[আতিয়া হোসাইন (১৯১৩-১৯৯৮) ভারতীয় লেখিকা। তাঁর জন্ম উত্তরভারতের লাখ্নো শহরের তালুকদার বংশে। তিনি ইসাবেলা থর্নবার্ন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তার বিখ্যাত সৃষ্টির মধ্যে ‘ফোনিক্স ফ্লেড অ্যান্ড আদার স্টোরিস (১৯৫৩)’, ‘সানলাইট অন এ ব্রোকেন কলাম (১৯৬১)’ ও ‘কুকিং ইন্ডিয়ান ওয়ে (১৯৬৭ )’ উল্লেখযোগ্য। আতিয়া হোসাইন ভারত ও যুক্তরাজ্যের বেতার সম্প্রচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি লন্ডনের সেভয় থিয়েটারের ‘দ্য বার্ড অব টাইম’-এ অভিনয়ের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৪৭-এর ভারত বিভাগের ফলে সংঘটিত দাঙ্গার শিকার ‘বিবি’ নামের একটি বালিকার জীবনের করুণ পরিণতি ‘আফটার স্টর্ম ’গল্পে বিধৃত করেছেন। তার লেখা ইংরেজি ভাষার মূল গল্প থেকে বঙ্গানুবাদ করা হলো।— অনুবাদক]
সরু গলার বোতলের ফুলগুলো বিশ্রীভাবে দলা পাকিয়ে আছে। বোতলের গায়ের কাগজের লেভেলটা এখনো জ্বলজ্বল করছে। বোতলের গায়ে ধুলোর আস্তর। ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ। বাইরে প্রচণ্ড গরমের হল্কা বইছে। জানালার কাচে সবুজ কাগজ সাঁটা। প্রচণ্ড গরমের হল্কার মাঝেও থেকে থেকে পাশের বাগান থেকে ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। বাগানে সাদা সাদা ফুল ফুটে আছে। গাঢ় সবুজ পাতার মাঝে ফুলের পেলব পাপড়িগুলো উঁকি দিচ্ছে। সবুজাভ আস্তরণের মাঝেও তারা প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য যেন প্রাণন্তকর চেষ্টা করে চলেছে। প্রচণ্ড দাবদাহের মাঝেও ফুলের মালা বিক্রি করছে একটি ছোট মেয়ে। বাইরে ধূলিঝড় বয়ে চলেছে। চারদিকের চরম রুক্ষতার মাঝেও প্রাণের প্রবাহ থেমে নেই।
ছোট মেয়েটির হাতে ফুলের মালা। মেয়েটির চোখে এক ধরনের বিষণ্নতা। তার মাঝেও মুখে ম্লান হাসির রেখা । মেয়েটি মালা হাতে আমার দিকে এগিয়ে এসে ফুলগুলোর দিকে তাকালো।
আপনি এই মালাটা পছন্দ করেন? মালাটা আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, এটি আপনার জন্য এনেছি।
আমি মেয়েটার মুখের দিকে তাকালাম। সে মালাটা আমার পাশে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানতাম আপনি ঘরেই আছেন। আমি কি আপনার ঘরটা পরিষ্কার করে দেব?
তুমি কে?
আপনার চাকরাণী। আমাকে আপনার ঘরদোর দেখাশোনার দ্বায়িত্ব দেবেন? আমি আপনার সব কাজকর্ম করে দেব। সে গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বলল।
তোমার নাম কী?
বিবি।
তুমি কত দিন এখানে আছ?
অনেকদিন যাবত, শাহজীর মাজারের মেলার সময় থেকে । মেয়েটা অনুচ্চকণ্ঠে জবাব দিল।
এখন সবাই ঘুমোচ্ছে। আমি আপনার চা করে আনছি। আপনার গোসলের জন্য পানি তুলে দিচ্ছি।
বালতিটা খুব ভারী। তুমি কি পারবে?
পারব, কুয়ো থেকে পানি তোলার অভ্যাস আমার আছে ।
আমি মেয়েটার প্রকৃত বয়স আন্দাজ করতে পারলাম। শারীরিক গঠন নয় দশ বছরের মতো হবে। কিন্তু কথাবার্তা বয়স্ক মেয়ের মতো। অপুষ্টি ও অভাবের তাড়নায় হয়তো মেয়েটা ঠিক মতো বেড়ে উঠতে পারেনি।
হয়তো মেয়েটার প্রকৃত বয়স এগারো কিংবা বারো হবে। অভাবের তাড়নায় তার শৈশব অযত্ন আর অবহেলায় ঝরে গেছে।
রোজ মেয়েটা ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথে, আর রোজই আমাকে তা এনে দেয়। একদিন মেয়েটা বলল, মালার ফুলগুলো কী সুন্দর! আমাদের বাড়ির পাশে ফুলের একটা ঝোপ ছিল। আমি রোজ ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে মা আর চাচীকে দিতাম।
বলতে গেলে তখন থেকে মেয়েটা আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে গেল। তার হাতের সুন্দর আঙুলগুলোয় কড়া পড়ে গেছে। মেয়েটা তার অতীত জীবন সম্পর্কে আমাকে জানাতে উৎসুক। আমিও তা জানতে আগ্রহী। আমি একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কি ভাইবোন আছে? মেয়েটা জবাবে বলল, আমার বড় বোন বিয়ের পর স্বামীর সংসারে চলে যায়। সেখানে যেতে গরুর গাড়িতে একদিন লাগত। আমার একমাত্র ভাইটা আমার চেয়ে বড় ছিল। আমার ভাইটা লেখাপড়া জানত। ভাইটার বুদ্ধিসুদ্ধিও ভালো ছিল ।
হঠাৎ মেয়েটা আমাকে প্রশ্ন করল, আপনি আমাকে লেখাপড়া শেখাবেন?
