বাংলা কবিতার সহজাত ধারা মূলত দুটি।একটি প্রেম-বিরহের, অন্যটি দ্রোহ-সংগ্রামের। এই দুয়ের বাইরে আরও একাধিক ধারা রয়েছে।এর একটি আত্মবিদ্রূপের।কিন্তু এই আত্মবিদ্রূপ প্রকাশে কবিরা প্রায় স্যাটায়ারের আশ্রয় নেন।ফলে অনেক সময় কবিতায় মনীষা ও আবেগের সুসমন্বয় ঘটে না।কিন্তু যদি বুদ্ধি ও আবেগের সুষম সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হয়,তাহলে সৃষ্টি হতে পারে কল্পনা ও অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে শ্রেষ্ঠতম কবিতা। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে অত্যল্প হলেও সমর সেনের কবিতায় এই বৈশিষ্ট্যই প্রধান।
সমর সেনকে কোনোভাবেই স্বপ্নচারী বলা যাবে না।আবার একেবারেই হতাশাবাদীও নন তিনি।জীবনকে তিনি দেখেছেন রূঢ়বাস্তবতার ভেতর,একজন ভুক্তভোগীর চোখে,সে চোখ নিছক বিলাসী পর্যবেক্ষকের নয়,রোমান্টিক-বাস্তববাদীর।ফলে সমাজে-রাষ্ট্রে যা ঘটেছে তারই অনুপুঙ্খ চিত্র অঙ্কনই তাঁর আরাধ্য হয়ে উঠেছিল।তাঁর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গই হয়ে উঠেছে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বুদ্ধি-প্রজ্ঞা ও কল্পনার সু-সমন্বয়।এ কারণে তাঁর কবিতায় তীব্র আবেগের থরোথরো কম্পন নেই।আবার নিছক বাস্তবতার মোচড়হীন রুক্ষ্ম-রূঢ়স্বরও নেই।কিন্তু আবেগ-মনীষার মিশ্রণে যে রুচি গড়ে তুলেছেন,সেখানে ব্যক্তিত্বের আভিজাত্যই প্রধান হয়ে উঠেছে।
তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো মোটামুটি এ রকম:
১) আত্মবিদ্রূপ
২) প্রজ্ঞা ও আবেগের সমন্বয়
৩) রোমান্টিকতা, স্বকাল ও স্বসমাজ চেতনা
৫) চিত্রকল্প ও উপমায় নৈঃশব্দ্যের ছাপ
সমর সেনের কবিমানস খুবই সংবেদনশীল।তবে পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তিনি সফল। এর ফলে প্রত্যাশাবঞ্চিত হওয়ার পরও তাঁর কবিতা রোদনহীন বিলাপে পর্যবসিত হয় না; আত্মবিদ্রূপ ও আত্মশাসনে হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ রুচির অভিজাত প্রকাশ।না পাওয়ার যন্ত্রণায় তিনি ক্ষতবিক্ষত সত্য,কিন্তু সেই ক্ষতচিহ্নকেই একমাত্র দৃশ্যমাণ সত্য করে তোলেন না।বিপরীতে অনুভবসম্ভব চিত্রকল্প প্রস্তুত রাখেন।যা হয়ে ওঠে আত্ম-শাসনের মৌলিক নিয়ামক।একই সঙ্গে তাঁর কবিতায় প্রায় সমান্তরাল পথে চলে বুদ্ধির দীপ্তি ও আবেগের ফল্গুধারা।অর্থাৎ কল্পনা ও প্রজ্ঞার মিথস্ক্রিয়ায় তিনি সৃষ্টি করেন একেকটি কবিতা।
ক.
কেন অন্ধকারে
মাটির পৃথিবীতে আসে সবুজপ্রাণ,
চপল, তীব্র, নিঃশব্দ প্রাণ—
বুঝতে পারি কেন
স্তব্ধ অর্ধরাত্রে আমাকে তুমি ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত থেকে বিরহের স্তব্ধতায়।
(নিঃশব্দতার ছন্দ)খ.
ঘনায়মান অন্ধকারে
করুণ আর্তনাদে আমাকে সহসা অতিক্রম করল
বিদ্যুতের মতো:
কীঠন আর ভারী চাকা, আর মুখর—
অন্ধকারের মতো সুন্দর,
অন্ধকারের মতো ভারি।
(একটি রাত্রের সুর)গ.
