আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার মতোই তাঁর কাব্যনাটকগুলোয় আছে পরাবাস্তবতার ঘোর। কাব্য নাটকের যে সব বৈশিষ্ট্য, তাও আছে। এখানে খলনায়ক সৃষ্টি করা কঠিন। এ যুগের লেখকেরা পারতপক্ষে তা করতে চান না। এই না চাওয়ার পেছনে থাকে এক রকম নার্সিসিটি। কাব্যনাটকের প্রতিটি সংলাপ নির্দিষ্ট চরিত্রের মুখের কথা এবং একইসঙ্গে লেখকের মনের কথা হয়ে ওঠার মতো দ্বৈতশক্তি ধারণ করে। আর সংলাপকে সে দ্বৈতশক্তিসম্পন্ন করে তোলার জন্য নাট্যকারেরা খলনায়ক সৃষ্টি করতে চান না। কারণ, খলনায়কের মুখের কথাও যখন নাট্যকারের মনের কথা বলে গণ্য হবে, তখন তাঁকে নিয়ে ভুল বোঝার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে তাঁরা ঝুঁকি নিতে চান না।
আরেকটি বিষয়, কাব্যনাটকে চরিত্র, ঘটনা বা প্লট অনুসারে সংলাপ বসানো কঠিন কাজ। বরং তারচেয়ে সহজ কাজ কবির পক্ষে কাব্যিক সংলাপ রচনা করা। প্রতিটি সংলাপ যেন স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম কবিতা হিসাবেও মর্যাদা লাভ করে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক আবদুল মান্নান সৈয়দের কাব্য নাটক ‘বিশ্বাসের তরু’ থেকে।
ক্রমশ ঘনায় সন্ধ্যা; ওদিকে আকাশ হয়ে ওঠে
ব্যক্তিগত প্যালেট— শিল্পীর: একসঙ্গে এত রঙ!
দুপুরের উড়োপাতা শান্ত হয়;…
প্রিয় পাঠক, ভাবুন তো কোন শ্রেণীর, কোন পেশার এবং কেমন ধরনের চরিত্রের মুখের সংলাপ এটা। যারা জানেন তারাও ভাবুন তো এ ধরনের সংলাপ কি একজন কাঠুরে চরিত্রের উপযোগী? না, অসঙ্গাত মনে হয়। এই অসঙ্গতি নিয়েই রচিত হয় কাব্যনাটক। রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্যগুলোতেও সমাজের সাধারণ চরিত্রদের মুখে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নান্দনিক, এবং শিল্পসম্মত সংলাপ দেখা যায়। আসলে এ ধরনের নাটকে সামাজিক বাস্তবতার জন্য ভাষা, অলঙ্কার বা ছন্দ নির্ভরতা পাঠককে হতাশ করবে। ধরে নিতে হয় সব কথাই আসলে লেখকের।
আবদুল মান্নান সৈয়দের তিনটি কাব্য নাটক পড়ার অভিজ্ঞতা এখানে তুলে ধরা হচ্ছে। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো এগুলোকে লেখকের দিক থেকে নাট্য বলা হয়েছে। আকারের ক্ষুদ্রতার কারণে নাটিকাই বলতে চাই। ‘অবিশ্বাসের তরু’ দশপৃষ্ঠার, ‘ঈশ্বরপ্রাপ্তির ছোট্টো গাথা’ আড়াই পৃষ্ঠার, আর ‘চাকা’ দশপৃষ্ঠার।
‘অবিশ্বাসের তরু’তে চরিত্রসংখ্যা মাত্র ছয়টি। প্রথম কাঠুরে, দ্বিতীয় কাঠুরে, তৃতীয় কাঠুরে, দেবদূত, কাঠকুড়ানি মেয়ে এবং চৌকিদার। সিলেট বনাঞ্চলের পটভূমি। নাটকের কাঠুরেরা তিনজনই চোর। ব্যক্তিমালিকানা একটি বাগানে চৌকিদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রবেশ করে কাঠ কেটে নিয়ে যায়। সেখানে কাঠকুড়ানি এতিম এবং অনাথ মেয়ে, কাঠ কুড়িয়ে তার সংসার চলে। কাঠুরেদের সাথে তার নিত্য দেখাশোনা। তিন জনের মনেই তার সম্পর্কে আন্তরিকতা দেখা যায়। একদিন এক দেবদূত এসে কাঠুরেদের সাথে কথা বলে। দেবদূত তাদেরকে তাদের অপরাধ সম্পর্কে সচেতন করে দিয়ে যায়। এর পরে তারা সবাই একে একে নিজের থেকে স্বীকার করে, পরের বনে ঢুকে তারা আর কাঠ চুরি করবে না। শেষ সময় যখন কাঠকুড়ানির সাথে দেখা হয়, তাদের বিদায়ের কথা শুনে মেয়েটি বিহ্বল হয়ে পড়ে। সে জানায় যে, আজই দুপুরে চৌকিদার বনে একা পেয়ে তার সর্বনাশ করেছে।
