‘ডুব’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘অবগাহন’ বা ‘নিমজ্জন’। শব্দটিকে যতটা সহজ মনে হয়, ততটা সহজ নয়। পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সম্প্রতি এই নামে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের ছায়া অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তবে এই চলচ্চিত্রের নামকরণ করতে কেন ‘No Bed of Roses’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হলো, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আরও প্রশ্ন উঠেছে—যদি ‘No Bed of Roses শব্দগুচ্ছই ব্যবহৃত হলো, তাহলে বাংলা নামকরণ ‘ডুব ‘ কেন?
এর উত্তর অবশ্য পরিচালক দিয়েছেন একটি সংবাদ সম্মেলনে। তিনি জানিয়েছেন, এই সিনেমার নামকরণ প্রথমে তিনি ইংরেজিতে করেছিলেন। পরে ‘No Bed of Roses’ শব্দগুচ্ছের বাংলা খুঁজতে গিয়ে নাকাল হয়েছেন। তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে নাম দিয়েছেন ‘ডুব’। কারণ, সিনেমাটির বেশিরভাগ অংশজুড়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা বিরাজ করবে। জীবন সংগ্রামের এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা প্রকাশ করতেই হয়তো তিনি ‘ডুব’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
সিনেমাটির কাহিনী কিভাবে আবর্তিত হবে, এটা নিয়ে স্পষ্ট করে জানার উপায় নেই। তবে এটুকু জানা গেছে, সিনেমাটির প্লট আবর্তিত হবে দুটি পরিবারের মধ্যে। পরিবারকেন্দ্রিক এই সিনেমার মধ্যে থাকবে জীবনবোধ, প্রেম ও জীবনের উত্থান-পতন। সিনেমার মূল চরিত্রগুলোয় অভিনয় করেছেন, বলিউডের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতা ইরফান খান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, রোকেয়া প্রাচী ও কলকাতার পর্নো মিত্র।
ইরফান খানের কথা না বললেই নয়। তিনি তার অভিনয় দক্ষতা দিয়ে জয় করেছেন বিশ্ব চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মন। তিনি হলিউড, বলিউড, তেলেগু, ব্রিটিশ ও কানাডিয়ান সিনেমায় বিচিত্র চরিত্রে অভিনয় করে এখন বাংলাদেশি সিনেমা ডুবের রথে। বিশ্বব্যাপী তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে মূলত অস্কার বিজয়ী ‘লাইফ অব পাই’ সিনেমার জন্য। এর আগে তিনি ১৯৮৫-৮৬ সালে শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাস থেকে র্নির্মিত একটি টিভি সিরিজে অভিনয় করেছেন। এছাড়া ২০১৬ সাল থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য বিষয়ক টিভি সিরিজ ‘টোকিও ট্রায়াল’-এ বাংলাদেশি আইনবিদ ড. রাধা বিনোদ পালের চরিত্রে অভিনয় করেন। তাই ডুবের জাভেদ হাসান চরিত্রটিকে তিনি যে শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে যাবেন, এটা সবাই আশা করছেন।
আব্দুল আজিজ ও ইরফান খানের প্রযোজনায় নির্মিত ডুব সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখেছেন পরিচালক নিজেই। পহেলা বৈশাখে ডুবের পর্দা ওঠার কথা থাকলেও আজ অবধি নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই কবে আলোর মুখ দেখবে। হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের অভিযোগে ডুবের মুক্তি যে পিছিয়ে গেছে, তাতে দর্শকের অপেক্ষার প্রহরই শুধু দীর্ঘ করে চলেছে। শিগগিরই সবার মনের সংশয় দূর করতে ডুবের পর্দা উঠবে এটাই সবার প্রত্যাশা।
তবে প্রশ্ন একটা থেকেই যায়, সেটি হলো, সিনেমাটির নাম কোনটি বেশি যুক্তিযুক্ত, ‘ডুব’ নাকি ‘ডুবন্ত’?
ডুব শব্দটির নানাবিধ প্রয়োগ আমরা দেখতে পারি, যেমন: ডুব দেওয়া, ডুবে যাওয়া, ডুবন্ত। একজন মানুষ গরমের দিনে পুকুরে ডুব-সাঁতার খেললে সেটি অবশ্যই কখনো অস্বস্তিকর বিষয় নয়।
আবার সূর্য ডুবে যাওয়া ব্যাপারটার সঙ্গে এই ডুবের তুলনা হয় না। এছাড়া ডুবের বহুমাত্রিক ব্যবহার লক্ষণীয়। তাই এই ‘ডুব’ হয়তো ‘ডুবন্ত’ কোনো মানুষের অস্বস্তিকর অবস্থাকেই প্রকাশ করবে।
একথা অস্বীকার করার জো নেই যে, বাংলা সিনেমার নামকরণে মুনসিয়ানা খুব কম পরিচালক দেখিয়েছেন। বাংলা সিনেমার নামকরণে আমরা দেখেছি ‘এক টাকার বউ’, ‘কোটি টাকার কাবিন’, ‘ভালোবাসা দিবি কিনা বল’, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’ প্রভৃতি নাম। তবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বাংলা সিনেমার নামকরণে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করছেন। তার প্রথম চারটি সিনেমার নাম ইংরেজিতে ছিল। ব্যাচেলর, মেড ইন বাংলাদেশ, থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার ও টেলিভিশন সিনেমা—চারটির নামই ইংরেজিতে দেওয়া। সর্বশেষ তার যে সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল সেটির নাম ছিল Ant Story বা পিঁপড়াবিদ্যা। তাই এ কথা বলতেই হচ্ছে, ডুবের পরিচালক তার সিনেমার নামকরণের জন্য বাংলা শব্দ খুঁজতে বার বার খুব ঝামেলায় পড়েছেন এবং বেশিরভাগ সময় ব্যর্থ হয়েছেন। অবশ্য বাংলা সিনেমার নাম ইংরেজিতে দিলেও তার সিনেমায় সিনেমেটোগ্রাফির উচ্চমার্গীয় উপস্থাপনার জন্য সিনেমার গুণগ্রাহীর অভাব পড়ে না। এক কথায়, বর্তমানে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও মার্কেটিং-এ ফারুকী বেশ কৌশলী।
অবশ্য বিশেষ ক্ষেত্রবিশেষ ছাড়া কোনো ইংরেজি সিনেমার নাম চাইনিজ, বাংলা বা অন্য ভাষায় দিয়ে তা ইংরেজিতে উচ্চারণ করে দেওয়ার মতো নজির আছে কি না, জানা নেই। তাই সিনেমার নামকরণে যে নতুনত্ব দেখা যাচ্ছে, তা সিনেমার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রশংসনীয় হলেও খুব উচ্চমার্গীয় বিষয় বলে মনে হয় না। বিষয়টা এমন যে, কেউ বাংলা সিনেমার নাম ইংরেজিতে দিতেই স্বস্তিবোধ করছেন; না হলে, কেনই বা আগে থেকেই ইংরেজি নাম নির্বাচন করতে হবে, এটা বোধগম্য নয়।