একজন মানুষ এক জীবনে কত কিছু হতে পারে? ডাক্তার, উড়োজাহাজ চালক, শিক্ষক, আইনজীবী, এফবিআই এজেন্ট সবই হয়েছিলেন ফ্রাঙ্ক অ্যাবেগনেল। পৃথিবীর কারও পক্ষে বোধ হয় এতকিছু এক জীবনে হওয়া সম্ভব নয়। ২০০২ সালে টম হ্যাঙ্কস ও লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও-এর মাঝে যে রসায়ন সৃষ্টি করেছিলেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ, তা আর কিছু নয়, ফ্রাঙ্ক উইলিয়াম অ্যাবেগনেলের জীবনীর শৈল্পিক উপস্থাপনা।
কিন্তু ফ্রাঙ্ক কিভাবে হয়েছিলেন এতকিছু? ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ সিনেমাটিতে একজন টগবগে যুবকের অপরাধকর্মের দৃশ্যপট ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, সঙ্গে মিলেছে প্রশ্নটির উত্তর। ১৯৭৯ সালে রবার্ট বেন্টনের ‘ক্রামার ভার্সেস ক্রামার’ সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে একটি পরিবারে কী ঘটতে পারে, সেই বিষয়গুলো। একজন বাবাকে তার ছোট বাচ্চার মায়ের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে কতটা সংগ্রাম করতে হয়েছিল তা উঠে এসেছে এই সিনেমায়। কিন্তু স্পিলবার্গের এই সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছে, বিবাহ বিচ্ছেদের পরে একটি পরিবারের যুবক ছেলে কী কী করতে পারে। এমনকি সে শুরু করতে পারে ব্যাংক জালিয়াতির কাজও।
প্রতিটি সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিত্রনাট্য। একটি ভালো চিত্রনাট্য ছাড়া কোনো চলচ্চিত্রই উঁচু মানের হতে পারে না। অনেক ভালো কাহিনী শুধু চিত্রনাট্যের যোগ্যতার জন্য জলে যায়, সে আত্মজৈবনিক কাহিনী হোক কিংবা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। তবে জেফ নাথানসন চিত্রনাট্য রচনায় অভিজ্ঞ। তিনি জানেন কী করে একটা কাহিনীকে চিত্তাকর্ষক করতে হয়। তাই ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ চলচ্চিত্রটি দেখা শুরু করলে না শেষ করে প্রশান্তি আসবে না।
সিনেমাটির কাহিনী খুব সাদামাটা, তা নয়। বেশ বাঁক আছে গল্পে। এটি একদিকে একটি পরিবারের ভেঙে পড়ার গল্প বলেছে, অন্যদিকে ক্রাইম থ্রিলারের গল্প বলেছে। ফ্রাঙ্ক অ্যাবেগনেল তার বাবা ফ্রাঙ্ক সিনিয়র ও মা পাউলা অ্যাবেগনেলের সঙ্গে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে। কিন্তু আর্থিক সংকটে ফ্রাঙ্ক সিনিয়র তার স্ত্রীকে হারায়। ফ্রাঙ্ক জুনিয়র সবাইকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। ছন্নছাড়া ফ্রাঙ্ক ব্যাংক জালিয়াতি থেকে শুরু করে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট, ল’ সার্টিফিকেট জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে দ্রুত। ব্যাংক জালিয়াতি তদন্তে থাকা এফবিআই এজেন্ট কার্ল হ্যানর্যাটি নানা নাটকীয়তার মাধ্যমে ফ্রাঙ্ককে শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সে গ্রেফতার করে। তাকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত নিয়ে গিয়ে ১২ বছরের জেল দেওয়া হয়। শেষমেশ তার জেল মওকুফ করা হয় শর্ত সাপেক্ষে। এফবিআই এজেন্ট হিসেবে তাকে ব্যাংক জালয়াতি ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফ্রাঙ্ক তার জালিয়াতি জীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অতি সহজে ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনাগুলোর খুব সহজ সমাধান দিতে থাকে।
পরিচালনার কথা বলতে গেলে স্টিভেন স্পিলবার্গের অন্যতম সেরা পরিচালনা পরিলক্ষিত হয়েছে ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ সিনেমাটিতে। তাঁর সূক্ষ্ণ পরিচালনায় সিনেমাটির দৃশ্যগুলো বিশেষায়িত হয়েছে। গল্পের প্রয়োজনে সিনেমার দৃশ্য এক শহর থেকে আরেক শহরে লাফ মারলেও তা চিত্রায়নে মেধার পরিচয় দিয়েছেন পরিচালক।
