ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও।
(ঝিনুক নীরবে সহো)
কবি আবুল হাসান। জন্ম ১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট। উপমহাদেশের স্বাধীনতার মাত্র কয়েকদিন আগে জন্ম নেওয়া এই কবি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কয়েকবছর পর ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র কয়েক বছরের জীবনে তিনি দেখেছেন দু’টি দেশের জন্ম। দু’টি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তিনি দেখেছেন, স্বপ্ন থেকে গড়ে ওঠা একটি দেশে কিভাবে আবার রক্তাক্ত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে নতুন জন্ম নেয়। একইভাবে রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বদেশেও কিভাবে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, অপূর্ণতা আর হতাশা গ্রাস করে মানুষকে। কেমন করে স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে মানুষকে আবার সংগ্রামী হয়ে উঠতে হয়। স্বাধীন দেশের পবিত্র মাটি আবার কী করে রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে।
বাংলা কবিতার ইতিহাসের যে সময়ে বেড়ে উঠেছেন আবুল হাসান, সে সময়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর পরিবেশ তাকেও আচ্ছন্ন করে রেখেছে তার সমসাময়িক অন্য কবিদের মতোই। তিনি উত্তাল সময়ের পথিক হিসেবে নিজের কবিতায় তুলে এনেছেন নিজের সময়কে। তবে তার সময়ের অন্য কবিদের মতো আবুল হাসানের কবিতায় উচ্চস্বর নেই, বরং তিনি মৃদুস্বরে তুলে এনেছেন আত্মকেন্দ্রিক দুঃখবোধ। যা তার নিঃসঙ্গচেতনারও স্মারক, তবে এই নিঃসঙ্গচেতনা শুধু একা আবুল হাসানের নয়, তা হয়ে ওঠে তার কবিতার সব পাঠকের। ফলে এক দশকের কাব্যচর্চার আয়ুতেও তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক মাইলফলক। তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা তিনটি। ‘রাজা যায় রাজা আসে’, ‘যে তুমি হরণ করো’ ও ‘পৃথক পালঙ্ক’। তিনটি কাব্যগ্রন্থই প্রকাশিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার পর, স্বাধীন বাংলাদেশে।
মাত্র ২৮ বছরের জীবনে আবুল হাসান অনেক অবিস্মরণীয় কবিতা রচনা করে নিজে যেমন স্মরণীয় হয়েছেন, তেমনি বাংলা কবিতাকেও সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি সবসময়ই আশার আলো দেখেছেন, নিজের ভেতরে, সমাজের ভেতরে, মানুষের ভেতরে। স্বপ্ন দেখেছেন নতুনের। ফলে তার কবিতা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সময় ও সম্ভবনার কথা। ওই সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শোষণ আর বঞ্চনার সঙ্গে যখন যোগ হয়েছে নতুন দেশের স্বপ্ন, তখন তিনিও স্বপ্ন দেখেছেন স্বাধীনতার। তবে তার সেই স্বপ্ন দেখার মধ্যে যেমন রয়েছে নিজেকে জড়িয়ে রাখার অনুভূতি তেমনি রয়েছে সমগ্রকে ধরে রাখার আকুলতা। তাই ওই সময়ের কবিতার অস্থিরতার বিপরীতে তার কবিতা হয়ে ওঠে শৈল্পিক প্রকাশ:
লক্ষ্মী বউটিকে
আমি আজ আর কোথাও দেখি না,
হাটি হাটি শিশুটিকে
কোথাও দেখি না,
কতগুলি রাজহাঁস দেখি
নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি,
কতগুলি মুখস্থ মানুষ দেখি, বউটিকে কোথাও দেখি না
শিশুটিকে কোথাও দেখি না!তবে কি বউটি রাজহাঁস?
তবে কি শিশুটি আজ
সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ?
অনেক রক্ত যুদ্ধ গেলো,
অনেক রক্ত গেলো,
শিমুল তুলোর মতো
সোনারূপো ছড়ালো বাতাস।
ছোটো ভাইটিকে আমি
কোথাও দেখি না,
নরোম নোলক পরা বোনটিকে
আজ আর কোথাও দেখি না!
