বাংলা কবিতার ইতিহাস কেবলই বিবর্তনের নয়। সেখানে আবর্তনও আছে। বাংলা কবিতা ঐতিহ্যচ্যুত কোনো অনিকেত প্রপঞ্চও নয়। তবে, আধুনিক বাংলা কবিতা আঙ্গিক বিচারে সনেটের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে কি না, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে। আজকের কবি যেখানে ছন্দ উচ্ছেদের অভিযানে নেমেছেন, সেখানে সনেট কতটা সমাদরের সঙ্গে পাঠক গ্রহণ করতে প্রস্তুত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সনেটের সমঝদার পাঠক কজন আছেন? চৌদ্দ পঙ্ক্তির মিলসর্বস্ব কবিতামাত্রই সনেট? পের্ত্রাকীয় সনেট ও শেক্সপিয়ারীয় সনেটের যে আঙ্গিক ও ভাবগত পার্থক্য, সে ধারণা না রেখে সনেট রচনা কতটা স্বতঃসিদ্ধতার পথে কবিকে নিয়ে যেতে পারে? এসব প্রশ্ন যদি অবান্তর হয়, তাহলেও বাংলা কবিতার ভাঁড়ার পূর্ণ হয়; বাংলা কবিতার মর্যাদাহানি হয় না।
এরপরও আশার কথা এই যে, আজকের যান্ত্রিক যুগে সাধারণ মানুষ যেখানে সামান্য অবসর পেলে সুর ও হৃদয়সংবেদী কথার জালে নিজের চিত্তকে বিলিয়ে দিতে চান, সেখানে সনেটের আঁটোসাঁটো বন্ধন পাঠককে কিঞ্চিৎ আলোড়িত করবে, সন্দেহ কী?
একদা ইতালিতে একটিমাত্র অখণ্ড অনুভূতি ও ভাবকল্পনা প্রকাশের আন্তর্তাগিদে চৌদ্দপঙ্ক্তির নির্দিষ্ট আঙ্গিকে রচিত যে সনেটের জন্ম, সে সনেটই পেত্রার্কার হাত ধরে শেক্সপিয়রের হাতে ভিন্নরূপ পায়। গঠনশৈলীতে পেত্রার্কা যেখানে অষ্টক-ষটক মেনে চলতেন, শেক্সপিয়রও তাই। কিন্তু পেত্রার্কা যেখানে অষ্টকে দুই চতুষ্ক এবং ষটকে দুই ত্রিপদিকার রীতি প্রবর্তন করেন, শেক্সপিয়র সেখানে অষ্টকের ক্ষেত্রে দুই চতুষ্ক ঠিক রাখলেও ষটকে এক চতুষ্ক ও এক যুগ্মকে সনেটের আন্তঃসংগঠনরূপ পুনঃনির্মাণ করলেন। পেত্রার্কা ও শেক্সপিয়রীয় দুই আঙ্গিকই বাংলা কবিতার সনেটের রূপকাররা সাদরে গ্রহণ করেছেন।
শেক্সপিয়রীয় সনেটের শর্তপূরণ করার পরও এই কবিতায় কবিকল্পনার যে স্ফূরণ ঘটে, শেষ দুই পঙ্ক্তির প্রশ্নশীলতার ভেতর তা অনন্য ও উজ্জ্বল।
মাইকেল মধুসূদনের হাত ধরে যে সনেট বাংলা কবিতার অন্দরমহলে মাদুর পেতে আসন পেতেছিল, সে সনেট রবীন্দ্রনাথ হয়ে আজকের কবিকেও প্রলুব্ধ করে তার অখণ্ড ও ঘনপিনদ্ধ ভাবনাকে সনেটের আঁটোসাঁটো বন্ধনে শিল্পরূপ দিতে। এই কবিদলের একজন আতাউল হক সিদ্দিকী।
দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় কবিতাচর্চা করেও প্রচার বাহুল্যে যার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, সে কবি আতাউল হক সিদ্দিকীর কবিতার বই মাত্র চারটি। প্রথম বই ‘বিবাগী বসন্ত বাউল যৌবন’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। এরপর ‘আমি সেই লোক’ (১৯৯৯), ‘অলকার কন্যা তুমি নও’ (১৯৯৯), ‘উড়ে যায় মরমি পাখি’ (২০০৪) প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ‘অলকার কন্যা তুমি নও’ বিভিন্ন ছন্দে লেখা কবিতার সংকলন। বাকি তিনটি সনেট সংকলন।
‘বিবাগী বসন্ত বাউল যৌবন’ কাব্যের প্রথম ও নাম কবিতা শেক্সপিয়রীয় ঘরানার। এটি বিশুদ্ধ সনেট, শিল্পসফল কবিতাও। এ কবিতায় একটি সময়ের উপান্তে এসে বিশেষ জনপদে কী কী অবকাঠামোগত পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে, সে সঙ্গে রুচিগত ও চিন্তার জগতে মানুষের কী কী সংস্কার হতে পারে, তারই বর্ণনা রয়েছে। অষ্টকের প্রথম চতুষ্কে প্রস্তাবনা, দ্বিতীয় চতুষ্কে সে প্রস্তাবনার সম্প্রসারণ, ষটকের চতুষ্কে সে ভাবনার পরিপূর্ণ বিস্তার এবং শেষে যুগ্মকে এসে উপলব্ধির চূড়ান্ত রূপের প্রকাশ ঘটেটে। শেক্সপিয়রীয় সনেটের শর্তপূরণ করার পরও এই কবিতায় কবিকল্পনার যে স্ফূরণ ঘটে, শেষ দুই পঙ্ক্তির প্রশ্নশীলতার ভেতর তা অনন্য ও উজ্জ্বল।
তবে আর হে মাধবী, দ্বিধা কেন; চতুরঙ্গে ঘুরে
আমি কি একাই হবো মগ্ন এই মহাদেবপুরে?
(হে মাধবী, দ্বিধা কেন: বিবাগী বসন্ত বাউল যৌবন)
কবিকে একাই মগ্ন হতে হয়। তার সহচর হওয়ার সামর্থ্য কারও হয় না। জীবনানন্দ কথিত ‘সকল লোকের মাঝে বসে/ আমার নিজের মুদ্রদোষে/ আমি একা হতেছি আলাদা’; এই সত্যে একবিও দীক্ষিত।
‘ভাস্বতী’ পেত্রার্কীয় ঘরানার সনেট। অষ্টকে কবি নিজেকেই প্রশ্ন করেন, ‘কাকে আমি জানাব নালিশ?’ এরপরের পঙ্ক্তিতে নিজের অসহায়ত্ব ও হাহাকার মূর্ত করে তুলে বলেন,‘পাঁজরে নিহিত ছুরি ঘুরে-ফিরে জানায় কুর্নিশ।’ ষটকের শেষ দুই পঙ্ক্তিতে এসে তার উপলব্ধি হয়, ‘বলি, দ্যাখ, ভাস্বতী রে, এ রকম বিস্মৃতি কি ভালো?/ আমাকে পোড়াবি কত অনশ্বর রাতের শরীরে?’ এখানেও কবি প্রশ্নশীল এক আত্মজিজ্ঞাসুর ভূমিকায়।
আবার অচ্ছুত কবিতায় মূলত আত্মগ্লানি ও গোপন রক্তক্ষরণেরই চিত্র আঁকা হয়েছে। এ সনেটটি বিশুদ্ধ শেক্সপিয়রীয় ঘরানার। অষ্টকের প্রথম চতুষ্কে যে অনিবার্য পরিণতিসম্ভব প্রেমাষ্পদের জন্য তার গোপন ও অঘোষিত কাঙ্ক্ষার তাড়না, তাকেই কবি ভুলে যেতে চান বলে যে প্রসঙ্গের অবতারণা করেন, দ্বিতীয় চতুষ্কে এসে তারই বিস্তৃত পটভূমি নির্মাণ করেন। ষটকের চতুষ্কে এসে তার গ্রন্থিমোচন করেন। যুগ্মকে পরিসমাপ্তি টানেন। শেষ পরিণতি খুবই স্পর্শকাতর ও সংরাগের মিথস্ক্রিয়ায় নির্মিত।
