এ ব্যাপক দৈন্যে এই বিবশ আলস্যে স্বাধীনতা কী, আর কেন—এ কি আর আমাদের মাথায় থাকে বা আছে? আসলে কোন জিনিসটা মানুষের মাথায় থাকে? ভালোবাসা কিংবা ক্ষরণ কিংবা দহন কিংবা দ্রোহ? এ জাতির রক্ত থেকে কি মুছে গেছে সব? একা একাই ভাবি এসব। ভাবতে ভাবতে নিজেকে কেমন এক অনাধুনিক আদিম পাড়াগাঁয়ের উদাসী অশিক্ষিত মনে হয়। আমি ভুল করেছি এই দেশে জন্মে? না কি এ দেশ আমাকে ভুল করে নিয়েছিল তুলে কোলে? বুঝি না কিছুই। কেবল ব্যর্থ, কেবলই অপমানিত, কেবলই মূক আর বধির হয়ে থাকি। ক’দিন ধরেই এই কষ্টটা যাতনা দিচ্ছে খুব।
একটি প্রাইভেট অ্যাডভার্টাইজিং ফার্ম দিয়ে চাকরি জীবনের শুরু আমার। এরপর হাইডেল বার্গ জার্মান, সিটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রাম (জেএইচইউ)স্পেস ডিজাইন ডেভেলপমেন্ট প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেড হয়ে যখন যোগ দেই একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, তখন খুব গর্ব নিয়ে কাজ শুরু করি। বাবা শিক্ষক ছিলেন। বড় এক ভাই শিক্ষক। দুলাভাইও শিক্ষক ছিলেন। বাবা সবসময় বলতেন, ‘শিক্ষকতা চাকরি করো। নিজে লেখাপড়া করেছ। ভালো রেজাল্ট করেছ। এবার মানুষ গড়ো।’ হায়রে মানুষ! কিছু কিছু মানুষ গড়া যায়, তাকে বোধ করি মানুষ বলে না। বলে কাদামাটি। আর কিছু কিছু মানুষ গড়া হয়েই আসে মাটির পৃথিবীতে। তারা গড়ারও অধিক। তাই আমি আমার ঘরে কাদামাটি গড়ি। মেয়ে আবার স্বাধীনতার মাসে ছবি আঁকে কেবলই স্মৃতিসৌধের কিংবা অপরাজেয় বাংলার। সেই চার বয়সে রাজেশ্বরীর ছবি আঁকার বিষয় ভাবনার কথা বলছি। সে কেবল স্বাধীনতার গল্প শুনতে চায়। নানা ভাইয়ের যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখতে চায়। আমি এই মার্চ, এই ডিসেম্বরে এই বাংলায় বসে লালসবুজের অভাব বোধ করি। রক্তে কেমন যেন ফুটতে থাকে আমার লাল সবুজ। পুরো মার্চ মাস কিংবা ডিসেম্বর মাসে গায়ে পরার জন্য আমি একটি লালসবুজ জামা খুঁজতে থাকি।
আমার জাতীয় পতাকা দেখে মাথা কেন যে আপনি নুয়ে আসে, জানা নেই। তবু মনে হয় ভুল। ক্লাসে পড়াতে যাই অমর একুশ কিংবা স্বাধীনতা। ছেলেরা বোঝে না। হা করে তাকিয়ে থাকে। বীর-শহীদদের কথা লিখতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলে ভাষা শহীদ আর বীর শ্রেষ্ঠ কী, বীরবিক্রম কী। বীরাঙ্গনা প্রসঙ্গ এলে হেসে গড়িয়ে পড়ে একের ওপর আর একজন। মাত্র গোঁফ-দাড়ি গজাচ্ছে ছেলেগুলোর চোখেমুখে,সে কী দারুণ ব্যঙ্গ বিদ্রূপ আর লালসা! দেখে আমি বিস্মিত হই। এই ছেলেটি জানে না কী তার স্বাধীনতা ফসল? কী তার বিজয়? কী তার সম্ভ্রম? উল্টোপাল্টা প্রশ্নে আমি স্থির থাকতে পারি না। কেবলই নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় মনে হয়। খুব অস্থির লাগে সব। কী হবে,কী হচ্ছে এসব? কারা সামনে আগাচ্ছে কিভাবে আগাচ্ছে! আদৌ হবে কি শেষ রক্ষা! না কি ক্রম অধোগতি নিশ্চিহ্ন করবে সব? এমনই কত কথা ভাবতে ভাবতে করিডোর দিয়ে মাথা নত করে অধোবদনে হাঁটতে হাঁটতে টিচার্সরুমে ঢুকি। খুব সাজানো গোছানো। কুসুমে কলিতে ললিত মাধুরী ছড়িয়ে বসেন হাঁটেন চা খান ওখানে শিক্ষকরা। রুমে ঢুকেই ধাক্কা খাই এক শিক্ষকের কথা শুনে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খুব ভালো রেজাল্ট করে বাংলা বিভাগ থেকে এম এ পাস করে এমফিল করেছেন। বাংলা ডিপার্টমেন্টের এক শিক্ষককে নিয়ে তিনি স্মৃতিচারণ করছেন। তাদের কথোপকথন:
তিনি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন কোন ব্রান্ডের লিপস্টিক দিয়েছ? তোমার ঠোঁটদুটো খুব সুন্দর লাগছে।
মেয়েটি নাকি উত্তর দিচ্ছে তার স্যারকে- স্যার মেয়েদের লিপস্টিকের ব্র্যান্ড আপনি চিনবেন?
কেন চিনব না? কত মেয়ের ঠোঁটের লিপস্টিক লেগে আছে আমার এই ঠোঁটৈ জানো?