কেবল পতাকা দেখি,
কেবল উৎসব দেখি,
স্বাধীনতা দেখি,
তবে কি আমার ভাই আজ
ঐ স্বাধীন পতাকা?
তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?
(উচ্চারণগুলি শোকের )
কবিতায় আবেগের ব্যবহার প্রয়োজন, আবেগের যথার্থ প্রকাশ ছাড়া অনুভূতির তীব্রতা স্পষ্ট করা সম্ভব নয়। তবে সেই আবেগের ব্যবহার যেখানে সংযত, সেখানেই কবিতার পূর্ণতা। সেই কবিই সময়কে, নিজের দশককে উতরে যান, যিনি আবেগের সঙ্গে নিজের মেধা ও মননের সেতু তৈরি করে তাকে প্রকাশ করতে পারেন। ভাবাবেগই শুধু নয়, বরং বুদ্ধির দীপ্তিও কবিতাকে আচ্ছন্ন করে রাখলেই শুধু অনবদ্য কবিতার জন্ম হতে পারে। অপ্রাপ্তিজনিত হতাশা আর দুঃখের চাদের জড়ানো অনুভূতিকে আবুল হাসান শুধু আবেগ নয়, বরং তার সঙ্গে মেধা ও মননের সেতু বন্ধন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে তার কবিতা হয়ে উঠেছে ওই সময়ে ভিন্নস্বর। জীবনানন্দ দাশের প্রভাবকে আত্মস্থ করেই তিনি স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছেন। ফলে বাংলা কবিতায় আবুল হাসান অবশ্য পাঠ্যতালিকায় যুক্ত হয়েছেন।
বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের অপ্রাপ্তি, হতাশা আর দুঃখবোধকে তিনি নিখুঁত শিল্পীর তুলিতে প্রকাশ করেন, ফলে পাঠকের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয় আবুল হাসানের কবিতার:
মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না,
আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে
আমার মৃত্যুর আগে বলে যেতে চাই,
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন
কী লাভ যুদ্ধ করে? শত্রুতায় কী লাভ বলুন?
আধিপত্যে এত লোভ? পত্রিকা তো কেবলি আপনাদের
ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস আর বিনাশের সংবাদে ভরপুর
মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামল না।পৃথিবীতে তবু আমার মতোন কেউ রাত জেগে
নুলো ভিখিরীর গান, দারিদ্র্যের এত অভিমান দেখল না।
আমাদের জীবনের অর্ধেক সময় তো আমরা
সঙ্গমে আর সন্তান উৎপাদনে শেষ করে দিলাম,
সুধীবৃন্দ, তবু জীবনে কয়বার বলুন তো
আমরা আমাদের কাছে বলতে পেরেছি,
ভালো আছি, খুব ভালো আছি?
(জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন )
আবুল হাসানের কবিতায় উঠে এসেছে মানুষ। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’—মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাসের এই মানুষ ভজনাই আবুল হাসানের কবিতার প্রাণ। তার সময়ের কবিদের কবিতায় উঠে এসেছে রাজনৈতিক চেতনা, আবুল হাসানও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে তিনি সরকারি রাজনীতিকে কবিতার বিষয় করে তোলেননি, স্পষ্ট করে বললে তার কবিতা রাজনৈতিক স্লোগান হয়ে ওঠেনি, বরং ব্যক্তি মানুষের মনের সঙ্গে পারিপার্শ্বিকতার যোগ ঘটিয়ে তিনি এক্ষেত্রে শিল্পকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ তিনি জানতেন, বিশ্বাস করতেন, ‘শিল্প তো নিরাশ্রয় করে না, কাউকে দুঃখ দেয় না কোনো হীন সিদ্ধান্তের মতো।’ (স্বাতীর সঙ্গে এক সকাল)। তিনি শিল্পকে বলেছেন স্বাতীর বুকের মানবিক হৃদপিণ্ড। ‘তাই আমি তার হৃদপিণ্ডে বয়ে যাই চিরকাল রক্তে আমি/ শান্তি আর শিল্পের মানুষ!’ এই মানবিক বোধই আবুল হাসানকে কবি করে তুলেছে। মানবিকতার প্রতি বিশ্বাস থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন শিল্পের মানুষ:
দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদী রাখবো না আর আমার ভেতর
সেখানে বুনবো আমি তিন সারি শুভ্র হাসি, ধৃতপঞ্চইন্দ্রিয়ের
সাক্ষাৎ আনন্দময়ী একগুচ্ছ নারী তারা কুয়াশার মতো ফের একপলক
তাকাবে এবং বলবে,‘তুমি না হোমার? অন্ধ কবি ছিলে? তবে কেন হলে
চক্ষুষ্মান এমন কৃষক আজ? বলি কী সংবাদ হে মর্মাহত রাজা?