ভয় পাই, সিঁড়ি ভাঙি, উঠি নামি দ্রুত,
বস্তুত আমার কাছে আমিই অচ্ছুত।
(অচ্ছুত: বিবাগী বসন্ত বাউল যৌবন)
আপন চিত্তের জয়ধ্বনি করার ক্ষেত্রে যে কবি ভিরুতার পরিচয় দেন, তার পক্ষে প্রেমিক হওয়া কতটা সঙ্গত? প্রেমে চিত্তের দার্ঢ্যই যদি কাম্য, তবে তার প্রকাশে কুণ্ঠাবোধ কবিকে অপ্রাপ্তির বেদনায় ব্যথিত না করে উপায় নেই।
প্রথম চতুষ্কের রৌদ্রতপ্ত দুপুরের ঔদাসীন্যকে ফুটিয়ে তোলার ধুধু মাঠকে আশ্রয় করে যে পঙ্ক্তি সেজে উঠেছিল, তাই-ই দ্বিতীয় চতুষ্কে পথচারীর ক্লান্তি দূর করার জন্য অসমর্থ্য।
কবি যেহেতু এ-সমাজেরই সদস্য, তাই তাকে এসমাজের নানা বিধি-উপবিধি নিয়ে শঙ্কিত হতে হয়। না হয়েও তার মুক্তি মেলে না। কারণ, কবি যতই স্বপ্নচারী হোন, শেষপর্যন্ত তাকেও মৃত্তিকার সমতলে এসে আপন জনপদের মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মেলাতে হয়। শুভবাদী চিন্তার স্থান পচে যাওয়া সমাজব্যবস্থায় সহজে হয় না। সেখানে কবি ও শুভবাদী মানুষকে কেবলই দ্রোহী উঠতে দেখা যায়। সে কারণে হয়তো, ‘পতনের ঢল’ সনেটে সমাজস্থ মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক বিচ্যুতিকে অঙ্কন করেছেন। ‘বিবাগী বসন্ত বাউল যৌবন’ কবিতা নির্বিবাদী ব্যক্তিসত্তার বৈরী যৌবনের প্রতিচিত্র। মানবজীবনের এই এক স্ববিরোধী উচ্চারণ। যেখানে স্বর্গের প্রতি তীব্র মোহ থাকার পরও বিতৃষ্ণভাব জন্মে, অথচ নরকের প্রতি ভয়মিশ্রিত অনুভূতির সংমিশ্রণেও নিষিদ্ধ আকর্ষণে ব্যাকুল হয়ে ওঠে কবিমন। তাই এই কবিতার শুরুতে কবির স্বগত উচ্চারণ:
উলঙ্গ প্রস্তুতি চলে জীবনের তৃষ্ণা নিবারণে
আকাশে শকুন ওড়ে। তবু এক আতাউল হক
সিদ্দিকী ধরে নি আজো পরাবৃত্তি। শুদ্ধ উচ্চারণে
বুকের গহিনে সংবেদনা, সুরের গমক।
(বিবাগী বসন্ত বাউল যৌবন : বিবাগী বসন্ত বাউল যৌবন)
এখানে আতাউল হক সিদ্দিকী তার মেরুদণ্ড সোজা করে চিত্তের দার্ঢ্য ঘোষণা করেন স্বতঃস্ফূর্ত ও প্ররোচনাহীন।
দ্বিতীয় কাব্য ‘আমি সেই লোক’-এর একটি গুরুত্ব পূর্ণ কবিতার নাম পৌরাণিক। মিথের প্রতি তার মনের সমর্থন প্রবল। তাই বক্তব্যকে আড়াল করতে আগ্রহ বেশি।
সনেট বাফায় যায়; রেস্তোরাঁয় অচেনা যুবক
বেষ্টিত; সীতাই!
