এক
বসন্ত,
তোর সঙ্গে আমার জনম—জনমের দূরত্ব। কিছু দূরত্বকে মেনে নেওয়া যায়, স্বাভাবিক নিয়মে মানতে হয়। কিছু দূরত্ব বুকের ভেতরে খচখচ্ করে ওঠে, ঘুমের ভেতরেও ঘোড়ার খুরের মতো আওয়াজ তুলে ছুটে যায়। কোথায় যায়, কতদূরে? তার কি কোনো শেষ নেই! দূরত্বের তো একটা সীমানা থাকতে হয়, তাই না? দূরত্বেরও তো লিপিবদ্ধ একটা নিয়ম থাকতে হয়! এই যে, ঋতু আসে ঋতু যায়—কতকিছুই তো বদলায় সঙ্গে সঙ্গে। প্রকৃতির রঙ বদলায়, পাতারা ঝরে পড়ে—জন্মায় নতুন পাতা। রাস্তার রং বদলায়—কখনো ধুলো, কখনো ভেজা মাটির পথ। বাতাস তার গন্ধ বদলায়, তার রং—রস—গন্ধ সব বদলায়। আর মানুষ বদলায় রূপ।
বসন্ত,
সবই কি নিয়মেই বদলায়, না কি অনেক অনিয়ম নিয়মকে ভেঙে চুরে আরেক রূপের ভেতরে পুরে দিয়েছে। অনেক অনিয়মই তো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেগুলো তো একসময় নিয়ম ছিল না। ঘোর অনিয়ম ছিল, তাই না বসন্ত? তবে এই যে, কোনো কোনো জীবনের নিয়ম, একটু অনিয়মে গেলে খুব কি ক্ষতি হতো? খুব কি পরিবর্তন হতো— প্রকৃতির বা মানুষের? ক্ষতি হতো প্রকৃতির কিংবা ঈশ্বরের? কারোই হয়ত খুব বেশি ক্ষতি হতো না, তাহলে? তাহলে এ—এক ধরনের নিষ্ঠুরতা। কোনো কোনো জীবনের জন্যে ঘোর অবিচার। অবিচার কোনো নিয়ম বা বিধান মানে না। অবিচার সম্পূর্ণ নিষ্ঠুর এক নিয়ম।
বসন্ত,
সব দূরত্বই কি এমন নিষ্ঠুর হয়? আমাদের এই নিষ্ঠুর দূরত্ব কি কোনোভাবেই ঘোচানোর নয়!
দুই
অতনু,
তোকেই লিখতে চেয়েছিলাম সব। কিন্তু তোকে যা কিছু লিখি, তার ওজন অনেক বেশি হয়ে যায়। এত বেশি ওজন বয়ে নেওয়ার শক্তি অন্তরের আর হয়ত নেই। যত অবহেলায় গড়িয়ে চলেছে জীবন, চলুক। কিন্তু এসব থেকে অন্তরকে বাঁচানোর দায়ও যে এড়ানো যায় না। আমার অন্তর, সে যে শুধু আমার জন্যেই, তাকে অবহেলা করাটা খুব অন্যায় মনে হয় নিজের কাছে। তার কোনো যত্ন আমি নিতে পারিনি কখনো, আনন্দ দিতে পারিনি, তাই বলে তার প্রতি এত অন্যায়ই বা করি কী করে বল! সে যদি প্রতিবাদ করে বসে তার কোনো জবাব যে দিতে পারব না আমি। তাই তো এমন নিশ্চুপ থাকি ইদানিং; কিচ্ছু না পারি, অন্তত তার সঙ্গে নিজেকে নিভৃত যাপন তো করতে পারি!
আমার জন্যে না হয় কেউ হতে পারেনি কখনো, আমার অন্তরের জন্যে না হয় আমি থাকি। সবসময় না পারি, অন্তত মাঝে-মাঝে; তাকে পাহারা দেই, তাকে যত্ন করি—ভালোবাসি—একটু বাঁচানোর জন্যে চেষ্টা করি। অন্তর মরে গেলে আর যে কিছুই বাকি রইলো না অতনু!
তিন.
অতনু,
ঝরে পড়া মানেই তো পড়ে থাকা নয়। আবার পড়ে থাকা মানেই ঝরা যাওয়া—তা নয়। সবকিছু নিয়েই যেমন জীবনের বসবাস, তেমনি সবকিছু দেখতে দেখতেই আমাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার পথচলা। এভাবে চলতে চলতেই কোথাও না কোথাও হঠাৎ থেমে যায় অদেখা নজর, অজানা অধীর মন নীরবে খুঁজে দেখতে চায় ভুল শব্দাবলির পদ্যভূমি। কিন্তু জীবন তো কবিতা নয়, জীবন তো গদ্য—তা আমার থেকে আর কে বেশি বুঝেছে এমন!তাই তো বার বার গদ্যে ফিরে আসতে হয়, বার বার সকালকে ভেঙে দুপুর করতে হয়, দুপুরকে নীরবে ভেঙে বিকেল, আবার রাত; সন্ধ্যা কিংবা গোধূলি, সব কোথায় যেনো মিলিয়ে গেছে সময়ের রুটিন থেকে। আহ্! কী বেদনা, কী যে কষ্ট, কী যে ঝরে পড়ার ব্যথা, কী যে পড়ে থাকার যন্ত্রণা, এসব কেউ কি বুঝবে এমন করে? না কি সবকিছু বোঝানোর মতো বল?
