বহুকাল এমনকি আজও আমরা পাশ্চাত্যমুখী। বহু শতাব্দী ধরে পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিশারদরা আমাদের সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা বা মিথিক্যাল স্ট্রাকচার তৈরি করেছেন। সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতার আকর এই এশিয়া মহাদেশ হওয়া সত্ত্বেও তারা এর সঠিক মূল্যায়ন করেননি। প্রাচ্যবিশারদরা সৃষ্টি করেছিলেন দুটি বিপরীতমুখী গতির অসম জনপদ—অরিয়েন্ট ও অকসিডেন্ট। এখানেই থেমে থাকেননি তারা—বোঝানোর চেষ্টা করেছেন অরিয়েন্ট মূলতই অচল। তৈরি করেছেন ‘অরিয়েন্টালিজম’ নামের এক বুদ্ধিবৃত্তিক চাতুরিক প্রজেক্ট—একটি ডিসকোর্স। সেই আঘাতে আমাদের চোখ পশ্চিমা দৃষ্টিতে এ দেশের মাটি ও আকাশের নিবিড় গবেষক- কৃষককেও অশিক্ষিত বানিয়ে যেমন ভুল করেছিল, তেমনি সব ক্রিয়া-কর্মে-শিল্প-সাহিত্যেও আমরা নিজেদের চোখে তাদের চোখ বসিয়ে আমাদের স্বকীয়তার যোগ্যতার অবমান করেছি। এডওয়ার্ড সাঈদ যার আন্তরমূলে আঘাত করে নতুন এক ডিসকোর্সের জন্ম দিলেন—অরিয়েন্টালিজম এর কাউন্টার ডিসকোর্স, যা সারা প্রাচ্য-প্রতীচ্যে নিন্দিত-নন্দিত গৃহীত হয়ে উঠেছে। ফলে সারাবিশ্ব প্রাচ্যের শিল্প সংস্কৃতিকে, ঐতিহ্য ইতিহাসকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শিখলো। প্রাচ্যের মনোজাগতিক স্তরও এই আমূল পরিবর্তনে স্বকীয়তায়, সম্মানে উঠে দাঁড়ালো। মনোউপনিবেশটি ধ্বংস করার এই নতুন ডিসকোর্স প্রাচ্যজনকে শেকড়বাকরে ফিরিয়ে আনলো। নিজের আয়নায় নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখতে চাইলো সে ‘অরিয়েন্টালিজম’ প্রকাশের(১৯৭৮ সাল) পরে। এডওয়ার্ড সাঈদ দেখালেন পাশ্চাত্য কিভাবে রাজনীতি ও ক্ষমতার জোরে সব বিষয়ে নাক গলিয়ে আমাদের দুর্বল করে রাখছে। তারা কিভাবে আমাদের অক্ষম, অধস্তন, রোমান্টিক মরমিবাদী, স্বপ্নবিলাসী, বাস্তবতা বিবর্জিত ভাবত—তার বিস্তর বর্ণনা পাই সাঈদের গ্রন্থ থেকে। বিশ্বকে আলোড়িত করা এই গ্রন্থের বক্তব্যের পরে আর হোর্হে লুই বোর্হেসের বক্তব্য আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকে না, যেখানে তিনি বলেন—সাধারণত প্রাচ্যের লোকেরা সাহিত্য ও দর্শন ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে চর্চা করে না, তারা এমনভাবে চর্চা করে যেন এরিস্টটল বের্গশ’র সঙ্গে, প্লেটো হিউমের সঙ্গে তর্ক করছেন—সবই যেন একই সময়ে। অর্থাৎ আমাদের কাণ্ডজ্ঞানের কোনো বালাই নেই। প্রাচ্যবিদ প্রতীচ্যের আরও গবেষক আছেন—যাদের কাজই ছিল এমত বয়ান। এদের মধ্যে দয়েৎসেন ও ম্যাক্স মুলারও নাকি খুবই বিব্রত হয়েছিলেন—আমাদের অঞ্চলের (প্রাচ্য) গ্রন্থকারদের কাল পরম্পরা নির্ণয় করতে!
