ফররুখ আহমদ—বাংলা সাহিত্যের স্বাপ্নিক কবি। একটি সোনালি সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বহু কবিতার চরণে চরণে নির্মল স্বপ্ন বুনেছেন। সুস্থ সুন্দর সমাজ জীবনের স্বপ্নে বিভোর কবি ফররুখ আহমদের পাশাপাশি ইংরেজ কবি পি বি শেলি ও জন কিটসের কাব্য জগতে প্রাসঙ্গিক কারণে অল্পবিস্তর বিচরণ করা যায়।
শেলির ‘ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড’ কবিতাটি তাঁর কাব্যসাধনার মূল বিশ্বাসের প্রতিনিধি। এর সঙ্গে ফররুখের ‘বৈশাখ’ কবিতার সাযুজ্য রয়েছে। কবিতার শুরুতেই শেলি ‘ওয়েস্ট উইন্ড’কে সম্বোধন করেছেন ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট উইন্ড’ বলে। ফররুখ বৈশাখকে বলেছেন ‘দুর্বার দুর্ধর্ষ বৈশাখ’। এখানে, ‘উইন্ড’ কিংবা ‘দুর্ধর্ষে’র সঙ্গে ভাঙচুর বা ধ্বংসলীলার যোগসূত্র রয়েছে। তাই দুজনের উভয় কবিতার চরণে চরণে ভেঙে ফেলার, গুঁড়িয়ে দেওয়ার কিংবা সমূল বিনাশের প্রবল প্রমত্ততা লক্ষ করা যায়। শেলি তার ‘ওয়েস্ট উইন্ড’কে ‘ডেসট্রয়ার’ (আবার ‘প্রিজারভার’ও বলেছেন) বলে আখ্যায়িত করেছেন। যার ধ্বংসলীলার সীমানায় মৌসুমের শুকনো, হলুদ, বিবর্ণ পলকা ‘ডেড লীভস’, নিষ্প্রাণ পাতা। যার দুর্নিবার প্রবাহে গভীর আকাশে প্রচণ্ডতার সৃষ্টি হয় এবং মেঘ চুয়ে পড়ে বৃষ্টি। গ্রীষ্মে ভূমধ্যসাগর যেন ঘুমিয়ে থাকে তার স্ফটিকস্বচ্ছ স্রোতধারার মধ্যে। কিন্তু আটলান্টিকের প্রশান্ত ঢেউয়ের বুক বিদীর্ণ করে নিজের পথ করে নেয় ‘ওয়েস্ট উইন্ড’। ভয়ে বিবর্ণ হয়ে ওঠে সমুদ্রের সগভীর তলদেশে লুকিয়ে থাকা ফুল ও পাতা। এমনি অনিঃশেষ এবং অপ্রতিরোধ্য এই দুর্বার পশ্চিমা বাতাস।
‘বৈশাখ’ কবিতায় ফররুখ বৈশাখকে সম্বোধন করেছেন ‘ধ্বংসের নকীব’ বলে। যা ‘প্রলয়ের ডাক’ দিয়ে যায়। ‘বিজয়ী বীরের মতো’ যার আবির্ভাব। যে নাড়া দেয় গ্লানির ‘দুঃসহ জীবনের’ ‘পুঞ্জিভূত হতাশায়’ ‘লক্ষ্যহীন বিভ্রান্ত জীবনে’। মুক্ত করে বিশ্বে ত্রাণের সরণী:
ওড়ায়ে বিশাল ঝান্ডা শক্তিমত্ত প্রাবল্য প্রাণের
সকল প্রাকার, বাধা, চূর্ণ করি মুক্ত কর পৃথিবীতে সরণী ত্রাণের।
‘বজ্রের আগুনে দীপ্ত’ বৈশাখ ‘ভ্রষ্ট, গোমরাহা’ ‘নির্বোধের অহমিকা’ ‘শূন্যগর্ভ দম্ভ, আস্ফালন’ চূর্ণ করে দেবে। ধ্বংস করবে ‘বাতিলের দূর্গ’। ‘কালের কুঠার’ রূপী এই বৈশাখ ‘পৌত্তলিক জড়তার’ অবসান ঘটাবে। প্রমত্ত দরিয়ার বুকে ‘ক্ষণিকের মৃত্যু মহোৎসবে’ ‘হাজার কিশতি লক্ষ ডিঙি’ ডুবিয়ে দিয়ে যাবে দুর্জয় বৈশাখ। ধ্বংস প্রমাদে সত্যি ভেদাভেদহীন:
পিষে ফেলে যাও সব রাজ্য, রাজধানী, গ্রাম, জনপদ, মাঠ;
আল্লার আলমে তুমি মর্দে মুজাহিদ, বীর সমুন্নত প্রদীপ্ত ললাট।
বৈশাখ ‘সম্পূর্ণ আপসহীন’। তার প্রবহমানতা সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী। ‘ওয়েস্ট উইন্ড’-এর মতোই অপ্রতিরোধ্য। যার অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী জীবনে আনে ‘অবিচ্ছিন্ন অব্যাহত গতি’। সেই প্রচন্ড ‘গতিবেগে ভাঙে, ভাঙে দুর্গ, আবদ্ধ প্রাকার’। উড়ে যায় ‘স্থবির জড়তা, ক্লেদ’।
ফররুখ আহ্বান করেছেন বৈশাখকে তার কণ্ঠ বিশ্বময় পৌঁছে দিতে:
শুনুক সমগ্র বিশ্ব তোমার প্রবল কণ্ঠ হে দুর্জয় সত্যের সৈনিক!
