রেজাউল করিম রনি কবিতা লিখছেন অনেক দিন। প্রকাশ করেছেন সম্প্রতি। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপক নাড়া দিয়েছেন এখনকার কবিতার পরিমণ্ডলকে। সময়ের ভাষা তাঁর হাতে নতুন মাত্র পেয়েছে। তরুণ চিন্তক হিসেবে ইতোমধ্যেই তিনি ব্যাপক মনোযোগ কেড়েছেন। সাহিত্য রাজনীতি, মিডিয়া, দর্শন নিয়ে তাঁর ভাবনা আগ্রহ-উদ্দীপক। একই সঙ্গে মাঠের কাজেও নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তাঁর বিশ্লেষণী লেখার মুগ্ধকর-ক্ষমতা অল্পদিনেই তাঁকে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। তিনি চিন্তা করেন বাংলার মূলধারার সঙ্গে নিজের নাড়ির যোগ রেখেই। ‘জবান’ নামে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার পত্রিকা সম্পাদনা করেন। প্রকাশিত বই কবিতা: ’গোলাপসন্ত্রাস’, ‘দাউ দাউ সুখ’। গদ্য: ‘শহীদুল জহিরের শেষ সংলাপ ও অন্যান্য বিবেচনা’। বিশ্লেষণ: ‘গণহত্যার রাজনীতি: ধর্মযুদ্ধে প্রবেশ’, ’বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের ধরন ও মোকাবেলার কৌশলগত দিক’। সাহিত্য নিয়ে তিনি মাঝে-মাঝে লিখে থাকেন। সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে চিন্তাসূত্রের পক্ষ থেকে তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন হিমু মাহিন।
হিমু: কবি হিসেবে আপনার ব্যক্তি জীবন, মানে আপনি যে জীবন যাপন করেন, সেই সম্পর্কে কিছু বলুন?
রনি: এই প্রশ্ন কিন্তু অনেক বড় বহর দাবি করে। ম্যালা কথা কইতে পারি। কিন্তু আমার কবিতা নিয়া আমি কথা বলতে এখনও লজ্জা পাই। আপনি এমন জায়গায় গিয়া প্রশ্ন করেছেন যে, উত্তরে যাবার আগে বাড়তি কয়টা কথা না বলতে পারলে কথা বলার কোনো অর্থ হবে না। প্রথম কথা হলো, আমার নিজের বলে কী আছে, এইটা আমি এখনো বুঝি না। কিন্তু এই খোদ ‘আমি’ ব্যাপারটার একটা বোঝাবুঝির দিক আছে। এখন তো আমি বলতে বোঝায় একটা তথাকথিত আধুনিক ব্যক্তি-মানুষের বিকার। এখন একজন কবি যদি আধুনিক হয়, এর চেয়ে অশ্লীল আর কী হতে পারে! যে আধুনিক ব্যাপারটা ধরে রেখেই কবি, সে কবিতার কলঙ্ক। আধুনিক কবিতার ইতিহাস বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস। আমাদের কাব্যধারার মধ্যে ভয়াবহ জনবিচ্ছিন্নতার পয়দা হয়েছে আধুনিকতার অসুখের কারণে। যা হোক, সেটা অন্য কথা। কবি কালের বিচিত্র সত্তার মধ্যে একটা নয়া বিশ্বের ইশারা হাজির করে। লিনিয়ার কোনো হিসাব নাই কবির। ও যেইটা কইতেছি, আমার নিজের বলে কিছু নাই। আমি পারসোনাল জীবন বলে কোনো জীবন যাপন করি না। আমি তো আমার বাপের কিনা বাতাস বুকে টেনে বাঁচি না। ফলে আমার যাপনের মধ্যে নিজের হিসাব বলে কিছু নাই। তার পরে আমি যে রেডিমেট কন্ডিশনের মধ্যে বসবাস করি, তা তো আমি প্রতিদিন উৎরে যাই। এই যে উৎরে যাবার হিম্মত এইটাই স্পিরিট বা পরম। এইটাই নয়া সম্ভাবনা বা বিপ্লবের আঁতুড় ঘর। এই ঘরের কোনো মালিকানা নাই। কোনো ব্যক্তির মধ্যে