যাই হোক, অজিত দত্তের কবিতায় বলি:
অনেক বিপথে ঘুরে পা দু-খানি পথ খুঁজে পায়।
আমরাও এবার না হয় আত্মকে সম্মান করতে শিখি! উঞ্চা উঞ্চা পাবত তহি বসই সবরী বালি—থেকে কাল আর ভাষা পরম্পরাটা একটু দেখি:
চাঁদবেনে বলে মর্ম বড় অপমান।
কেমনে করিব আমি মনসার ধ্যান।।
বাদ বিসম্বাদ ছিল যার সনে কালি।
কোন লাজে লইব তাহার পদধূলি।।
চেঙমুড়ী বলিয়া যাহারে দিতাম গালি।
কোন মুখে তার আগে হব কৃতাঞ্জলি।।
এই বড় অপমান হইল আমার।
কেমনে পূজিব পদ দেবী মনসার।।
তারও পরে:
তুমিও আইস, দেবি, তুমি মধুকরী
কল্পনা। কবিরচিত্ত ফুলবন মধু
লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে
আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।
তারও পরে আমরা দেখি:
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়।
এভাবে চর্যাপদ থেকে আজ অব্দি বাংলা ভাষায় রচিত শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো বোর্হেসের কথার প্রতিউত্তর হয়েই রইল।
খ.
শক্তিশালী কবির ভাষা প্রয়োগের একটি ভঙ্গি থাকে। যেমন জীবনানন্দ দাশ আমাদের এক বিশুদ্ধ ভাষা ভঙ্গির উজ্জ্বল দুয়ার খুলে দিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু—যিনি তার ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ গ্রন্থে হেমচন্দ্র বাগচীকে আধুনিক কবি হিসেবে স্থান দিয়েছিলেন। আজকের পাঠক তাকে তেমন জানেনই না। বেঁচে থাকতে কেউ মূল্যায়ন করেননি বটে, বুদ্ধদেবই করেছিলেন জীবনানন্দকে ও জীবদ্দশায় তিনিই পাঁচ/ছয়টি মাত্র কবিতা ছাপিয়েছিলেন জীবনানন্দের। কালই প্রকৃত মঞ্চ। ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’র ভূমিকায় বুদ্ধদেব বসু ত্রিশের কবিদের সম্পর্কে বলেন—‘এই কবিরা নতুন সুর এনেছেন আমাদের কাব্যে, রবীন্দ্রনাথের পরে নতুন সুর। যারা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র এবং স্বতন্ত্রভাবে নতুন।’ এখানে সুর বলতে তিনি চেতনা বুঝিয়েছিলেন। সেই চেতনাটি ছিল বিংশ শতকীয়—যার মর্মে ছিল নির্দয় বাস্তবতা, যেখানে মানুষ মূলত একা। মানুষ একান্তই ব্যক্তিক, তার চিন্তাধারাও অন্তর্গত ও নিজেকে নিয়ে। সে তার কষ্টের বেদনা আর্তি আকুতি নৈঃসঙ্গ্য অন্যকে দিতে চায়। কিন্তু পেরে ওঠে না। ফলে নিজের ভেতর আরও এক গভীর বেদনা গভীর বোধ বিপন্ন বিস্ময় তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর পুঁজিবাদী সমাজ যখন গ্রাস করে ফেলতে থাকে কৃষিনির্ভর মন, তখন একাকিত্ব আরও প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। এই ভূখণ্ডে ১৯৪৭-পরবর্তী বিভাজন ৫২-র হাত ধরে ৭১-এ এসে দাঁড়ায়। কিন্তু বাংলা কবিতায় পঞ্চাশের দশকেই একটি ভৌগলিক আর্তি তৈরি হয়। ৬০-এর দশকে তা আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে বিশ্ব জুড়ে উপনিবেশবাদ তার নখর গুটিয়ে ফেলে এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কবিতা কথাসাহিত্য অসাধারণ জ্যোতি ছড়াতে থাকে—যার বেশিরভাগ বিষয়ই ছিল মূলত উপনিবেশবাদ ও