যাওয়া বলে কিছু নেই, সবই ঘুরেফিরে আসা
শূন্যতায় মাথা কুটে ফিরে আসে সমস্ত সংলাপ
সব শীৎকার, চিৎকার
বিশাল রণপা-য় চেপে
. প্রাচীন গোধুলি ফিরে আসে,
নীলিমা ভ্রমণ শেষে ঘরে ফেরে পাখি;
নদী, তারও গতি নয় শুধুই সাগরে
সেও মেঘে মেঘে ঝর্ণার নিকটে ফিরে যায়।
শুধু
একবার চলে গেলে
. নারীরা ফেরে না।
(নারীরা ফেরে না: নারীরা ফেরে না)
অরুণাভ সরকার নিজেকে নির্মাণ করেছেন, শিল্পীর ধৈর্য,স্থিরতা নিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, নির্মাণ করেছেন, পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়েছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় দীর্ঘ প্রস্তুতির পর। লেখালেখি শুরুর প্রায় দেড়যুগ পরে—১৯৭৬ সালে। প্রথম কাব্যের নাম ‘নগরে বাউল’। অরুণাভ সরকার যত না লিখেছেন, ছেপেছেন তার চেয়ে অনেক কম। তার সমসাময়িক অনেকেরই কাব্যিক মৃত্যু ঘটলেও অরুণাভ সরকার নিজের প্রকাশউন্মুখতা ধরে রেখেছেন। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলেও কাব্যচর্চার এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ তিনি তার সতৃষ্ণ পাঠককে দিয়েছেন।
তার উন্মেষকালে বাংলাদেশের রাজনীতির উত্তাল ঘটনাতরঙ্গ সব কবিকেই ছুঁয়ে গেছে। ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন ওই সময়ের কেউ-কেউ।
যেখানে মানুষের স্বপ্নের জগৎ ভেঙে যায়, মানুষ বিভ্রান্ত হয়, সেখানে ঔদাসীন্যের ভেতরে নয়, মানব জীবনের সংকটের মধ্যে, টালমাটাল, সংকুচিত পৃথিবীতে অরুণাভ সরকার জীবনকে স্বীকার করেই বলেন:
আমার দক্ষিণে-বামে
(হয়তবা)
জনতা ও জনপদ
. মিনার, মন্দির
. ধ্বসে যায়
দাউদাউ জ্বলে ওঠে
উঠোন, বাগান
. পথিক-নিবাস আর বিউটিরিসোর্ট
(হয়তবা)
নদী-দ্বীপ, চর জেগে ওঠে
মাটির কুমারী বুকে চুমু খায় প্রেমিক উদ্ভিদ
তৈরি হয় ছায়াচ্ছন্ন আঁতুড় বসত
. গোলাপের, সবজির বাগানআমি এর কিছুই দেখি না
আমি
চেতনার মধ্যে নয়
স্বপ্নে নয়
স্বপ্নহীনতায়ও নয়
যেন ঘুমের বোরকায়
আপদমস্তক ঢেকে
নিদ্রা থেকে, নিদ্রাতুর, অন্য এক নিদ্রায় বলেছিআমার নিদ্রার মধ্যে, ঘুমের দরজায়
কড়া নাড়ে প্রতিবেশ, প্রতিবেশীজন
নিউজ রিলের ধাঁচে
ভেসে ওঠে
নিরুদ্দিষ্ট দিনপঞ্জী, রুটি ও রাইফেল
আমার ঘুমের মধ্যে এক ঘুমহীনতার মধ্যে
কাচ-স্বচ্ছ দেখি
আমার জননী, জায়া, ভগ্নী ও আত্মাবিধৃত দৌপদী সাজে উঠোনে- উঠোনে
সহস্র স্বজন ভাসে পদ্মায়, মেঘনায়এরপর আরও কিছু গোলাগুলি
কিছু উল্লাসী আওয়াজ
একটি রক্তিম বৃত্ত
বিশাল বিশালএরপর
রাজপথে ক্ষুধাতুর মুখের মিছিল
. আর কিছু রক্তভেজা শাড়ি
. কিছু হিঁস হিঁস শব্দ
কিছু অক্ষমতা, ক্ষমা, কিছুটা প্রশ্রয়
…
আমার ঘুমের মধ্যে কেবলই কড়া-নাড়া
আমার ঘুমের মধ্যে
. কেবলই ঘুমহীনতার পদপাত
আমার ঘুমের মধ্যে কেবলই ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া।