আজকে দুপুর বেলা, সূর্য মাথার উপর
ঠিক, বনের উঠোনে, জারুল-পাতার বিছানায়
জারুল গাছের তলে চৌকিদার করেছে আমার
সর্বনাশ
মেয়েটিকে এর পরেও চৌকিদার অনুসন্ধান করে। কাঠকুড়ানিও বুঝতে পারে তাকে বার বার এই ধর্ষকের কবলে পড়তে হবে। কাঠুরেদের যখন বিদায়ের সময় তখন অসহায়ত্ব প্রকটিত হয় কাঠকুড়ানির। দ্বিতীয় কাঠুরে তাকে এই বনে আর না আসার অনুরোধ করলে মেয়েটি জানায়, তার বাবা নেই, তালিমারা পুরনো পোশাকে তার দিন যায়। বনে তো আসতেই হবে। নইলে চলবে কেমন করে। সে নিজেও বুঝতে পারে আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। সে দেখতে সুন্দরী বলেই তাকে নিয়ে এই ঝামেলা। দ্বিতীয় কাঠুরে তখন বলে,
তবে থাকো সুন্দরতা
সার্বভৌম জানোয়ার পাশে নিয়ে চিরকাল। থাকো।
প্রথম কাঠুরে তাকে জিজ্ঞাসা করে ভবিষ্যতে কোনো দিন দেখা হলে চিনতে পারবে কি না। সে গাছের বাকলে খোদাই করে কয়েকটি অক্ষর রেখে যায়।
কোনো দিন দেখা হয় চিনতে পারবে আমাদের?
ও কাঠকুড়–নি মেয়ে, বাস্তবের প্রবেশদুয়ারে
তোমাকে গেলাম রেখে। মনে রেখো, ক্ষোদিত অক্ষর
রেখে যাই শালগাছে, কয়েকটি ক্ষোদিত অক্ষর
হৃদয়ের দারুমঞ্চে রেখো—এরি সঙ্গে চিরকাল—
দুঃখজলে ঝাপসা হবে না, বসন্তে যাবে না ভুলে।
এখানে দেখা যাচ্ছে তিনজন কাঠুরেই কাঠকুড়ানি মেয়েটিকে ভালো বাসত। তিনজনেরই স্বপ্ন ছিল সে। প্রেমের ব্যর্থতা তিনজনেরই। আর এই প্রেম দাঁড়িয়েছিল অনৈতিক পেশা এবং অবস্থানের ওপর। দেবদূতের কথায় তারা চুরি করা ছেড়ে দিয়েছে বলে এখান থেকে চলে যেতে হচ্ছে। আর তাদের চলে যাওয়াতে মেয়েটির অসহায়ত্ব এবং তিনজনেরই হৃদয়ের গোপনে প্রেমের অপমৃত্যু ঘটছে। দ্বিতীয় কাঠুরে যাওয়ার আগে বিশ্বাসের মৃত্যু ঘটানোর জন্য কুপিয়ে গাছ কেটে বনভূমির অনেকটা ধ্বংস করে দিয়ে যায়। তৃতীয় কাঠুরে বলে,
তোমার রুপোলি ফাঁশ এঁটে বসে গেছে, দেবদূত,
কণ্ঠদেশে আমাদের।
দেবদূত যদি তাদের এই পথ ছাড়তে না বলত তাহলে তাদের ভালো লাগাই ভালো বাসা হয়ে দেখা দিত। মেয়েটি পেত প্রেম, পেত সংসার আর নিরাপত্তা।
‘ঈশ্বরপ্রাপ্তির ছোট্টো গাথা’ অতিক্ষুদ্র নাটিকা। এখানে দেখা যায় কয়েকটি বালক ও বালিকা, একটি ভালুক এবং ভালুক নাচিয়ে। মাত্র আড়াই পৃষ্ঠার এই নাটিকাটি বেশি নান্দনিক। সংলাপে অন্ত্যমিল আছে। এটি দিয়েছে শব্দালঙ্কারের মাধুর্য। এছাড়া বিষয়বস্তুও বিস্ময়কর। শিশুদের সামনে ভালুকনাচিয়ে তার পোষা বালুকটিকে নাচাচ্ছে। নাচাতে নাচাতে সে ভালুকটির জীবনবৃত্তান্ত, শিকারের গল্প এবং পোষ মানানোর গল্প বলে। শিশুরা বিমল আনন্দে ভেসে যাচ্ছে। এই আনন্দের মধ্যেই, শিশুদের নিষ্পাপ বিনোদনের মধ্যেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়।