সামরিক সরকারবিরোধী। এই ভূখণ্ডে বিগত শতাব্দীর ৮০-র দশকে কবিতার আকরণ যেমন নতুন বীক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে, তেমনি প্রকরণেও এসেছে নতুনত্ব। মুক্তিযুদ্ধ কাব্যচেতনার অমিত দুয়ার খুলে দিলেও ৭০-এর দশকে বাংলা কবিতা দীর্ঘ বাগাড়ম্বরপূর্ণ এবং স্লোগানধর্মী হয়ে ওঠে। আশির দশকে সামরিক শাসনের বিক্ষুব্ধ উত্তাল সময়ে বাংলা কবিতা নানামুখী স্রোতের ঘূর্ণিপাকে পূর্বোক্ত বহু পোশাক আশাক খুলে ফিরে যেতে শুরু করে তার আত্মার দিকে। মূলত আশির দশকে বাংলা কবিতায় যে পরিবর্তনটি সূচিত হয়, নব্বই দশকে তা গাঢ় রূপ ধারণ করে ও স্পষ্টতই আমরা দেখতে পাই বাংলা কবিতার বহিরঙ্গ এবং অন্তরঙ্গ বদলে এক নতুন কবিতার জন্ম হয়েছে। এ সময় প্রবীণদের অনেকেই পরিবর্তমান কাব্যভঙ্গির পাঠ না নিয়েই নেতির মন্তব্য করে বসেছেন এসব তথাকথিত ‘অকবিতাকে’। তারা উত্তরকালকে ধরতে পারেননি বলেই এমনটি ঘটেছে। নিজের কাল বা দশকের গণ্ডি তারা পার হতে পারেননি। এদের ছানি আক্রান্ত চক্ষু তাই আর দূরান্বয়গামী হতে পারে না, কলমও সময় অনতিক্রান্ত হয়ে ওঠে। এটি রবীন্দ্রনাথেরও হয়ে ছিল। বুদ্ধদেব বসু তো তরুণদের কবিতা ‘বোঝেন না’ বলে ‘কবিতা’ পত্রিকাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আর কবিতার দুর্বোধ্যতাকে টলস্টয় তো ‘দুর্নীতি’ বলতেও পিছ পা হননি। শুধু তাই নয়—তিনি কবিতাকে ‘কুশিল্প’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন। নব্বইয়ের কবিতাকেও যারা দুর্বোধ্য বা অকবিতা আখ্যা দিয়েছেন তারা পিছিয়ে পড়েছেন, সময়ের সুর ও স্বর তারা ধরতে পারেননি—এখনো লিখে চলেছেন মধ্য আশি পূর্ববর্তী ঢঙে। অথচ এই ভূখণ্ডের কবিতার ‘নির্মোক’ পাল্টেছে। মুক্তিযুদ্ধও তাতে বিশাল প্রণোদনার ক্যানভাস তৈরি করে দিয়েছে—যা পশ্চিমবঙ্গের ঊষর ভূমিতে নেই। পশ্চিমবঙ্গের কবিকূল এখনো ত্রিশ-আক্রান্ত হলেও এ পারের নব্বইয়ের কবিরা কিন্তু আরও বহুগামী হয়ে উঠেছে। তারা রবার্ট ফ্রস্টের মতো সাধারণের ভাষায় মধ্য আর প্রাচীন যুগকে ভেঙে নতুন ফর্মে লিখছেন আমাদের লোকগাথা, পুরাণ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, রূপকথা, উপকথা, কিংবদন্তী, প্রবাদ প্রবচন, শ্রুতি বাগধারা—সব। স্পষ্টতই কবিতার আধার ও আধেয়র নতুন নির্মাণ চোখে পড়ছে। একই বিস্তৃতি ঘটেছে এসময়ের কবিদের কবিতায়ও। তারা নব্বইয়ের স্বরে কবিতা লিখলেও নব্বইয়ের কবিদের উজ্জ্বল নির্মাণশৈলীর কাছাকাছি এখনো পৌঁছাতে পারেননি।
আশির দশকটি বাংলা কবিতায় সামরিক বুটের নিষ্পেষণে সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেও কবিরা ত্রিবিধ ধারায় সৃজনক্রিয়ায় মশগুল ছিলেন। এক শ্রেণী সরাসরি রাষ্ট্রপ্রধানের কবিত্বের আনুকূল্যে মিডিয়ার প্রশ্রয়ে কাব্য সৃজন করে যাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় শ্রেণী উচ্চকিত হলেন স্বৈরাচারের পতনে এবং মঞ্চউৎসব করে শৃঙ্খলমুক্তি ও অন্যান্য বিষয়ে জ্বালাময়ী কবিতা লিখে। আরেকটি শ্রেণী কোনো দিকেই গেলেন