মহাজন গান গায় নদারৎ ধান।
অন্ধকারে প্রেতলোকে ভাবে ভগবান।।
অক্ষম এ রায়বার ঈশ্বর কথনে।
প্রভুর বন্দনা শুনি বেণের ভবনে।।
(স্তোত্র)ঘ.
ভুলে গেছি বাগবাজারি রকে আড্ডার মৌতাত
বালিগঞ্জের লপেটা চাল,
আর ডালহাউসির আর ক্লাইভ স্ট্রিটের হীরক প্রলাপ
ডকে জাহাজের বিদেশি ডাক।
রোমান্টিক ব্যাধি আর রূপান্তরিত হয় না কবিতায়।যৌবনের প্রেম শেষ প্রবীণের কামে।
বছর দশক পরে যাব কাশীধামে।।
(জন্মদিন)
প্রথম উদাহরণে অচরিতার্থ জীবনের গ্লানি বয়ে বেড়ানো এক যুবকের আত্মপ্রবোধের দেখা মেলে। যে উপলব্ধি করে অন্ধকার প্রাণচাঞ্চল্যের আদি উৎস। অন্ধকারে পৃথিবীতে সত্যিকারের প্রাণ জাগে। অথচ সে প্রাণচাঞ্চল্যের উৎসবে ডাকে মিলনবঞ্চিত রেখে চয়ে যায় প্রেয়সী বিরহের স্তব্ধতায়। কিন্তু এই বঞ্চনায় কবি ব্যথিত হলেও যুক্তিহীন নির্বোধ আবেগে কাতর হন না। রোদনবিলাসী স্বভাব তাকে পেয়ে বসে না। আত্মশাসন-আত্মপ্রবোধে সামাজিক বাস্তবতা মেনে নেন তিনি। তাই রোমান্টিক হয়েও উদ্দাম নন, ব্যথিত হয়েও করুণাপ্রার্থী নন, আপনশক্তিতে অবিচল-নিষ্কম্প। বুঝতে পারেন—কারও জন্য কারও জীবন থেমে থাকে না, কিছুক্ষণের জন্য থমকে যেতে পারে মাত্র।আর যথারীতি এই থমকে যাওয়া ব্যক্তিকে রেখে সবাই যার-যার মতো চলেও যায়। কেউ দাঁড়ায় না। অপেক্ষার প্রয়োজনও মনে করে না কেউ। এমন বাস্তবতা ফুটে উঠেছে দ্বিতীয় উদাহরণে। গতির প্রতীক চাকা,দ্রুত তাকে অতিক্রম করে যায়। তাও সুন্দর অন্ধকারে। অর্থাৎ এখানেও অন্ধকার সৃষ্টির মুহূর্ত-আশ্রয়।
তৃতীয় উদাহরণে পয়ারের চালে বিশ্বাস-বিশ্বাসীর সম্পর্ক আবিষ্কারের চেষ্টা করেন কবি। তবে যথারীতি এবারও চিন্তা ও সৃষ্টির আশ্রয় করে তোলেন অন্ধকারকেই।চতুর্থ উদাহরণে রয়েছে স্মৃতিচারণ;প্রাত্যহিক জীবনের অনিবার্য উপকরণগুলোর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বর্ণনা। আর এই বর্ণনার সময় তিনি অকপটে বলেছেন—চরম সত্য—‘রোমান্টিক ব্যাধি আর রূপান্তরিত হয় না কবিতায়’।এছাড়া শেষ দুই পঙ্ক্তিতে আত্মবিদ্রূপের মাধ্যমে রূঢ়বাস্তবতার কষাঘাতকে চিহ্নিত করেছেন।
সমকাল-স্বসমাজ চেতনার সঙ্গে রোমান্টিকতা মিলে সমর সেনের কাব্যমানসকে করে তুলেছে রূঢ়-রোমান্টিক। সমাজকে যে বার্তা তিনি দেন, তার বুননে থাকে রোমান্টিক মানস, কিন্তু বিষয় হয়ে ওঠে প্রায় রূঢ়-কঠিন। এ ক্ষেত্রে তিনি অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেন বেশি। কল্পনার ডালপালাকে রাখেন নিয়ন্ত্রণে। সঙ্গতাকারণে তাঁর কবিতায় তরল আবেগের গুরুত্ব কম। সমর সেনের কাব্য আলোচনা প্রসঙ্গে ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৭৪ সংখ্যায় অমলেন্দু বসু লিখেছেন—‘হৃদয়ের প্রতি অবজ্ঞাশীল, মনন-প্রধান, স্থানকালপাত্রের—মুখাপেক্ষী; সমাজগতিতে অংশীদার—এই হলো সমর সেনের আত্মসচেতন কবিস্বরূপ, এমন কবিই তিনি হতে চেয়েছেন।’ তাঁর চিন্তা ও কল্পনার সিংহভাগজুড়েই রয়েছে হৃদয়ের প্রতি অবজ্ঞাশীল ও মননপ্রধান কবিত্বের পরিচয়। তিনি সংবেদনশীল সত্য, তাই বলে তরল আবেগের প্রাবল্যে ভেসে যাওয়ার পক্ষে নন, হৃদয়ের প্রতি সংবেদনশীল, কিন্তু ভাবালুতাসর্বস্বও নন।ফলে সমকালীন সমাজের চিত্র আঁকতে গিয়ে ‘মুক্তি’ কবিতায় অনুভব করেন, ‘হিংস্র পশুর মতো অন্ধকার এলো/ তখন পশ্চিমের জ্বলন্ত আকাশ রক্তকরবীর মতো লাল।’ যেখানে প্রেম-ভালোবাসার চেয়ে মানুষের দৈনন্দিন দুঃখ-কষ্ট-সংগ্রামী চিত্রই বেশি। এ কারণে মনে রোমান্টিক হয়েও মননে তাঁকে হতে হয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত-বাস্তববাদী। সমর সেন নিজেও ‘২২ শে জুন’ কবিতায় ঘোষণা করেছেন, ‘আমি রোমান্টিক কবি নই, আমি মার্ক্সিস্ট।’ আর এই কবিতার রোমান্টিকদের প্রতি শ্লেষও প্রকাশ করেছেন। পুরো জাতির দুর্দশনার জন্য অতি রোমান্টিকতাকে দায়ী করেছেন। একইসঙ্গে আশাবাদী মনোভাবও প্রকাশ করেছেন। ‘রাত্রি আর সকালের গূঢ়সন্ধিক্ষণে’ কবি স্বপ্ন দেখেন ‘শূন্যে ওঠে সোনালি ঈগল’। সবশেষে বলেন, ‘আশা রাখি একদিন এ কান্তার পার হয়ে পাব লোকের বসতি, হরিৎ প্রান্তরে শ্যামবর্ণ মানুষের/ গ্রাম্যগানে গোধূলিতে মেঠোপথ ভরে/ পরিচ্ছন্ন খোশগল্পে মুখোরিত ঘনিষ্ঠ নগর/ বাংলার লোহিত সকালে সকলের অক্লান্ত সফর।’
দেশ-কাল-সমাজের বাস্তবচিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে সমর সেন কল্পনার আশ্রয় যতটা নেন, তারও বেশি বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সংগ্রহ করেন কবিতার রসদ। ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় চিত্রকল্প-উপমার আশ্রয়ে সেই বাস্তবদৃশ্যই আঁকেন। বিষ্ণু দে তাঁর ‘বাংলা গদ্য কবিতা, সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’ প্রবন্ধে ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় দেখেছেন—‘উপমা-উপচারের জটিলতার সহজ সাহস ও ব্যঞ্জনাদাঢ্যতা’।
মাঝে মাঝে সন্ধ্যার জলস্রোতে
অলস সূর্য দেয় এঁকে
গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ,
আর আগুন লাগে জলের অন্ধকারে ধূসর ফেনায়!
….
