রতাপশালী ধারাটির মধ্যে জীবন ও জগতের উপরিতলের এতটা ফেনা ও আবর্জনা এবং রিফ্রেইন, রিপিটেশন, ডিফিউশন, ক্যাটালগিং-এর এতটা অতিরেক, এত হালকা বিষয়আশয় এসে ভিড় করেছিল যে, কবিতা হয়ে উঠেছিল অনেকটা মুড়িমুড়কির মতো হালকা, নির্জলা জলের মতো তরল। কবিতাকে ঠিক কবিতা বলেই চেনা যাচ্ছিল না। সে-ধারায় হয়তো অন্তর্জাগতিক, বহির্জাগতিক, ব্যষ্টিক, সামষ্টিক, স্বীকারোক্তিমূলক, স্বগতোক্তিধর্মী, সোচ্চার, অনুচ্চার, সামাজিক, অসামাজিক—নানা ধরনের লেখাই হয়েছে। ইনট্রোভার্ট, এক্সট্রোভার্ট কোনো বিষয়েরই ঘাটতি ছিল না, কেবল ঘাটতি ছিল কবিতার। মর্মগতভাবে যা কবিতা, কবিতার যা সৌন্দর্য, রহস্য, বিস্ময়, নিবিড়-গভীরভাবে দোলা দেওয়ার যে অলৌকিক ক্ষমতা, তা থেকে কবিতা দূরে সরে গিয়েছিল। আভিধানিক অর্থের বাইরে শব্দের আর কোনো অর্থ বা ব্যঞ্জনাই নিষ্কাশন করা সম্ভব হচ্ছিল না। কাব্যক্ষেত্র হয়ে উঠছিল এক বিশাল একঘেঁয়ে বদ্ধপ্রায় জলাশয়।
এরকম এক পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের লেখালিখির শুরু। ওই সময় তরুণ কবিদের হাত দিয়ে ফুটে উঠছিল যেসব বৈচিত্র্যময় বিকল্প ধারা, সেসব ধারায় কবিতাকে কবিতার দিকে, সৌন্দর্য এবং অবাধ-অফুরান সৃজনস্ফূর্তির দিকে নেওয়ার চেষ্টা ছিল। বলা বাহুল্য এসবই হলো কবিতার মূল এসেন্স।
কুড়িগ্রাম ॥ মাসুদ খান
কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম।
রাত গভীর হলে আমাদের এই প্রচলিত ভূপৃষ্ঠ থেকে
ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়।
অগ্রাহ্য করে সকল মাধ্যকর্ষণ।
তারপর তার ছোট রাজ্যপাট নিয়ে উড়ে উড়ে
চলে যায় দূর শূন্যলোকে।আমরা তখন দেখি বসে বসে আকাশ কত-না নীল
ছোট গ্রাম আরো ছোট হয়ে যায় আকাশের মুখে তিল।অনেকক্ষণ একা-একা ভাসে নিখিল নভোভারতের রাজ্যে রাজ্যে।
দক্ষিণ আকাশে ওই যে একনিষ্ঠ তারাটি,
একসময় কুড়িগ্রাম তার পাশে গিয়ে চিহ্নিত করে তার অবস্থান।
তখন নতুন এই জ্যোতিষ্কের দেহ থেকে মৃদু-মৃদু লালবাষ্প-ঘ্রাণ ভেসে আসে।সেই দেশে, কুড়িগ্রামে, ওরা মাছরাঙা আর পানকৌড়ি দুই বৈমাত্রেয় ভাই
কুড়িগ্রামের সব নদী শান্ত হয়ে এলে
দুই ভাই নদীবুকে বাসা বাঁধে
স্ত্রীপুত্রকন্যাসহ তারা কলহ করে।নদী শান্ত হয়ে এলে
শাস্ত্রবাক্যে বাঁধা যত গৃহনারী
প্রাচীর ডিঙিয়ে এসে নদীকূলে করে ভিড়
প্রকাণ্ড স্ফটিকের মতো তারা সপ্রতিভ হয়।হঠাৎ বয়নসূত্র ভুলে যাওয়া এক নিঃসঙ্গ বাবুই
ঝড়াহত এক প্রাচীন মাস্তুলে ব’সে
দুলতে দুলতে আসে ওই স্বচ্ছ ইস্পাত-পাতের নদীজলে।
কুড়িগ্রাম, আহা কুড়িগ্রাম!পৃথিবীর যে জায়গাটিতে কুড়িগ্রাম থাকে
এখন সেখানে নিঃস্ব কালো গহ্বর।কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম।
আহা, এ-মরজীবন!
