অরণি—উপন্যাসের শুরু ঢাকা নগরীর গ্রাভিটিশূন্য আকাশের বর্ণনা দিয়ে, যে আকাশ যন্ত্রের মতো ঝুলে আছে দৃষ্টির সীমানায়, স্থবির এবং বিশালাকার এক শূন্যতার ইঙ্গিত ধারণ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চার দশক পরের ঢাকা নগরীর চিত্র ধরা পড়ে লেখক মোজাম্মেল হক নিয়োগীর ক্যানভাসে। এই ঢাকায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি, মানুষ আর মানুষ। রাস্তা চাপমারা, ভরা। গাড়ি চলে না। ‘গাড়ির ভেতরে মূর্তির মতো মানুষেরা অস্থিরতায় হাঁসফাঁস করে আর সামনের দিকে তাকিয়ে বলে কখন যানজট থেকে মুক্তি মিলবে।’ রাজধানী ঢাকা নগরী এভাবে যানজটবন্দি লেখকের বর্ণনায়। স্থিতিজড়তা এই নগরীকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে, এর কোনো গতি নেই। গতি নেই ঢাকা নগরীর আকাশের, সে আকাশ গ্রাভিটিশূন্য। সাবেরা এই নগরীরই উঁচু এক অফিস ভবনের নিচে, দুহাতি গ্রিলের পাশে খড়বিছালির বিছানায় পাখির মতো আস্তানা খুঁজে জীবনযাপন করে। তার বয়স যখন আট-নয় বছর ছিল, মা-বাবাকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী-রাজকাররা। সাবেরা তখন থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী-ছিন্নমূল। সে কর্মক্ষম নয়, নির্বাক অথবা স্বল্পবাক। তবে লজ্জা নিবারণের ব্যাপারটা বুঝতে পারে।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মানুষ চিকিৎসা পাওয়ার আশায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকা নগরীর ব্যবসায়িক হাসপাতালের সামনে আসে, দালাল-বাটপারের খপ্পরে পড়ে, বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। চরম হতাশা ও অপমান-লাঞ্ছনায় তার আত্মীয় পরিজন নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়ে গ্রামে ফিরে যায়। গুণ্ডা-মাস্তান-লুটেরা-মাদকাসক্ত ও ভাসমানদের দখলে এই ঢাকা নগরীর একাংশ। গ্রাম থেকে আসা দুর্ঘটনায় আহত রোগী মারা যায় বিনা চিকিৎসায়, তার সহযোগী ভাই-বন্ধু মফিজ ও নূরুল ইসলাম হয়ে দাঁড়ায় গ্রাম বাংলার সরল মানুষ ও মানবতাবোধের প্রতীক, যার বিপরীতে চিত্রিত দেখি খুনি-লুটেরা-লম্পট-প্রতারক হাতকাটা জব্বারের ছবি, ঢাকা নগরীর সমকালীন চরিত্রহীনতা নিয়ে স্ব-মূর্তিতে উপস্থিত পাঠকের দৃষ্টির সম্মুখে। লেখকের কলমের খোঁচায় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের কষাঘাত নতুন মাত্রা লাভ করে, যখন দেখি হিরোইনখোরদের বিনামূল্যে নতুন সিরিঞ্জ ও সূঁচ সরবরাহ করতে আসে তথাকথিত মানবতাবাদী এনজিও ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো!
রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের রাজধানীতে আছে চোরের ওপর বাটপার, বাটপারের ওপর লুটেরা ও খুনি, লুটেরা ও খুনির ওপর আছে পতিতভূমি দখলদকারী ক্ষমতাবান মো. আকবর হোসেন, যিনি একজন জনদরদি রাজনৈতিক নেতাও বটে। যার প্রাসাদতুল্য বাসভবনের লাগসই নাম ‘শান্তিনিবাস’। ‘অরণি’র লেখকের স্যাটায়ারধর্মী আক্রমণের বেত্রাঘাত অবশ্যম্ভাবী রেখাপাত করে দেশের এই জাজ্জ্বল্যমান ক্ষতের দিকেও।
কাগজ-কুড়ানো টোকাইদের জীবনচিত্র ফুটে ওঠে উপন্যাসের পৃষ্ঠা ২৬-এর একটি বর্ণনায়—‘‘অপুষ্টিতে আক্রান্ত, বুকের পাঁজর ভাসা, শীর্ণ-দীর্ণ, রুগ্ণ শিশুদের কোটরাগত দুচোখ এবং চোয়ালভাঙা মুখে ক্লান্তি-ক্ষুধা-অবসাদের দুঃখময় ছায়া পরিব্যাপ্ত। মা-বাবার আচরণে মনে হয় ওদের জন্ম দেওয়া হয়েছে মা-বাবাকে রোজগার করে খাওয়ানো-পরানোর জন্যই। এদের মধ্যে মনসুরার ঘরের তিনটি ঘর থেকে পুব দিকের ঘরের এক কোণে দেখেই তার মা এমনভাবে চেঁচিয়ে উঠল যে, শিশুটি আতঙ্কে ঘরের এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে যেন বা বাঁচার আকুতি করে-এমন অভিব্যক্তি তার চোখেমুখে ব্যাপৃত হলেও তার মায়ের ক্রোধ যেন বা ফেনিয়ে ওঠে এবং মুহূর্তে মায়ের কাছে থাকা একটি চেলাকাঠ দিয়েই শিশুর পিঠে ধুমধাম কয়েক ঘা মেরে বাজখাঁই গলা ছেড়ে বলে, ‘হারামজাদা পোলা, এই কয়ডা কাগজ টুকাইলি হারা দিনে? খাওন কইতে আইয়ে, অ্যাঁ। খাওন কইতে আইয়ে? চেলাকাঠের বাড়ি খেয়ে শিশুর পিঠ ধনুকের মতো বেঁকে যায় এবং ভয়াতঙ্কে চিৎকারে কাঁদতে শুরু করলেও ক্ষণকাল পরেই আর তার কান্নার শব্দ শ্র’ত হয় না, গলা শুকিয়ে কাঠ। তার বিকট চিৎকারই তার সাথীদের কানে পৌঁছেছে; তাদের বুকের ভেতরেও হৃদযন্ত্রে কাঁপন অনুভূত হয় এবং নিজ নিজ ঘরের মধ্যে অপরাধীর মতো নেতিয়ে পড়ে থাকে।’’
প্রোটাগোনিস্ট মুসলেম খলিফা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। সে মানবতার পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধেরও পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো মানবতার চেতনাই। তার কাজ টুকিটাকি ছেঁড়া কাপড় সেলাই করা, বস্তির নারীদের ব্লাউজ, ছোট বাচ্চাদের জামা তৈরি করা। এই মুসলেম খলিফা সাবেরার মুখাবয়বে নিজ মাতা ও দেশমাতার প্রতিকৃতি দেখতে পায়। সে সাবেরাকে ‘মা’ বলেই সম্বোধন করে, বাড়িতে নিয়ে এসে খেতে দেয়, অসুখবিসুখে থাকতে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের প্রতি সহানুভূতিশীল লেখক মুসলেম খলিফার মধ্যে সেই মহান ত্যাগের আদর্শ ফুটিয়ে তোলেন, তাদের বিপন্ন শারীরিক অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র উপস্থাপন করেন। লেখক মুসলেম খলিফার মধ্যে আবিষ্কার করেন বিপন্ন মুক্তিযোদ্ধার চেতনা। একইসঙ্গে আশাহত, ক্লান্ত-ব্যর্থ-মুখ থুবড়ে পড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক, ‘ক্রাচে ভর করে ধীর লয়ে হাঁটে মুসলেম, যে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ডান পা হারিয়েছে, তখন সে বীর ও বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও এখন সংসার, রাষ্ট্রের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে পরাজিত এক মানুষ। হাঁটতে হাঁটতে সে সাবেরার পাশে এসে দাঁড়িয়ে একবার তার দিকে তাকায়; তাকে নিদ্রামগ্ন দেখে দীর্ঘশ্বস ফেলে আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। বাসায় ফেরার পথে মাঝে মাঝে সাবেরাকে সজাগ দেখতে পেলে জিজ্ঞেস করে, মা খেয়েছ? সমীহ ও শ্রদ্ধাভরা সাবেরার উত্তর, ‘হে খাইছি।’ আবার যেদিন না খায় সেদিন বলে, ‘না, খাই নাই।’ সেদিন মুসলেম খলিফা তাকে দশটি বা বিশটি টাকা দিলে সাবেরা হাত পেতে নেয়। সাবেরার সঙ্গে তার কোথায় যেন একটা নাড়ির টান আছে, তা মুসলেম নিজেকে প্রশ্ন করেও খুঁজে পায় না। মুসলেম খলিফার সাথে তার স্মৃতিও আজ বিদ্রোহ করেছে—বিস্মরণ, সব বিস্মরণ; মনে মনে বলল, কই যেন দেখছি মাইয়াডারে?’
এই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনার শত্রুরা সর্বত্রগামী। হাতকাটা লুম্পেন-লুটেরা-চরিত্রহীন জব্বার এর শত্র; খাসজমি দখলকারী ঠিকাদার আকবর হোসেন এর শত্রু; জনদরদি রাজনৈতিক নেতার আবরণে গরিবের ভোট-ক্রেতারা এর শত্রু; ধর্মের ধ্বজাধারী ফতোয়াবাজরা এর শত্রু। ওরা বাংলা নববর্ষকে না-জায়েজ ঘোষণা করে রমনার অনুষ্ঠানে বোমা ফাটায়। একদিন লুম্পেন হাতকাটা জব্বার সরাসরি মুখোমুখি হয় পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা মুসলেম খলিফার। জব্বার তার মুখের আকার বিকৃত করে, তার চোখ থেকে আগুন বের হবার উপক্রম; তারপর মুসলেম খলিফাকে সে জিজ্ঞেস করে,
‘আমারে কাডা পাও দেহাও? মানে কী? তুমি কি আমারে ভয় দেহাও?’ মুসলেম খলিফা উত্তর দেয়, ‘মানে কিছু না। পাকিস্তানি আর্মির এলএমজির গুলি লাগছিল। মরি নাই। শুধু একটা পাও গেছে, জান যায় নাই।’
‘অতপর মুসলেম স্বস্তিবোধ করে যে, এইসব কীটপতঙ্গের কাছে সাহসের সঙ্গে তার মনের কথাটা জানাতে সক্ষম হয়েছে। সে মনে মনে বলে, এত পঙ্গপাল দেশে, কে তাড়াবে ওদের? মুসলেম দেখতে পায় মাঠভরা সোনালি শস্য পঙ্গপাল এসে নষ্ট করে দিচ্ছে আর অসহায় চাষি বিস্ময়াহত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে!’