এখানে আঁধার পাওয়া যায়? এখানে কি শিশু নারী কোলাহল আছে?
রূপশালী ধানের ধারণা আছে? এখানে কি মানুষেরা সমিতিতে মালা
পেয়ে খুশি?গ্রিসের নারীরা খুব সুন্দরের সর্বনাশ ছিল। তারা কত যে উল্লুক!
ঊরুভুরুশরীর দেখিয়ে এক অস্থির কুমারী কত সুপুরুষ যোদ্ধাকে
তো খেলো!
আমার বুকের কাছে তাদেরও দুঃখ আছে, পূর্বজন্ম পরাজয় আছে
কিন্তু কবি তোমার কিসের দুঃখ? কিসের এ হিরণ্ময় কৃষকতা আছে?
মাটির ভিতরে তুমি সুগোপন একটি স্বদেশ রেখে কেন কাঁদো
বৃক্ষ রেখে কেন কাঁদো? বীজ রেখে কেন কাঁদো? কেন তুমি কাঁদো?
নাকি এক অদেখা শিকড় যার শিকড়ত্ব নেই তাকে দেখে তুমি ভীত আজ?
ভীত আজ তোমার মানুষ বৃক্ষশিশু প্রেম নারী আর নগরের নাগরিক ভূমা?বুঝি তাই দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও তুমি অনাবাদী রাখবে না আর
এম্ফিথিয়েটার থেকে ফিরে এসে উষ্ণ চাষে হারাবে নিজেকে, বলবে
ও জল, ও বৃক্ষ, ও রক্তপাত, রাজনীতি ও নিভৃতি, হরিৎ নিভৃতি
পুনর্বার আমাকে হোমার করো, সুনীতিমূলক এক থরোথরো দুঃখের
জমিন আমি চাষ করি এদেশের অকর্ষিত অমা!