কোনোদিন যাওয়া হবে কি কুড়িগ্রাম?
বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে তখন চলছে এক উত্তেজনার কাল। তরুণ প্রজন্মের ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে সেই উত্তেজনা। পো, পাউন্ড, এলিয়ট, এলুয়ার, অ্যাপোলোনিয়র থেকে শুরু করে জয়েস, স্যাঁ জঁ পার্স, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস, নেরুদা, লোরকা, হিমেনেথ, জয়েস, বোর্হেস, মার্কেজ, পাররা, কার্দেনাল, পোপা, হোলুব, মিউশ, মাচাদো, গিয়্যেন, হিউজ, হিনি, গিন্সবার্গ—পঠনপাঠন চলছে এঁদের বিচিত্র লেখালিখির।
পঠনপাঠন চলছে আপ্রাচীনআধুনিক নানা বাংলা কবিতার। ইমপ্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, সিম্বলিজম, ফভিজম, পয়েন্টিলিজম, ডাডাইজম, স্যুররিয়ালিজম, ফটোগ্রাফিক সিম্বলিজম, ব্ল্যাক আর্ট, ব্ল্যাক ম্যাজিক, অপটিক্যাল আর্ট, কাইনেটিক আর্ট, প্রত্নপ্রতিমা, পুরাণ, সর্বপ্রাণবাদ, দুয়েন্দে-তত্ত্ব, স্ট্রিম অব কনসাসনেস, ম্যাজিক রিয়ালিজম—ইত্যাকার বিচিত্র তত্ত্ব, প্রপঞ্চ ও পরীক্ষানিরীক্ষার ছাপ পড়ছে সে-সময়কার অনেক তরুণ কবিসাহিত্যিকদের লেখালিখিতে। তালগোলও পাকিয়ে যাচ্ছিল। জীবনানন্দ, বিনয়, উৎপল, শক্তি, শঙ্খ—এঁরা তো আছেনই, ওপার বাংলা থেকে জয় গোস্বামী, রণজিৎ দাশ, মৃদুল দাশগুপ্ত, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, ভাস্কর চক্রবর্তী—. এঁদেরও ঢেউ এসে লাগছে এপার বাংলায়। জয়ের ‘আলেয়া হ্রদ’, ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ বেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে তাঁর ‘ভুতুম ভগবান’ নামের একটি দীর্ঘ কবিতা রকমারি ইলাসট্রেশনসহ ছাপা হলো ‘দেশ’ পত্রিকায় (পরে ওই নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছিল)। এক অদ্ভুত ঘোর আর উন্মাদনার বাঁধভাঙা প্রবাহ যেন কবিতাটি। কী ছন্দে, কী অলঙ্কারে, কী কল্পনায়—একেবারে বল্গাছেঁড়া বেগ ও আবেগ। ম্যাড হয়ে লেখা কবিতা। আর ‘উন্মাদের পাঠক্রম’-এ তো ব্ল্যাকের সঙ্গে রীতিমতো ম্যাড-মেশানো এক উন্মত্ত অটোমেটিক রাইটিংয়ের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে দিলেন জয়। ব্ল্যাক-ম্যাজিক তরিকার ওইসব কবিতাতরঙ্গের অভিঘাত এসে পড়তে থাকে এপারের বেলাভূমিতে। জয়ের ওইসব কবিতার দিকে কেউ-কেউ অবশ্য তাকাচ্ছেন তির্যক চোখে। বলছেন—‘কী সব কবিতা! অপোগণ্ড, গলগণ্ড, অণ্ডকোষে মলভাণ্ড…।’ হজম হবে না বলে হাড্ডিগুড্ডি চিবানো থেকে বিরত থাকতে বলছেন কেউ-কেউ। জয়ের বইগুলো তো বটেই, রণজিৎ-এর ‘জিপসিদের তাঁবু’, ‘সময়, সবুজ ডাইনি’, মৃদুলের ‘জলপাই কাঠের এস্রাজ’, ‘এভাবে কাঁদে না’ তখন ঘুরছে অনেকেরই হাতে-হাতে। পাঠ হচ্ছে, পাঠান্তর হচ্ছে, চলছে আলোচনা-প্রত্যালোচনা।