শুনুক সভয়ে যত আত্মরতিমগ্ন প্রাণ-জড়তায় নিস্বব্ধ নির্বাক।
একইভাবে শেলি ‘ওয়েস্ট উইন্ড’-এর প্রবল উদ্দীপনাকে নিজের মধ্যে একাকার করে দিতে চান। সেই ‘ফিয়ারস্ স্পিরিট’ যেন পুরনো, জড়বৎ অসাড় ধ্যান-ধারণা (তিনি যাকে বলেছেন, ‘ডেড থটস্’) সমাজ থেকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন শুকনো পাতার মতো। তারপর একটি সুখী বিশ্বের নবজন্ম ত্বরান্বিত করতে চেয়েছেন:
Drive my dead thoughts over the universe,
Like withered leaves to quicken a new birth.
পাশাপাশি ফররুখ নতুনের স্বপ্ন দেখেছেন এভাবে:
হে বিশীর্ণ পুরাতন আলবিদা জানাই তোমাকে,
নতুনের স্বপ্ন জাগে মৃত্যুম্লান পৃথিবীতে রৌদ্রদগ্ধ বৈশাখের বাঁকে।
প্রকৃত অর্থে, পুরাতনের ধ্বংসস্তূপ বা ভগ্নস্তূপের ওপরই নতুনের সগর্ব অবস্থান। তাই শেলি ও ফরুরুখ অজস্র ভাঙচুরের ওপরই নির্মাণ করতে চেয়েছেন সুখী সমৃদ্ধ নতুন এক বিশ্বের অনড় কাঠামো।
শেলি তাঁর কাঙ্ক্ষিত বিশ্ব গড়ার জন্য ‘ওয়েস্ট উইন্ড’-এর অপরিমেয় শক্তির সাহায্য কামনা করেছেন তেমনি ফররুখ অন্যত্র তাঁর ‘তাজি’ কবিতায় ইসলামের বিজয়ের ইতিহাসকে স্মরণ করে কালের লবণাক্ত সমুদ্রের দুর্গমতার ওপর দিয়ে ইসলামী চেতনারূপী ‘সাদা তাজি’কে বিজয়ীর বেশে ছুটে যেতে চেয়েছেন। আর তীব্র গতি সম্পন্ন দুর্নিবার তাজিকে (আরবীয় অশ্ব, ‘তাজি’ কবিতায় সাদা পাল তোলা জাহাজ) তার বিজয় দৃপ্ত মহাযাত্রা অব্যাহত রাখার কথা বলেছেন:
পার হয়ে ম্লান জুলমাত ঘেরা
পারে নিয়ে যাবে ভাসমান এই ডেরা
দরিয়ার সাদা তাজি
সরনদ্বীপের ঘাটে নোঙর ফেলবে আবার মাঝি।
লক্ষণীয়—শেলি সমাজের জঞ্জাল দূর করে সম্পূর্ণ নতুন সোনালি বিশ্ব নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন আর ফররুখ একটি সমৃদ্ধ অতীত এবং সোনালি ঐতিহ্য ক্রমাগত উচ্চকিত করার কথা উচ্চারণ করেছেন। এখানে উভয়ের সাদৃশ্যের ব্যাপারটি একটি সুন্দর সাবলীল বিশ্বের স্বপ্নের সঙ্গে একাকার।
জন কিটস্ রোমান্টিক ও পলায়নবাদী (এসকেপিস্ট) কবি। প্রেমিকার অবহেলা, ক্ষয়রোগে ছোট ভায়ের মৃত্যু এবং বৈরী পারিপার্শ্বিকের কারণে পার্থিব জগৎ সম্পর্কে কিটস্-এর ভেতর নৈরাশ্য কিংবা পলায়নবাদী মনোভাব আসে।
‘ওড টু অ্যা নাইটিংগেল’ কবিতায় কিটস্ নাইটিংগেলের সুমধুর গানে অপার আনন্দ অনুভব করেছেন। সুরের অকৃত্রিম সম্মোহনে তার আনন্দ পরিণত হয়েছে আনন্দপূর্ণ বেদনায় (Joyous pain)। সুরের প্রাবল্যে তন্দ্রালুতায় পেয়ে বসেছে তাকে। তিনি মিশে যেতে চেয়েছেন নাইটিংগেলের সত্তায়। উড়ে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন তার সঙ্গে তার নিজস্ব জগতে—ছায়াচ্ছন্ন, আবছা, মায়াময় বনভূমির গভীরে। যেখানে বাস্তব জীবনের অবসাদ, জরা, অস্থিরতা ও উদ্বেগ নেই, ব্যথিতের আর্তনাদ নেই। নেই যুবকের ক্রমে ক্রমে বিবর্ণ বিশীর্ণ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। যেখানে হতাশার ভারে আনত চক্ষু নেই, সৌন্দর্য ও ভালোবাসার নেই দ্রুত বিলয়। এইসব পার্থিব দুঃশ্চিন্তা, দুর্দশা নাইটিংগেলকে স্পর্শ করে না। ছায়া-নিবিড় সুগভীর বনভূমির মধ্যে তাই সে পরিপূর্ণ মুক্ত কণ্ঠে গান গেয়ে যেতে পারে:
Of beechen green, and shadows numberless,
Singest of summer in full-throated ease
এই গান চির অমর। যুগে যুগে সেই সুদূর অতীত হতে এই অমর পাখির (ইম-মরটাল বার্ড) গান শুনে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সুরের অমিয় রস-সুধা পান করে আনন্দ অনুভব করে আসছে কালে কালে।
‘নাইটিংগেল’-এর মতো ফররুখের ‘ডাহুক’ কবিতায় ডাহুকের ডাক নিস্তব্ধ নীরবতার মাঝে ক্রমাগত ভেসে আসে:
সামুদ্রিক অতলতা হতে মৃত্যু-সুগভীর ডাক ভেসে আসে,
ঝিমায় তারার দ্বীপ স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাশে আকাশে।
ফররুখের ডাহুক নিবিড় বনের ‘সজাগ প্রহরী’র মতো যে ‘চেতনার পথ’ ধরে চলে। ডাহুকের ‘অশরীরী সুর’ যেন বিষাদ-মথিত। তার ‘অপরূপ সুর’ যেন ‘অফুরান সুরা’ যা কাঁদায় ‘রাত্রির কিনার’। ‘যার ব্যথা-তিক্ত রসে জমে ওঠে বনপ্রান্তে বেদনা দুঃসহ’। কিটসের নাইটিংগেলের মতো ফররুখের ডাহুকও মুক্তকণ্ঠে গান গেয়ে যায়:
রাত্রির অরণ্যতটে হে অশ্রান্ত পাখি!
যাও ডাকি ডাকি
. অবাধ মুক্তির মতো।
কারণ, কঠিন বাস্তবতার শিকলে সে শৃঙ্খলিত নয়। মানুষের মতো ‘ভারানত’ নয়। ‘ম্লান কদর্যের দলে’ও সে নয়। তাই সে ‘শৃঙ্কলমুক্ত পূর্ণচিত্তে জীবন মৃত্যুর / পরিপূর্ণ সুর’ কণ্ঠে ধারণ করে সেই ‘মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক’ বুক পূর্ণ করে, রিক্ত করে অমন গাইতে পারে। যার ডাক জাগতিক সমস্ত দুঃখ বেদনা জরাজীর্ণতা ক্ষণিকের জন্য হলেও নিথর করে দেয়:
ডাহুকের ডাক…
সকল বেদনা যেন, সব অভিযোগ যেন
. হয়ে আসে নীরব নির্বাক।
কিটস্ পাখির গানে আনন্দের আতিশয্যে যন্ত্রণাহীন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। কারণ, নাইটিংগেলের সুরে মোহিত বনভূমির মধ্যকার এই স্বর্গীয় আনন্দময় পরিবেশই মৃত্যুর জন্য যথার্থ সময় (‘rich to die) মনে করেছেন। তার গান সমস্ত বেদনাকে হরণ করে বিভীষিকাময় মৃত্যুকের বেদনাহীন ও সুখময় করে তুলতে পারে। কিন্তু ফররুখের ডাহুকের ডাক বিষাদময়তা ছড়িয়েছে সবখানে। ফররুখ যেন এমন এক বৈরিতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ, যেখানে তিনি ডাহুকের মতো করে নিজের একান্ত সুর তুলে ধরতে পারেন না, কারণ:
ভারানত
আমরা শিকলে,
শুনিয়া তোমার সুর, নিজেদেরি বিষাক্ত ছোবলে
তনুমন করি যে আহত।
ফররুখ ডাহুকের সুখের গানের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়েছেন, যে কিনা জীবনের দুঃখ, দুর্দশা ও উদ্বেগের বাইরে। তেমনি ঈর্ষা প্রকাশ করেছেন কিটস নাইটিংগেলের প্রতি। দুঃখ মানুষের জীবনে বর্তমান। কিন্তু ডাহুক, নাইটিংগেল কিংবা স্কাইলার্ক—এদের জীবনে তেমন নয়। তাই শেলি তার স্কাইলার্ককে, ঈর্ষান্বিত হয়ে বলেছেন:
Our sweetest songs are those that tell of our saddest thoughts.
ফররুখের ‘দুর্ধর্ষ বৈশাখ’, ‘সাদা তাজি’র অপ্রতিরোধ্য গতি, ডাহুকের অশ্রান্ত মোহময় সুর, শেলির ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট উইন্ড’, এবং কিটসের অমর পাখি নাইটিংগেলের অমিয় সুর-ঝংকারে মানব জাতির জীবনে সোনালি দিনের আগমনী ধ্বনিত হোক যুগে যুগে।