সূর্য উঠতে হয় ওঠে, ডুবতে হয় ডোবে। মুণ্ডমালায় কী হয়, দেখে না। কিন্তু মুণ্ডমালাকে সময় আজ অন্যভাবে নিয়েছে। একটু খোঁজখবর করছে। মেঘের ভেতর দিয়েই সকাল-দুপুর এমনকি বিকালের কিছু অংশ চলে গেছে। যখন সূর্যটাকে মেঘেরা ছেড়েছে তখন সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগে—সময়, পরিবেশ, দৃশ্য। বোকা বোকা বিকাল। বোকা বিকাল সুর্যটাকে নিয়ে ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। অনেকক্ষণ থেকেই ওটাকে ওই দূরের নিমগাছটার মাথার কাছে আটকে রেখেছে।
ভোর থেকেই গরুটা পড়ে আছে। মরা গরু। কাক, চিল, শকুন কোথায় যে ছিল, সব এসে হাজির। এতদিন মনে করা হতো হয়ত এরা পালিয়ে গেছে নয়ত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ উদয় হওয়াতে সবার ধারণা পাল্টাল—‘কোথাও ঘাপটি মেরে পড়েছিল, মোক্ষম সময়ে এসে হাজির হয়েছে’।
গরুটা, লেজটা নড়ে উঠল। না, নড়েনি, একটা পাজি শকুন মনে করেছিল, লেজটা ঠোঁটে চেপে ধরে পুরো গরু নিয়েই উড়াল দেবে। কিন্তু পারেনি, মুখ থেকে ছিটকে পড়েছে, তাই নড়ে উঠেছিল। গরু নড়ছে না।
বিকালটা ইতস্তত করছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, সূর্যটাকে দূর ওপারে পাঠিয়ে দেবে কিনা। তারপর ভাবল আরও কিছুক্ষণ দেখি। গরুর গায়ে রোদ পড়ছে। সূর্যটা আরও একটু ওপরে উঠল? হঠাৎ রোদ পড়াতে সবকটা নখরপক্ষী চিৎকার-চেঁচচেচি শুরু করে। কিন্তু গরু ছেড়ে যায় না। গরুটাকে কেন্দ্র করে তার চারধারে বৃত্তাকারে চক্কর দিতে লাগল। কিন্তু সূর্যটা তখন ঠিক ওপরে ওঠেনি। নিমগাছের ঘন গাছের মাথার আড়ালে ছিল। আসলে আরও একটু নিচে নেমেছে। নিচে নামার ফলে, নিমগাছের যে ফাঁক ছিল সে ফোকর গলে রোদ এসেছে।
এবার গরুর পেটটা নড়ছে। বেশ দর্শনীয়ভাবে নড়ছে। সূর্যটা আশ্চর্য হয়—গরু কি জিন্দা! সূর্যটা আরও একটু নিচে নেমে, নিমগাছের বড় ফাঁকে মাথা চালিয়ে কৌতূহলী চোখ বাড়িয়ে দেয়। পেট নড়ছে কিন্তু আসলে নড়ছে না। গরুটাকে পুরো ক্ষত-বিক্ষত করেনি নখরপক্ষীরা। পেটের কাছের বেশ খানিকটা ফুটো করে তার ভেতরে ঢুকে ভেতরের মাংস খাচ্ছে। তাতেই তাদের মধ্যে ঝগড়া বেধেছে মরা গরুর পেটের ভেতর। অথবা মরা গরুর পেটের মধ্যে তারা মাংস খেতে খেতে নেচে নেচে উল্লাস করছে। তাতেই পেট নড়ছে বলে দূর থেকে মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল গরুটা জীবিত আছে বা জীবিত হয়ে গেছে।
বিকালটার ইচ্ছা, আরও কিছুক্ষণ দেখে যায়, শেষ পর্যন্ত কী হয়, জানার আশায়। কিন্তু হয় না, সূর্য এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকে না। সূর্যটা ডুবল। পাগলা বাতাস গাছের ফাঁকফোকরে রতি করে, পাতায় পাতায় চুমু শীৎকার রচনা করে ওপারে চলে যাচ্ছে। গাঢ় রাত নামল। মুণ্ডমালার প্রতিটি কোনায় কোনায়, কণায় কণায় গাঢ় আঁধার পূর্ণ হলো।
২
মরা গরুর পাশ দিয়ে জলভরা নদী। জলভরা নদী নৌকাগুলোকে বইয়ে দিচ্ছে। মোড়লের মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছে দূরের দেশের কে যেন। সামনে একটা বড়ো নৌকা, পেছনে একাত্তরটা নৌকা। নৌকাভর্তি মাল চলে যাচ্ছে। নখরপক্ষীরা উড়ে গেল সূর্যটা যেদিকে গেছে সেদিকে। সব নৌকা যেতে যেতে অদৃশ্য হলো। মোড়ল শান্তির শ্বাস ফেলে—‘যাকগে, মেয়েটা সুখে থাকবে!’
৩
গ্রামের লোকজন হারিকেন জ্বালিয়ে হারানো গরু খুঁজতে এসে দেখল, কিছুই নেই। নখরপক্ষীদের বিষ্ঠা আর গরুর চামড়া পড়ে আছে শুধু। লোকজনের মুখ গোমড়া, কী করবে বুঝতে পারে না। ‘ঢোল হবে চামড়াটা দিয়ে’—কে একজন বলল। গোমড়া মুখের সবাই তখন মুখ থেকে গোমড়া খুলে ফেলে ‘চামড়া নেব, চামড়া নেব’ বলে টানাটানি শুরু করল।