পাদবদ্ধোহক্ষরসমস্তস্ত্রীলয়সমন্বিতঃ।
শোকার্তস্য প্রবৃত্তো মে শ্লোকো ভবতুনান্যথা।
বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চমিথুন-বিয়োগজনিত শোকে ‘মা নিষাদ…’ ইত্যাদি বাক্য উচ্চারণ করলেন, তখন তিনি নিজেই মুগ্ধ হয়ে ভাবতে লাগলেন, এ আমি কী বললাম। তারপর ভেবে তিনি তাঁর শিষ্যকে এই শ্লোকটি বলেন, যার সরলার্থ—এই বাক্য পাদবদ্ধ, এর প্রতি পদে সমাক্ষর, ছন্দের তন্ত্রীলয়ে এ আন্দোলিত, আমি শোকার্ত হয়ে একে উচ্চারণ করেছি, এর নাম শ্লোক হোক।’ তাহলে দেখা যাচ্ছে বাল্মীকি তাঁর মুখ-নিঃসৃত বাণীকে শ্লোকের মর্যাদা যে যে গুণাবলীর কারণে দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি হলো ছন্দ। আমাদের বাংলা কবিতার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখবো যে চর্যাপদের সময় থেকেই ছন্দ কবিতার অনুগামী হয়েছে এবং বর্তমানে যারা যথার্থ কবি, তাদের পঙ্ক্তিমালায় ছন্দের চাষ-বাস লক্ষণীয়। এখন একটি অভিযোগ শোনা যায়, আধুনিক কবিতায় ছন্দ নেই। এটি মারাত্মক ভুল ধারণা। বিভিন্ন বিদগ্ধজন তাঁদের মননশীল সাহিত্যে এর প্রতিবিধান দিয়েছেন। পুনরাবৃত্তির ভয়ে এ সম্পর্কে কিছু বলার থেকে নিরস্ত থাকলেও বলতে চাই, তিরিশি আধুনিকীরা ছন্দের বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও তাঁরা ছন্দের কাছেই ছিলেন সমর্পিত। আর আমাদের বড় দুই কবি জসীমউদ্দীন এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছন্দছুট একটি কবিতাও রচনা করেননি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একটিমাত্র গদ্যকবিতা লিখেছেন, সেই কবিতা বিষয়ের দিক থেকে ছিল গদ্যকবিতার বিরুদ্ধগামী। কাব্যের আত্মা কী? এ প্রশ্ন নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। এর স্বীকৃত উত্তরটি হলো—যে বাক্য আমাদের মনে ব্যঞ্জনা জাগায় তা-ই কাব্য। অর্থাৎ ব্যঞ্জনা-ই কবিতার প্রাণ। ছন্দ এমন এক উপাদান, যা কবিতাকে আর শ্রুতিমধুর করে তোলে, মানুষের মনে দোলা দেয় এবং স্মরণ রাখতে সাহায্য করে। তাই পুরনো ও চিরায়ত একটি মতকে আবারও স্বীকার করে নেওয়া যায়, তাহলো ছন্দ কবিতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
কবি আবু হাসান শাহরিয়ার (জন্ম-২৫ জুন, ১৯৫৯) বিশ শতকের সত্তর দশকে সাহিত্য জগতে আবির্ভূত হন। প্রথমে ছড়াচর্চা, ছোটগল্প রচনার পাশাপাশি ছড়া ও ছোটগল্পের গ্রন্থাকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও আবু হাসান শাহরিয়ারের প্রধান পরিচয় তিনি কবি। বর্তমানে সফল সম্পাদক ও কলামিস্ট হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও তাঁর প্রধান সিদ্ধি কবিতায়। কবিতায় তিনি স্বতন্ত্র স্বর নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। নিজস্ব বাক্-ভঙ্গির কারণে খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায় কোনটি আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতা। আবু হাসান শাহরিয়ার উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প নির্মাণ, আঙ্গিকগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি বাংলা ভাষার তিন ধরনের ছন্দ ব্যবহারেই মু্ন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। প্রখ্যাত কবি, প্রাবন্ধিক আবদুল মান্নান সৈয়দ অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে বাংলা কবিতার মেরুদণ্ড হিসেবে অভিহিত করেছেন। এছাড়া অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বর্তমানে কবিদের অধিক প্রিয় হলেও আবু হাসান শাহরিয়ারের প্রথম দিকের কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো বেশিরভাগই মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তে রচিত। সব ধরনের ছন্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রেই তাঁর নিরীক্ষা প্রবণ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন—
রাস্তা ছিল / চওড়া তবু / রাস্তা ছেড়ে / আমি
খোলা মাঠের / মধ্যে নেমে / পড়ি।
রাস্তা সে কী / দ্রুত, সে কী / অহঙ্কারে / চলে।
রাস্তা যাদের, / তাদের সাথে / পাল্লা দেওয়া / সাজে?আমি পরম / নির্ভরতায় / একাকী পায় / দলে
মর্জিমাফিক / চলি।
মাঠের গতি / একটু ঢিলে / ঢালা—
একটু জিরেন, / একটু হাঁটা, / হঠাৎ করে / ঠা ঠা
অট্টহাসি / দিয়ে কাঁপাই / মাটির স্থবি / রতা।রাস্তা যাদের, / তারাও থামে। / ব্যগ্র জ্যোতি / ঢেলে
তারাও তাকায় / সবুজ মাঠের / দিকে।
হাওয়ায়-হাওয়ায় / উড়ে তখন / রাজার অট্ট / হাসি
দিগন্তবি / স্তৃত।
( রূপকথার রাজা)
কবিতাটি মুক্তক স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। কবিতাটির মাত্রাবিন্যাস হলো:
৪+৪+৪+২
৪+৪+২
৪+৪+৪+২
৪+৪+৪+২৪+৪+৪+২
৪+২
৪+৪+২
৪+৪+৪+২
৪+৪+৪+২৪+৪+৪+২
৪+৪+২
৪+৪+৪+২
৪+২
তেরো চরণের এই কবিতাটি তিন স্তবকে বিন্যস্ত। এর পূর্ণপর্ব চার মাত্রার ও অপূর্ণ পর্ব দুই মাত্রার। লক্ষণীয় প্রতি চরণে-ই অপূর্ণ পর্বের ব্যবহারের ফলে স্বর-তরঙ্গে এসেছে ভিন্নতা। স্বরবৃত্তের চিরাচরিত দোলা এখানে নেই। কবিতার ১ম, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম, ৮ম, ৯ম, ১০ম, ১২তম চরণ স্বরবৃত্তে রচিত। স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা আবু হাসান শাহরিয়ারের আরেকটি কবিতা:
ভিক্ষা যদি করিই, হব রাজভিখিরি
. সোনার থালা ধরব মেলে—
দিতে চাইলে মোহর দিও রাজকুমারী
মোহর দিও, মোহর দিও, মোহর দিও।কানাকড়ির চেয়ে আমার শূন্য থালা, সোনার থালা
. অনেক দামি
তাই সামান্য দিলে আমার ভরবে না মন;
ভিক্ষা যদি করিই, তুমি মোহর দিও।রাজকুমারী, তোমাকে চাই। নেই অর্ধেক রাজত্বে লোভ।
রাজমুকুটের লালসা নেই, সিংহাসনে বসার চেয়ে
তোমার পায়ের কাছে বসে থাকা
. অধিক প্রিয়।
তাই সামান্য দিলে আমার ভরবে না মন;
ভিক্ষা যদি করিই, তুমি মোহর দিও।
( মোহরপ্রার্থী )
কবিতার পর্ব ও মাত্রাবিন্যাস—
৪+৪+৪
৪+৪
৪+৪+৪
৪+৪+৪৪+৪+৪+৪
৪+৪+৪+৪
৪
৪+৪+৪
৪+৪+৪৪+৪+৪+৪
৪+৪+৪+৪
২+৪+৪
৪
৪+৪+৪
৪+৪+৪
প্রবহমান মুক্তক স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত চৌদ্দ চরণের এই কবিতাটি তিন স্তবকে সাজানো। তবু আগের কবিতাটির চেয়ে এই কবিতায় ছন্দের লয়ের প্রার্থক্য খুব সহজেই কানে ধরা পড়ে। প্রথম পর্বে যেখানে প্রতি চরণান্তে অপূর্ণ পর্বের ব্যবহার, সেখানে এই কবিতায় কোনো অপূর্ণ পর্বের ব্যবহার-ই নেই। পূর্ণ পর্বের মাত্রা সংখ্যা চার। তৃতীয় স্তবকের তৃতীয় লাইনের শুরুতে অতিপর্বের ব্যবহার রয়েছে। সাধারণত স্বরবৃত্তছন্দ দ্রুত লয়ের হয়ে থাকে, এজন্য পঙ্ক্তির শেষে অপূর্ণ পর্ব রাখা হয় বিশ্রামের জন্য। কিন্তু এ কবিতায় অপূর্ণ পর্বের ব্যবহার না থাকায় কোনো বিশ্রামের কোনো জায়গা তৈরি হয়নি। এছাড়া পর্ব বিন্যাসে অসমতা থাকার পরও প্রথম ও দ্বিতীয় স্তবকের পূর্ণ পর্ব কিংবা মাত্রা সংখ্যা সমান। তাই বাহ্যিক দৃষ্টিতে অসমতা দেখা গেলেও এর অন্তর্গত ধ্বনির সমতা পাঠকের শ্রবণ-ইন্দ্রিয়ে ধরা দেয়। যা নিঃসন্দেহে আবু হাসান শাহরিয়ারের স্বরবৃত্ত ব্যবহারের মুন্সিয়ানার পরিচয় বহন করে। স্বরবৃত্তে সাধারণত চার মাত্রার পূর্ণপর্ব হলেও কখনো কখনো সে পাঁচ বা তিন মাত্রা নিয়েও অনায়াসে তার চাল অক্ষুণ্ন রাখতে পারে। আবু হাসান শাহরিয়ার স্বরবৃত্তের এই শক্তিকেও কাজে লাগিয়েছেন—
৪ ৪ ৪ ৪
‘আকাশ’ লিখতে / চন্দ্রবিন্দু / বসিয়ে দিলে / ‘আ’—এর মাথায়
৪
লিখলে ‘আঁকাশ’।(শব্দাকাশে চাঁদ উঠেছে)
এছাড়া বিশেষ আঙ্গিকে লেখা তাঁর ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’ কাব্যগ্রন্থের সবক’টি কবিতাই স্বরবৃত্তে রচিত, যা তাঁর স্বরবৃত্তপ্রীতির পরিচয় বহন করে।
দুই
