লোমহর্ষক গোয়েন্দা কাহিনীগুলোতে খলনায়ক সবসময় ভয়ঙ্কর প্রকৃতির হয়ে থাকে। তার সঙ্গে গোয়েন্দার বিরোধ হয়, বন্দুকযুদ্ধ হয়, তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। কিন্তু পরিচালক গ্রেগরি হবলিটের ‘ফলেন’-এর গল্প আর অন্য সব সিনেমার গল্পের মতো নয়। এখানে একজন পুলিশ অতিপ্রাকৃত শয়তানের মুখোমুখি, তাদের ভেতর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই অতিপ্রাকৃত শয়তানের বয়স হাজার বছরেরও বেশি। একে হত্যা করাও সহজ কাজ নয়। অনেকে একে হত্যা করতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছে। শয়তানের ক্ষমতা এতটা বেশি যে, সে স্পর্শের মাধ্যমে একজন মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে স্থানান্তরিত হতে পারে।
ফলেন বলতে গেলে একটি যৌগিক গল্প। এটি একই সঙ্গে ক্রাইম থ্রিলার ও অতিপ্রাকৃত থ্রিলার। এছাড়া এখানে আপনি পাবেন এক অসাধারণ সিরিয়াল কিলার চরিত্র, অ্যাডগার রিসকে, শার্লক হোমসের মতো গোয়েন্দা জন হবসকে। তবু সিনেমাটি শতভাগ লোমহর্ষক নয়। অতি ঠাণ্ডা মেজাজের লোমহর্ষক সিনেমা ‘ফলেন’-এ অন্য সব থ্রিলারের মতো বন্দুকযুদ্ধ কিংবা মল্লযুদ্ধ নেই।
মৃত্যুর মুখোমুখি সৎ ও দক্ষ গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা জন হবস। কিন্তু কেন? কে তাকে মারতে যাচ্ছে? এ রকম একটি মুহূর্ত দিয়েই সিনেমাটির শুরু। হবস চরিত্রে অভিনয় করেছেন হলিউডের দুই বারের অস্কারজয়ী বাকপটু কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা ডেঞ্জেল ওয়াশিংটন।
শহরের বিখ্যাত সিরিয়াল কিলার অ্যাডগার রিসকে গ্রেফতারের পর মৃত্যুদণ্ডের সময় অদ্ভুত আচরণ করে রিস। সিরিয়ান অ্যারামিক ভাষায় কিছু দুর্বোধ্য কথা জীবনের শেষমুহূর্তে দক্ষ গোয়েন্দা জন হবসকে বলে যায় সে। এছাড়া হবসের দিকে ছুড়ে দেয় একটি ধাঁধা। কেন লায়নস ও স্পাকোয়াস্কির ভেতর ফাঁকা স্থান আছে? এছাড়া মৃত্যুদণ্ডের সময় রিসের গাওয়া রোলিং স্টোনসের ‘Time Is on My Side’ গানটির প্রভাব পুরো সিনেমায় বার বার ফিরে এসেছে। অ্যাডগার রিসের এই সীমিত ব্যাপারগুলোই পুরো সিনেমাটির কাহিনী সজ্জাকরণের মূল সূতো।
রিসের মৃত্যুদণ্ডের পরও সিরিয়াল কিলিং থেমে থাকে না। আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কপিক্যাট ধরনের যে হত্যাগুলো হচ্ছিল সেগুলোর সঙ্গে রিসের হত্যাযজ্ঞের মিল ছিল। অন্যদিকে হত্যার সূত্রগুলোর মাঝে চলে আসে লায়নস-স্পাকোয়াস্কির সেই আজব ধাঁধা। হবস প্রথমে মনে করেছিল হত্যাগুলো মানুষের কাজ, কিন্তু তার কাছে আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে থাকে, এসব আসলে আজাজিলের কাজ।
নিকোলাস কাজানের চিত্রনাট্যে ফুটে উঠেছে অসাধারণ কিছু দৃশ্য। কিছু শান্ত সময় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ফলেনে, যেমন রাত দুটোর সময় গোয়েন্দা হবস ও তার সহকর্মী জোনসির মধ্যে খারাপ শক্তি সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা। জোনসি চরিত্রে জন গুডম্যান দারুণ অভিনয় করেছেন। ভাগ্যের পরিহাসে হবসের প্রিয় সহকর্মী জোনসিকে একসময় নিজ হাতে হত্যা করে হবস। এই নির্মম পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী, সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য সিনেমাটিতেই মিলবে।
প্রাইমাল ফেয়ারের জন্য প্রসিদ্ধ পরিচালক গ্রেগরি হবলিটের ফলেনে মল্লযুদ্ধ বা বন্দুকযুদ্ধের আধিক্য না থাকলেও পুরো সিনেমাজুড়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজমান। তিনি সিনেমাটিকে অ্যাকশনহীন করার জন্য বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। এ কারণে গ্রেটা মিলানোকে যখন আজাজিল রাস্তার মাঝে তাড়া করে, সে সময় গ্রেটা মিলানোকে ধরার জন্য চমকপ্রদভাবে একজনের শরীর থেকে আরেক শরীরে স্থানান্তরিত হয় আজাজিল।
সিনেমাটিতে গ্রেটা মিলানো চরিত্রে অভিনয় করেছেন অ্যামবেথ ডেভিডজ। গ্রেটা মিলানো একজন ধর্মতত্ত্ববিদ, সে একসময় হবসকে আজাজিল সম্পর্কে বলেছিল, ‘সে অনেকটা মাফিয়ার মতো। আমরা তার সম্পর্কে জানতে পারি কিন্তু দেখতে পারি না।’
আজাজিল সম্পর্কে সবচেয়ে রহস্য সৃষ্টি করেছে যে চরিত্রটি সেটা হচ্ছে গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট স্টানটোন। এই চরিত্রে অসাধারণ অভিনেতা ডোনাল্ড সাদারল্যান্ড অভিনয় করেছেন, তবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পরিচালক সাদারল্যান্ডকে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। তবু সাদারল্যান্ডকে যে স্বল্প সময় দেখা গেছে, তাতেই তার নিপুণ অভিনয় দক্ষতা ফুটে উঠেছে।
আজাজিলের সঙ্গে গোয়েন্দা জন হবসের চূড়ান্ত শত্রুতা তার ঘরেও পৌঁছে যায়। সিনেমাটিতে জন হবসের সহজ সরল ভাই আর্ট হবস চরিত্রটি আপনাকে বিরক্ত করতে পারে, আপনার মনে হতে পারে, এই চরিত্রটির প্রয়োজন কী? তবে একটা সময় আপনি বুঝবেন আজাজিলের শৈল্পিক শয়তানি। আর্টের ছেলে স্যামের সঙ্গে গোয়েন্দা হবসের আলাপচারিতায় স্যামের দৃঢ়চেতা কথাবার্তাও অর্থবহ। নিজের বাবার মৃত্যুর সংবাদেও স্যাম ভেঙে পড়েনি, চাচা জন হবসের প্রস্থানেও তার কান্না আসেনি। সে শুধু তার পরিবারের একটা ঝড়ের সাক্ষী হয়ে থেকেছে। স্যাম চরিত্রে সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন মাইকেল জে পেগান।
ম্যালকম এক্স কিংবা আমেরিকান গ্যাংস্টারের জন্য খ্যাত ডেঞ্জেল ওয়াশিংটন হবস চরিত্রে তার দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। অন্যদিকে ইলিয়াস কোটিস, রিস চরিত্রে একজন সিরিয়াল কিলার হিসেবে নিখুঁত অভিনয় করেছেন।
ফলেন সিনেমাটিতে অতিপ্রাকৃত শক্তির কাছে বাস্তববাদী এক গোয়েন্দার মনস্তাত্ত্বিক পরাজয় লক্ষনীয়। একসময় হবস আজাজিলের অস্তিত্ব স্বীকার করে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু গোয়েন্দা হবস কি সেই ব্যক্তি, যে অতিপ্রাকৃত শক্তিধর আজাজিলকে হত্যা করতে পারবে? না কি জন হবসই আতিপ্রাকৃত শক্তির একটা অংশ? সিনেমার শেষের দিকে গোয়েন্দা জন হবস, জোনসি ও লেফটেন্যান্ট স্টানটোনকে একত্রিত করে একটি দৃশ্যের অবতারণা করার চেষ্টা চলেছে।
১৯৬৬ সালের সার্জিও লিওনের দ্য গুড, ব্যাড অ্যান্ড আগলি সিনেমাটিতে তিনজনের যে দ্বন্দ্বযুক্ত মুহূর্ত সৃষ্টি করা হয়েছিল। ফলেনে এই তিনজনের মাঝে সে রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলেও সে রকম কিছুর চেষ্টা হয়েছে। যাই হোক, আপনি ফলেনের দর্শক হলে সিনেমার খলনায়ক আজাজিলের জন্য আপনাকে সিনেমাটিকে মনে রাখতেই হবে। আজাজিল শয়তানের এমন আজব রূপ দক্ষ উপস্থাপনায় আর কোনো সিনেমাতে দেখানো হয়নি।