চুপ! ঐ দেখো, পাখির পায়ের পথ
ধ’রে আছে আকাশের সেই রথ
ছোট্টো চাকায় নেমে আসে অতিদ্রুত
এঁকেবেঁকে এক স্বপ্নযানের মতো:
পাথরের মতো অরব নিথর শোনো,
দ্যাখো, চুপচাপ, আওয়াজ কোরো না কোনো:
এর পরে আসে আকাশবাণী।
রাত-দিন ঢুঁড়ে মরছি সবুজ স্বর
আজ খুশি দেখি: এই তো ঈশ্বর।
এরপরেই যবনিকা।
‘চাকা’ নাটিকাটিও দশপৃষ্ঠার মাত্র। সেখানেও অল্প কয়েকটি চরিত্র। তবে এটিতে আছে তিনটি দৃশ্য। প্রথম দৃশ্যে মীরা আর হাসানের কথোপকথন। এখানে হাসানকে দেখা যায় কবিরূপে। তার কথায় আছে ছন্দ, লালিত্য, উপমা, চিত্রকল্প আর অপার্থিব সৌন্দর্যের আলো। কিন্তু প্রেমের গতি চিরকালই মিলনের দিকে। তাই প্রেম চায় প্রতিশ্রুতি। প্রতিশ্রুতির অবাবেই আসে প্রতারণা। এ দু’টি অনুষঙ্গ সামাজিক। আর আমাদের দেশে প্রেম সামাজিকরূপে রূপান্তরিত হতে চায়। হাসানের মধ্যে কিন্তু সে ধরনের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এ কারণে মীরা হীরককে বিয়ে করতে চায়। বিষয়টি হাসানের চোখে প্রতারণা মনে হতে পারে। কিন্তু মীরার দৃষ্টিতে বরং হাসানকেই প্রতারক মনে হতে পারে। মীরা বলে,
হাসান, বিশ্বাস করো; আমি তোমাকেই ভালোবাসি।
কিন্তু তুমি বড়ো মৃদু, কোমল, কাতর, স্বপ্নাক্রান্ত সংবেদনশীল
সামান্য কম্পনে তুমি বেজে ওঠো শতদলে।
হীরককে আমার চাই। সে অবিচলিত থাকে সব কিছুতেই
সে কঠিন, হীরকের মতো দ্যুতিমান।
হাসান কাব্যভাষায় মীরাকে প্রেমের প্রস্তাবগুলো আবৃত্তি করে যেতে থাকে। হয়তো হৃদয় থেকেই সে মীরাকে চায়। কিন্তু মীরাকে দরে রাখার যোগ্যতা হাসানের নাই। দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা যায় হাসানের সাথে রিনার কথাবার্তা। এখানে দেখি হাসান রিনাকেও ধরে রাখতে পারে না। আসলে হাসান ভালো বাসতে পারে কিন্তু ভালোবাসা ধরে রাখতে জানে না। অতি কাব্যিকতা আর স্বপ্নাক্রান্ত মন প্রেম পাওয়ার যোগ্য না। মীরার সঙ্গে হাসানের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির অনেক বছর পরে ঢাকার একটি বহুতল উঁচু ভবনের আটতলার রেস্তোরাঁয় কথা হয় রিনার সঙ্গে। এখানে হাসানের বয়স বেড়েছে কিন্তু বাড়েনি বয়সের মনের। মানুষের বয়সের সঙ্গে তার আচরণ, চিন্তা এবং কর্মপদ্ধতির উন্নতি না হলে তাকে অবোধ বা শিশু বরা যায়। হাসান তখনো শিশুই রয়ে গেছে। হাসান যখন বলে, ‘মানুষ জটিল বড়ো, বুঝলে রিনা, অরণ্যের চেয়েও জটিল…।’ তখন রিনা বলে,
খুব বুঝতে পারছি। এতো বোঝো, কিন্তু কিছুই বোঝো না।
আজ তোমাকে পরিষ্কার বলতেই হবে—
কিন্তু হাসান নদী, বন, বৃক্ষ, ঝর্না এসব কাব্যিক অনুষঙ্গ দিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলে সবকিছু ভুলিয়ে রাখতে চায় রিনাকে। নিজের দায়িত্ব ভুলে যায় হাসান। এ দৃশ্যের শেষ সংলাপ রিনার। এখানে লেখক যেন হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার সুযোগ দিয়েছেন রিনাকে। রিনা সবশেষে বলে,
আর কতো অপমান করবে, হাসান?