না। সেই উত্তাল সময় তাদের এতটুকু স্পর্শও করল না। কেবল আত্মরতির পঙ্ক্তিমালা পুঞ্জিভূত করলেন তারা। তবু এই তিনের ভেতর থেকেই উঠে এসেছে কিছু সংহত দেশকালের ইতিহাস ঐতিহ্যনির্ভর মিতবাক দূরান্বয়ী স্বাদু কবিতা। তারই হাত ধরে নব্বই—আমাদের সামনে একটি বহুমাত্রিক নবতর কাব্যদুয়ার খুলে দিল—যার মাত্রার বিভিন্নতা থাকলেও কেন্দ্র কিন্তু একটিই। বহু পরিকেন্দ্রে তার বিচরণ। নব্বইয়ের কবিরা কবিতার প্রচল ধারণাকে প্রশ্নই কেবল করলেন না, ভেঙেও ফেললেন। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান এবং দীর্ঘ দিন পরের গণতান্ত্রিক নির্বাচন তাদের চেতনারেখাটি বিস্তৃত করে দিল। ফলে প্রতিনিয়ত তারা বিদ্রোহ করেছেন নিজের ভেতরে পুরনোর সঙ্গে নতুনকে নিয়ে—নতুন চিন্তাধারা, নতুন ফর্ম, নতুন প্রকরণ, নতুন আঙ্গিক ও নতুন বিষয় নিয়ে। সেই ধারায় আশি এবং নব্বই হাত ধরাধরি করেই চলেছে। অনেকেই কবিতার এই বিস্তারকে ত্রিশি ধারার পুনর্জাতকরণ বলেছেন। আগেই বলেছি বাংলা কবিতা পঞ্চাশের দশকে স্বকীয়তার পথে আকরিত হতে শুরু করে—যার বিস্তৃতি মহাকাব্যিক। অথচ গভীর গীতল ও আত্মমগ্নও বটে। ষাটের দশকে কাব্য সমসাময়িক রাজনৈতিক সংক্ষুব্ধতায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব-জিজ্ঞাসা, বিদ্রোহ, আত্মরতিসংশ্লিষ্ট হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে বিষয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার ফলে কবিতা সমাজ ও শিল্পীর দ্বন্দ্বময় পরিবেশে যতটা অগ্রসর হয়, সম্মিলিত জীবনধারার মূল কেন্দ্র নিয়ে ততোটা নয়। তারা প্রেমের কবিতা রচনায় অবিরাম শরীরকামী, মোহন হৃদয়ের সন্ধান যেন ছিল বাতুলতা। ফলে শারীরিক মোহের মতো খোলামেলা শরীরী কবিতাও এক সময় স্থূল অচল হয়ে পড়ে। তবে ৭০-এর কবিদের কবিতা সমাজ মনস্কতায় এবং রাজনৈতিক চিত্রণে সফলতার চূড়ান্ত শীর্ষ ছুঁয়েছিল।
৭০ ও ৮০-র বহু কবি তাদের কবিতায় পরিবর্তিত সময়ের টোন মেজাজ ও ভাষাভঙ্গিটি আনতে না পারলেও কেউ কেউ ভেতরে ভেতরে বদলাতে থাকেন। নব্বইয়ে পাল্টানো রুচি ও মেজাজটি দার্শনিক ছোঁয়ায় আস্তিত্বিক সংকটে ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। পাশাপাশি কবিতা আত্মগত, সুবেদী, সুস্থির ও প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠে। এ সময়ের কবিতায় চিরকাল খেলা করে। মানবের অস্তিত্বের সংকট ও রহস্য, ঐতিহাসিক মন্ময়তা তাকে স্বকাল ও স্বসমাজের বিন্দু থেকে বিশ্ববৃত্তে ছড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কবিতায় চেতনার নতুন বিষয় আসয় সংযুক্ত হলেও বাগাড়ম্বরপূর্ণ এবং রিপিটেশনধর্মী কাব্যের স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে আশির দশকে। ৭০-এর পুরনো স্তম্ভগুলো ধসে পড়তে থাকে। নব্বইয়ের কবিরা সেগুলো ধুলোয় মিশিয়ে দেন। তারা বাংলা কবিতার অগ্রসরমানতাকে খতিয়ে দেখেন। পরবর্তী দশকে অর্থাৎ শূন্যর কবিতাও সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছে। কিন্তু একটি বিষয় আমাকে আহত করে— যখন দেখি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম অথবা মানবতাবিরোধী অপরাধীরা মন্ত্রী হয়ে জাতীয় পতাকা বহন করলেও কবিতায় সেই বিষয়টি তেমন কোনো সংক্ষুব্ধ বাতায়ন তৈরি করে না। বহু কবির কবিতায়ই রাজনীতি একটি অস্পৃশ্য বিষয়।