যখন এই স্পিরিট আধার আকারে আছর করে, তখন সে ব্যক্তিমানুষ নিজের জীবনেই কেবল থাকে না। সে তার চারপাশের দৃশ্য-অদৃশ্য জগতের সঙ্গে সম্পর্ক করে। প্রেম করে কুয়াশার সঙ্গে । আমার যেমন হাওরের জোছনার সঙ্গে প্রেম। বা অদৃশ্য অনেক কিছুর সঙ্গে প্রেম। তো এইটা নিয়া আমি বাঁচি। এখন আপনি কি কইবেন জোছনা খাইলে আপনের পেট ভরে? তাইলে আপনার লগে কী কথা কমু। বুঝছেন বিপদে আছি। কোনো কথা কইতে পারি না। কিছু বোঝাইতে পারি না।
একে বহে অনন্ত ধারা। এই কথাগুলো তত্ত্ব আকারে এখন আমরা বুঝি। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে আমরা কিন্তু একটা জীবন যাপন করে চলেছি। এই সভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে জীবনের যে অর্থ এর বাইরেও জীবন ও যাপন আছে। এমন অনেক লোক আছে যে কোনো দিন ভাবে না, ওর নিজের জীবন কী? ওর আপন কী? ওর ‘আমি’ টা কী? যখন সে এগুলো নিয়া ভাবে, তখন এই ভাবনার পরিমণ্ডলেই কবিতার মুহূর্ত হাজির হয়। এটা কিন্তু দর্শনের মতো না। দর্শন দিয়া কবিতা বোঝা যাবে না। কবিতার একটা অটনোমাস জায়গা আছে। তো কেউ লেখে, কেউ লেখে না। ফলে এই দিক থেকে দেখলে আমি তো আমার কবিতা লেখি না। আমি যা লেখি, আমি তা জানি না। ফলে আমি যেমন আমাকে জানি না, ফলে আমি স্থির নির্দষ্ট করে কিছু বলতে চাই না। আমি একটা জীবন যাপন করি, সেইটার দুই পয়সার কোনো দাম নাই। হয়তো অন্য কারও কাছে। কারণ আধুনিক অবস্থা তো এমন এক বিকারগ্রস্ত ইনডিভিজুয়াল তৈয়ার করেছে যে, কানা না হলে নিজেরে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে না। যেহেতু আমি নিজেরে কানা মনে করি না, সেই অর্থ এ আমি নিজস্ব কোনো জীবন যাপন করি না। খুব পাগলমি মনে হতে পারে। কিন্তু আমি এই রকমই বাস করি। আর আমি নিজে ব্যক্তি আমারে নিয়া খুব ভাবি নাই। ভাবি না। ভাবার বিশেষ কিছু নাই। আমি খাইদাই বাজার করি। চাকরি পাইলে করি, না পাইলে অন্য কিছু করে টাকা আয় করি। এগুলো আট দশটা মানুষ যেমন করে, তেমনই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমার নিজেরে নিয়া কোনো বিহ্বলতা নাই। এই যে এত আমি আমি করতেছি, নিজেরে বেহায়া মনে হচ্ছে। আমি কিন্তু এই ‘ব্যক্তিতান্ত্রিক’ ‘আমি’রে খুব অপছন্দ করি। তারপরেও এই এত আমি আমি করতে হচ্ছে। মনে হতে পারে, এর মধ্যে একটা প্যারাডক্স আছে। ব্যাপারটা হলো, এই যে বিষয় বিন্যস্ত করে ভাবা। একদিকে আমি আর একদিকে জগৎ বা অন্য বিষয়। এটা কোনো কবির ভাবনা না। এটা দর্শনের একটা চিন্তা পদ্ধতি।
সময়টা বুঝে আমার জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত ইতিহাসের মধ্যে আমি জীবন যাপন করি। এর মধ্যে আমার নিজের ব্যক্তিগত বলে কিছু নাই। আর নিজের আমি ফকিন্নি মনে করি। শূন্য-শূন্য লাগে। বাট এইটার কোনো হাহাকার নাই। তাছাড়া আমি তো বাচ্চাপুলা তাই না। আরও বড় হই, দেন আমার বলে হয়তো কিছু হবে। আর কিছু না হোক আমার একটা বউ থাকা তো উচিত?