(কালো কৃষকের গান)
আবুল হাসান প্রেমিক কবি। ভালবেসেই তিনি দায়বদ্ধ। আর এই দায়বদ্ধতাকে তিনি প্রেমিক সত্ত্বার বাইরে নিয়ে যান নি। প্রেমই তাকে যেমন মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলেছে, তেমনি প্রেমই তাকে করে তুলেছে দ্রোহী। তবে তার এই দ্রোহ একজন প্রেমিকের মতোই নতমুখী, বিনম্র তার ভাষা, তা কেবলি যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে, দগ্ধ করে, পুড়ে পুড়ে খাঁটি হীরাতে পরিণত করে, কিন্তু সেই সেই থেকে কোনো দ্রোহের আগুন মানুষের দিকে তার লেলিহান থাবা বাড়িয়ে দেয় না। তাকে গ্রাস করতে আসে না। ভালবাসলে মানুষ একা হয়ে যায়, নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। সে নিঃষঙ্গতার ছায়া একা একা গ্রাস করতে থাকে ভালবাসার মানুষকে। একা একা ভাবাতে থাকায়, কল্পনার পাখা মেলতে থাকে, সেখানে সৌন্দর্যের কল্পনা থাকে। থাকে অতৃপ্তির দুঃখবোধ। কিন্তু সেই প্রেমে, সেই কল্পনায় অনিষ্ঠের কালো ছায়া থাকে না। আবুল হাসানও কবিতায় ব্যক্তির অপ্রাপ্তির সেই দুঃখবোধ থেকেই নিজেকে প্রকাশ করেছেন। অপূর্ণতার পূর্ণতা খুঁজেছেন। যন্ত্রণামুখর জীবনের ভেতর থেকে একমুঠো রোদ খুঁজেছেন। নিঃসঙ্গতাকে ভাষায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রকাশ যন্ত্রণায় উন্মুখ হয়েছেন:
এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো, তোমার ভিতরে এক অসম্পূর্ণ যাতনা আছেন,
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই শুদ্ধ হ, শুদ্ধ হবো
কালিমা রাখব না!এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
তোমার ওখানে যাবো; তোমার পায়ের নীচে পাহাড় আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই স্নান কর
পাথর সরিয়ে আমি ঝর্ণার প্রথম জলে স্নান করবো
কালিমা রাখবো না!
এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়াতোমার ভিতরে এক সাবলীল শুশ্রূষা আছেন
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই ক্ষত মোছ আকাশে তাকা
আমি ক্ষত মুছে ফেলবো আকাশে তাকাবো
আমি আঁধার রাখবো না!এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া
যে সকল মৌমাছি, নেবুফুল গাভীর দুধের সাদা
হেলেঞ্চা শাকের ক্ষেত
যে রাখাল আমি আজ কোথাও দেখি না– তোমার চিবুকে
তারা নিশ্চয়ই আছেন!তোমার চিবুকে সেই গাভীর দুধের শাদা, সুবর্ণ রাখাল
তিনি যদি আমাকে বলেন, তুই কাছে আয় তৃণভূমি
কাছে আয় পুরনো রাখাল!
আমি কাছে যাবো আমি তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না!
(তোমার চিবুক ছোঁবো, কালিমা ছোঁবো না)
আবুল হাসান জানতেন বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একা। তাই তিনি বলতে পেরেছেন, ‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা! জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!’ সেই অচেনা মানুষের চেনা দুঃখগুলো বর্ণনার ক্ষেত্রে তাই তিনি ছিলেন নিপুণ কারিগর। ফলে তার কবিতা হয়ে উঠেছে চিত্রকল্পময়। তিনি কবিতায় ছবি নির্মাণ করেন। ফুঁটিয়ে তোলেন দৃশ্য। ফলে তার কবিতা হয়ে ওঠে দৃশ্যের বর্ণিল উপস্থাপন। কবিতাকে তার এই চিত্রময় করে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি কখনোই অসম্ভব, অবাস্তব কোনও ছবি ব্যবহার করেননি। চির পরিচিত দৃশ্যকেই তিনি বর্ণনার গুণে করে তুলেছেন আলাদা। দেখার এবং ভাবনার চোখকে মিলিয়ে তিনি কবিতায় দৃশ্য এঁকেছেন। তাই তার কবিতা কখনোই কষ্ট কল্পনা নয়। বরং নিজেকে, নিজের পরিবেশকে মিলিয়ে দেখার সুযোগ থেকে পাঠকও একাত্ম হয়ে ওঠে তার কবিতার সঙ্গে। নিজেকে খুঁজে পেতে সাহায্য করে আবুল হাসানের কবিতা। ফলে কবির মতো আলোড়িত হয়ে ওঠে তার পাঠকও। মানুষের অধিকার আর অধিকার বঞ্চনার কথামালা আবুল হাসানকে পীড়া দিয়েছে। যে ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল। তার বাস্তবায়ন আজও হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের অল্প পরেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে দারিদ্র্য আর ক্ষুধা তার ভয়াল থাবা বসায়। সেই দুঃখ, সেই কষ্ট আবুল হাসানকে ছুঁয়ে যায়:
আমি জানিনা দুঃখের কী মাতৃভাষা
ভালোবাসার কী মাতৃভাষা
বেদনার কী মাতৃভাষা
আমি জানিনা নদীর কী মাতৃভাষা
নগ্নতার কী মাতৃভাষা
একটা নিবিড় বৃক্ষ কোন ভাষায় কথা বলে এখনো জানি না।
শুধু আমি কোথাও ঘরের দরোজায় দাঁড়ালেই আজো
সভ্যতার শেষ মানুষের পদশব্দ শুনি আর
কোথাও করুণ জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে,
আর সেই জলপতনের শব্দে সিক্ত হতে থাকে
সর্বাঙ্গে সবুজ হতে থাকে আমার শরীর।
সর্বাঙ্গে সবুজ আমি কোথাও ঘরের দরোজায় দাঁড়ালেই আজো
পোষা পাখিদের কিচিরমিচির শুনি
শিশুদের কলরব শুনি
সুবর্ণ কঙ্কন পরা কামনার হাস্যধ্বনি শুনি!