বদ্ধাক্ষরকে দুই মাত্রার মর্যাদা দিয়ে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সুপ্ত শক্তিকে আবিষ্কার করেন রবীন্দ্রনাথ। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে বদ্ধাক্ষর দুই মাত্রার হওয়ায় এর লয় বেশ ধীর। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। কবি শাহরিয়ার স্বরবৃত্তের পাশাপাশি মাত্রাবৃত্তেও প্রচুর কবিতা লিখেছেন। মাত্রাবৃত্ত্ সাধারণত ৬ মাত্রার চাল বেশি ব্যবহৃত হলেও তিনি পাঁচ মাত্রার চাল-ই প্রথম দিকের কবিতায় বেশি ব্যবহার করেছেন।
৫ ৫ ২
চৈত্রে আজ / বৃক্ষ পাতা / হীন
৫ ৫ ২
নড়ে না ঝড়ে, / দোলে না এক / তিলও
৫ ৫ ২
তুমিতো জানো / এখানে সব / ছিল।
৫ ৫ ২
তুমিতো জানো / তুমিতো সব / জানো।
(পড়োরাত্রি পড়োদিন—২)
অথবা,
৫ ৫ ৫ ২
‘কুত্তা আসে / কুত্তা যায় / কুত্তা যায় / আসে৫ ৫ ৫ ২
রাধার লাশ / দেখে এলাম / পাট ক্ষেতের / পাশে
(রাধার লাশ)
এখানে আঞ্চলিক শব্দের যথার্থ ব্যবহার লক্ষণীয়। তবে ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্তের চরণও রচনা করেছেন:
৬ ৬ ২
নারী নও তুমি; / স্বপ্নপ্রাপ্ত / হীরে
৬ ৬ ২
গোপন শোকেসে / সাজিয়ে রেখেছি / আর
৬ ৬ ২
হাঁটু মুড়ে আমি / বসে আছি সম্ / মুখে
৬ ৬ ২
একটি জীবন / তোমাকে দিয়েছি / ধার।
(তুমি)
চরণগুলো মাত্রাবৃত্ত পয়ারে সাজানো। মাত্রাবৃত্ত পয়ারে তিনি আরও কবিতা লিখেছেন। মাত্রাবৃত্তে প্রধানত ছয়, পাঁচ মাত্রার চাল-ই বেশি। তবে চার, সাত, আট মাত্রার চালও দেখা যায় কিন্তু সংখ্যায় কম।
আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতায় সাত মাত্রার পর্বও আমরা দেখতে পাই—
জাহাজ ছেড়ে গেছে / জাহাজ ছেড়ে যায়
পেছনে ফেলে যায় / বন্দর
নাবিক খালাশিরা / অপার ঢেউ চেনে
জীবন চেনে খানা / খন্দ
(ভূমিকাব্য)
মাত্রাবিন্যাস:
৭+৭
৭+৪
৭+৭
৭+৩
ছন্দ সবসময় বক্তব্যের অনুগামী হবে। সাত মাত্রার চাল পাঁচ বা ছয় মাত্রার চেয়ে ধীর। এখানে সাত মাত্রার ধীর লয়ের সাথে ধীরে ধীরে বন্দর থেকে জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার গতির সাথে সাদৃশ্যময়, যা কবিতার বক্তব্যকে পাঠকের কাছে আরও হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে। এছাড়া নানা আঙ্গিকে তিনি মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার করেছেন। যেমন মাত্রাবৃত্তে রচিত সম্পূর্ণ কবিতায় অতি পর্বের ব্যবহার, যা অন্যরকম দোলা তৈরি করে:
নতুন পুরানো হয়ে যায়
পুরানো নতুন হয়ে আসে।
মানুষ বদলে যেতে-যেতে
পেছনে তাকাতে ভালবাসে।
(খনন)
ছয় মাত্রার অসম চরণের মাত্রাবৃত্ত:
৬ ৬ ৬
তুমি তোমাকেই / খুঁজে হয়রান।/ যেখানেই যাও,
৬ ৬
যেখানে দাঁড়াও, / যত দূর চোখ
৬ ৬ ৬
ছুটে যায়, পথ / যেখানে হারায়— / তুমি তোমাকেই৬
পেতে চাও শুধু।
(ভ্রমণ)
তিন.
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেছেন, ‘বাংলা ছন্দত্রয়ের মধ্যে প্রসার গুণে অক্ষরবৃত্ত অদ্বিতীয়।’ অক্ষরবৃত্তের প্রাচীনরূপ পাওয়া যায় ‘চর্যাপদে’। মধ্যযুগে অক্ষরবৃত্ত-ই পয়ার নামে পরিচিত ছিল। আধুনিক কালে অক্ষরবৃত্তেরই জয়-জয়কার। আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতাতেও অক্ষরবৃত্ত অপ্রচুর নয়। অনেক কবিতাই তিনি রচনা করেছেন অক্ষরবৃত্তে। যেমন:
শোনো শোনো শবর পা শোনো চন্দ্রাবতী
তোমাদেরই নামে আমি জানাই প্রণতি
তোমাদেরই নামে করি আকুলি-বিকুলি
সুরে গান বান্ধি খাতা পদ্যে ভরে তুলি
তোমাদেরই পুত্র আমি মাটি-বংশধর
পৃথিবীর শত কবি সহস্র ধীবর
সকলই আমার ভাই শব্দ-সহোদর
যাহারা আসিয়াছিল আসে নাই যারা
সকলই আমার মতো শব্দে দিশাহারা
(ব্রাত্য গীতিকা)
কবিতাটি চৌদ্দ মাত্রার পয়ারে লেখা। পুরো কবিতাটিতে পয়ারের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। প্রতি চরণে ভাবের শেষ। প্রথম চরণের সাথে দ্বিতীয় চরণের অন্তমিল আছে। তবে পয়ারের প্রথম চরণ শেষে এক দাঁড়ি, দ্বিতীয় চরণ শেষে দুই দাঁড়ির নিয়ম এখানে রক্ষিত না হলেও প্রতি স্তবক শেষে দুই দাঁড়ি ব্যবহার করা হয়েছে।
মূলত আবু হাসান শাহরিয়ার ঐতিহ্য সন্ধানী— ‘মাটি-বংশধর’। তবে ঐতিহ্যের কঙ্কালমূর্তিকে পুজো নয়, ঐতিহ্যকে আধুনিকতার সাথে নবায়ন করে নেন তিনি। সেটা কী বিষয়ে, কী আঙ্গিকে, কী ছন্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। সব ক্ষেত্রেই তিনি নবায়ন-পন্থী। তাই তাঁর কবিতা যেমন ঐতিহ্যের ধারক, তেমনি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
আধুনিক যুগ পেরিয়ে উত্তরাধুনিক যুগ চলমান। উত্তরাধুনিকতার ধামাকায় অনেক অকবিও কবি বনে যাচ্ছেন শব্দের পর শব্দ জোড়া দিয়ে, না জেনে ‘ছন্দ মানি না’ এই অহঙ্কারের ওপর দাঁড়িয়ে। দিস্তার পর দিস্তা ভরে তুলছেন গদ্য-ফর্মে গদ্যকবিতার নামে শূন্য ব্যঞ্জনার গদ্য লিখে।
আবু হাসান শাহরিয়ারও গদ্যছন্দে বেশ কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ’, ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’ ও ‘সে থাকে বিস্তর মনে বিশদ পরানে’ কাব্যত্রয়ীর কবিতাগুলো টানা গদ্যে লেখা। এছাড়া তাঁর ‘বালিকা আশ্রম’ গ্রন্থের ৭৬ সর্গের ৩৮টি সর্গ টানা গদ্যের আঙ্গিকে লেখা। কিন্তু যিনি নবায়নে আস্থাবান, স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী। যিনি বিশ্বাস করেন, ‘ছন্দ উচ্ছেদের আগে ছন্দ শেখা বাঞ্ছনীয়’, তিনি তো টানা গদ্যের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাতে পারেন না; আসলে তিনি তা করেনওনি। তাঁর টানা গদ্যে লেখা কবিতার দুই/একটি নমুনা দেখা যাক:
ক.
‘এ পোড়াবাড়ির নাম ‘কাব্যলক্ষ্মী’;— নিলামে উঠেছে। মেটিয়াব্রুজের
বুড়ো দর্জি গেছে ঠাকুরবাড়িতে। ফেরে না ফিটন গাড়ি; অস্ত গেছে
বিলেতি মেমেরা। বুকের-পাছার মাপে ওস্তাগরি কবেই চুকেছে।
ইতিহাসই বড় কবি;— কুপিকাব্য লেখে কেরোসিনে। টিপু
সুলতানের নাতি বসেছিল সেলাই মেশিনে।’
(ইতিহাসই বড় কবি; কুপিকাব্য লেখে কেরোসিনে)
খ.