বিংশ শতাব্দীর আশির দশক
পুরাণে প্রবেশ করে। রামচন্দ্র ফেরে ইস্কাটন-
(পৌরাণিক: আমি সেই লোক)
এখানে পাঠক হিসেবে দেখি সীতার আড়ালে অসংখ্য তরুণী-যুবতী আর প্রৌঢ়ার জীবিকার দহনক্রিয়া আর প্রতারিত হতে; প্রতারণা করতেও। সমাজস্থ কবি সমাজের নানা প্রপঞ্চকে অস্বীকার করতে পারেন না। তাই নানা ঘাতপ্রতিঘাতকে উপমা-চিত্রকল্প-রূপকের বল্কল পরিয়ে সনেটের অনুষঙ্গ করে তোলেন।
‘পরকীয়া’ কবিতায় সমাজের এসব অসঙ্গতির আঘাতে রক্তাক্ত প্রেমিকসত্তার সাক্ষাৎ পাই। এখানে প্রতারিত মন, প্রবঞ্চকের পেছনে ছোটে আর আর ব্যর্থ প্রত্যাশায় নিজের বুকের পাঁজর খুঁড়ে রক্তাক্ত করে তোলে, সবার অলক্ষ্যে। সে বিরহতম মুহূর্তকে কবি সনেটের পোশাক পরিয়ে পাঠকের সামনে হাজির করেন:
আজকে ছুটির দিন। ছাদে ঝোলে উজাড় দুপুর
নীল শাড়ি; আলিসায় দাঁড়কাক। অন্য কেউ পাশে
নেই–একা। নির্জনতা ডেকে আনে তোমার মধুর
ভঙ্গিমা, বাঁকিয়ে গ্রীবা মুগ্ধ চোখে তাকানো। উচ্ছাসে
(পরকীয়া: আমি সেই লোক)
উদ্ধৃতাংশের ছাদে ঝোলে উজাড় দুপুর এবং নীল শাড়ি, আলিসায় দাঁড়কাক এদুটি চিত্রকল্পে একটি বিরল ও অনন্য মুহূর্তকে যেভাবে রঙের আঁচড়ে বাঙ্ময় করে তোলা হয়েছে, তাতে কবির চিত্রকল্প নির্মাণের নৈপুণ্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে না কেবল; সঙ্গে অবক্ষয়সর্বস্ব সময়কে একটি চিরকালীন অধিষ্ঠানে বসিয়ে তার থেকে পাঠ নিতে উত্তরসূরিদের প্রণোদনাও দেন। যে নারী পরকীয়ায় আক্রান্ত, তাকে শত নীতিবাক্য কিংবা হিতোপদেশও ফিরিয়ে আনতে পারে না। ‘পরকীয়া’য় যে একবার সুখ খুঁজে পায়, সে কবে কখন ফিরে আসে প্রবঞ্চিতের ব্যাকুল আহ্বানে? তাই প্রবঞ্চিত আত্মগ্লনিতে ডুবে যেতে যেতে শেষ বারের মতো নষ্টামির সুরে মজে কাকে যেন ডাকে মহোৎসবে, ‘হে রমণী ফিরে এসো কৃষ্ণপ্রিয়া রাধার গৌরবে।’ কিন্তু তার সে মিনতি দ্বিচারিনীর মর্মমূলে আদৌ পৌঁছয় না।
‘সোনালি আগুন জ্বলে’ কবিতাটিও চিত্রকল্পপূর্ণ শেক্সপিয়রীয় সনেট। এ-সনেটের অষ্টকের প্রথম চতুষ্কের প্রথম পঙ্ক্তি ‘সোনালি আগুন জ্বলে, মাঠ জ্বলে, বিশাল দুপুর’ দ্বিতীয় চতুষ্কের শুরুতে এসে হয়ে যায়, ‘সোনালি আগুন জ্বলে, ছায়াতলে জুড়াতে অক্ষম।’ অর্থাৎ প্রথম চতুষ্কের রৌদ্রতপ্ত দুপুরের ঔদাসীন্যকে ফুটিয়ে তোলার ধুধু মাঠকে আশ্রয় করে যে পঙ্ক্তি সেজে উঠেছিল, তাই-ই দ্বিতীয় চতুষ্কে পথচারীর ক্লান্তি দূর করার জন্য অসমর্থ্য। তবু কবির মনে হয়, তখনো কোনো স্বভাবগায়কের কণ্ঠ থেকে উঠে আসে অলৌকিক গান। আর তখনই ষটকের প্রথম পঙ্ক্তি হয়ে যায়, ‘সোনালি আগুন জ্বলে, খরাক্লিষ্ট এ গোঠ গোকুল।’ সেখানে সুন্দরের প্রতীক ফুলদল মুক্তির প্রহর গোনে। কবির অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না। তাই কবি আহ্বান করেন, ‘সুরভি! ধুপের মতো দগ্ধরাত কবে শেষ হবে/উড়িয়ে মেঘের পাল এসো মিলি শ্রাবণ উৎসবে।’ এখানে কবি যে খরাক্লিষ্ট দুপুর ও ধুপের মতো দগ্ধরাতের চিত্রকল্প আঁকলেন, তা কি কেবলই প্রাকৃতিক নিয়মের অহোরাত্রির চিত্র? না। সৃজনশীল সত্তার খরার মৌসুমের যন্ত্রণাকাতর চিত্রও।
ফলে তার সনেট-কবিতা হয়ে উঠেছে সংবেদনশীল মানুষের সংহত সংরাগ। গদ্যের এই প্রবল পরাক্রান্ত যুগে, যেখানে নবীন কবি যশপ্রার্থী ছন্দ উচ্ছেদের স্লোগানে বিভোর, সেখানে সনেটের কঠিন বন্ধনে কাব্যের যে মুক্তি আতাউল হক সিদ্দিকী অন্বেষণ করেছেন, তা বর্তমানে বিস্ময়কর।
তৃতীয় সনেটগ্রন্থের নাম ‘উড়ে যায় মরমি পাখি’। এই কাব্যের বিষয়বস্তুও পূর্ববর্তী কাব্য দুটির মতো স্বদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি, নারী, প্রেম ও নিসর্গ। বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথ তার সনেটের বহলব্যবহৃত অনুষঙ্গ। এই কাব্যের বৈশাখ বিষয়ক সনেটের নাম ‘বৈশাখে উচাটন’। এই কবিতায় বৈশাখের কোনো একসময়ের এক অন্তর্মুখীন নারীর প্রসঙ্গ এনে তার ঔদাসীন্য প্রণয়প্রার্থীর বুকের ভেতর যে ঝড় ওঠে, সে চাঞ্চল্যের রূপ আঁকেন। এভাবে তিনি অসাধারণ এক চিত্রকল্প এঁকেছেন শেষপঙ্ক্তিতে এভাবে, ‘ভরাঘট উছলায় তার বুকে কাঁখে।’ শেষ পঙ্ক্তির এই দৃশ্য আবহমান গ্রাম বাংলারই দৃশ্য। ভীরু চপলার চলার পথে কত লাজুক লতা লজ্জায় লুটিয়ে পড়ে, সেদিকে যার খেয়ালই নেই, অপেক্ষমাণ প্রণয়প্রার্থীর ব্যাকুল চাহনির মূল্য সে কখনসে দেবে? ‘ধীবরের গান’ একটি গুরত্বপূর্ণ সনেট। এটি পেত্রার্কীয় ঘরানার। এখানে নিস্তরঙ্গ একটি নদীর বন্ধ্যাত্বের গল্প বলার ছলে সৃজনশীল সত্তার চিত্তের চাঞ্চল্য ও কাঙ্ক্ষিত বিষয় অর্জনের প্রসঙ্গ বর্ণিত। কবি যে আঁধারে নিজেও উধাও হতে পারবেন বলে ভরসা পাবেন, সে আঁধারে নদী চেনে জাল ফেলার কাঙ্ক্ষাপোষণ করেন। আজন্ম কৃষক কবিতায় কবি নিজেকে কৃষকের আদলে কল্পনা করতে স্বচ্ছন্দ্য। তার কাছে নারী ও কবিতা দুটোই সমার্থক। তাই তার সহজ উচ্চারণ: ‘সেই নারী ঘরে আসে নিটোল কবিতা/ ওর নাম ধানকন্যা, প্রজ্ঞাপারমিতা।’ আত্মকথনে যাকে খুঁজে ফেরেন, যাকে ছাড়া বিষয়-আশয় ও খ্যাতিকেও ঠিকানাবিহীন মনে হয়, সে হয়তো তার কাছে কবিতা।
সবচেয়ে চৌকর্যময় সনেট ‘বৃষ্টিবন্দনা’। বৃষ্টি যদিও প্রাকৃতিক বিষয় ও বিশেষ ঋতুতে এর বর্ষণ, তবু কবিমনে বৃষ্টির আনাগোনা সার্বক্ষণিক। খরা আর তপ্ত দিনে প্রকৃতিতে শান্তির ও প্রেমের বারতা বয়ে আনার জন্য বৃষ্টিই কাম্য। বৃষ্টি কখনো প্রিয়ার নাকফুল, কখনো এলোচুল, আবার মেঘের প্রতীক এলোচুল। এলোচুল যেমন চিত্রকল্পের অভাব পুরণ করে, তেমনি শ্লেষের দাবিও মেটায়।