তখনই আমি ঢুকি ক্লাসে। শুনতে পাই স্যারের এই উক্তিকে অবলম্বন করে স্যারকে লুইচ্চা থেকে শুরু করে কোনো কিছুই বাদ নেই বলার তাদের। আমি এর মাঝে ওদের কথায়ও ঢুকে পড়ি। বস্তুত এটা তাদের একেবারেই পছন্দ হয়নি- আচ্ছা, স্যারের পাক সাদ জমিন সাদ বাদ বইটি পড়েছ কখনো? কিংবা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল?
ইমলামিয়াতের শিক্ষক বলেন, এই দুটোর একটা পড়েছি। কোনটা ঠিক মনে নেই। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। কি নোংরা গালিরে বাবা। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিভাবে এসব লেখে?
আমি বলি, যেভাবে তিনি লেখেন–‘ভালো থেকো ফুল মিষ্টি বকুল ভালো থেকো। ভালো থেকো নাও মধু মাখা গাঁও ভালো থেকো…’
এটা আবার কী?
হা হা হা, এটা কবিতা। আর এটাও স্যারেরই লেখা।
মাত্র নাক দিয়ে দুধ পড়া বন্ধ হয়েছে কচি শশা শিক্ষিকা। যিনি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে এ লে লেভেল পাস করেছেন অর্থাৎ এইচএসসির সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা। কিন্তু বেতন পান প্রায় আমারই সমান। তিনি বলে ওঠেন, কিন্তু বইটিতে এত গালি কেন? ওটা গল্পের বই নয়?
না। ওটা উপন্যাস। কিন্তু ওটা একটা ইতিহাসও।
কিসের ইতিহাস? ইতিহাস আবার উপন্যাস হয় কী করে?
ওটা তোমার দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস। স্বাধীনতার ইতিহাসের সেই কলঙ্কিত মানুষগুলোর কথা আছে ওখানে। যারা বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানকে সাহায্য করে গেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। আর পরবর্তী সময়ে এই আমরাই যাদের পুনর্বাসন করেছি। দিয়েছি বাংলার মাটিতে নিশ্চিন্তে বসবাসের নিশ্চয়তা। করেছি সংসদ সদস্য আর মন্ত্রী। দিয়েছি রাজাকারের গাড়িতে বাংলাদেশে পতাকা ওড়ানোর দুঃসাহস।
তাকে নাকি মেরে ফেলেছে শাহবাগের কাছে কোথায় কারা?
না তাকে ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলায় উপর্যপুরি কোপানো হয়েছিল। তারপর হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা গেছেন।
কারা কোপালো? কেন কোপালো?
কুপিয়েছিল স্বাধীনতার বিপক্ষের শত্রুরা।
কেন?
তিনি কবিতায় গল্পে উপন্যাসে সাহিত্যে রাজাকারের চরিত্র উন্মোচন করেছিলেন।
তাতে করে কোপাতে হবে কেন তাকে?
হা হা হা।
আমি তখন কচি শশা শিক্ষককে আর আপনি বলে সম্বোধন করতে পারি না। বলি- তুমি ওসব আর কোনোদিনই হয়তো বুঝবে না।
আমি হাসি ওদেরই সামনে। আর বাংলা বিভাগ থেকে এমফিল করে আসা বাংলার সেই শিক্ষিকা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন আমার ওপর এই ধরনের আলোচনা করে আদি রসাত্মক গল্পের মোড়টা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু মুখে কিছু বলতে সাহস পান না। কারণ তিনি আগে জানতেন না যে একই ডিপার্টমেন্ট থেকে আমি পাস করেছি। আর স্যার আমাদের পড়াতেন ফনেটিক্স। তিনি ভীষণ বিরক্ত মুখ নিয়ে স্ক্রিপ্ট চেক করতে বসে যান।
আমি বাকি স্ক্রিপ্টগুলো আর সেদিন চেক্ করে শেষ করে পারি না। এতদিন ছাত্রগুলোকে নিয়ে যে বিরক্তি আমার ছিল, আজ শিক্ষক মহলেও অমন কিছুর পরিচয় পেয়ে আমার বুকের ভেতর খুব ব্যথা করতে শুরু করে। আমি ভাবি আচ্ছা আমার সন্তানটিও এভাবে বেড়ে উঠছে না তো? স্বাধীনতার চেতনাবিহীন? অতীতের সমৃদ্ধ ইতিহাসের জ্ঞানহীন? জাত-পরিচয়হীন এক মানুষ হয়ে পৃথিবীর আনাচে কানাচে একদিন ঘৃণিত হয়ে বেঁচে থাকবে না তো আমারই সন্তান? যে জাতির কোনো একজন শিক্ষক জানেন না, তার স্বাধীনতার ইতিহাস। জানেন না তার ইতিহাসের পক্ষে কাদের অবস্থান। কারা কেন কিভাবে মারছে জাতির বিবেক। এ জাতি কবে মুখে শোনা কথার চেয়ে কাজের গুরুত্ব দিতে শিখবে? কবে একজন মানুষ বাঙালি হয়ে উঠবে, কবে একজন শিক্ষক একজন ছাত্র, একজন মানুষ বাংলাদেশি হয়ে উঠবে? আমি সেই দিনের অপেক্ষায় নেই। তাই আমি এখনই বসে যাই একজন মানুষ তৈরি করতে। এখনই বসে যাই একজন বাঙালি তৈরি করতে, একজন বাংলাদেশি তৈরী করতে। জানি না সেই পথ কতটা বন্ধুর, কতটা কাঁটায় বিক্ষত হতে হবে সে পথচলায়।
আজ সমস্ত বাঙালি আর বাংলাদেশবাসীকে জানাই স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।