উপন্যাসের উপসংহার আসে ঝোড়ো নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে। সাবেরা জানতে পারে যে তার পরনের শাড়িটির দাতা একজন স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার। সাবেরার মানসিক প্রতিবন্ধিত্বের বন্ধনাবস্থা হঠাৎ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সাবেরা মনে করে যে তার পরনের শাড়িটা যেন একটা বিষাক্ত শঙ্খচূড় সাপ, যে তাঁকে পেঁচিয়ে রেখেছে। তার শরীর ও মন একযোগে মোচড় দিয়ে ওঠে। দ্রোহে, ক্ষোভে, প্রতিবাদে হঠাৎ বদলে যায় সাবেরা।
‘সাবেরা অরোধ্য যন্ত্রণায়, বিমর্ষতায়, কষ্টে নীল হতে থাকে এবং ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে, কাঁপতে থাকে এবং হাত-পা সঞ্চালন করতে থাকে। এই বাঁধহীন ক্ষোভ আর প্রচণ্ড ঘৃণার অগ্নিলাভা যেন তার বুক চিরে বের হতে থাকে অপ্রতিরোধ্য ধারায়। ঠোঁট দুটি কাঁপছে…কিছু বলতে চায়…কিন্তু কিছুই বলতে পারে না…তার সৌম্য নারীমূর্তি ইত্যবসরে অগ্নিমূর্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং সে যা করতে চাইছে তাও করতে পারছে না। এমতাবস্থায় উটকো লোকটি যেমন আশ্চর্য হয়, ঠিক তেমনি আঞ্জু, জব্বার ও আশপাশের আরও কয়েকজন হতবাক হয়ে সাবেরা কী করতে চায়, তা দেখার জন্য অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। ক্রোধ আর আক্রোশে সে গোঙায়। কিছুক্ষণ পরে তার এই কুপিতমূর্তি ভেঙে খান খান হয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই সে নিজের পরনের শাড়িটি হেঁচকা টান দিয়ে নিজের শরীরকে অনাবৃত করে এবং রাস্তা পেরিয়ে আস্তে আস্তে মুসলেম খলিফার দোকানের দিকে এগিয়ে যায়।
এই দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হলে জব্বারের শরীরও ঘামতে থাকে। আঞ্জু ও উটকো লোকটির শরীরও ঘামতে থাকে। রাস্তার পাশে মানুষগুলো হতবিহ্বল হয়ে পড়ে।
জব্বার সাবেরার পেছনে পেছনে এগিয়ে যায়। রাস্তার সমস্ত মানুষ সাবেরার শরীর থেকে চোখ তুলে নিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি রাখে। জব্বার তাকে অনুসরণ করে পায়ে পায়ে। এইক্ষণে আঞ্জুও তার দোকানের ক্যাশে তালা মেরে সাবেরার হেঁটে যাওয়া পথে এগিয়ে যায়। উটকো লোকটিও সাবেরাকে লক্ষ করে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। রৌদ্রদগ্ধ আকাশ কাঁপছে, বাতাস কাঁপছে, মাটি যেন কাঁপছে। ফেটে যাচ্ছে এইরূপ অনুমিত হয় আঞ্জু, উটকো লোকটি ও জব্বারের কাছে।
সাবেরা মুসলেম খলিফার দোকানে গিয়ে দাঁড়ায় এবং তাকে লক্ষ করে বলে, ‘আমারে একটা কাপড় দেও।’
মুসলেম সাবেরাকে এক পলক দেখামাত্র দ্বিধাগ্রস্ত, হতভম্ব ও অনেকটা জ্ঞানশূন্য হয়েই তার দুচোখ মাটিতে নিবদ্ধ করে বলে, ‘দাঁড়াও মা, তোমারে কাপড় দিতাছি।’
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ একটি বিশালাকার বাংলাদেশের পতাকার ফরমায়েশ দিয়েছিল মুসলেম খলিফাকে কিছুদিন আগে। সেটি গতকালই তৈরি হয়েছে। মুসলেম খলিফা হাতের কাছে সেই বিশালাকার পতাকাটি পেয়েই সাবেরার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাও মা, তোমার কাপড়।’
