রোআল্ড ডালের ১৯৮২ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত শিশুতোষ উপন্যাস দ্য বিএফজি অবলম্বনে এ পর্যন্ত সিনেমা হয়েছে দুটি। উপন্যাসটির গল্প একদম আজগুবি ও চমকপ্রদ। এ ধরনের গল্প চিত্রায়নে এনিমেশনের সহযোগিতা নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তাই দুটি সিনেমাই এনিমেশননির্ভর। এর মধ্যে একটি ১৯৮৯ সালে, আরেকটি ২০১৬ সালে নির্মিত। ১৯৮৯ সালের সিনেমার গ্রাফিক্স টম অ্যান্ড জেরির মতো, অন্যদিকে ২০১৬ সালের স্টিভেন স্পিলবার্গের বিএফজির এনিমেশন একেবারে ভিন্ন।
সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে স্টিভেন স্পিলবার্গের নাম শোনেননি এমন লোক কমই আছেন। তবে আপনি হয়তো স্পিলবার্গের নাম শোনেননি কিন্তু দেখে ফেলেছেন ইন্ডিয়ানা জোন্স সিরিজের সব সিনেমা, দেখে ফেলেছেন ‘জুরাসিক পার্ক’, দেখে ফেলেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি সিনেমা ‘শিন্ডলারস লিস্ট’ ও ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’। তবু যদি আপনার মনে হয় এখনো আপনি তাকে চিনতে পারছেন না, তবে দেখে ফেলুন এই দশকের অসাধারণ দুটি সিনেমা ‘লিংকন’ এবং ‘ব্রিজ অব স্পাইজ’। তার পরিধি এতটাই বিশাল। সিনেমাজগতে আর কোনো পরিচালকের সিনেমা ৯.২৪৬ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারেনি।
সুতরাং বিএফজিতে যে চমকের মতো কিছু একটা থাকবে, সেটাই আশা ছিল। তবে সে আশা কতটুকু পূরণ হয়েছে, সেই প্রশ্নটা থেকেই যায়। কেননা, বিএফজি বক্স অফিসে ফ্লপ একটি সিনেমা। সিনেমা বিশ্লেষকদের অনেকের কাছে ২০১৬ সালের ডিজনির বিএফজি সুনাম কুড়িয়েছে, আবার কেউ কেউ সমালোচনায়ও মেতেছেন।
ম্যালিসা ম্যাথিসনের চিত্রনাট্য রুপান্তরে প্রথমেই দ্য বিএফজিতে ফুটে ওঠে ভিক্টোরিয়ান পিরিয়ডের মত লন্ডনের চেহারা। বিএফজিতে প্রথমে যে দৃশ্যপট ফুটে উঠেছে, তা দেখে আপনার অবশ্যই মনে পড়বে চার্লস ডিকেন্সের কথা। কেননা লন্ডনের এমন রূপই তার লিখনীর মাধ্যমে অঙ্কন করেছিলেন ডিকেন্স। মনে করা হচ্ছে, সেখান থেকেই হয়তো স্পিলবার্গ এমন দৃশ্য চলচ্চিত্রে তুলে এনেছেন।
সোফি নামের এতিম ১০ বছরের মেয়েটি রাতজাগা পাখির মতো। রাত তিনটাতেও সে জেগে থাকে। সময়টাও খারাপ। কারা যেন এসে নিয়ে যাচ্ছে শিশুদের। এমন এক ভয়ঙ্কর রাতে এতিমখানার জানালা দিয়ে এক বিশাল লম্বা দৈত্যকে দেখতে পায় সোফি, যার হাতে একটা ব্রিফকেস। শেষ নিস্তার হয় না সোফির। সোফি দৈত্যটাকে দেখতে পায় বলে দৈত্য তাকে ধরে নিয়ে যায় দৈত্যপুরীতে তার গুহায়।
সোফি সেখানে প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। সে ভাবে তাকে বুঝি দৈত্যটা খেয়ে ফেলবে। তবে দৈত্যটা তাকে জানায় সে মানুষখেকো নয়, সে শুধু স্নুজকাম্বার নামের একধরনের শসা খায়। দৈত্যটা তাকে জানায় দৈত্যপুরীতে সবাই ভালো নয়। তার প্রতিবেশীদের সবাই ভয়ঙ্কর ও মানুষখেকো। এসব মানুষখেকোর সর্দারকে বলা হয় ফ্লেশলাম্পইটার। সোফিকে জানানো হয় তাকে আজীবন দৈত্যেপুরীতে থাকতে হবে।