কবি এই সবের বাইরে সরাসরি প্রজ্ঞার জগতে কারবার করে। ফলে কবির কোনো আমির বিকার নাই। এখন ভাষা তো লজিক্যাল নিয়মের মধ্যে ফাংশন কর। ফলে অনেক কথা আমার এই অচল পদ্ধতিতে বলি। কিন্তু ভাষার যেহেতু একই সঙ্গে গায়েবি ক্ষমতা আছে, তাই ভাষা যুক্তির সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে যেতে পারে। আর এইটার গুরু হলো কবি। ফলে এই কবি যে প্রজ্ঞার জগতে থাকে, সেখানে তো তার নিজের বলে কিছু নাই। সে ডিভাইন পসিবিলিটির ভাষিক উদ্ভাসন মাত্র। ফলে আমার নিজের কথা সামান্যই। আমি নিজেরে সময়ের সন্তান মনে করি। সময়টা বুঝে আমার জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত ইতিহাসের মধ্যে আমি জীবন যাপন করি। এর মধ্যে আমার নিজের ব্যক্তিগত বলে কিছু নাই। তার নিজের আমি ফকিন্নি মনে করি। শূন্য-শূন্য লাগে। বাট এইটার কোনো হাহাকার নাই। তাছাড়া আমি তো বাচ্চাপুলা তাই না। আরও বড় হই, দেন আমার বলে হয়তো কিছু হবে। আর কিছু না হোক আমার একটা বউ থাকা তো উচিত? হা হা হা…কী বলেন? কিন্তু জানি না এই শূন্যতাকে ভালোবাসার মতো কিছু আছে কি এখনো কোথাও।
হিমু: আপনার কবিতায় জীবনান্দদের প্রচুর প্রভাব লক্ষ করা যায়, আপনি কী বলবেন?
রনি: আমি খুশি। খুলে বলি, আমি তো ছোট বেলা থেকে কবিতা লিখি। কিন্তু প্রকাশ করিনি। প্রকাশ করা শুরু করেছি এই তো কয়েক বছর হবে। এমনকি কাছের বন্ধুরাও জানত না যে, আমি কবিতা লিখি। আমি কবিদের সঙ্গে মিশি। কথা বলি। কিন্তু আমি যে কবিতা লেখি, এইটা বলি না। তো যখন আমি কবিতা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন তো আমি নিজের মধ্যে কিছু হিসাব কিতাব করছি। কবিতার পাঠক হিসেবে আমি ভালো। নানা কিসিমের কবিতা আমি পড়ি। দেশি বিদেশি নানা কবির কবিতা পড়ি। আমি জীবনে যার কবিতা সবচেয়ে কম পড়েছি তার নাম জীবনানন্দ। তথাপি আমি জানি জীবনানন্দ দাশ অনেক বড় কবি। আমি তাঁর প্রবন্ধ ও অন্য গদ্য পড়েছি। তার কবিতা যেগুলা সবাই জানে, এর বাইরে এখনো পড়ি নাই। জীবনান্দ দাশ পড়তে বেশ আরাম লাগে। এত আরামের কবিতা পড়ব পড়ব করে দিন যায়। যাই হোক অনেকে বলে আমার ওপর আল মাহমুদের প্রভাব আছে। আমি কই সবার প্রভাব থাক সমস্যা নাই। আমার ওপর আমার প্রভাব