একসময় মহাকাব্যকেই ধরা হতো আত্মপরিচয়ের নিজস্ব ভূমি। সে-ভূমিতে পরম নিবিষ্টতায়, নিবিড় ধীরতায়, অসীম ধৈর্যে কবি প্রোথিত করতেন কোনো জাতির প্রকৃত ইতিহাস, গৌরব, কিংবদন্তি। সেখান থেকেই জানা যেত সেই বিকাশোন্মুখ জাতির প্রকৃত নায়ক ও খলনায়কের রূপ।
আমাদেরও তো রয়েছে হাজার বছরের নিজস্ব ইতিহাস। রয়েছে একাত্তরের মতো শত বছরের সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়। তার পরিণতি। আমাদেরও রয়েছে নায়ক। রয়েছে খলনায়কও। কিন্তু মহাকাব্য কোথায়?
আচ্ছা ইতিহাস বদলের এই দেশে যদি হঠাৎ সবাই একই সঙ্গে নীরব ষড়যন্ত্রে বিস্মৃত হয়ে যাই! যদি দিন বদলের কেউ কিংবা নতুন প্রজন্মের কেউ পুরনো খলনায়কের প্রেতাত্মার সঙ্গে যোগসাজশে একইসঙ্গে জ্বালিয়ে দেয় আমাদের আসল ইতিহাস! আমাদের বাঙালি জাতির আসল ইতিহাস! সব লাইব্রেরির ইতিহাসের বইগুলো যদি একইসঙ্গে সাদা হয়ে যায়! সাদা সাদা পৃষ্ঠার ওপর কালো কালো অক্ষরগুলো একই ঙ্গে যদি বকের পালকের মতো উড়ে যায়! তখন!
হয়তোবো এগুলো নিছকই কল্পনা। কিংবা ইতিহাস বদলে দেওয়ার এই সংস্কৃতির দেশে এ রকম প্রবণতা দেখে-দেখে আতঙ্কিত মনের দুঃস্বপ্ন।
যা-ই হোক না কেন সবকিছুর মূলে রযেছে ইতিহাস মুছে দেওয়ার দুঃস্বপ্ন। কিন্তু এই দুঃস্বপ্নও যদি সত্যি হয়ে যায়!
বড় আশার কথা হলো, তখনও আমাদের ইতিহাস মুছে যাবে না। বাঙালি জাতি না হয়ে যদি আমরা অন্য কোনো জাতি হতাম, তাহলে হয়তোবা মুছেই যেত সবকিছু। তারা হারিয়ে ফেলত তাদের ইতিহাস। কিন্তু আমরা হারাব না। কারণ আমাদের রয়েছেন শামসুর রাহমান।
মহাকাব্যের দিন শেষ হয়েছে অনেক আগে। আজ আর মহাকাব্য লেখা হয় না। তাই কবিতা থেকে, কাব্য থেকে একটি জাতির ইতিহাস উদ্ধার করা যেন সুদূর পরাহত। বাঙলা ভাষার কবি শামসুর রাহমান কোনো মহাকাব্য লেখেননি ঠিক, কিন্তু এক জীবনে যা লিখেছেন তিনি, নিরবিচ্ছিন্ন বা বিচ্ছিন্নভাবে তা ইতিহাসের এক অনন্য আকর। ভাবতে অবাক লাগে সেই আপাত বিচ্ছিন্ন কবিতাগুলো জোড়া লাগালেই হয়ে যায় একটি মহাকাব্য। যেখান থেকে অনায়াসেই তুলে আনা যায় আমাদের প্রকৃত ইতিহাস। ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁক। পাওয়া যায় ইতিহাসের উপাদান। সেখানে তুমুল তীব্রভাবেই উপস্থিত আমাদের নায়কেরা। সেখানে তুমুল তীব্রভাবেই ধীকৃত খলনায়কেরা।
যে-কোনো জাতির ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে উপরিতলা থেকে। নিম্নবর্গের মানুষেরা যেখানে থেকে যান প্রায়শই উপেক্ষিত। ইতিহাস হয়তোবা বড় কোনো ঘটনাকে বিশেষ মহিমা দেয়। নিম্নবর্গের কারো অনুভূতি কিংবা আবেগের কোনো স্থানই হয় না সেখানে। কাঠখোট্টা ওই জায়গা থেকে আমরা সহজেই মুক্তি পেতে পারি। যদি আমাদের ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে কবিতা থেকে। আরও স্পষ্ট করে বললে কবি শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে। কারণ এখানে একেবারে নিম্নবর্গের জায়গা থেকে ছোটবড় সব বাঁককে, ইতিহাস সূচনার বাঁককে প্রত্যক্ষণ করা হয়েছে। আর কোনো জাতির ইতিহাসের ক্ষেত্রে এভাবে কোনো কবির কবিতা ওঁতপ্রোতোভাবে জড়িত হয়েছে কি না, সন্দেহ।