এই স্নুজকাম্বারখেকো দৈত্যটিই হচ্ছে বিগ ফ্রেন্ডলি জায়ান্ট, সংক্ষেপে বিএফজি। বিএফজি ভালো দৈত্যদের একজন। সে স্বপ্ন কুড়ানোর কাজ করে। সে স্বপ্নপুরীতে যেয়ে দৌড়ে দৌড়ে ভালো স্বপ্নগুলোকে ধরে নিয়ে আসে বোতলে পুরে। বোতলগুলো সাজিয়ে রেখে দেয় গুহায়। একেক বোতলে একেক রকমের স্বপ্ন। পৃথিবীতে যখন রাত তখন বিএফজি মানুষের মাঝে ভালো স্বপ্ন বিলাতে বের হয়। একটি বাঁশির মাধ্যমে সে স্বপ্ন বিতরণ করে।
এককথায় বলতে গেলে, দৈত্যপুরীকে এবং দৈত্যদের অনেক সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন স্পিলবার্গ। এছাড়া স্বপ্নপুরীর স্বপ্নবৃক্ষটাকেও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অসাধারণভাবে।
এদিকে ফ্লেশলাম্পইটার বিভিন্ন ওছিলায় বিএফজিকে জ্বালাতন করে। দৈত্যরা তাকে রান্ট বলে ডাকে। ফ্লেশলাম্পইটার তাকে বলে, সে দৈত্য নামেক কলঙ্ক, কেননা সে মানুষ না খেয়ে শাকসবজি খায়। বিভিন্ন সময় ফ্লেশলাম্পইটার সোফিকে খেয়ে ফেলার পাঁয়তারা করে, কিন্তু বিএফজি তাকে রক্ষা করে। সোফির মনে একসময় স্নুজকাম্বারভোজী নিষঙ্গ দৈত্যটির প্রতি মায়া জন্মে। তারা একরকম বন্ধুতে পরিণত হয়।
খারাপ দৈত্যদের হাত থেকে বাঁচতে এবং শিশুদের বাঁচাতে একটা পরিকল্পনা করে সোফি। সোফির পরিকল্পনা অনুযায়ী রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্য একটি স্বপ্ন প্রস্তুত করে বিএফজি। যে স্বপ্নের সাহায্যেই একসময় রাণী এলিজাবেথের সঙ্গে তাদের দেখা হয়। বৃটেনের রাণীর প্রাসাদে প্রথম পদার্পণ করে দৈত্য। রাণীর সহযোগিতায় ও স্বপ্নাস্ত্র ব্যবহার করে শেষপর্যন্ত মানুষখেকো দৈত্যদের ধরে অথৈ সমুদ্রের মাঝে একটা দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়। তাদের খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয় স্নুজকাম্বার। তাদের জন্য পাঠানো হয় স্নুজকাম্বারের বীজ। এভাবেই তারা মানুষখেকো থেকে নিরামিষভোজী হয়ে উঠবে।
সিনেমাটিতে সোফি এবং বিএফজির ভিতর আবেগের বিষয়টা কতটুকু ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন স্পিলবার্গ এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কেননা সিনেমাটিতে ক্লাইম্যাক্স সৃষ্টিটা ঠিকমতো হলেও তার পরিসমাপ্তিটা তেমন আবেগী হয়নি। ১৯৮৯-এর বিএফজির সমাপ্তিতে যে তীব্র আবেগী মূহুর্ত ছিল, তা এতে ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। রোআল্ড ডালের কাহিনীকে একটু পরিবর্তন করে সোফিকে রাণী এলিজাবেথের দরবারে আশ্রয় দেওয়া হয়। কিন্তু রোআল্ড ডাল এবং ১৯৮৯-এর বিএফজিতে সোফি শেষপর্যন্ত বিএফজির সঙ্গে বসবাস করতে থাকে।
ফ্যান্টাসি বা অ্যাডভেন্সার ধারার এনিমেশননির্ভর এই সিনেমাটিতে জাগতিক সব শব্দগ্রাহী বিএফজি বা বিগ ফ্রেন্ডলি জায়ান্ট চরিত্রে অভিনয় করেছেন মার্ক রাইলেন্স। অন্যদিকে অন্যতম প্রধান চরিত্র সোফির ভূমিকায় অভিনয় করেছে রুবি বার্নহিল। ১১ বছর বয়সী ব্রিটিশ অভিনেত্রী রুবি বার্নহিলের হলিউড ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সূচনা হয় দ্য বিএফজি সিনেমার মাধ্যমেই। মার্ক রাইলেন্স ও রুবি বার্নহিল দুজনই তাদের নিজ নিজ চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন।