আপনি যদি মনোযোগী দর্শক না হয়ে থাকেন, তবে মনোযোগী হোন। কেননা, এক্স-ম্যান সিরিজের রূপকার ব্রাইন সিংগারের ১৯৯৫ সালের অসাধারণ সৃষ্টি ‘দ্য ইউজ্যুয়াল সাসপেক্টস’ দেখতে হলে আপনাকে পলকহীন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। সিনেমাটি দেখতে দেখতে আপনি হয়তো কল্পনায় হারিয়ে যেতে পারেন এক শৈল্পিক অপরাধ জগতের মাঝে। রহস্যময় পেঁচানো ক্রাইম থ্রিলার দ্য ইউজ্যুয়াল সাসপেক্টস সম্পর্কে যে কথাটি বলতে হবে, সেটা হলো, এটি আপনাকে অবশ্যই দ্বিতীয় বারের মতো দেখতে হবে।
ক্যালিফোর্নিয়ার সান পেড্রো বে। একটি জাহাজে বিস্ফোরণে ২৭ জন নিহত, ৯১ মিলিয়ন ডলারের কোকেইনের হদিস নেই। ঘটনাস্থলের শুধু দুই জন জীবিত। একজন ৬০ ভাগ দগ্ধ হাঙ্গেরিয়ান, অন্যজন অক্ষত ভার্বাল কিন্ট। তারাই শুধু পারে ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে।
ভার্বাল কিন্টের স্বাভাবিক স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে কিছু সন্দেহজনক ব্যাপার। রাজনৈতিক চাপের ফলে ভার্বাল কিন্টকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তাকে ছেড়ে দেওয়ার দুই ঘণ্টা আগে দক্ষ কাস্টমস কর্মকর্তা এজেন্ট ডেভ কুইয়ান ভার্বাল কিন্টের কাছ থেকে সত্য ঘটনা জানার শেষ চেষ্টা করেন।
ছয় সপ্তাহ আগে নিউইয়র্কের পাঁচ বিপজ্জনক সন্ত্রাসীকে ট্রাকভর্তি বন্দুক চুরির অপরাধে সন্দেহজনকভাবে আটক করে নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অপরাধীরা হলো দুর্নীতিগ্রস্ত প্রাক্তন পুলিশ অফিসার ডিন কিটন, বাম হাত অবশ হওয়া ও খোঁড়া ভার্বাল কিন্ট, বিপদজ্জনক মাইকেল ম্যাকমেনাস, পাগলাটে টড হকনি ও রুক্ষ মেজাজের ফ্রেড ফেনস্টার।
অতীত ও বর্তমানের দোলাচালে ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারির লেখা গল্পটি এগিয়ে চলে। ফ্ল্যাশব্যাকের শৈল্পিক ব্যবহার সিনেমাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
বিপজ্জনক পঞ্চসন্ত্রাসী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একত্রিত হয়। চোরাকারবারি সন্ত্রাসীদের নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সেসময় নিউইয়র্ক ট্যাক্সি সার্ভিস নামে একটি বেআইনি সেবা প্রচলিত ছিল। ম্যাকমেনাসের প্রস্তাবে ও ভার্বাল কিন্টের বুদ্ধিতে তারা নিউইয়র্ক ট্যাক্সি সার্ভিসে আক্রমণ করে অনেক হীরা সংগ্রহ করে। সেই হীরা বিক্রি করতে ক্যালিফোর্নিয়াতে রেডফুটের কাছে যায় তারা।
প্রথমবারের মতো সিনেমাটি দেখলে আপনার মনে হবে সিনেমাটির মূল ফোকাস ডিন কিটনের প্রতি। আইনজীবী গার্লফ্রেন্ড ইডি ফিনারেনের সাথে তার সখ্যতা, সব কিছু মিলিয়ে ডিন কিটন সিনেমাটিতে একটি রহস্যময় চরিত্রে পরিণত হয়। এজেন্ট কুইয়ানের বর্ণনা তাকে আরও রহস্যময় ও ভয়ঙ্কর করে তোলে।
এজেন্ট কুইয়ান আর ভার্বাল কিন্টের ভিতর এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়। এজেন্ট কুইয়ান ভার্বাল কিন্টের কাছ থেকে একদিকে সব সত্য বের করে আনার চেষ্টায় মগ্ন, অন্যদিকে চৌকস ভার্বাল কিন্ট অতি সাবলীলভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলে যেতে থাকে। জিজ্ঞাসাবাদের এই যে মহাদ্বন্দ্ব তা খুব কম সিনেমাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দ্য ইউজ্যুয়াল সাসপেক্টসে এই দ্বন্দ্ব প্রখর। এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় ভার্বাল কিন্ট।
ভার্বাল কিন্ট একসময় কাইসার সোজি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলে ওঠে, ‘The greatest trick the devil ever pulled was convincing the world that he didn’t exist’ অর্থাৎ, ‘শয়তানের সবচেয়ে বিপজ্জনক কৌশল হচ্ছে সে পৃথিবীকে বুঝাতে চায় তার অস্তিত্ব নেই।’
সিনেমাটির সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্র কাইসার সোজির আবির্ভাব ঘটে সিনেমাটির মাঝামাঝি। প্রভুভক্ত কোবায়াশি নামে এক আইনজীবীর মাধ্যমে তার আবির্ভাব। কোবায়াশি তার দায়িত্ব পালনে জীবন ত্যাগ করতে পারে কিন্তু, কাইসার সোজির কথার বাইরে কিছুই করতে পারে না। কাইসার সোজি অপরাধজগতের এমন এক প্রভাবশালী ব্যক্তি যার নাম সবাই জানে, যার জন্য অনেকে কাজ করে, কিন্তু কেউ তাকে দেখেনি। কাইসার সোজির আধিপত্য বেলফাস্ট থেকে পাকিস্তান সর্বত্র।
পঞ্চসন্ত্রাসীর সকলেই কাইসার সোজির কাছে বিভিন্ন সময় তাদের কাজের জন্য দায়বদ্ধ। একারণে তাদেরকে একটা মিশন দেওয়া হয়। এই মিশনটা অনেকটা মিশন ইম্পসিবল টাইপের। ক্যালিফোর্নিয়ার বন্দরের এক জাহাজ ঘিরেই মিশনটা পরিচালিত হয়। যার ফলাফল কী তা আগেই বলা হয়েছে।
সিনেমাটিতে ‘কাইসার সোজি’ শব্দটিকে অরসন ওয়েলস পরিচালিত সিটিজেন কেইনের ‘রোজবাড’-এর সঙ্গে অথবা রোমান পোলানস্কির ‘চায়না টাউন’ মেটাফোরের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ‘রোজ বাড’ কিংবা ‘চায়না টাউন’ মেটাফোরের স্পষ্ট সমাধান সিটিজেন কেইন ও চায়না টাউন সিনেমাতে না থাকলেও ‘কাইসার সোজি’ মেটাফোরের উত্তর দ্য ইউজ্যুয়াল সাসপেক্টসের শেষ সাড়ে তিন মিনিটে দেওয়া হয়েছে। এই রহস্যময় মেটাফোরের উত্তর পেয়ে আপনি তৃপ্ত হবেন, আপনি চমকে উঠবেন। মূহুর্তেই সিনেমটির মূল চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে যাবে।
তাইতো আপনাকে নতুন মেজাজে পুনরায় সিনেমাটি দেখতে হবে। আপনাকে দেখতে হবে খোঁড়া ভার্বাল কিন্ট জিজ্ঞাসাবাদের আগে কেনো ডান হাত দিয়ে লাইটার জ্বালাতে ব্যর্থ হলো। আপনাকে দেখতে হবে, কী চতুরতার সঙ্গে ভার্বাল কিন্ট এজেন্ট কুইয়ানকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে গেল। আপনাকে নতুন করে ভাবতে হবে, আতেরো মারকেজ কে? আতেরো মারকেজো কী কাইসার সোজির পরিবার জিম্মিকারীদের একজন? শুধু যে ব্যক্তিটি কাইসার সোজিকে শনাক্ত করতে সক্ষম।
হলিউড সিনেমার ইতিহাসে অনেক সিনেমাতে চমকপ্রদ সমাপ্তি দেখা গিয়েছে কিন্তু দ্য ইউজ্যুয়াল সাসপেক্টসের সঙ্গে তুলনা কোনোটিই করা যায় না। ১৯৯৫ সালে যখন সিনেমাটি মুক্তি পায়, তখন ইউজ্যুয়াল সাসপেক্টসকে তুলনা করা হয়েছিল কুয়েন্টিন টারান্টিনোর ‘রিজার্ভর ডগস’ নামক পেঁচানো ক্রাইম থ্রিলারের সঙ্গে। তবে দ্য ইউজ্যুয়াল সাসপেক্টস রিজার্ভর ডগসকেও হার মানিয়ে ক্লাসিক সিনেমাগুলোর মাঝে তার উজ্জ্বল অবস্থান প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে প্রায় দুই যুগ ধরে।
সিনেমাটিতে ভার্বাল কিন্ট চরিত্রে কেভিন স্পেসি, ডিন কিটন চরিত্রে গ্যাব্রিয়েল বার্ন, মাইকেল ম্যাকমেনাস চরিত্রে স্টিফেন বাল্ডউইন, ফ্রেড ফেনস্টার চরিত্রে বেনিসিও ডেল টোরো, টড হকনি চরিত্রে কেভিন পোলাক, এজেন্ট ডেভ কুইয়ান চরিত্রে চাজ পালমিনতেরি, কোবায়াশি চরিত্রে পিট পাসোফোয়েট, ইডি ফিনারেন চরিত্রে সুজি এমিস চমৎকার অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সিনেমাটির কাস্টমস এজেন্ট ডেভ কুইয়ান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ক্রিস্টোফার ওয়াকেন ও রবার্ট ডি নিরোকে প্রস্তাব দেওয়া হলেও তারা অভিনয় করতে রাজী হননি, এমনকি এই চরিত্রে আল পাচিনোকে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তাও করেছিলেন পরিচালক ব্রাইন সিংগার। কিন্তু সে সময় ‘হিট’ সিনেমায় পুলিশি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তাকে কাস্টমস এজেন্ট ডেভ কুইয়ান চরিত্রে দেখা যায়নি।
মাত্র ছয় মিলিয়ন ডলারের সিনেমাটিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য কেভিন স্পেসি ও চিত্রনাট্যের জন্য ক্রিস্টোফার ম্যাককুয়ারি অস্কার পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আরও ৩২টি পুরস্কার পায় দ্য ইউজ্যুয়াল সাসপেক্টস।