মেয়েটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে। পুরনো শাড়ি কেটে দোপাট্টা বানিয়ে বয়স্ক মহিলাদের মতো মাথা ঢেকে চলাচল করতে সে পছন্দ করে। চুল পরিপাটি করে আঁচড়িয়ে মাঝ দিয়ে সিঁথি কাটে। যদিও সে কারও নজর কাড়ার মতো সুন্দরী নয়। সে যেন শুকিয়ে যাওয়া একটা ফুলের কুঁড়ি।
একদিন মেয়েটা বিষণ্ন কণ্ঠে বলল, আমার একজোড়া কানের দুল ছিল। ফসল ওঠার পর মা আমাকে একজোড়া সোনার বালা গড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন ।
আমি মেয়েটাকে একজোড়া কাঁচের চুড়ি কিনে দিলাম। একদিন মেয়েটা আমার চা বানিয়ে এনে বলল, আপনি ইংলিশ কেক পছন্দ করেন? আমার মা সুস্বাদু হালুয়া তৈরি করতেন। যদি তা খেতেন তবে তা আপনারও ভালো লাগত।
একদিন মেয়েটা হঠাৎ আমার কোলের কাছে এসে বসল। আমি আপনাকে ভালোবাসি আপনি আমাকে পাকাপাকিভাবে রাখবেন? সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল।
আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, বিবি, তুমি এখানে কেমন করে এলে? যদিও আমি জানতাম, সে যা বলবে তা দুঃখ আর বেদনায় ভরা।
মেয়েটা বলতে শুরু করল, আমি রেলস্টেশনে পড়েছিলাম। পুলিশ আমাকে সেখান থেকে যেখানে নিয়ে যায়, সেখানে একগাদা মহিলা ও শিশু গাদাগাদি করে বসবাস করছিল। আমি একদিন রাতে সেখান থেকে পালালাম।
কেন?
আমি জানি না ।
তোমার মার কী হলো? আমি জানতে চাইলাম। এবার মেয়েটার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। সে অস্ফুটস্বরে যা বলল, তা বড়ই মর্মান্তিক!
মার কী হলো আমি জানি না। সে সময় আমি চাঁদবিবির বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম।
চাঁদবিবি কে?
তিনি খুবই সাহসী মহিলা। তাদের বাড়িটা বেশ বড়সড়ো। আমি প্রায়ই তাদের বাড়ি বেড়াতে যেতাম। ওইদিনও গিয়েছিলাম। চাঁদবিবি গুণ্ডাদের সঙ্গে প্রাণপণে লড়ে কয়েকজন গুণ্ডাকে মেরে ফেলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গুণ্ডারা তার একটা হাত কেটে ফেলে।
তখন তোমার মা কোথায় ছিলেন?
বাড়িতে। আমাদের পাশের বাড়ি থেকে যারা পালিয়ে এলো, তারা বলল যে, আমাদের বাড়িতে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে গেছে। কেউ বেঁচে আছে কি না, কেউই বলতে পারে না। মেয়েটা কিছু সময়ের জন্য থেমে আবার বলতে লাগল, আমি কয়েকজনের সঙ্গে চাঁদবিবির বাড়ি থেকে পালিয়ে মাঠের মাঝে পৌঁছিলে একজন বলল, এদিকে এসো। আমি হাঁটতে পারছিলাম না। লোকটা আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে স্টেশনে পৌঁছে আমাকে একটা চলন্ত ট্রেনে তুলে দিল। ট্রেনে আমি কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছিলাম, তা বুঝতে পারলাম না। এক সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। জ্ঞান ফিরলে দেখলাম, আমি অন্য একটা স্টেশনে শুয়ে আছি। তারপর আমি কেমন করে এখানে এলাম তাতো আপনাকে আগেই বলেছি। মেয়েটা তার কথা শেষ করে মালা গাঁথতে মন দিল—দেখেন, মালাটা কত বড় আর কত সুন্দর! দু‘প্যাচ দিয়ে আপনি এটা গলায় পরতে পারবেন। কথাটা শেষ করে সে মালাটা আমার হাতে দিল ।