‘কতদূর এগোলো মানুষ’—আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমে তাঁরই লেখা এই চরণ মনের ভেতরে গুঞ্জরণ তোলে। এই পঙ্ক্তির ভাঁজ খুলে খুলে যে অপার রহস্য এবং সীমাহীন গন্তব্যের হাতছানি দিয়ে টেনে নিয়ে যায়, বাংলা কবিতাযাত্রায় তা যেন দুটো ধারায় মিশে একটি একক প্রশ্নের জন্ম দেয়। কত দূর এগুলো বাংলা কবিতা? কত দূর এগোলেন আল মাহমুদ? প্রথম প্রশ্নটি সার্বভৌম কবিতাযাত্রার একক নির্দেশক হওয়ায় তা বহুবিস্তৃত আলোচনাসাপেক্ষ। দ্বিতীয় প্রশ্নটি কোনো কবির সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের একটি উপসংহারিক মূল্যায়ন নির্দেশক। সচরাচর এ ধরনের প্রাক-কাঠামোর ভেতরে ফেলে কোনো কবির সামগ্রিক মূল্যায়ন করা হয় না। কিন্তু কবি হিসেবে যখন আল মাহমুদের নাম উঠে আসে, তখন সমালোচকের মন অনায়াসেই- অজ্ঞাতসারেই দ্বিতীয় কাঠামোর দ্বারস্থ হয়ে যায়। কারণ বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক বিপরীতার্থক আদর্শের ধারক আল মাহমুদ। যাঁর পরিবর্তিত আদর্শ মেনে নেওয়া যায় না। অন্যদিকে তাঁর কাব্য-প্রতিভাকেও অস্বীকার করা যায় না।
এ হেন অম্ল মধুর বিড়ম্বনায় পড়ে সমালোচক কোনো পাপবোধ ছাড়াই আল মাহমুদের কবিতার ব্যবচ্ছেদ করে যান। তখন আপনা-আপনিই তাঁর প্রথম দিকের কাব্যের সঙ্গে শেষ জীবনের কাব্যের তুলনায় প্রয়াসী হয়ে ওঠেন। প্রয়াসী হয়ে ওঠেন একদা সাম্যবাদে দীক্ষা গ্রহণকারী এই প্রতিভাবান কবি কবিতায় যেভাবে বাংলার প্রকৃতি ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থার স্বাপ্নিক ছিলেন তিনিই এখন মৌলবাদে দীক্ষা গ্রহণ করে কবিতা থেকে কতদূর সরে গেলেন। কারণ যেকোনো মৌলবাদ কবিতা, মানবতাবাদ ও সাম্যবাদের বিপরীতে অবস্থান করে।
আজও আল মাহমুদের কোনো কাব্যগ্রন্থ বের হলে অধিকাংশ পাঠক উপর্যুক্ত তুলনায় প্রথম প্রয়াসী হয়ে ওঠেন। সে-রকম কিছুর সন্ধান না পেলে, তুলনীয় কিছু না পেলে অন্য ছাঁচে ফেলে তার কবিতার ব্যবচ্ছেদ করতে থাকেন। আমরা দেখেছি মৌলবাদে দীক্ষাগ্রহণ করার পরও তার কবিতা প্রায়ই ‘সোনালী কাবিন’-এর কবির গোপন এবং সরব উপস্থিতির স্বাক্ষর বহন করে। আর মৌলবাদের অংশটুকুকে নিছক আরোপিতই মনে হয়। যদিও সাম্প্রতিক আল মাহমুদ মৌলবাদ অংশটুকুতেই গভীর আস্থা রাখেন। তাঁর ‘দ্বিতীয় ভাঙন’ কিংবা ‘নদীর ভেতরে নদী’ কিংবা ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’র ভেতরেও ঝিলিক দিয়ে উঠতে দেখি ‘সোনালী কাবিন’-এর কবির। বিশেষ করে দ্বিতীয় ভাঙনের সনেটগুলোতে, খনাকে নিয়ে লেখা সনেটগুলোতে এখনো আমরা সেই প্রারম্ভিক যৌবনের আল মাহমুদকে পাই। তখন মনে হয়, মৌলবাদের আল মাহমুদ আসলে টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া এক লোভী মানুষ। আর কালের কলসের আল মাহমুদ আসল মাহমুদ। যার রক্ত বহন করে চলেছে এই আবহমান বাংলার ঐতিহ্য এবং শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন।