সেই সময়কার বৈচিত্র্যপূর্ণ কবিতাকৃতি, নিরীক্ষা, উন্মাদনা, অতিরেক—সবকিছুকে বিশেষভাবে ধারণ-লালন করেছে ছোটকাগজ ও সাহিত্যপত্রিকাগুলো—‘গাণ্ডীব’, ‘সংবেদ’, ‘নৈবেদ্য’, ‘পেঁচা’, ‘প্রসূন’, ‘প্রান্ত’, ‘দ’, ‘একবিংশ’, ‘নদী’, ‘নিসর্গ’, ‘দ্রষ্টব্য’, ‘প্রতিশিল্প’, ‘বিপ্রতীক’, ‘লিরিক’, ‘আড্ডারু’, ‘চালচিত্র’, ‘কিছুধ্বনি’, ‘ফৃ স্ট্রীট স্কুল’—(দুঃখিত, অনেক পত্রিকার নাম হয়তো বাদ পড়ল)।
বলা বাহুল্য, ওইসকল জ্বর ও উত্তাপে আমিও তপ্ত ও উত্তেজিত তখন। ছন্দ, অলঙ্কার, শব্দচয়ন, কয়েনেজ, ভাব, ভাষা এসব নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা ও ভাঙচুরে আমিও তখন অকাতর, বেহিসাবী। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, নৃতত্ত্ব, শিল্পকলা, ইতিহাস আর পুরাণের নানা রঙের ঢেউ, জমকালো মেঘ-রৌদ্র তখন খেলা করছে আমার কবিতায়। শব্দের ওজোগুণের, শব্দের ঝঙ্কারের প্রেমে আমি মশগুল তখন। তাপ ও ঘোরের ভেতরে থেকে ততদিনে ‘ত্রিজ’, ‘ধূলিবিদ্যা’, ‘স্রোত’, ‘কোলাজ’, ‘সার্কারামা’, ‘সিলিকন চিপ…’, ‘সিমেন্ট/আরসিসি’, ‘পরমাণু’ ‘এপ্রিল’—এগুলো সব লেখা হয়ে গেছে। সে-ও কয়েক বছর ধরে। তারপর উত্তেজনা একটু থিতিয়ে এলে, কিংবা উত্তেজনাপর্ব বহাল-থাকা অবস্থাতেই, শহর যখন পুড়ছে তুমুল আগুনে, তখন যেমন হঠাৎ ইচ্ছা করে, শহর থেকে দূরে গিয়ে হাঁটি ঝিরঝির বৃষ্টির ভেতর, হাওয়া খাই মনোরম আবহাওয়ায়, অনেকটা সেরকম ইচ্ছা করছিল আমার। কোনো ক্লান্তি বা একঘেয়েমি থেকে নয়, এমনিতেই।
বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা ॥ মাসুদ খান
মেঘ থেকে মেঘে লাফ দেবার সময়
তুরীয় আহ্লাদে দ্রুত কেঁপে-বেঁকে
একটানে একাকার যখন বিজলিসূত্র, ওই ঊর্ধ্বতন
মেঘের আসনে এক ঝলক দেখা গেল তাকে
আলোকিত ঘনকের আকারে।তাকে ডাক দেবো-দেবো, আহা কী বলে যে ডাক দিই!
জন্ম এক রুদ্ধভাষ জাতিতে আমার—
মুহূর্তে মিলিয়ে গেল অপর আকারে।দূর মহাকাশে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুটে আছে কত ফুয়েল-স্টেশন—
সেইসব এলোমেলো নৈশ নকশার মধ্যে তাকে, প্রিয় তোমাকেই,
ঘোর মধ্যরাতে
এইভাবে দেখে ফেলি আমিও প্রথম।
সর্ববায়ু আমার সুস্থির হয়ে যায়।যেই দেখি আর ডাক দিতে যাই প্রিয়, অমনি
তোমার সমস্ত আলো, সকল উদ্ভাস
হঠাৎ নিভিয়ে নিয়ে চুপচাপ অন্ধকার হয়ে যাও।
আবার উদ্ভাস দাও ক্ষণকাল পরে—
এইরূপে খেলা করো, লুকোচুরি, আমার সহিত।
আমি থাকি সুদূর রূপতরঙ্গ গাঁয়, আর তোমার সহিত