এবার একটা তালিকা করতে পারি আমরা। শামসুর রাহমানের কোন কবিতাগুলো একত্রিত করলে আমরা পেতে পারি মহাকাব্যিক স্বাদ আর ইতিহাসের পরম্পরা! তালিকাটি হতে পারে এরকম—বর্ণমালা, আমরা দুঃখিনী বর্ণমালা, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, আসাদের শার্ট, তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, তুমি বলেছিলে, গেরিলা, আক্রান্ত হয়ে, সফেদ পাঞ্জাবি, দুঃসময়ের মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, অভিমানী বাংলাভাষা, ইলেকট্রার গান, জয়নুলী কাক, উদ্ভদ উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, শহীদ মিনারে কবিতা পাঠ, জয়দেবপুরের মুক্তিযোদ্ধা, মাস্টারদার হাতঘড়ি, দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে, একটি মোনাজাতের খসড়া, ধন্য সেই পুরুষ, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়, গর্জে ওঠো স্বাধীনতা, তোমারই পদধ্বনি, বরকতের ফটোগ্রাফ, সুধাংশু যাবে না, শহীদ জননীকে নিবেদিত পঙক্তিমালা।
এই মহাকাব্যের শুরু ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতা দিয়ে। যে-বর্ণমালা নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে দেয় সত্তায়। তারপর যুদ্ধের আগুন থেকে শুরু করে সৃষ্টির ফাল্গুন পর্যন্ত সর্বক্ষণ থাকে। থাকে জাগরণে হৃদপিণ্ডের মতো। সার্বক্ষণিক এই সত্তাকে উপড়ে নিলে কিছুই যে থাকে না। কিছু থাকতোও না আমাদের। আমাদের স্বাধীনতার বীজ যে ওখানেই নিহিত। আমাদের আত্মপরিচয় উদ্ধারের প্রথম সোপান যে ওই বর্ণমালা। ‘তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো, বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। ভাবতে অবাক লাগে সত্যিই আজও আমার বর্ণমালার মুখের দিকে তাকানা যায় না।
‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’। এই একটি কবিতাই যথেষ্ঠ আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম ঘটনা উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে জানতে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের টেমপারমেন্ট, পরাক্রমশীলতা, গভীরতা, ব্যাপকতা আর গুরুত্ব জানতে আর সাধারণ মানসলোকে তার গভীর ছাপ সম্পর্কে জানতে।
এরপর একে একে আসাদের শার্ট থেকে শুরু করে শহীদ জননীকে নিবেদিত পঙ্ক্তিমালা পর্যন্ত আমাদের জাতীয় জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনা, ঘটনার নেপথ্য, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত উঠে এসেছে। উঠে এসেছে ‘কী হচ্ছে’ অথচ ‘কী হতে পারত’ এই আকুলতার আদ্যপান্ত। ইতিহাসের সাধারণ উপাদান আর কবিতা থেকে ইতিহাস চয়নের এটাই মূল পার্থক্য। ইতিহাসবিদের ইতিহাসে থাকে তথ্য আর কবির কবিতায় থাকে ওই ‘কী হচেছ’ আর ‘কী হতে পারত’র আকুলতা। একজন ইতিহাসবিদ আর একজন কবির পার্থক্য এখানেই। আর কিছু না হোক। এই বোধ আর উপলব্ধির জায়গা থেকে হলেও আমাদের যেতে হবে শামসুর রাহমানরে কাছে। যেতেই হবে। কারণ একমাত্র তার কবিতাতেই উঠে এসেছে আমাদের সামগ্রিক সময়ের গতিপ্রকৃতির সামগ্রিক প্রবাহ, যে প্রবাহকে তিনি নিখুঁত আঁচড়ে পৃথক করেছেন ‘কী হচ্ছে’ আর ‘কী হতে পারতো’র পার্থক্যে।
মন্তব্য