কবি আল মাহমুদের শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে হারিয়ে কুড়িয়ে পেয়েছি’ প্রকাশিত হয় গত বইমেলায়। জয়তী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এ কাব্যগ্রন্থখানিতে যে কবিতাগুলো স্থান পেয়েছে সেখানে প্রারম্ভিক যৌবনের আল মাহমুদের সামান্যই উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এখানে পাওয়া যায় তীব্র রোমান্টিক এক কবিকে, পাওয়া যায় মিস্টিক এক কবিকে, পাওয়া যায় শেষযাত্রার জন্য প্রস্তুত একজন সাধারণ মানুষকে, পাওয়া যায় মৌলবাদে দীক্ষাগ্রহণকারী একজন আরোপিত বাচালকে। আমরা তীব্র রোমান্টিক আল মাহমুদকে প্রত্যাশা করি, আমরা প্রত্যাশা করি একজন মিস্টিক কবিকে, শেষ যাত্রার জন্য প্রস্তত এক জন সাধারণ মানুষকেও আমরা ধারণ করি কিন্তু মৌলবাদে দীক্ষা গ্রহণকারী একজন আরোপিত বাচালকে এড়িয়েই চলি। ‘তোমাকে হারিয়ে কুড়িয়ে পেয়েছি’র ভেতরে গ্রহণীয় অংশটুকু নিয়ে আমরা এখন কথা বলতে পারি।
যে থাকে মনের কোণে, সঙ্গোপনে, তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে যদি বোঝা যায়, সে তো নেই, তখন থাকা না-থাকা জুড়ে বিরাজ করে এক বিশাল শূন্যতা। একটু আগের হাসির ঝিলিক কোথায় যে মিলিয়ে যায়! তবু যেন ধরা দেয় দেহের গন্ধমদির। এসব রহস্যময়তা নিয়ে, এসব যতসব ধরা না-ধরা নিয়ে, ‘তুমি’ নামক চিরন্তন মানসীকে হারিয়ে ফের কুড়িয়ে পাওয়ার কাব্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন কবি আল মাহমুদ।
ভূমিকায় কবি জানাচ্ছেন, ‘যেন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে কোনো আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা, বাসনা, কামনা এবং সব মিলিয়ে এর নাম কাব্য’। একটুও মিথ্যা বলেননি কবি। পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে, হারিয়ে আত্মহারা হয়ে, কামনায় লীন হয়ে, বাসনায় অধীর হয়ে তিনি লিখেছেন এ কাব্য। এসব মিলিয়ে কবির ‘আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা’ তাঁর অদম্য প্রেমিকসত্তা ও কবিতায় অফুরন্ত দমের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কবি আল মাহমুদ সেই সার্থক সত্তার অধিকারী।
নানা ধরনের কবিতা রয়েছে গ্রন্থটিতে। মৃত্যুচিন্তাময় কবিতা ‘ফেরার গাড়ি’তেও চিরন্তন গ্রামবাংলার উপস্থিতি। রয়েছে আরোপিত স্রষ্টা নিবেদন। কবিতা কখনোই নামাজান্তের মোনাজাত নয়। এ অংশটুকু বাদ দিলে কাব্যগ্রন্থটিতে যা থাকে তাই প্রকৃত আল মাহমুদ। সে আল মাহমুদ প্রকৃত প্রেমিকসত্তা নিয়ে হাজির হন। তার ভেতরে থাকে রহস্যের ইন্দ্রজাল। থাকে প্রকৃতির সৌন্দর্যঘন অবগাহন। থাকে প্রেমের পেলব স্পর্শ। থাকে যৌনতার রহস্য-ভেজা দাগ। ‘তোমার কানেই ফিসফিস করে বলি,/ লও গো যুবতী, পুষ্পের অঞ্জলি।’ (একি অলৌকিক ছন্দ!)। কিংবা খুঁজতে খুঁজতে বুঝতে পারি তুমি তো নেই / একটু আগেই ছিলে আমার গতর ঘেঁষেই, /এই ধরেছি তোমার দেহের গন্ধমদির/ আঁচলখানি টানাটানি করলে দেখো/ পড়বে খুলে সোনার খনি, ও সাবধানী। (টানাটানি, ও সাবধানী!) কিংবা গান বেঁধেছি তোমায় নিয়ে মান করো না নারী/ তুমিতো এক সৃষ্টি অবাক; বৃষ্টিভেজা শাড়ি।/ আঁচলখানি ধরতে পারি কিন্তু দ্বিধা লাগে/ চোখের কোণায় উপচে ওঠে অশ্রু সবার আগে। (কবির নামে হয় না গড়া কোনো তাজমহল)।