কালোমেঘ দাও তবে ঢেলে এলোচুল
পড়ুক না ঝাঁকে ঝাঁকে ঝরে নাকফুল।
(বৃষ্টি-বন্দনা: উড়ে যায় মরমি পাখি)
বৃষ্টির এমন আবাহন অনিন্দ্য। অনন্যও। সে সঙ্গে অলঙ্কার প্রয়োগে আতাউল হক সিদ্দিকীর স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষরও।
কালসচেতন বলে সমকালীন বিষয়কেও কবিতার বিষয় করে তুলতে জানেন আতাউল হক সিদ্দিকী। মুহূর্তের বর্তমানকে চিরকালের মহিমা দিতেও তার সচেতন প্রয়াস লক্ষণীয়। ‘অসঙ্গতি’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ বারবার’ কবিতায় তার প্রমাণ মিলবে।
আনন্দ চেয়েছি পেতে, উঠে আসে ক্লেদ
হয়তো স্বভাবে আছে জটিল অসুখ
(অসঙ্গতি: উড়ে যায় মরমি পাখি)তুই যাস স্বপ্ন ভেঙে, আমি নিই ইতিহাস গড়ে,
বিজয় দিবস আসে পরাজিত তোর ঘাড়ে চড়ে।
(মুক্তিযুদ্ধ বারবার : উড়ে যায় মরমি পাখি)
আতাউল হক সিদ্দিকীর সনেটের ভাষা ঋজু, লালিত্যময় ও মনোগ্রাহী। তার অলঙ্কার অনেক সময় চরাচরের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক দূরের অনাত্মীয় সম্বন্ধ রচনা করে। কণ্ঠের ধ্বনিসাম্য, বিষয়নির্বাচন ও পরিবেশনে তিনি রবীন্দ্রনাথের সমাত্মীয়। আঙ্গিকে পেত্রার্কীয়, শেক্সপিয়রীয় ও মাইকেলি মিশ্রণ সুস্পষ্ট। চৌদ্দমাত্রার সনেটগুলোতে পয়ারের ধ্বনি যেমন বেজে ওঠে, আঠারো মাত্রার সনেটে তার ব্যতিক্রম। এই কবি আঠারো মাত্রার প্রলম্বিত লয়ে সনেটের ঠাস বুনটে অধিক পারঙ্গম। পেত্রার্কীয় সনেটের চেয়ে শেক্সপিয়রীয় সনেটে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতীপূর্ণ ভাবের ঐক্য রক্ষায়, ভাবনাকে পঙ্ক্তি থেকে পঙ্ক্তিতে চারিয়ে দেওয়ার পক্ষে তার নৈপুণ্যের স্বাক্ষর সুস্পষ্ট।
তবে, সামাজিক কোনো কমিটমেন্ট তার কবিতায় পাওয়া যায় না। রাজনীতি, সমাজব্যবস্থাপনা বিষয়ে কবি কিছুটা নিস্পৃহ। সনেটের ক্রমোৎকর্ষের পথের চেয়ে বৈচিত্র্যসন্ধানী, সেখানে সমান্তরাল গতিতে চলেছেন প্রথমদিকের চিত্তের চাঞ্চল্যপূর্ণ অধ্যায় থেকে সংহতরূপের হাত ধরে প্রৌঢ়ত্বেও। কিন্তু কোথাও তার জাড্য চোখে পড়ে না। তিনি চির তরুণ। তারুণ্যই তার সুদীর্ঘ সনেটজীবনের সারথী। ফলে তার সনেট-কবিতা হয়ে উঠেছে সংবেদনশীল মানুষের সংহত সংরাগ। গদ্যের এই প্রবল পরাক্রান্ত যুগে, যেখানে নবীন কবি যশপ্রার্থী ছন্দ উচ্ছেদের স্লোগানে বিভোর, সেখানে সনেটের কঠিন বন্ধনে কাব্যের যে মুক্তি আতাউল হক সিদ্দিকী অন্বেষণ করেছেন, তা বর্তমানে বিস্ময়কর।
প্রথম প্রকাশ: দৈনিক যুগান্তর, সাহিত্য সাময়িকী (২০০৯)