(মাতৃভাষা)
সময়ের প্রয়োজনেই আবুল হাসানের কবিতা হয়ে উঠেছে ব্যতিক্রম। সময়ের তীব্রতম প্রকাশ হয়েও তার কবিতা কখনোই হয়ে ওঠেনি রাজনীতির ভাষা। তিনি দেখেছেন, অনুভূতির তীব্রতা দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, ‘রাজা যায় রাজা আসে’ কিন্তু কোনও পরিবর্তন আসে না। সেই ক্ষোভ, অপ্রকাশ্য বেদনাকেই তিনি কবিতার অংশ করে তুলেছেন। সরাসরি রাজনৈতিককর্মী না হয়েও তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। তাই সময়কে এড়িয়ে যাননি তিনি। তবে শুধু সাময়িক বা সমকালীন বোধই নয়, তিনি চিরকালীনতাকেই ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর কবিতা সম্পর্কে কবি শামসুর রাহমান ‘আবুল হাসান রচনা সমগ্র’র ভূমিকায় বলেন, ‘‘আবুল হাসান মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কবি, কবি ছাড়া আর কিছুই নন। তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে বয়ে গেছে কবিতা। তার এলোমেলো জীবনের ছাপ পড়েছে তার কবিতাতেও। এই এলোমেলোমি তার কবিতার দুর্বলতা এবং শক্তি।‘…’ গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের মিলিত অভিজ্ঞতা তার কবিতাকে বর্ণাঢ্য, সমৃদ্ধ করেছে। তিনি নৈঃসঙ্গ্য এবং দীর্ঘশ্বাসের কবি।’’ এই নিঃসঙ্গতা এই দীর্ঘশ্বাস আজন্ম তাড়িয়ে বেরিয়েছে আবুল হাসানকে। আর এ থেকেই তার কলমে বেরিয়ে এসেছে-
আমার এখন চাঁদ দেখলে খারাপ লাগে
পাখির জুলুম, মেঘের জুলুম, খারাপ লাগে
কথাবর্তায় দয়ালু আর পোশাকে বেশ ভদ্র মানুষ
খারাপ লাগে,
এই যে মানুষ মুখে একটা মনে একটা. . .
খারাপ লাগে
খারাপ লাগে
(আমি অনেক কষ্টে আছি)
আবুল হাসান ছিলেন হৃদয়ের ‘অনিচ্ছুক দাস’। তার কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে ছড়িয়ে রয়েছে আবেগ। যে আবেগের মধ্যে ধরা থাকে, ‘লাবণ্য, উজ্জ্বলতা আর মায়া’। আর এ সবের মিলিত নাম আবুল হাসান। তিনি ভালবেসেছিলেন, ‘ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আর আলোর ইশকুল’। তিনি কবিতায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়েছেন, সেই বেদনা ছুঁয়ে গেছে পাঠককে।