আছে কি না এইটা গুরুত্বপূর্ণ। জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে আমার একটা মিল আছে। সেটা হলো পয়েট্রিক ডিকশনের মিল। কবি হিসেবে জীবনানন্দ যেমন একটা কাব্যিক ভাবনা বিশ্ব নির্মাণ করেন, একটা আলাদা জায়গায় নিয়া যান, আমার কবিতার মধ্যে এই কাব্যিক জার্নিটা আছে। অবশ্যই জীবন বাবু যেখানে যান, আমি সেখানে যাই না। যাওয়ার কোনো মানে হয় না । আর এটা সম্ভবও না। আমি আমার জীবন যাপন করি। তবে এর সঙ্গে অতীত ইতিহাসের অনেক কবি ও কবিতা আমার কাছে অনুচ্চারিত নিয়মের মতো ধরা দেয়। প্রথম আমি যখন লিখি, ছাপি, কবিরা এত নাক সিটকাইছে যে, আমি রাগে কইছি, এগুলো কবিতা না। কবিতা আমি লিখতে পারি না। এগুলো এক ধরনের লেখা। এখন আপনে যখন জীবনানন্দর লগে আরেক জন আল মাহমুদের লগে আমার সম্বন্ধ আবিষ্কার করেন, তখন আমি মজা পাই। আমি উনাদের ভালোবাসি। কিন্তু আমি উনাদের মতো কবিতা লিখতে পারি না। সম্ভব না। কিন্তু একই ইতিহাসের ধারা বা একই ল্যান্ডস্কেপ ইমাজিন করি। জীবন বাবু বাংলাদেশকে দেখেছেন, আল মাহমুদ দেখেছেন, জসীমউদ্দীন দেখেছেন, আমিও দেখি। কিছু রেস তো ধরা পড়ারই কথা। কিন্তু কবির জার্নিটা তো একার। এটা কবি নিজের সঙ্গে নিজেই করে। বাইরে প্রকাশের সময় অনেক ফাতরামি করে অনেক কবি। এইটা কেন করে আমি বুঝি না। আমি কবি হিসেবে আমার পবিত্র অনুভূতির কাছে সৎ। সেটা কারও সঙ্গে মিললে সেও সৎ অনুভূতির কবি। তাছাড়া প্রভাবের কথাটা যেমন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের আধুনিক অহং–এর জায়গা থেকে বলা হয়, এটা খুব প্রবলেমেটিক। আগের উত্তরে এগুলো নিয়ে বলেছি। কবিতায় ব্যক্তির প্রজ্ঞা, বোধ ও যাপনের হাজিরা থাকে। থাকে সময়ের হাজিরাও। সেই দিক থেকে কারও প্রভাব না থাকলে তো দুঃখজনক হইত ব্যাপারটা। আমার প্রিয় কবি বিনয় মজুমদার। বিনয় কিন্তু অনেক আপার লেবেলের কবি। বিনয় বলেন, সময় উপযোগী লেখাই কালোত্তীর্ণ। এটা আমি মানি। কিন্তু কবিতায় কবিতার শর্ত হাজির থাকলেই কথাটা খাঁটি হবে। আমিও এটা আমল করি।
হিমু: আপনার কবিতায় প্রচুর আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন, চান, রাইত, গুলা ইত্যাদি। কোন চিন্তা থেকে আপনি এগুলো ব্যবহার করেন?
