সিনেমা সমাজ-জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। সমাজের নানা রকমের চরিত্রেরই প্রতিচিত্রায়ণ ঘটে সিনেমায়। এ কারেই প্রতিটি সিনেমাতেই নায়ক থাকেন। তবে, সমাজের নায়ক আর সিনেমার নায়ক এক নয়। চিত্রনাট্যকারের কাহিনী পরিচালকের নির্দেশনায় সিনেমার নায়ক অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। নায়ককে সিনেমার পর্দায় কখনো দেখা যায় প্রেমিকরূপে, কখনো মাস্তান রূপে, কখনো পুলিশের বেশে, কখনো ডাক্তারের চেম্বারে, কখনো যোদ্ধার ভূমিকায়, কখনো জাজের পোশাকে। নায়কের রূপের শেষ নেই, তবে নায়ক এসবের কিছুই নয়। নায়ক অতি সীমাবদ্ধতার ভেতর বেঁচে থাকা একজন অভিনয়শিল্পী। একজন নায়ক প্রকৃতপক্ষে কেমন, তা তুলে ধরতে ১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেন নায়ক।
সত্যজিৎ-এর চিত্রনাট্যে ‘নায়ক’ সিনেমাটি শুরু হয়েছে খুব সাদামাঠাভাবে। একজন জনপ্রিয় নায়ক পুরস্কার নিতে কলকাতা থেকে দিল্লি যাবেন। তবে, নায়কটির সেটা নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই। অবহেলায় প্লেনের টিকিট কাটাও হয়ে ওঠেনি, তাই নায়ককে যাত্রা করতে হবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ট্রেনে। ধীরে ধীরে জানা যায় নায়কটি অরিন্দম মুখার্জী, যার একটি সিনেমাও ফ্লপ খায়নি।
ট্রেনে নায়কের পদার্পণের পর থেকে ঘটতে থাকে কিছু ঘটনা। আস্তে আস্তে প্রকাশিত হতে থাকে নায়কের ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-কষ্টের নানা দিক। এছাড়া উন্মোচিত হতে থাকে সেই সমাজের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের জীবনাচরণ, উন্মোচিত হয় সেময়ের ধর্মব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের কথা।
ট্রেনযাত্রার মধ্যেই নায়ক অরিন্দমের সঙ্গে পরিচয় ঘটে এক আধুনিক ঘরানার নারী অদিতি সেনগুপ্তার। অদিতি ‘আধুনিকা’ নামে একটি নারী পত্রিকার সম্পাদনা করে। তিনি তার পত্রিকাটি বাঁচাতে মরিয়া। তাই কিছু গ্রাহক বাড়ানোর আশায় তার কলকাতা টু দিল্লি যাত্রা। ট্রেনে অদিতি ও অরিন্দমের রসায়ন বেশ জমে ওঠে। অদিতি তার পত্রিকায় অরিন্দমের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। তবে নায়কের সঙ্গে কথাবার্তায় তিনি বুঝতে পারেন, সবাই যাকে দেবতুল্য ভাবে, যার আছে অঢেল টাকা পয়সা, তার ভেতরেও আছে তীব্র অভাববোধ, আছে দুঃখকষ্ট। সে অভাববোধ একজন দরিদ্র মানুষের চেয়ে কম নয়। তিনি বুঝতে পারেন—একজন অভিনয়শিল্পীর জীবনাচরণ একজন সাধারণ মানুষের জীবন থেকে আলাদা। ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ সবকিছুকে আড়াল করে সবার সঙ্গে অভিনয় করে চলতে হয় একজন অভিনয়শিল্পীকে। শত দুঃখকষ্টের মাঝেও অভিনয়শিল্পীর সামনে যখন তার ভক্তরা এসে হাজির হয়, তখন তাকে হাসিভরা মুখে ভক্তদের কাছ থেকে গলায় পুষ্পমাল্য পরে নিতে হয়, অটোগ্রাফ দিতে হয়। তারা চাইলেও পারেন না বন্ধুর অনুরোধে রাজনীতির মাঠে বক্তৃতা দিতে। তারা চাইলেও সাক্ষাৎকারে তাদের মনের কথা মুক্তভাবে বলতে পারেন না, কেননা সেখানেও শঙ্কা, সিনেমার বাজার যদি নষ্ট হয়!