২৮ বছর বয়সী লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও অভিনয় করেছেন সিনেমাটির মূল চরিত্রে। ১৭ বছর বয়সী এক চঞ্চল তরুণকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তার সবটুকু নিঙ্ড়ে দিয়েছেন তিনি। তাই চরিত্রটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। বাবাপ্রেমী ও পরিবারপ্রেমী এক যুবক তার পরিবারের সুতো জোড়া দিতে যে সংগ্রাম শুরু করে, তা তাকে ভুল পথে নিয়ে যায়। যুবকের এই দগ্ধ অবস্থা প্রকাশে তিনি কার্পণ্য করেননি। পেশা পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে নিজের চাল-চলনের পরিবর্তন উপস্থাপনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন ডিক্যাপ্রিও। হুট করে জেমস বন্ড সেজে জালিয়াতির ঘটনা অন্য রকম একটি বিষয়ই বটে। আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জালিয়াতকারী চরিত্রটিকে একরকম স্বার্থকভাবে অলঙ্করণ করেছেন তিনি।
তার সঙ্গে-সঙ্গে সময়ের আরেক স্বনামধন্য অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস এফবিআই এজেন্ট হিসেবে তার স্বভাবসুলভ অভিনয় করেছেন। টম হ্যাঙ্কসের নিজস্ব ভঙ্গিমা অনেক বছর ধরে হলিউড দর্শকদের মন মাতিয়ে আসছে। সিনেমাটির পার্শ্বচরিত্রগুলোকে অলঙ্কৃত করেছেন ক্রিস্টোফার ওয়াকেন, মার্টিন শীন, নাথালিয়া বাইয়ি, এমি অ্যাডামস। পার্শ্বচরিত্রে ফ্রাঙ্ক সিনিয়র চরিত্রে ক্রিস্টোফার ওয়াকেনের অভিনয়ের কথা না বললেই নয়। এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি বেশ কিছু সিনে পুরষ্কারও লাভ করেছেন।
মিউজিক প্রতিটি সিনেমার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এদিক দিয়েও ‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ পরিপূরক। জন উইলিয়ামসের মিউজিকে দৃশ্যগুলো যেন সমুদ্রের ঢেউ-এর সঙ্গে ভেসেছে।
সিনেমাটিতে ক্লাইম্যাক্সের অভাব ছিল না। পরিবারকে পুনরায় একত্রিত করার একটা ক্লাইম্যাক্স কাজ করেছে, অন্যদিকে কার্ল ও ফ্রাঙ্কের মধ্যে ক্রিসমাসের রাতে কথা বলাটা সত্তরের দশকের কাহিনী উপস্থাপনায় মাত্রা যুক্ত করেছে। ফ্রাঙ্ক ও কার্লের মাঝে একরকম ইঁদুর-বিড়াল খেলা দেখা যায় সিনেমাজুড়ে। যার সমাপ্তি ঘটে বটে, তবু কার্ল ফ্রাঙ্ককে ছাড়তে পারে না। পিতৃহারা ফ্রাঙ্কের প্রতি একরকম মায়া জন্ম নেয় কার্লের ভেতর। সেই মায়া থেকেই কার্ল ফ্রাঙ্কের জন্য এফবিআই-এ কাজের ব্যবস্থা করে।
যদিও ফ্রাঙ্ক অ্যাবেগনেলের আত্মজৈবনিক গ্রন্থের সঙ্গে এই চলচ্চিত্রটির কাহিনীর অনেক ক্ষেত্রে মিল নেই, তবু স্বয়ং ফ্রাঙ্ক সিনেমাটির গুণগ্রাহী। এমনকি সিনেমাটির একটি ক্ষুদ্র চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছেন। অনেক সময় দেখা যায় আত্মজৈবনিক সিনেমা তৈরি করার ফলে পরিচালক ও সিনেমার মূল চরিত্রটির বাস্তব ব্যক্তিটির ভিতর বোঝাপড়া শুরু হয়। এক্ষেত্রে সেটি হয়নি, বরং ফ্রাঙ্ক আগে থেকেই স্পিলবার্গের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পরে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয় এবং আজ অবধি এই আত্মজৈবনিক অপরাধ উন্মোচক সিনেমাটি নিয়ে দর্শকদের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই।
সত্যিকারের ফ্রাঙ্ক অ্যাবেগনেল এখন বিভিন্ন ব্যাংক ও কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। তার ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, এপর্যন্ত ছোট-বড় প্রায় ১৪ হাজার ব্যাংক-কোম্পানি আর্থিক নিরাপত্তা ও প্রতারণা প্রতিরোধের জন্য তার কাছ থেকে সহায়তা নিয়েছে।