রনি: একটু আগে জীবন বাবুর কথা বলছিলেন। জীবনানন্দ দাশ কিন্তু এই রকম করত না। যা হোক এই যে আঞ্চলিক শব্দ কথাটা বললেন? এটা কী জিনিস? যেই ভাষা গৌরবের মধ্যে দাঁড়ায়ে আপনি এগুলারে আঞ্চলিক বলেন সেটা কী? সেটাও তো আঞ্চলিক তাই না? এইখানেই মান ভাষার বাজে তর্কটা আসে। আমি সেই দিকে যাব না। আমার কাছে কোনো ভাষাই আঞ্চলিক না। কোনো ভাষাই মান ভাষা না। আমি যে শব্দ ব্যাবহার করি তা আমার সহজাত। ভাষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতির সম্পর্ক আছে। এইটা বুঝতে পারা খুব জরুরি। আমার কবিতার ভাষা আমার স্বাভাবিক বুঝ থেকেই আসে। আমি সেইভাবে সহজে কমিউনিকেটিভ করতে পারি, তাই লিখি। সেটা আঞ্চলিক না ঐতিহ্যিক দেখি না। তাছাড়া দেরিদার কল্যাণে সাহিত্যের ভাষা ও ডিসকোর্স অনেক দূর প্রসারিত হয়েছে। রাইটিং অ্যান্ড ডিফারেন্ট ব্যাপারটা ধরতে পারা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি যখন দেখি, তখন যতই আমি জনগোষ্ঠীর কাছাকাছি ভাষায় দেখি, একটা দূরত্ব তৈয়ার হয়। এইটা আবার ভাব দিয়া পূরণ করা যায়। ভাষা অদ্ভূত জিনিস। ভাষা মানুষের মতো আন প্রিডিকটেবল। কবি হিসেবে আমি ভাষাকে শাসন করি, আমার ভাবের অনুকূলে ফেলে। ভাষা বেয়ারা জিনিস, ওরে জাতে তুলি। কবির কাছে তাই কোনো আঞ্চলিক ভাষা বলে কিছু নাই। এগুলা অধ্যাপকীয় বিভাজন মাত্র। নিজের কবিতা নিয়ে কথা বলে বোঝানো মুশকিল। পাঠক আমার চেয়ে জ্ঞানী। তারা আমার কবিতার বিশেষ ব্যাপারটা আমার চেয়ে ভালো ধরতে পারেন। ভাষা বা ভাব বা চিন্তা বা বোধ যাই বলেন, আমার কবিতার পাঠক কিন্তু ঠিকই ধরে ফেলেন। এতে আমি অনেক কথা বলা থেকে রেহাই পাই। অন্য অনেক মহান কবি আছে জগতে তার পরেও আমার কবিতায় যে ব্যাপারগুলার জন্য পাঠক এই কবিতার কাছে ফিরে আসেন তাই-এই কবির কাজ বলে ধরা যেতে পারে। ফলে বিশেষ কোনো আলাদ চিন্তা থেকে আমার কবিতা বা শব্দ বাক্য ইত্যাদি আলাদা হয় না। এটা খুব সহজাতভাবে ঘটে।
হিমু: আপনার কবিতায় মনোবিশ্বে, মানে আপনার সামনে কী থাকে? বাংলাদেশ না গোটা বিশ্ব?
রনি: দেখেন কবিতা কেমনে লেখা হয়, তা আমি ব্যাখ্যা করতে যাব না। ব্যাখ্যা করার কিছু নাই। কবিতা লেখার সময় আমার সামনে কাগজ কলম থাকলেই হলো। আমি কোনো দিন কবিতা লিখতে বসি না। কবিতা আসে আমি টুকে রাখি। কাগজ বা আমি তো সবসময় বই কেরি করি, বইয়ের পাতায় লিখে রাখি পরে এগুলা খুঁজে এক সঙ্গে করতে জান বাইর হয়া যায়। কবিতা লেখার সময় স্থির নির্দিষ্টভাবে কবির সামেনে কিছু থাকে না। কবি ও দার্শনিক এখানে আলাদা। কবি পূর্ব পরিকল্পিত