প্রেমের সন্ন্যাসী আমি, থাকি কল্পতরুমূলে একা। সেখানে পার্বতী আসে,
বুকে তার চন্দনের ঘ্রাণ। রতিকলাবৃত্ত ছন্দে লেখা এই প্রেমের পুরাণ…
(বালিকা আশ্রম—১)
ছন্দ-অজ্ঞ যে কেউ-ই উদাহরণ দুটিকে গদ্য কবিতার নমুনা হিসেবে গ্রহণ করবে। কিন্তু সচেতন পাঠক মাত্র-ই বুঝতে পারবেন গদ্য-এর বহিরঙ্গে; টানা গদ্যের ফর্ম শুধু এই কবিতার খোলসমাত্র, এই খোলসের অভ্যন্তরে অন্তঃসলিলার মতো আছে অক্ষরবৃত্তের ঢেউ। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য পর্বানুসারে পঙ্ক্তি ভেঙে মাত্রা নির্ণয় করা যেতে পারে—
ক.
৮ ৪ ৬
এ পোড়াবাড়ির নাম /‘কাব্যলক্ষ্মী’;/— নিলামে উঠেছে।
৮ ৪ ৬
মেটিয়াব্রুজের বুড়ো / দর্জি গেছে / ঠাকুরবাড়িতে।
৮ ৪ ৬
ফেরে না ফিটন গাড়ি; / অস্ত গেছে / বিলেতি মেমেরা।
৮ ৪ ৬
বুকের-পাছার মাপে / ওস্তাগরি / কবেই চুকেছে।
৮ ৪ ৬
ইতিহাসই বড় কবি; / — কুপিকাব্য / লেখে কেরোসিনে।
৮ ৪ ৬
টিপু সুলতানের নাতি / বসেছিল / সেলাই মেশিনে।
খ.
১০ ১০
প্রেমের সন্ন্যাসী আমি, / থাকি কল্পতরুমূলে একা।
১০ ১০
সেখানে পার্বতী আসে, / বুকে তার চন্দনের ঘ্রাণ।
১০ ৮
রতিকলাবৃত্ত ছন্দে লেখা / এই প্রেমের পুরাণ…
তাহলে দেখা যাচ্ছে গদ্যের আড়ালে তিনি অক্ষরবৃত্তের দোলা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ক-এর উদাহরণতো পষ্টই আঠারো মাত্রার মহাপয়ার। পাঠককে যেমন রহস্যের আবরণ সরিয়ে কবিতার মূল বক্তব্যের কাছে পৌঁছাতে হয়, কখনও হয়তো পৌঁছাতেও পারেন না; আবু হাসান শাহরিয়ারও তেমনি অক্ষরবৃত্তের চাদরে ঢেকে দিয়েছেন পঙ্ক্তিমালা। কান সজাগ না থাকলে যে ছন্দ অধরাই থেকে যাবে পাঠকের কাছে। আলোচ্য চারটি গ্রন্থের গদ্যকবিতার আড়ালে তিনি ছন্দের চাষবাস করেছেন। অক্ষরবৃত্তে রচিত আরও কিছু কবিতার নমুনা দেখা যাক। দশ মাত্রার সমিল অক্ষরবৃত্ত:
নিন্দুকের তাবৎ কেচ্ছাই
অপরের বাড়া ভাতে ছাই।
কৃপণের ব্যক্তিগত সুখ
লোটে সমবায়ের সিন্দুক।
(বিস্মরণ)
বাইশ মাত্রার দীর্ঘ পঙ্ক্তি:
জোছনা ভালবাসো বলে তুমি চাঁদের বউ, চন্দ্রাবতী নাম?
ঐ চাঁদও শতবর্ষী; আমার মতোই সে-ও বিবাহ মানে না।
(বন্ধ দরজায়, ঝুলন্ত তালায় : চিরকুট ৭)
ছন্দ ব্যবহারে এই বৈচিত্র্য, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আবু হাসান শাহরিয়ারের মু্ন্সিয়ানাই প্রকাশ করে। আর এই মু্ন্সিয়ানা-ই কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের গোত্র চিনতে সাহায্য করে। তিনি ছন্দকে কবিতায় অপরিহার্য করে তুলেছেন। নিরূপিত তিন ছন্দ-ই তাঁর হাতে ব্যবহার গুণে হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র।