দাঁড়িয়ে থাকা জব্বার এই দৃশ্য লক্ষ করে এবং তার শরীর থেকে পূর্ববৎ ঘাম ঝরতে থাকে দরদর করে। সে পুনরায় সাবেরাকে অনুসরণ করে। সাবেরা ক্ষিপ্র গতিতে দৃপ্ত পায়ে দৃঢ়তার সঙ্গে অনিরুদ্ধ অগ্নিমূর্তির মতো বস্তি পার হয়ে আকবর হোসেনের বাড়ির গেটে গিয়ে স্থির হয়, তার চোখ দুটিও ক্ষিপ্র ও ‘সে চক্ষুদ্বয় থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যেন বা ঠিকরে পড়ছে, সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী যেন দেখে; না কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অতপর প্রচণ্ড ঘৃণায় দুর্দণ্ড প্রতাপে সে আকবর হোসেনের বাড়ির দেয়ালে কয়েকবার থুথু ছিটায়। বিড়বিড় করে বলে, রাজাকার, হারামজাদা রাজাকার। সাবেরার চোখ থেকে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হয় তা যেন বেগবান দাবানলে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। বস্তির আশেপাশে থেকে মানুষের এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে, তাদেরও চোখমুখ দীপ্তিময় হয়ে ওঠে। দৃঢ়চেতা সাহসী মানুষেরা যেন বা পরাক্রমশালী হয়ে এগিয়ে আসতে থাকে সাবেরার দিকে। কোনো অন্ধকার রাতে উল্কাপিণ্ড যেভাবে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে, তাদের দেখে মনে সেভাবে উল্কাপিণ্ডের মতো অপ্রতিরোধ্য ধারায় ধাবমান এবং তাদের উজ্জ্বল দৃষ্টি সাবেরার দিকে নিবদ্ধ।
তার চোখে ভেসে আসে চারদিক ছাপিয়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের সবুজ-শ্যামল বাংলা। সাবেরার সঙ্গে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত বৃক্ষপল্লবের অগাধ সবুজের গহিনে ডুবে যাচ্ছে সমস্ত মানুষ, ঘরবাড়ি, দালানকোঠা, রাস্তাঘাট এবং এই ব্যস্ত শহর…সবকিছু মিশে যাচ্ছে তরঙ্গায়িত সবুজের সমুদ্রে। মুহূর্তের মধ্যে তার মনে হলো, এই শহরটি একটা সবুজসমুদ্রে পরিণত হয়েছে এবং সেই সবুজসমুদ্রের তলহীন গভীর থেকে কম্পমান ঊর্মিমালার সঙ্গে কাঁপতে কাঁপতে সাবেরা একটা সূর্যের মতো আস্তে আস্তে ভেসে হয়ে উঠছে অনন্ত আলোকধারার অনিভন্ত অগ্নিগোলা।
সাবেরা হাঁটছে, তাকে ঘিরে বস্তির শত শত মানুষও; একটি মিছিলের মতো দেখাচ্ছে, এমন মিছিল সে দেখেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর; তার চোখ দুটি আনন্দোচ্ছলতায় কাঁপতে থাকে, চোখের পলক দ্রুত পড়তে থাকে এবং কিছুক্ষণ পর তার চোখের কোনা থেকে উদগত অশ্রুবিন্দুগুলো দানা বেঁধে গণ্ড বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে। তার গণ্ডদ্বয় বেয়ে গড়িয়ে পড়ে বিগলিত অশ্রুধারা আর মুখে উদ্ভাসিত অপূর্ব মোহনীয় উজ্জ্বল স্মিত। তার চোখ দুটি মুহূর্তে বৈশাখের রৌদ্রের মতো ঝলমল করে এবং আনন্দ আবেগে বৈশাখের অশান্ত ঝড়ের মতো তার বক্ষপিঞ্জর আন্দোলিত করে….।’
‘অরণি’ উপন্যাসের ৬৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ অথবা ঝোড়ো তাণ্ডবের ভাষা মানবিক আবেগের সঙ্গে নৈসর্গিক মিথস্ক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ। মর্ত্যের মানুষ যখন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, তার চারদিকের প্রকৃতি তখন নীরব দর্শক হয়ে থাকে না। লেখক মোজাম্মেল হক তাঁর এ উপন্যাসে এই সত্যই তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটির বহুল প্রচার কামনা করি।
অরণি
লেখক: মোজাম্মেল হক নিয়োগী
প্রচ্ছদ: হাশেম খান
প্রকাশক: সাকী
প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ২০১১।
মূল্য: ১০০ টাকা।