কোনো কিছুর মধ্যে ভাষার কারিগরি করেন না। কবি অনুভূতিকে ভাষায় ধরেন। কোনো জবরদস্তি ছাড়াই ধরেন। পরে প্রকাশের সুবিদার জন্য পরিমার্জন করতে পারেন। আমি কবিতা খুব পরিমার্জন করি না। কবি কালের বিচিত্র মানবসত্তা। তাকে কিছুই সামনে রাখতে হয় না। আবার সবই সামনে থাকে। কিভাবে কবিতাটা কবিতা হয়ে ওঠে, তা কবি লেখার সময়ও জানে না। পরে পাঠ করে বুঝতে পারে। তারপরেও চিন্তার স্বভাব, ভাবুকতা নিজ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ভাব ও ভাষার মোলাকাত কবির কবিতায় ধরা পড়ে। এটা অতি বাইরে দিক। সেখানে নিজ দেশ পর দেশ চান, তারা, আসমান, হুর, জান্নাত-জাহান্নাম কত কিছু আসে। দেখা ও অদেখায় কত ভ্রমণ কবি করেন। এর কোনো নিয়ম নাই। অবশ্যই আমি কবি হিসেবে আমার বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর তাবৎ ব্যাপার নিয়েই হাজির হই। এর মধ্য দিয়েই মানুষের সঙ্গে যোগ হয়। আমার কাছে জীবন ও পৃথিবীর মানুষ বেশি মনযোগ দাবি করে। কবিতায় এগুলার ব্যাপার হয়তো আসে।
আধুনিক মানুষ তো ভালোবাসতে পারে না। এরা আত্মরতির পূজা করে। সেইটা নিয়া তো প্রেম হয় না। আগে মন খারাপ হইতো, এখন এইটা নিয়া আমার আপসোস নাই অবশ্য। কারণ ভালোবাসার ক্ষমতাই আমাকে কবি করেছে।
হিমু: আপনার কবিতায় নারী কখনো অপশক্তি, যেমন ‘গোলাপসন্ত্রাস’ কবিতায়। আবার সাধারণ নারী ধীরে ধীরে অশরীরী মানে বিমূর্ত ঈশ্বরী হয়ে উঠেছে। নারী কে আপনি কী ভাবে দেখেন?
রনি: আমার কোনো কবিতায় নারীকে অপশক্তি হিসেবে দেখা হয়নি। ‘গোলাপসন্ত্রাস’ কবিতায় নারী কই? আপনি যেভাবে বলছেন সেভাবে, নারী তো নাই । তাছাড়া নারী বলতে একাট্টা কিছু নাই। এর বহুরূপ। নানান ধরন। আমি নারী নিয়া আলাদা কইরা চিন্তা করি না। কিন্তু নারীবিষয়ক নানা জটিলতা নিয়া চিন্তা করি। নারী নিজেরে কেমনে দেখে, এইটা বুঝতে চেষ্টা করি। তবে প্রেমের ক্ষেত্রে নারী নিজেকে নিয়া যে দোলাচালে ভোগে, তার কিছু অভিজ্ঞতা আমার লেখায় আছে। আধুনিক মানুষ তো ভালোবাসতে পারে না। এরা আত্মরতির পূজা করে। সেইটা নিয়া তো প্রেম হয় না। আগে মন খারাপ হইতো, এখন এইটা নিয়া আমার আপসোস নাই অবশ্য। কারণ ভালোবাসার ক্ষমতাই আমাকে কবি করেছে। এখন আপনি আমারে ভালো নাও বাসতে পারেন। পাগল বলতে পারেন। কোনো সমস্যা নাই। যাক যে কবিতা নিয়া কথা হচ্ছে, এটা আমার বইয়ের শিরোনাম কবিতা। কবিতাটা পড়ি,
আমাদের নগরে, পুষ্পিত ঘুমের মধ্যে জেগে ওঠে রক্তাক্ত বুক।
ধান খেতের আইলে কুড়িয়ে পাওয়া রাজ-হাসের ডিম আগলে ধরে ছোটে
—আমাদের শৈশব।
নগরে বেড়েছে গোলাপের প্রসার,