যুগে যুগে কবিরাই তো সমাজের অগ্রকথক। কবি লেখক শিল্পীদের বিরুদ্ধে সবসময়—ধর্ম, রাজনীতি আর নীতির অভিযোগ উঠেছে। উঠবে। সাম্প্রতিক কবিরা এই তিনের অসামঞ্জস্য নিয়ে কী খুব বেশি সরব? অথচ, নিকট ইতিহাস বলে—রবীন্দ্রনাথের গান রেডিও পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়েছিল, নজরুলকে এক সময় কাফের বলা হয়েছিল, নজরুলের ভাস্কর্য এসএম সুলতানের ‘দুরন্ত’ ভেঙে ফেলা হয়, ডক্টর আহমদ শরীফকে মুরতাদ ঘোষণা করা হয়, কামরুল হাসানের ফাঁসি চাওয়া হয়, আরও এগুতে পারি হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন পর্যন্ত।
বাইরে ডক্টর জিভাগো নিষিদ্ধ হয়েছিল, কবি শেলী শুধু নাস্তিক্যবাদ নিয়ে লেখার কারণে অক্সফোর্ড থেকে বিতাড়িত হন। লরেন্সের লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার, হেনরি মিলারের ট্রপিক অব ক্যান্সার, এলেন গিনসবার্গের হাউল নিয়ে মামলা চলে খুবই অশ্লীলতার সঙ্গে। নজরুলের একাধিক গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়, নাজিম হিকমত দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। লোরকা নিহত হন ফ্রাঙ্কোর হাতে। সব অভিযোগই শাসকদের চাপানো ছিল। কবিতা রাজনৈতিক, ধর্মতাত্ত্বিক না আর কিছু এসব বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। বরং মেরে ফেলা নিষিদ্ধ করাই সহজ কাজ। তাই বলে কী সভ্যতার পক্ষের কবিতা লিখতে কবিরা পিছিয়ে থাকবেন? থেকেছেন কখনো?
কাল দশকের ভার বহন করে না। সময়ের স্বর শুধু তুলে আনে। কিন্তু কার স্বর? কেমন স্বর? জীবনানন্দ দাশের দুটো বক্তব্য উদ্ধৃত করি—‘এক পৃথিবীর সমস্ত কবিতা পড়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়: কিন্তু প্রথমত নিজের দেশের সমস্ত কালের ভালো কবিতাগুলো পড়া দরকার।’ অন্যত্র তিনি বলেন—‘কিন্তু নিজের যুগে বাস করেও আরও অনেক যুগে বাস করার খানিকটা স্বভাব ক্ষমতা, নিজের সমাজের পুরোপুরি জীব হয়েও অন্য অনেক সমাজে নিজেকে যথাসম্ভব স্বচ্ছন্দ্যে স্থিত ও মিলিত করে নেওয়ার মতো অনুভূতি ও বিচারের স্পষ্টতা না থাকলে নানা দেশ ও সময়ের কবিতা পাঠে বিশেষ কোনও ফল হয় না।’ আজকে অনেকেই অজস্র বাক্যরাশি কাব্য হিসেবে প্রকাশ করেই চলেছেন—কাব্যের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বুঁজে—প্রকাশিত গ্রন্থিত হওয়ার দুর্মর বাসনায়, প্রযুক্তির আনুকূল্যে কেবলই প্রসবযাতনায় আকুল তারা। মিডিয়াপালিত বহু মুখরোচক সমালোচক কবিও আছেন—যারা প্রান্তিকের কোনো খবরই রাখেন না, কেন্দ্র বলেও যা ভাবেন, তা আসলে কেন্দ্রচ্যুতি। এমন বহু আড়াল কবি আছেন, যাদের পাঁচ ছয়টি কবিতার সামনে ওইসব কবিকূলের তাবৎ কাব্যকৃতি ফিকে হয়ে যাবে। সেজন্যই কেন্দ্র ও প্রান্তের সমবায়ে, আড়াল ও সম্মুখ কবিতার সমন্বয়ে একটি বৈভব কবিতার প্লাটফর্ম থাকা প্রয়োজন।