কবিতার ভাষার জটিলতা নিয়ে যখন বিস্তর অভিযোগ তখন আল মাহমুদের এ গ্রন্থখানি হতে পারে এক প্রকৃষ্ট জবাব। কারণ তাঁর বলার ভঙ্গিটা আটপৌরে, ক্লান্তিহীন, সাধারণ। রঙচঙহীন সাদামাটা, মুখের ভাষার কাছাকাছি। অতি চেনা শব্দ দিয়েই তিনি শুরু করেন। বলে যান। তারপর কখনো একটু ব্যপ্তিতে বিকশিত হন, কখনো খুব তাড়াতাড়িই উপসংহারে পৌঁছে যান। মাঝখানে পরিভ্রমণ করান বিস্তর পথ। পাঠকও তুমুল আকর্ষণ নিয়ে তাঁর নির্দেশিত পথে ভ্রমণ করতে থাকেন। যখন তাঁর বক্তব্য বিকশিত হতে থাকে তখন পাঠকও তাতে লীন হয়ে যান, যখন ব্যপ্তীহীন তাঁর বক্তব্য, যখন খুব অবিকশিত কিংবা যখন হঠাৎ শেষ হয়ে যায় তখনও পাঠক হোঁচট খান না। কারণ সব যাত্রার সব ধরনের গতি প্রকৃতি তার চেনা। সেই চেনা পথে কিভাবে পাঠককে শীর্ষ সুখ দেওয়া যায় তা খুব ভালো করে জানা। পাঠক তাতে অভিযোজিত হয়ে যান। যেন এটাই হওয়ার কথা ছিল। মজার বিষয় হলো এই আত্মলীন করে তোলার পাশাপাশি আসল কাজটিও সেরে ফেলেন। যা বলার তা বলে দেন। যতটুকু দরকার ততটুকুই। মেদহীন, ঝরঝরে।
তাতে মনে হয়ে অতি সাধারণ এ কাব্যপ্রয়াস। এটা যে কেউ-ই পারে। কিন্তু আসলে তা নয়। এটা এত সহজ নয়। এটা যে কেউই পারে না। তাহলে কেন মনে হয় এমনটি? কারণ ব্যবহারিক শব্দ, ঘরোয়া ভঙ্গি আর চেনাজানা উপস্থাপন। কিন্তু তা অবশ্যই নিজস্ব। আল মাহমুদীয়। এই তিনটি বিষয় কেউ আত্মস্থ করতে পারলেও যে জিনিসটি তাঁকে অনন্য করে তোলে, সেটা অন্য জিনিস। জিনিসটি হলো যা কিছু দৃশ্যমান ও শ্রুতিগ্রাহ্য তা ব্যতিরেকে এর অন্তঃস্থ অন্য এক সত্তা রয়েছে, যা পাঠশেষে ভিন্নতর উপলব্ধির ছাকুনিতে ধৃত হয়। এখানেই প্রকৃত কাব্যসত্তার পরিচয় দিয়ে ফেলেন কবি আল মাহমুদ।
‘আমি তো হাঁটছি তোমাকে ঘাঁটছি অন্তরালে/ পাখি উড়ে যায় গাছ থেকে গাছে শূন্য ডালে/’ (ধূসর গোধূলি)। গাছ থেকে গাছে পাখি উড়ে যায়। কবি আল মাহমুদ পার করে ফেলেন জীবনের দীর্ঘ কাব্য-পথ। এক সময়ের বিপরীত মতাদর্শে নিজেকে বিসর্জিত করলেও মাঝে মাঝে তাঁর কাব্যভ্যন্তরে এখনও প্রথম যৌবনের আদর্শের খেল খেলে যায়, অজান্তেই। তাই তো আক্ষেপ জাগে, যদি তোমাকে হারিয়ে কুড়িয়ে পাওয়ার মতো করে তিনি ঘোষণা দেন তাঁর প্রথম যৌবনের আদর্শের কথা, আরেকবার! আমরা এখনো বিশ্বাস করতে চাই কবি আল মাহমুদ তাঁর জীবনের দ্বিতীয়াংশকে ভুল হিসেবে স্বীকার করবেন। তাহলে কাব্যসত্তা ও জীবনসত্তার সমপাতন ঘটে যেতো। তাতে জয় হতো কবিতারই। জয় হতো প্রগতিশীলতারই। আমরা বিশ্বাস করতেই চাই। কারণ কবির ওপর বিশ্বাস হারানো মহাপাপ।