এখানে অসহ্য নিবিড় অন্ধকারে
মাঝে মাঝে শুনি
মহুয়া বনের ধারে কয়লা খনির
গভীর, বিশাল শব্দ,
(মহুয়ার দেশ)
কবিতাটি দুই পর্বে বিন্যস্ত। প্রথম পর্ব রোমান্টিকতায় পরিপূর্ণ; দ্বিতীয় পর্বে বাস্তব জীবনের রূঢ় রূপ প্রকাশিত। উভয় অংশ মিলে সৃষ্টি হয়েছে ‘নিরাবেগ রোমান্টিক’। কথাটা বোধ হয় কিছুটা জটিল আর স্ববিরোধী হয়ে গেল। কিন্তু সমর সেনের সম্পূর্ণ কবিমানস আসলেই এমন ‘নিরাবেগ রোমান্টিক’। আবদুল মান্নান সৈয়দ যাকে বলেছেন ‘দমিত রোমান্টিক’। কবিতাটির প্রথম চার পঙ্ক্তি পাঠককে মহৎ কোনো দেয় না। এমনকী উল্লেখ করার মতো প্রয়োজনীয় কোনো তথ্যও নেই এখানে। যা আছে, তা হলো উপমা-আশ্রয়ী এটি চিত্রকল্প। যেখানে সন্ধ্যার বর্ণনা করা হয়েছে। দূর সমুদ্রের পারে সূর্য ডুবছে। খুব ধীর গতি। মনে হচ্ছে গলিত সোনা ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে স্রোতে। তাতেই যেন আগুন জ্বলে উঠছে ধূসর ফেনার ভেতর। কর্মক্লান্ত শ্রমজীবীর মনোবিকলনের নিপুণচিত্র এই বর্ণনা। যে শ্রমজীবী দিনের ক্লান্তি শেষে, একটু আশ্রয় খোঁজে শ্রান্তির। কিন্তু পায় না। অথচ কল্পনায় দেখে এমন সব দৃশ্য, যা বাস্তবে তার জীবনে এমন ঘটনা হয়তো কখনোই সম্ভব নয়। তখন সে কল্পনার ঘুড়ির নাটাই গুটিয়ে আনে। বড় কোনো স্বপ্ন সে দেখে না। মনে মনে প্রার্থনা করে যেন তাঁর ‘ক্লান্তির উপর’ ঝরে ‘মহুয়া ফুল’। কিন্তু মহুয়া ফুল ঝরে না, হয়তো গন্ধ এসে নাকে লাগে। তাতেই সে তৃপ্ত। অথচ একটু পরেই ঘুমহীন ‘চোখে হানা দেয়’ ‘ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন’।
সমর সেন যাপিত জীবনের চিত্র আঁকতে গিয়ে সমাজের প্রতিচ্ছবিই তুলে ধরেছেন।কোথাও কোনো রঙ চড়াননি। তবে ঘটনা-দৃশ্যের বর্ণনায় উপমা-চিত্রকল্প এমনভাবে প্রয়োগ করেছেন। প্রথম পাঠে তাকে স্বপ্নচারী বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু উপমা-চিত্রকল্প বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কবিতাটি যতই মোহনীয় রূপে উপস্থিত হোক, আসলে তারও বেশি বাস্তবতার কষাঘাত এর অন্তর্জগৎকে নীল করে তুলেছে। ফলে এক অর্থে সমর সেনের কবিতা হয়ে ওঠে মূলত করুণ রোমান্টিক। অর্থাৎ তাঁর কবিতায় উচ্ছ্বাস-হাসি-আনন্দের পরিমাণ কম। বিপরীতে ক্লান্তি-হতাশা-দীর্ঘশ্বাসে পরিপূর্ণ।
এই পর্বে তাঁর সবচেয়ে উজ্জ্বল কবিতাটির নাম সম্ভবত ‘নাগরিক’। নগর জীবনের গ্লানি, গতি, ব্যস্ততা ও নীচুতার যেন পোট্রেট এই কবিতা। জীবিকার টানে ছুটে আসা মানুষের বেদনা যেমন ফুটে উঠেছে এই কবিতায়, তেমনি চিত্রিত হয়েছে প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততার দৃশ্যও। তবে সর্বত্রই অমানবিকতা, সর্বত্রই কদর্য রূপ। কোথাও স্নিগ্ধতা কিংবা কোমল রূপের কোনো স্পর্শ নেই।
মহানগরীতে এলো বিবর্ণ দিন, তারপর আলকাতরার মতো রাত্রি
আর দিন
সমস্ত দিন ভরে শুনি রোলারের শব্দ
দূরে, বহু দূরে কৃষ্ণচূড়ার লাল, চকিত ঝলক,
হাওয়ায় ভেসে আসে গলানো পিচের গন্ধ;
আর রাত্রি