(নিদ্রাহীন জাগরণহীন)
অরুণাভ সরকারের কবিতা নিঃসঙ্গতা ও প্রেমের দিক উন্মোচন করলেও জীবন সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি অভিজ্ঞতায় জারিত, বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি জীবন থেকে সন্ধান করেন কবিতার, তাই তার কবিতার ভাষায় উঠে আসে গভীর সত্য। তার কবিতায় কোন আরোপিত বিষয় নেই, তিনি নেতিবাচক ধারণাকেও জীবনে, কবিতার ভাষায় উপস্থাপন করেন না। বরং জীবনের নির্মমতার দিকগুলো তিনি স্পর্শ করেন, তবে তা শুধু রোমান্টিকতায় ভরা নয়, তিনি সময়ের হাতে নিজেকে সমর্পণ করেন না, সময়কে নিয়ন্ত্রণ করে, সময়ের ভেতর নিজের কাব্যচেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। মানুষ স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্নের ওপর ভর করেই তৈরি করে ইমারত। আবার কখনো একই স্বপ্ন ভেঙে যায়, পুঞ্জিভূত হাহাকার বুকের ভেতর লালন করে, মানুষ তবু বেঁচে থাকতে চায় পৃথিবীতে। যদিও জানে, অসীম শূন্যতার দিকে তার যাত্রা—সেই যাত্রাকেই তিনি ভাষায়িত করেন:
একদিন ছিল না কিছুই। না রাত, না দিন
. গ্রহ ও নক্ষত্র, ছায়াপথ
কিছু না, কিছু না। অনন্ত শূন্যতা ছাড়া
কিছুই ছিল না।
তারপর হঠাৎ ম্যাজিক
ম্যাজিকের মতো এই মাটি ও সাগর
তারপর চারদিকে খুব বৃক্ষের মহিমা
শাখায় শাখায় গুচ্ছ গুচ্ছ প্রাণ
আরও প্রাণ নিবিড় ছায়ায়
প্রাণ ঝর্ণার স্রোতের মধ্যে
কেউ কেউ আরও দূর লবণাক্ত জলে
…
প্রাণ-কাম-ক্ষুধা ছিল
আর ছিল ক্রোধ, দাউ দাউ ক্রোধ
ক্রোধের আগুনে মৃত্যু- তাও ছিল
. আর কিছুই ছিল না
তারপর মানচিত্রে খুব হিজিবিজি টান
গুচ্ছ গুচ্ছ স্বতন্ত্র পতাকা
পতাকার নিচে তূণ
তূণের তীর ও ধনুক
অর্থাৎ তখন খুব ক্ষুধা লোভা লালসা ইত্যাদিতারপর পাথরের গায়ে গায়ে অপূর্ব আঙুল
. ছেনি ও হাতুড়ি
. গৌতম বুদ্ধের বাণী
. রবীন্দ্রনাথের গান
তবু আজও দেহে দেহে দাউ দাউ শিখা
তবু আজও হাতে হাতে তীর ও ধনুক
তবু আজও পায়ে পায়ে শূন্যতার দিকে
অন্তহীন শূন্যতার দিকে।
(পুনরাবৃত্তি)
অরুণাভ সরকার তার কবিতাকে তুলনামূলকভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলেন। তিনি ভাষায় এবং বর্ণনার সঙ্গে বিষয়ভাবনাকে একত্রিত করে শান্ত এবং নির্বেদ ভঙ্গিতে প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ই শুধু নয়, দার্শনিকসূত্রের আভাসও রেখে যান। আর সেখানে শুধু দৈনন্দিনতাই নয়, বরং বৈশ্বিকতার দিকেও ফেরানো থাকে তার চোখ। তিনি একদিকে যেমন মানুষের বিপুল সম্ভবনায় বিশ্বাসী তেমনি এর সঙ্গে নিজের কালমগ্নতার ভেতর দিয়ে নির্মাণ করেন চিত্রকল্প। যে চিত্রকল্পে থাকে সহজ ভাষা, থাকে সহজ বর্ণনা। আর এর মধ্য দিয়েই তিনি গড়ে তোলেন নিজেকে। প্রকৃতির সৌন্দর্যের সঙ্গে রোমান্টিক উপলব্ধি আর এই দুইয়ের বর্ণনার ভেতর দিয়ে তিনি সহসা নির্মাণ করেন আশ্চর্য এক সমন্বয়, যা পাঠকের হৃদয়ে অনুরণন তোলে। যে একমুখী বর্ণনায় তিনি কবিতাকে এগিয়ে দেন, তার শেষ হয় ভিন্ন মেজাজে, ভিন্ন বক্তব্যে।