তুমি একটা পাথর..পাথর!
এর পরেই তার প্রস্থান। গভীর বেদনা নিয়ে একা বসে থাকে হাসান। হাসানের তো একাই থাকার কথা। অনেক বছর পরের হাসানের ঘরের এক গভীর রাত্রির নিঃসঙ্গতা নিয়ে হাসানের তৃতীয় দৃশ্য। সেখানেও দেখা যায় হাসানের কাব্যিক উচ্চারণ। আজ তার কোনো শ্রোতা নেই। হাসান একাই দুই প্রেমিকার স্মৃতিচারণ করে। আর এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর কথা স্মরণ করে দার্শনিক চিন্তায় ভাবে, ‘কোনো কিছু আকাঙ্ক্ষা কোরো না।’ সময় বয়ে যায়, এ জগতে কেউ কাউকে পায় না। চাকা ঘুরেই চলে। অমোঘ চাকা গড়িয়েই চলে।
আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রথম বয়সের রচনা এগুলো। উনিশ শ বাষট্টি থেকে উনসত্তর সাল পর্যন্ত লেখা নিয়ে উনসত্তরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’ গ্রন্থটি। এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে এই কাব্যনাটিকাগুলো। নাটিকাগুলোতে প্রথম বয়সের ছাপ বোঝা যায়। কাব্যিক ভাষা, মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা সংলাপ তারুণ্যের শক্তিতে ও আবেগে ভরা। এর একটি সমিল অক্ষরবৃত্ত। আরো একটি বিষয় যে, নাটকের অন্যতম প্রধান নাট্যগুণ দ্বন্দ্ব; তা এই নাটিকাগুলোতে নেই। ‘চাকা’য় একে একে দুইজন প্রেমিকার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় হাসান, সেখানে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির সুযোগ ছিল। নারীদের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, কিন্তু হাসানের কোনো বিপরীত বা বিরোধাভাষপূর্ণ কথা ছিল না। বরং ছোটগল্পের চরিত্রের মতো হাসান তার নিজের স্বভাব নিয়ে চলে। ‘বিশ্বাসের তরু’তেও নাট্যদ্বন্দ্ব দেখানোর মতো পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু সেখানে দেবদূত যা বলে কাঠুরেরা নির্দ্বিধায় বিনা বাক্যব্যয়ে তা মেনে নেয়। এখানে বিরোধাভাষ সৃষ্টি হতে পারত। কাঠকুড়ানির বিপন্নভাবেও তাদের মনে কোনো দ্বিধা সৃষ্টি হয়নি।
‘চাকা’ পড়ে মনে হয় লেখক ছাত্রজীবনে, পেশাগত অনিশ্চিত জীবনে লিখেছেন এটি। উনিশ শ পঁয়ষট্টি সাল থেকেই তিনি অধ্যাপনায় নিযুক্ত। যদি সত্যিই চাকরি পাওয়ার আগে, উঠতি তরুণ কবির আবেগে লিখে থাকেন তাহলে তা অবশ্যই পঁয়ষট্টি সালের আগে লেখা। বাইশ-তেইশ বছর বয়সে লেখা কাব্যনাটিকাগুলোতে সমাজের কোনো উচ্চ আদর্শ, রাজনীতি, দর্শন বা মানবজীবনের অন্য কোনো মহত্ব প্রকাশিত হয়নি সত্য কিন্তু বয়সের আবেগ, গভীর প্রেম ঠিকই নানন্দনিক ভাষায় ফুটে উঠেছে। আর এখানেই আবদুল মান্নান সৈয়দের সৃষ্টিশীলতার সাফল্য।