তোমারই সাহিত্যে আহা এভাবে আমার বেলা বয়ে যায়।এরপর থেকে একে একে এক উচ্চতর জীবের বিবেক
প্রথমে প্রয়োগ করে দেখি,
মিলিয়ে যাচ্ছেন তিনি আকারে ও নিরাকারে।
এক অতিকায় জট-পাকানো যন্ত্রের
আগ্রহ সাধন করে দেখি,
তা-ও তিনি ছড়িয়ে পড়েন সেই আকারে নিরাকার;
আকাশে আকাশে মেলে রাখা তার কী ব্যাপক কর্মাচার,
একটির পর একটি গ্রহ আর জ্বালানি-জংশন সব
অতর্কিতে নিভিয়ে নিভিয়ে প্রবাহিত হন তিনি।একদা মণ্ডলাকার ছিলে জানি
আজ দেখি দৈবাৎ ধর্মান্তরিত, ঘনকের রূপে।
ঘনক তো গোলকেরই এক দুরারোগ্য সম্প্রসার।
তবুও তো ধর্ম রক্ষা পায়। রক্ষিত, সাধিত হয় তবু।গোলকত্ব পরম আকার
গোলকতা যথা এক অপূর্ব বিহেভিয়ার, প্রায়-
নিরাকারসম এক নিখুঁত আকার।শৈশবের কালে, এক আশ্চর্য মশলা-সুরভিত
গুহার গবাক্ষপথে আচম্বিতে ভেসে উঠেছিল মেঘ,
যার বাষ্পে বাষ্পে কূটাভাস।
কিছুতেই পড়তে পারি নাই সেই মেঘ
আমরা তখন।বিব্রত বাতাস তাকে, মেঘে মেঘে সংগঠিত ক্ষণ-ক্ষণ-আকৃতিকে,
ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে যাচ্ছে কত বিভিন্ন প্রদেশে।
নিরাকৃত হতে হতে প্রায়, ওই তো ব্যক্ত হচ্ছেন ফের আকারে আকারে।
ধর্মচ্যুত হতে হতে প্রায়, ফের প্রচারিত হন ধর্মে ধর্মে।
আহা, ধর্ম হারালে কী আর থাকে তবে এ ভুবনে!
ঘনক যে গোলকেরই এক নিদারুণ তাপিত প্রসার।বৃহৎ, অকল্পনীয় এক জড়সংকলন। বড় বালিপুস্তকের মতো—
তারই মধ্যে অকস্মাৎ একটু প্রাণের আভা। মাত্র তার একটি পৃষ্ঠায়।
এই সংকলনের ভূমিকাপত্রটিও নেই। ছিন্ন। সেই প্রধান সংঘর্ষে।নিষ্ক্রান্তিদিবসে, অতঃপর, ওই গুহামুখে পড়ে থাকে
এ বিপুল জড়সংকলনের ছেঁড়া ভূমিকাপৃষ্ঠাটি,
অর্থাৎ সেই যে প্রথম ক্যাজুয়াল্টি, নিখিলের—
ওই গুহাপথে, নিষ্ক্রমণকালে।
একবার মাত্র দেখা হয়েছিল কায়ারূপে
ঝাপসা, ছায়া-ছায়া!
তা-ও বিজলির দিনে, তা-ও মেঘের ওপরে
উল্লম্ফকালীন।এরপর থেকে শুধু ভাবমূর্তি…
যেদিকে তাকানো যায়
কেবলই, উপর্যুপরি ভাবমূর্তি ঝলকায়।মাঠে মাঠে স্প্রিং স্ক্রু আর নাটবোল্ট ফলেছে এবার সব জং-ধরা।
সে-সব ভূমিতে হাঁটু গেড়ে গলবস্ত্র হয়ে পরিপূর্ণ দুই হাত তুলে
যাচ্ঞামগ্ন সারি সারি সম্প্রদায়– তারা অসবর্ণ, তারা
লঘিষ্ঠ- কলহরত বিড়ালের আধো-আলো-আঁধারি বাচন ও কণ্ঠস্বর
কেড়ে নিয়ে দ্রুত নিজ কণ্ঠে কণ্ঠে গুঁজে দিয়ে সারিতে দাঁড়িয়ে যায় তারা।তেজের অধিক তেজ
বাক্-এর অধিক বাকস্ফূর্তি তুমি,
গোলকে স্ফুরিত হয়ে এস পুনর্বার
পূর্বধর্ম ধারণ ক’রে সরাসরি উত্তম পুরুষে।আর
কত অর্থ যে নিহিত করে রাখো বীজাকারে
সেইসব ভাসমান বাক্যের অন্তরে,
শ্যত যা অর্থহীন অতি-অর্বাচীনদের কাছে।সঙ্কটে সঙ্কটে, সর্ব-আকারবিনাশী
দহন দলন আর দমনের দিনে
আদিগন্ত কুয়াশা-মোড়ানো সেই তৎকালীন রৌদ্রের মধ্যেই
চতুর্দিক থেকে একসঙ্গে আর
বৃক্ষে বৃক্ষে আর দ্রব্যে দ্রব্যে আর ভূতে ভূতে সর্বভূতে
মুহুর্মুহু উদ্ভাস তোমার, এক অবধানপূর্ব রহিমের রূপে।
ঘনক তো গোলকেরই এক অপূর্ব অপিনিহিতি।এইরূপে লীলা করো, লুকোচুরি, আমার সহিত।
আমি থাকি দূরের রূপতরঙ্গ গাঁয়, আর তোমার সহিত
তোমার সাহিত্যে দ্যাখো এভাবে আমার বেলা বয়ে যায়।
তখন আমি বগুড়ায় থাকি। ছোট ও নিরিবিলি একটি শহর। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৮। বেশ কয়েক বছর ছিলাম বগুড়ায়। মাঝখানে দুই বছর রংপুরে। এই দশ বছরে কত সখ্য, কত মাখামাখি, কবিতা-কবিতা করে কত পাগলামি, কত বয়ে যাওয়া,প্রাণপাত্র উপচে কত ছলকে-ছলকে-পড়া! প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে সারাদিন নিঙ্ড়ে নিচ্ছি প্রভূত প্রাণশক্তি আর তা উজাড় করে ঢেলে দিচ্ছি আমাদের সান্ধ্য আড্ডাগুলোতে। আমাদের দিনযাপন তখন কবিতাযাপনের নামান্তর। কবিতাকে সাক্ষী রেখেই আমাদের সূর্য উঠছে, সূর্য ডুবছে। কবিতার আবহেই আমাদের নিরন্তর ডুবে থাকা, কবিতার কোহলেই নিবৃত্তি আমাদের তাবৎ নেশা ও পিপাসা, কবিতা থেকেই অক্সিজেন গ্রহণ, আবার কবিতাতেই ত্যাগ আমাদের সকল আক্ষেপ, অভিমান, গ্লানি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড।
নিরীক্ষার ঘোর ও রেশ পুরাপুরি কাটেনি তখনো। ‘একটি চিত্রিত হরিণের পেছনে একটি চিত্রিত বাঘ ছুটছে’ ধরনের নিরীক্ষাধর্মী কবিতাও লিখছি, আবার পাশাপাশি এরকমও ভাবছি—নিরীক্ষার জটিল স্রোতে সাঁতার না কেটে সহজ-সাধারণ বিষয় নিয়ে অনুভূতি ও কল্পনার বিন্যাস ঘটিয়ে কবিতা রচনা করা যায় কি না, করলে কিভাবে করা যায়—এইসব।
আমার প্রথম বই ‘পাখিতীর্থদিনে’ বেরিয়েছিল ১৯৯৩ সালে। বিচিত্র সব উৎস থেকে—এমনকি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জগৎ থেকেও, আহরণ-করা শব্দ ও বিষয়বস্তুর সমাবেশ ঘটেছিল বইটিতে। ঘটেছিল অনেকটা অনিয়ন্ত্রিত কল্পনারাশির ক্রীড়া ও বিচরণ। সেইসঙ্গে ছিল আধার ও আধেয়গত, ভাষা ও শৈলীগত নিরীক্ষা। মশগুল থেকেছি শব্দের ওজোগুণ আর ধ্বনিঝঙ্কারের প্রেমে। কাব্যের লাগামছেঁড়া ঘোড়া-ছোটানোর সেই বেহিসাবী দিনগুলোতে আমার কাব্যকৃতি হয়তো সুযোগ পায়নি কেলাসিত হওয়ার, অনেক ক্ষেত্রেই। তখনকার অনেক কবিতাতেই ঘটেছে সঙ্গতি ও সুষমা-ভঙ্গ (এখন যে ঘটে না, তা নয়, অহরহই ঘটে)।
সময় যতই গড়িয়েছে, ধীরে ধীরে বদলে বদলে গেছে আমার নন্দনভাবনা। কবিতাকে ঘিরে বহুকাল ধরে বহু কথা ও কোলাহল জমে ওঠার পরও আমার কাছে মনে হয়েছে কবিতা, বা যে কোনো শিল্প, শেষপর্যন্ত রূপ-রচনা, সৌন্দর্য-সৃজন। যেহেতু ‘রূপ ও সৌন্দর্য’, তাই স্বাভাবিকভাবেই কবিতার ভাব ও ভাষা, আধার ও আধেয়—এদের পরস্পরের মধ্যে থাকে, থাকতে হয় সুষমা, সুসঙ্গতি, পরিমিতি ও ভারসাম্য। আবার কবিতা যেহেতু ’সৃজনলীলা’-ও, তাই তাতে থাকতে হয় বৈচিত্র্য, নতুনত্ব ও ‘মৌলিকত্ব’, যদিও সেই অর্থে কোনো কিছুই মৌলিক নয়, সবই যৌগিক।
দীক্ষা ॥ মাসুদ খান
পথ চলতে আলো লাগে। আমি অন্ধ, আমার লাগে না কিছু।
আমি বাঁশপাতার লণ্ঠন হালকা দোলাতে দোলাতে চলে যাব চীনে, জেনমঠে
কিংবা চীন-চীনান্ত পেরিয়ে আরো দূরের ভূগোলে…
ফুলে-ফুলে উথলে-ওঠা স্নিগ্ধ চেরিগাছের তলায় বসে মৌমাছির গুঞ্জন শুনব
নিষ্ঠ শ্রাবকের মতো, দেশনার ফাঁকে ফাঁকে।
মন পড়ে রইবে দূরদেশে। সাধুর বেতের বাড়ি পড়বে পিঠে,
দাগ ফুটবে সোনালু ফুলের মঞ্জরীর মতো স্নিগ্ধ সালঙ্কার।দীক্ষা নেব বটে মিতকথনের, কিন্তু
দিনে দিনে হয়ে উঠব অমিতকথক,
নিরক্ষর হবার সাধনা করতে গিয়ে আমি হয়ে উঠব অক্ষরবহুল
এই হাসাহাসিভরা ভুঁড়িটি ভাসিয়ে গল্প বলে যাব
কখনো প্রেমের ফের কখনো রাগের…
অথবা ধ্যানের, কিংবা নিবিড়-নিশীথে-ফোটা সুগভীরগন্ধা কোনো কামিনীফুলের।ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরবে মঠের মেঘলা আঙিনায়
ওদিকে অদূরে লালে-লাল-হয়ে-থাকা মাঠে পুড়তে থাকবে ঝাঁজালো মরিচ
সেই তথ্য এসে লাগবে ত্বকে ও ঝিল্লিতে।
আমি সেই মরিচ-পোড়ার গল্প বলব যখন–
উত্তেজিত হয়ে তেড়ে গিয়ে যুদ্ধে যাবে সবে, এমনকি বৃদ্ধরাও।
যখন প্রেমের গল্প– কমলায় রঙ ধরতে শুরু করবে সোনাঝরা নরম আলোয়।
আবার যখন গাইব সে-গন্ধকাহিনি, সেই ভেজা-ভেজা রাতজাগা কামিনীফুলের–
ঘ্রাণের উষ্ণতা লেগে গলতে থাকবে মধুফল দেহের ভেতর।
পরবর্তীকালে তাই, বিশেষ করে, ‘নদীকূলে করি বাস’-পর্ব থেকে, ধীরে ধীরে (অবশ্যই উল্লম্ফন আকারে নয়) অভিনিবেশী হয়েছি কবিতার সুষমা ও সঙ্গতির প্রতি। সুরের প্রতিও। প্রবণতা ছিল কবিতার ভাবে ও ভাষায়, রূপে ও রীতিতে বৈচিত্র্যগত পরিবর্তন আনবার, প্রয়াস ছিল কিছুটা সহজ ভাষায় তুলনামূলকভাবে জটিল ভাব প্রকাশের এবং কবিতাকে এক ধরনের সামগ্রিক অর্থময়তা দেওয়ার। এক বই থেকে আরেক বইয়ে বদলে বদলে যাওয়ার বা কিছু-কিছু প্রস্থানচিহ্ন রেখে যাওয়ার প্রবণতাও হয়তো দুর্লক্ষ্য নয়। আখ্যান, আখ্যানের ইশারা, কাহিনীচূর্ণ-এসবেরও সমাবেশ ঘটেছে আমার অনেক কবিতায়। কখনো-কখনো আধেয়-তে যুক্ত হয়েছে কজমো-মেটাফিজিক্সের ভাব, কখনো-বা সমাজ ও রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ। আঙ্গিকের দিক থেকে কোনো কোনো কবিতা হয়ে উঠেছে বর্ণনাত্মক, কোনো-কোনোটা আবার গীতিধর্মী, সুরেলা।