নদীর সাগরে যাবার কথা, এঁকেবেঁকে
নদীরা সাগরে যায়
সাগরে নদীর কোন নাম নেই
. নেই দৈর্ঘ্য বা প্রস্থের কৌলিণ্য
সেখানে নদীরা ভিন্ন ভিন্ন নদী নয়
সেখানে পদ্মার নাম সাগর
ভোলগা, আর আমাজনের নামও।
নদী তবু সাগরের দিকে
সাগরের পথে ধুধু মরুভূমি
. কাঁচাঝোঁপ, শৈলের প্রাচীর।
নদী ওতে ভ্রূক্ষেপ করে না
নদী নির্বিকার থাকে তার শাখা বা প্রশাখা
ভিন্ন পথে, ভিন্ন দিকে গেলে
নদী জানে, ঘুরে ফিরে সেও ওই সাগরেই যাবে
যেতে যেতে মিলেমিশে বড় হবে আরও।
নদীর ত সাগরে যাবার কথা
সাগরে নদীরা ভিন্ন ভিন্ন নদী নয়
সাগরে নদীর কোন বিশেষণ নেই
সাগরে প্রতিটি নদী শুধুই সাগর।
মানুষও, নদীর মতো, একদিন অভিন্ন মানুষ।
(নদীদের মতো)
অরুণাভ সরকার মূলত রোমান্টিক কবি। তবে রোমান্টিসিজমের ঘেরাটপে তিনি বন্দি থাকেননি। তিনি কল্পনার ফানুস ওড়াননি কবিতায়। তার কবিতার ভিসয়ে নেই কোনো বায়বীয়তা। বরং দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাকে তিনি নাগরিক রূপ দিয়েছেন। তিনি জীবন ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে উপকরণ নিয়ে শব্দের যাদুতে তার স্বচ্ছন্দ প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সেখানে থাকে চিন্তার খোরাক। ক্রমাগত আবেগের স্রোতে ভেসে যাওয়া কবির মতো তিনি শব্দকে কখনো আলগা করে দেন না। বরং নিয়ত শাসনের ছড়িতে শব্দকে তিনি চালনা করেন। তাই তার কবিতা মেদহীন, কোথাও কোথাও তা অবলীলায় আপ্তবাক্যের মতো মুগ্ধতা ছড়ায়-স্নিগ্ধ সৌরভ আর মধুর সরলতার ভেতর দিয়ে তা প্রকাশ করে জীবন যন্ত্রণার অকৃপণ ছবি। যে শব্দের জাদুতে তিনি গভীর বিশ্বাসে ক্রমাগত নিজেকে ধারণ করেন, মেলে ধরেন তা শুধু নিজেকে ভোলানোর জন্য নয়, বরং সেই স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণের ভেতর দিয়ে আধুনিক জীবন যন্ত্রণার ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নগর বাউল অভিধায় অভিসিক্ত অরুণাভ সরকার কবিতায় বিষয়ের অন্তরালে, ভাবনার গভীরে যে অন্তরঙ্গ দীর্ঘশ্বাসে একত্রিত করেন, তা নিজস্ব প্রসঙ্গ অতিক্রম করে ব্যক্তিগত আবেগের বাইরেন বার বার একটি উজ্জ্বল রঙিন বাঁকের মতো নির্দেশ করে—নিজস্বতা।
আদি কবি বাল্মীকির ক্রৌঞ্চমিথুন-বিয়োগে যে শোক প্রকাশ পেয়েছিল শ্লোকরূপে। যে শোক, যে বেদনা, যে অতৃপ্তি- শব্দকে আশ্রয় করে ভাষা পায়, উঠে আসে কবির কলমে তা শুধু কবির কল্পনা হয়েই আর থাকে না, হয়ে ওঠে পাঠকের নিজের জন্যও এক অনন্য অর্থ-ব্যঞ্জনার বাহন। কল্পনা বা অনুভূতি-স্নিগ্ধ যে ভাব অরুণাভ সরকার তুলে আনেন অন্তর থেকে তা স্বতঃউৎসারিত।