রাত্রি শুধু পাথরের উপরে রোলারের
মুখর দুঃস্বপ্ন।
(নাগরিক)
মূলত নাতিদীর্ঘ কবিতাটির সারবত্তা এই কয় পঙ্ক্তিতেই প্রকাশিত। নগরের সমস্ত চারিত্র্য-স্বভাব-রুচি-মর্জি—এখানেই বিধৃত। বাকি পঙক্তিগুলো এই ভাবেরই সম্প্রসারণ মাত্র।
সমর সেন প্রায় বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলিকে একত্রে বর্ণনা করেন। তবে প্রতিটি ঘটনাদৃশ্য আলাদা করেই বর্ণনা করেন। এ কারণে তাঁর অধিকাংশ কবিতা প্রবহমান নয়। প্রায় থেমে থেমে পড়তে হয়। এই পদ্ধতির বড় বৈশিষ্ট্য হলো কবিতার মাঝখান থেকে এক বা একাধিক পঙক্তি বাদ পড়লেও পাঠক টের পায় না। বিষয়টি দোষ-গুণের নয়, কবিতার অখণ্ড অনুভবের পথে একটি বড় বাধা। তবে সমর সেন হয়তো ভেবেছেন জীবনের ঘটনাবলি একই সূত্রে সবসময় গাঁথা থাকে না।প্রায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা এসে উপস্থিত হয়।এসব ঘটনার মধ্যে সাদৃশ্য তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না।কবিতায় এই জীবনের প্রতিচ্ছবিই যদি আঁকা হয়,তবে সংঘটিত ঘটনাবলির মূল স্বভাব ঠিক রেখে নয় কেন?
কয়েকটি উদাহরণ:
ক.
অনুর্বর বালুর উপরে
কর্কশ কাকেরা করে ধ্বংসের গান।কাঁচা ডিম খেয়ে প্রতিদিন দুপুরে ঘুম,
নারী ধর্ষণের ইতিহাস
পেস্তাচেরা চোখ মেলে প্রতিদিন পড়া
দৈনিক পত্রিকায়।
(ঘরে বাইরে)খ.
দিন যায়,বসন্ত গতপত্র বহুদিন
গ্রামে গ্রা ম মাঘমাসে দীর্ঘদেহ কাবুলিরা আসে,
ঘুরে-ফিরে হানা দেয় ঘরে ঘরে,
বর্বর ভাষায় কাঁচাপাকা দাড়ি হাওয়ায় নড়ে।
(কয়েকটি দিন)গ.
সূর্যে আজ কবন্ধের ছায়া,দিন শেষ,
চরাচর কী ভীষণ করুণ লাগে;
অভিশাপে শতছিদ্র মনের উপর
বাঁধন টুটে বুঝি নামে রক্তের প্লাবন।মরা সমুদ্রে মরণ আসে না,
নোনা জলে শরীর ভাসে।
(গ্রহণ)
উদ্ধৃত কবিতাংশগুলোয় দেখা যাচ্ছে একইসঙ্গে একাধিক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। কোনো বিষয়কেই প্রধান করে তোলা হয়নি। কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর তীব্র আলো ফেলা হয়নি।আবার একাধিক বিষয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট কোনো ঐক্যও প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। সবমিলিয়ে কবিতাংশগুলো নানা রকম ঘটনার সংঘর্ষে এসে একটি বিচিত্র ফুলের মালার মতো তৈরি হয়েছে। এতে বৈচিত্র্য এসেছে, একইসঙ্গে চরাচরে সংঘটিত ঘটনাপুঞ্জের বিচিত্র রূপও ফুটে উঠেছে।
জীবনের কর্কশ রূপ প্রকাশেও চিত্রকল্প-উপমাকে করে তুলেছেন স্বকাল-স্বমাজের প্রতিচ্ছবি। কোথাও কোনো কোমলতা নেই, কোথাও কোনো স্নেহের বাঁধন নেই।সর্বত্রই মোচড়হীন বাস্তবতার কঠিন চিত্র, আবেগবিবর্জিত রূঢ় আচরণের প্রকাশ। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক—
ক.
গরুর দুধ, পোষা মুরগির ডিম, ক্ষেতের ধান;
রাত্রে কান পেতে শোনা বাশ বনে মশার গান;
সেখানে দুপুরে শ্যাওলার সবুজ পুকুরে
গরুর মতো করুণ চোখ
বাঙলার বধূ নামে;
নিরালা কাল আপন মনেপুরনো বিষণ্নতা হাওয়ায় বোনে।
(নিরালা)খ.