নব্বই ও শূন্য দশকের কবিতার একটি বিরাট অংশ প্রকরণ চর্চার নির্বিকারত্বে অসার। বিষয়গুরুত্ব, অভিজ্ঞতার বীক্ষণজাত ভিশন, সত্তাগত প্রশ্ন ও উপলব্ধি এসব বিষয় আশয় নিয়ে তারা অনেকেই তেমন ভাবিত নন। বরং তাদের কবিতা গুহ্যতান্ত্রিকতায় ভরপুর। শব্দের অর্থচ্যুতি ও পঙ্ক্তির স্বেচ্ছাঅসংলগ্নতা কবিতার জন্য কতটুকু অনিবার্য, তা ভাবতে হবে। নয়, কবিতার পরিমণ্ডল বহুদূর বিস্তৃত হলেও কবিদৃষ্টি সীমায়িত, আত্মকৌণিক, খণ্ডবিখণ্ড চেতনাতলের বিরোধাভাসে ধস্ত হতে বাধ্য। সংস্কৃতির বিনির্মাণধর্মী প্রক্রিয়ায় শ্রেণীচেতনার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা নয়, এই দর্শন, এই আধ্যাত্মবাদী কবিতারাশি ভিন্নদিকে মুখ ফেরালে বাংলা কবিতার জন্য সেটি হবে হতাশাব্যঞ্জক। আজকাল কতক তরুণ কবিতার নামে একপেশে ধর্মবাক্য প্রচারে ব্যস্ত, যা কবিতার আবর্জনাকে কেবল বাড়িয়েই তুলছে।
কবিতা কোন রাজনীতি গ্রহণ করবে সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবিতার ইতিহাসে রাজনীতি ছিল, থাকবে, প্রত্যক্ষে অথবা পরোক্ষে—এটাই স্বাভাবিক। সেই চর্যাপদ থেকে মধ্যযুগের রাজা বা দেবতাশাসিত কাব্য অথবা তার পরবর্তী সময়ে রচিত কাব্য থেকে আজ অব্দি সব স্বভাষা-বিভাষার কবিতায় রাজনীতি আছে, থাকবে। অনেকেই বলেন, সাম্প্রতিক কবিতায় ছন্দের বেসামাল অবস্থা, ব্যাকরণ ঠিক নেই। আমি নিজেও দেখেছি ছন্দের ব্যাকরণগত অসিদ্ধ মিশেলে কবিতা লিখে চলেছেন অনেকে। মাত্রাবৃত্তের চালের ঠিক পরে নিরেট গদ্যের টানা ছাঁদ। কোথাও আবার ছন্দের বালাইই নেই। এমনটি হতে পারে কি পারে না ‘পাণিণিগণ’ এসব হিসাব কষবেন। আমি কবিতা পাঠান্তে কবিতায় কবিতাই খুঁজি ও আনন্দই যাপন করতে চাই। কবিতা যদি আমার সঙ্গে কম্যুনিকেট না করে তবে তাতে যতই ব্যাকরণ, ছন্দ, বক্রোক্তি, উপমা, দৃশ্যকল্প ইত্যাকার বিষয় থাকুক না কেন, সেটি আমার কাছে কবিতা নয়।
আমার বিশ্বাস বাংলা কবিতা সাম্প্রতিক বিশ্বের সেরা কবিতাকীর্তির পর্যায়ে রয়েছে। কবিতা যেহেতু সময়ের সবচেয়ে অগ্রসর স্বর, সেহেতু কবিকে সমকাল ও মহাকালের ইশারাটি বুঝতে হবে। তা নয়, সাজানো শব্দরাশির স্তূপের নিচে তিনি নিজেই চাপা পড়ে যাবেন। জীবনানন্দকে মল্লিনাথেরা অস্বীকার করেছিলেন, কিন্তু সময়ের পাঠক তাকে ঠিকই চিনতে পেরেছেন। বাংলাদেশের কবিতার অর্ধশতক পূর্ণ হতে চলেছে। আজ মোটাদাগে, বৈশিষ্ট্যে, ধারায় বাংলা কবিতাকে চিহ্নিত করার সময় এসেছে। আমার বিশ্বাস বিগত পঞ্চাশ বছরের বাংলা ভাষার প্রকৃত কবিদের তালিকা প্রণয়ন করা হলে অনেক জনপ্রিয় কবিই সেই মহাকাল থেকে ঝরে পড়বেন। সময়ের দাপুটে ক্ষমতালোভী মিডিয়াকাতর মুখরোচক কবি সমালোচক ও পাঠকের হাত থেকে প্রকৃত কবি ও কবিতাকে রক্ষা করে শীলিত, আকারিত ইতিবাচকতায় চিহ্নায়নের লক্ষ্যে অর্ধ শতকের বাংলা কবিতার খেরোখাতা থেকে একটি নোটবুক তৈরি করা আজ অত্যন্ত জরুরি।