হয়ত নিজেকেও বুঝতে দিতে মন চাইনা আর; বিশাল এক ফাঁকি দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখে নিজের এই পথচলা। তার যতটুকু দেখা যায়—সেটুকুই আনন্দ, আর যা কিছু নিজস্ব এবং নিজেই বোঝার, তার সবটুকু যন্ত্রণার বৃহৎ এক পাহাড়। সে আমায় এক মূহুর্তও একা হতে দেয় না, দেবে না—তা আমি খুব বুঝি।
অতনু, এই যে ফিরে আসা, ফিরে থাকা—তার সবটুকু ইচ্ছের বাইরের, শুধুই জীবনের জন্যে, সম্ভ্রমের জন্যে। এই জীবন খুব বুঝেছে, সম্ভ্রম শুধু নিজের; তাকে নিজেই আগলে রাখতে হয়। সবার বেলাই এমন নয়, সবার কেউ কেউ বাঁচানোর আছে। আমার জন্যে হয়ত শুধু‘আমি’। ভালো কাটুক সারাবেলা, সারাটি জীবন।
চার.
অতনু,
বুকের সব কথা মুখকে জানাতে নেই। দেহেরও প্রতিটি অঙ্গের স্বাতন্ত্র্য আছে, বিশেষত্ব আছে। কিছু কিছু কথা একেবারেই বুকের নিজের, আজীবন শুধু তাকেই বয়ে বেড়াতে হয়। খুব চেষ্টা করেও অনেক কিছুই বলা যায় না, বলা ঠিকও না। আমাকে যে বোঝেনি, আমি তার কাছে নিজেকে বোঝানোর কোনো চেষ্টাই করি না কখনো। ছেড়ে যেতে চাই না সহজে কিন্তু একটা জিনিস খুব ঠিক—ভালোবাসা মাঝামাঝি কোনো অবস্থানে থাকতে পারে না। হয় নিজেকে উজাড় করে সবটুকুন দিয়ে ভালোবাসতে হয়, না হয় সব রকমভাবে নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হয়। নিজেকে ঝুলিয়ে রাখা যে নিজের অসম্মান, অপমান। ভালোবাসা থেকে মুখ ফেরাতে হলে সেখানে ভালোবাসার উল্টোটাই দরকার।
অতনু,
অস্বচ্ছতায় হাজার রকম প্রশ্নের জন্ম হয়। সেটা কি সন্দেহ অতনু? প্রশ্ন তো উদয় হয়, এ কি প্রশ্নকারীর দোষ—না কি প্রশ্নের! অস্বচ্ছতা তো বিরাট একটা ফাঁকি, এ তো অন্যায়। অন্যায়কে মেনে নেওয়ার অভ্যেস জীবনে কোনোদিন করতে পারিনি। তাই আজ এত বন্ধুহীন। অস্বচ্ছতার ভেতর ভালোবাসা খুব বেশিদিন বাঁচতে পারে না। সে স্বচ্ছতায় সাঁতার কেটে বেঁচে থাকে। সে সম্মানের মৃত্তিকা, সহজ সবুজ বনভূমি, সমুদ্রের আদর। ভালোবাসা আর কিছু দাবি না করুক, স্বীকৃতিটুকু তো প্রত্যাশা করবেই।
পাঁচ
তোমাকে,
ইদানিং খুব কটাক্ষ করো তুমিও। আমার আশঙ্কায় খুব বিরক্ত হয়ে ওঠো— তা বুঝি। তোমাকে সন্দেহ করি না মোটেই, আশঙ্কা হয় খুব। এ আশঙ্কা হারানোর নয়, কারণ তোমাকে তো পাইনি আমি, যে হারাবো। কিন্তু আমি তো আছি!
তোমাকে অবিশ্বাস করি না মোটেই কিন্তু অন্যদের বিশ্বাস হয় না, তাই এত ভয় হয়।
তুমি আমার প্রার্থনার মতোই শুদ্ধ ও স্বচ্ছ; প্রার্থনার মতোই একান্ত ভেতরের। কিছু বিষয় আছে, যেগুলো সবকিছুকে ডিঙ্গিয়ে যায়, তা তুমি ভাবো না। কিন্তু আমি তো জানি, এই যে দেখা জানা বোঝা, এর বাইরেও একটা জিনিস আছে যা মানুষ কিছুতেই ডিঙ্গিয়ে চলে যেতে পারেনা। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, তারপরে তো ব্যক্তি। এর সবগুলো উপেক্ষা করতে পারা যায় কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক যে জটিলতা আরেকজন মানুষ তৈরি করে, তা একটা জীবনকে তছনছ করে দেয়। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ঘোচানো মানুষের সাধ্যের বাইরে। তাইতেই যে এত ভাঙন, এত কষ্টের বিস্তার, এতটা নিজের দিকেই নিজেকে টেনে ধরে রাখা। খোলসের মত বিশ্বাস দিয়েই অবিশ্বাসকে ধ্বংস করার এত চেষ্টা। কার জয় হবে তা অনিশ্চিত, আর সেটাই হয়ত নিয়তি।
হাঁ, ঈশ্বর ! তুমি কি তবে নিয়তির সন্তান!