নায়ক সিনেমার চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনায় সত্যজিৎ রায় যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, তা খুব কম পরিচালকই সফলভাবে করে দেখিয়েছেন। সত্যজিৎ-এর আরও নামকরা সিনেমা আছে, কিন্তু সেসব থেকে এই সিনেমাটির পার্থক্য হলো—এই ছবিতে অতি সাধারণ একটি গল্পকে অসাধারণভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে।
সিনেমাটিতে অরিন্দম মুখার্জীর আশেপাশের চরিত্রগুলোকে এত গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যেন সেই সমাজের চিত্রটা ফুটে ওঠে। যেমন, সিনেমার শুরুতে একজন কন্ট্রাক্টধারীর চামচামিপূর্ণ আচরণ, নরেন বোসের মতো একজন উচ্চবিত্তের মুখোশ উন্মোচন, প্রীতিশ সরকার নামের মধ্যবিত্ত বিজ্ঞাপন বিপণন প্রতিষ্ঠান মালিকের বিচিত্র রূপ, ধর্ম ব্যবসায়ী সন্ন্যাসীর অদ্ভুত আচরণ খুব নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠে। এছাড়া মফস্বলের একটি স্টেশনে মাটির কাপে চা খাওয়া, মাতালের প্রতি সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি শৈল্পিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
ফ্লাশব্যাকের ব্যবহারের মাধ্যমে সিনেমাটির রহস্য উদঘাটনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসেনি, বরং একজন নায়কের উত্থানের গল্প বলা হয়েছে এতে। সঙ্গে-সঙ্গে উঠে এসেছে ওই সময়ের সাংস্কৃতিক ও রাজনীতির চর্চার বিষয়াদি। পাড়ার ক্লাবের প্রধান শংকরের বলিষ্ট সিনেমাবিদ্বেষী বাক্যগুলো যেমন দর্শকদের কানে ঝঙ্কার তোলে, তেমনি বীরেশের মতো শ্রমিক বিপ্লবীর সুযোগসন্ধানী রূপও সম্মুখে আসে। এগুলো বাদেও উঠে আসে মুকুন্দ লাহিড়ী নামক খুঁতখুতে স্বভাবের এক প্রবীণ অভিনেতা, যিনি শেষ জীবনে পরপর তিনটি সিনেমা ফ্লপের কারণে পথে বসেছিলেন, তার কথাও।
এছাড়া দুটি স্বপ্নের দৃশ্যের মাধ্যমে পরিচালক সিনেমাটির গ্রন্থিমোচন করেছেন। প্রথম স্বপ্নটিতে টাকার চোরাবালিতে অরিন্দমের ডুবে যাওয়াটা সত্যজিৎ-এর আধ্যাত্মিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। অন্যদিকে দ্বিতীয় স্বপ্নটি সিনেমাটির দুর্দান্ত মেটাফরের উত্তর। আসলে সিনেমাটিতে একটি খবরকে মেটাফর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্যই সিনেমার বিভিন্ন সময় আকারে ইঙ্গিতে ওই ধস্তাধস্তির খবরটা উঠে এসেছে।
নায়কে অরিন্দম মুখার্জী চরিত্রে অভিনয় করেছেন মহানায়ক খ্যাত অভিনেতা উত্তম কুমার। উত্তম-সুচিত্রা বিখ্যাত জুটির সিনেমা দেখে এক সময় বাঙলিরা মুগ্ধ হতো। অবশ্য নায়ক সিনেমায় উত্তম কুমারের সঙ্গে সুচিত্রা সেন জুটি বাঁধেননি, জুটি বেঁধেছিলেন অদিতি সেনগুপ্তা চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর।
অরিন্দম মুখার্জী চরিত্রে উত্তম কুমারের অভিনয়ের প্রশংসা করে কূল পাওয়া যাবে না। সিনেমার শুরুতে ট্রেনযাত্রার আগে কোনো এক বেনামি নায়িকার সঙ্গে ফোনে অরিন্দমের কথোপকথনের সময়, কালো চশমাটা পরে নায়কোচিত ভঙ্গিমায় একটা সিগারেট ধরান তিনি। ওই সময় নায়িকার সঙ্গে ফোনে অভিমান ভরা কণ্ঠে যে আলাপচারিতা হয় উত্তম কুমারের, সেখানে এখনকার নায়কদের মতো অভিনয়ে বাহুল্যদোষ নেই।
এছাড়া অরিন্দম তার উচ্চাকাঙ্ক্ষাবশত উত্তেজিত হয়ে টেবিল চাপড়ে বলেছিলেন, I will go to THE TOP! THE TOP! THE TOP!
এখানে, উত্তেজনাকর একটা মুহূর্তের দৃশ্য নিখুঁতভাবে সম্পাদনা করতে উত্তম কুমার তার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
শর্মিলা ঠাকুর অদিতি সেনগুপ্তা চরিত্রে একজন আদর্শ বাঙালি আধুনিক নারীর চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। নায়ক অরিন্দমের সামনে লাজুক লাজুক ভাব, উচিত কথা বলার সময় কণ্ঠে বলিষ্ঠতা কিংবা মুচকি হাসিতে ভাসিয়ে চরিত্রটিকে একরকম রোমান্টিক মিষ্টি নারীতে পরিণত করেছেন শর্মিলা ঠাকুর।
এছাড়া অন্য চরিত্রগুলোতে যারা অভিনয় করেছেন তারা সবাই তাদের শৈল্পিক অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সিনেমাটিকে উঁচু পর্যায়ে নিয়েছেন। এজন্য মুক্তির বছর সিনেমাটি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আরও কয়েকটি পুরস্কার লাভ করে।
সবশেষে সিনেমাটি সম্পর্কে একটি কথা বলতেই হবে, আর ডি বনশল প্রযোজিত নায়ক সিনেমাটিতে কিছু সূক্ষ্ণ শূন্যস্থান আছে। সেগুলো পূরণ না করতে পারলে সিনেমাটির শৈল্পিক মূল্য নিরূপণ করা সম্ভব হবে না, এমনকি দর্শকের কাছেও প্রথম দর্শনে সিনেমাটির হিসাব-নিকাশ মেলানো কষ্টকর হয়ে যেতে পারে। সিনেমাটি একাধিকবার দেখা প্রয়োজন, একবার মাত্র দেখায়, এর কাহিনী যেমন পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়, তেমনি টেকনিকও ধরা সহজ নয়।
https://www.youtube.com/watch?v=pK5hvo8xws0&t=579s