নাগরিক বুকে ফোটে টকটকে গ্রেনেডফুল
ককটেল আওয়াজে উড়ে যায় স্বপ্ন-পায়রা।
ঝিরিঝিরি পর্দায় রক্তাক্ত শরীরে জেগে ওঠে ইতিহাসের গোরস্তান
তন্দ্রাপ্রিয় বাহুগুলো এরই মধ্যে শয়ন ঘরে বাকবাকুম ডাক তোলে
ঘুম চোখে শিশুরা হাতড়ে পায় না স্বাভাবিক দুধের নহর
কান্নার আওয়াজ জাগার আগেই আরও কিছু মানুষ
ঘুমে বাকবাকুম ।
পাশেই লাশের ডিবিতে জমছে সকালের শিশির।
আগুন জ্বলা বাস্তবতায় সুখপাখি
লাশ ছাড়া আর কোন আহার গ্রহণ করে না।
বিভোর স্বপ্নময় চোখে তুমি যতোই
ভালবেসে গোলাপ ছুড়ে মারো না কেন…
আমি জানি,
প্রতিটি ফুলের গর্ভ থেকে বেড়িয়ে, দ্রুত গতির বুলেট
—বিদ্ধ করবে একে অপরকে।
গোলাপসন্ত্রাসে বিদ্ধ প্রতিটি হৃদয়।
রক্তাক্ত বুকগুলা নতুন মানচিত্র হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত—
লাশের সাকোতেই রক্ত নদী পেরোতে হয়।
নষ্ট হলে গোলাপের গর্ভ, এমন দিনেও—
বাসনা শূন্য হাতে উড়ে এসে বসে অলৌকিক প্রজাপতি।
এখানে তো নারীকে অপশক্তি হিসেবে দেখা হয়নি। গোলাপ বিষয়ক যে একাট্টা ধারণা আছে, তাকে খতিয়ে দেখা গেলো এর মধ্যে সন্ত্রাস আছে। গোলাপের একটা হেজিমনিক রোল আছে না ফুলকূলে? এটাকে এখনকার সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে কবি লিখছেন। যা হোক এর ব্যাখ্যা দেওয়া আমার কাজ না। আমি এই কবিতা হয়তো কোনো চিন্তা থেকে লিখিনি। লিখতে লিখতেই এমন হয়েছে। মানে কবিতা যেমনে লেখা হয় আর কি। আমার চিন্তাশীল অধ্যায়ন আর কবিতার জগত দুইটা আলাদা। কবিতায় আমি অবোধ শিশুর মতো। চিন্তায় আমি তিক্ষ্ম ও অনেক সতর্ক। অনেক ধারালো। অনেক কাটকাট। দুইটা নিয়ে কোনো বিবাদ নাই। সম্পর্ক আছে অবশ্য। কিন্তু এটা কবিতার স্বভাবকে প্রভাবিত করতে পারে না বলেই আমি কবিতা লিখি। বরং উল্টাটা।
কতগুলো বিষয় নারীর কাছ থেকে শিখি। শ্রদ্ধা করি। নারীদের সঙ্গে আমি রাগ না করতে চেষ্টা করি। যদিও এমনিতে আমি একটু মেজাজি পুলা। কিন্তু এই নারী যদি যৌবনধর্ম নিয়া কূট-ক্যাচাল করে তখন বিরক্ত হই। এগুলা ভালো লাগে না। আমি স্নিগ্ধ নীরবতা পছন্দ করি। আলগা ‘ফেমিনিন’ এটিচুড ভালো লাগে না।
এবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আমি নারী বা পুরুষকে বাইনারিভাবে দেখি না। ইডিভিজুলাল জেন্ডার আইডেনটিটি তা নারী বা পুরুষ যাই হোক তা শেষ পর্যন্ত নারী ও পুরুষকে সম্মানিত করে না। নারীকে নারী ক্লেইম করা নারীবাদের ভয়ঙ্কর শিক্ষা। এটা পুরুষকে পণ্য সভ্যতায় নারীকে দাসী বানাতে প্ররোচিত করে। নারী কে আরও নারী করে বাজারে তোলার ব্যবস্থা হয়। নারীকে আমি আলাদাভাবে দেখি না। তারপরেও নারী বলে আলাদা যে প্রকরণ জারি আছে, তাকে প্রগতিশীল ধারণা বা নারীবাদ দিয়া বুঝি না। আমি জেন্ডার, ম্যাসকুলিনিটি নিয়ে কাজ করেছি। এই বিষয়ে আমার কাজ অনেক দেশে দেখানো হয়েছে। নিজেও গেছি কথা বলতে। ফেমিনিন এপিসটোমলজি বলে একটা ব্যাপার আছে। এটা ব্যাখ্যা করতে গেলে অন্য দিকে চলে যেতে হবে। এখানে সংক্ষেপে বলতে পারি, নারীকে ভারতীয় দর্শন যেভাবে দেখেছে, আমি সেই দেখার সঙ্গে নিজেকে সব জায়গায় একমত করতে পারিনি। আমার কাছে নারী খুব পবিত্র অনুভূতি নিয়ে ধরা দেয়। আমি নারীকে শরীরের দিক থেকে দেখি না। শরীর আছে, থাকবে। আমি তাঁর বোধের ধরন নিয়ে বেশি আগ্রহী। তাঁকে তার মন ও মর্মসহ বুঝতে আন্তরিক চেষ্টা করি। আমি এখনও বিয়ে না করার কারণে প্রেমিকা বা জীবনসঙ্গীনি টাইপের বিষয়গুলা নিয়ে হয়তো নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না অনুভূতির কথা বলছি মাত্র। আমি নারীকে নিয়া খুব কম ভেবেছি। নিজেকে নারীর স্বভাবের কাছে হাজির করে দেখি, আমি তো আসলে অনেক নিকৃষ্ট। আমার ধৈর্য্য, জগৎকে বুঝবার ধরন সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে বোধ নারীর চেয়ে অনেক কম অনেক জায়গায়। আবার কতগুলা জায়গায় আমি নারীর চেয়ে এত আলাদা যে, নারী এটা বুঝেই উঠতে পারে না। কতগুলো বিষয় নারীর কাছ থেকে শিখি। শ্রদ্ধা করি। নারীদের সঙ্গে আমি রাগ না করতে চেষ্টা করি। যদিও এমনিতে আমি একটু মেজাজি পুলা। কিন্তু এই নারী যদি যৌবনধর্ম নিয়া কূট-ক্যাচাল করে তখন বিরক্ত হই। এগুলা ভালো লাগে না। আমি স্নিগ্ধ নীরবতা পছন্দ করি। আলগা ‘ফেমিনিন’ এটিচুড ভালো লাগে না। স্বাভাবিক নিরহঙ্কার নারী আমি পছন্দ করি। আধুনিক দিশাহারা পণ্য কালচারের নারীর প্রতি আমি করুণা বোধ করি। খারাপ লাগে ওদের দেখলে। আমি নারীকে কেবল শরীরী প্রাণী মনে করি না। প্রেমের তো কোনো জেন্ডার নাই। তাই আমার প্রেমে নারী আর শুধু নারী থাকে না তার আরও বহুদূর বিকাশ দেখা যায়। আমি মৌলিক মানবিক, সদানন্দ চিত্তশুদ্ধরূপের সাধক-কবি। আর পুরুষ হিসেবে নিজেকে রক্ত মাংসের বাইরেও অনেক বেশি স্পিরিচুয়াল মনে করি। কামটা প্রেমের লতা হয়ে যায়, যেই প্রেমে এমন প্রেমই আমি প্রেফার করি। ফলে নারীকে অধুনিক ব্যক্তি ফেমিনিনের চেয়ে অনেক বড় জায়গা থেকে দেখি। সেটা আমার যাপন ও কবিতায় মনে হয় কম বেশি আছেও।
হিমু: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
রনি: আপনাকে এবং আমার পাঠক, বন্ধুদের ও চিন্তাসূত্রকে আমার আন্তরিক সালাম ও শ্রদ্ধা।