বরফের জ্বলন্ত স্তব্ধতায়
সূর্যের উজ্জ্বল বর্শা লাগল;
সামনে স্বপ্নের মতো উঠেছে পাহাড়ের ঢেউ।
আজো জ্বলন্ত খড়ুগের মতো আকাশে
চাঁদ ওঠে,
আজো সামনে
মৃত্যুর মতো মন্থর জীবন।
(স্বর্গ হতে বিদায়)গ.
ভুলে যাওয়া গন্ধের মতো
কখনো তোমাকে মনে পড়ে
হাওয়ার ঝলকে কখনো আসে কৃষ্ণচূড়ার উদ্ধত আভাস।
আর মেঘের কঠিন রেখায়
আকাশে দীর্ঘশ্বাস লাগে।
(বিস্মৃতি)
এই তিনটি উদাহরণ গভীরভাবে পাঠ করলে দেখা যাবে, উপমা-চিত্রকল্পে মূলত জীবনের রূঢ় রূপই আঁকা হয়েছে।যেখানে কবি দেখেন—‘গরুর মতো করুণ চোখ/ বাঙলার বধূ নামে’, ‘আজো জ্বলন্ত খড়ুগের মতো আকাশে/ চাঁদ ওঠে’,কিংবা দেখেন ‘হাওয়ার ঝলকে কখনো আসে কৃষ্ণচূড়ার উদ্ধত আভাস’। তিনটি উপমা-চিত্রকল্পেই কবিকে দেখি সমাজের করুণ চিত্র বর্ণনা করতে। যেখানে স্বপ্নদেখার চেয়ে জীবিকাজটিল জীবনে স্বপ্নহীনতাই বড় হয়ে ওঠে।এভাবেই সমর সেন নিজের সমাজ, রাষ্ট্রের ছবি এঁকে গেছেন। কোথাও তিনি অতিকল্পনার স্রোতহীন ঢেউয়ে তলিয়ে যান না। সর্বত্রই কঠিন বাস্তবতার রুক্ষ্ম-রূঢ় ছবিই দেখেন, একইসঙ্গে উত্তরকালের জন্যও রেখে যান।
সমর সেন তীব্র আবেগে ভেসে যেতে যেতে হারিয়ে যান না। নিজের সম্পর্কে অলৌকিক কোনো ভাবমূর্তি দাঁড় করান না। যে জীবন তিনি যাপন করেছেন, তাঁর সমাজের আর দশজন যে জীবন যাপন করেছে, তিনি সে জীবনচিত্রেরই অকৃত্রিম চিত্র-ভাষ্যকার। তবে উচ্চকণ্ঠে কোনো স্লোগান রচনা করেন না তিনি। কোনো বিপ্লব-সংগ্রামের ডাকও দেন না। কেবল ঘটে যাওয়া ঘটনাপুঞ্জের নিরুচ্চার ধ্বনি তৈরি করেন। যা সমাজের বাকি দশজনও শোনেন এবং শুনতে শুনতে জেনে নেন—এই দৃশ্য তাদেরও পরিচিত। সমর সেন সমাজের রূঢ়ছবি প্রকাশ করেই তৃপ্তি খোঁজেন না; বরং এসব অসঙ্গতি-বিসদৃশ ঘটনাপুঞ্জের জন্য নিজেকেও দায়ী করেন এবং আত্মবিদ্রূপে আত্মশাসন করেন। এভাবে সমাজের রূঢ়চিত্র আঁকতে আত্মবিদ্রূপের একটি শৈল্পিক রূপও দাঁড় করান। সমর সেনের সমস্ত কাব্যচর্চার মাহাত্ম্য এখানেই নিহিত।
________________________________________________________________________________________________
২৩ আগস্ট আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রাণপুরুষ সমর সেনের (জন্ম ১০ অক্টোবর, ১৯১৬) মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮৭ সালের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি লিখেছেন কম। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা পাঁচ। কাব্যগ্রন্থগুলো হলো ‘কয়েকটি কবিতা’ (১৯৩৭), ‘গ্রহণ’ (১৯৪০), ‘নানা কথা’ (১৯৪২), ‘খোলা চিঠি’ (১৯৪৩) ও ‘তিন পুরুষ’ (১৯৪৪)। এই মহান কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে চিন্তাসূত্রের বিনম্র শ্রদ্ধা।