এবারের বইমেলায় কবি জুনান নাশিতের কোনো বই আসেনি। তবু মেলায় তার সরব উপস্থিতি। বই কিনছেন, কবি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। মেলার সার্বিক বিষয় এবং ব্যক্তিগত সাহিত্যচর্চা নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: এবারের নতুন বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
জুনান নাশিত: এবারের মেলায় নতুন বই আসেনি। আসার কথা ছিল। একটি প্রবন্ধের বই। এছাড়া বলার আপাতত তেমন কিছু নেই।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: বইমেলা সম্পর্কে আপনার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা?
জুনান নাশিত: বইমেলা মানেই আনন্দের শিহরণ। বইমেলা মানেই রক্ত ছলকে ওঠা। টিপটিপে আনন্দের রেশ মগজ থেকে সারা অস্তিত্বে ছড়িয়ে পড়া। বইয়ের সান্নিধ্যের পাশাপাশি প্রিয় লেখক ও লেখক বন্ধুদের পাশে পাওয়া। ভালোলাগায় বুঁদ হওয়া। বইমেলা মানেই আড্ডার আনন্দে টগোবগো হওয়া, অনর্থক ও অফুরান কথায় শূন্য মুহূর্তকে ভরিয়ে তোলা। পরিচিত অপরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়া। অর্থাৎ বইমেলা লেখক, কবি, প্রকাশক ও পাঠকের মিলনমেলা।
তো স্থান সংকুলান না হওয়ায় এই বইমেলা বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এ দুভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে।এতে মেলার আয়তন বেড়েছে সত্যি। কিন্তু মিলন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে। অর্থাৎ তারুণ্যের আড্ডা মূলত বহেড়া তলার লিটল ম্যাগকে কেন্দ্র করেই চলে। অথচ মূল স্টলগুলো উদ্যানের অংশে।এতে শ্যাম রাখি না কুল রাখি দশা। আড্ডায় এসেছে বাস্তবিক বিচ্ছিন্নতা। মানে আড্ডা চলছে, কিন্তু এর যূথবদ্ধতা নষ্ট হয়েছে। যদিও সময়ের সাথে সাথে এতেও অভ্যস্থ হচ্ছেন সবাই। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভাববেন আশা করি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সমকালীন সাহিত্য নিয়ে আপনার চিন্তা–ভাবনা কেমন?
জুনান নাশিত: সমকালীন সাহিত্য নিয়ে বলার সময় এখনো আসেনি। কারণ এখন হৈ হুল্লোড় আর ডামাডোলটাই চোখে পড়ছে বেশি। সময়ের ভেলা যখন এসবকে পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে যাবে তখনই সত্যিকার চিত্রের দেখা মিলবে। তখনই বোঝা যাবে সাহিত্যের জমিনে কে কতটুকু আঁচড় কাটতে পেরেছেন। তবে তা যদি সততার সঙ্গে মূল্যায়িত হয় আর কি!
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: বর্তমান লেখকদের মধ্যে কাদের লেখা ভালো লাগে?
জুনান নাশিত: উল্লেখ করার মতো অনেকের লেখাই ভালো লাগছে। তবে এ মুহূর্তে নাম ধরে ধরে বলা সম্ভব হচ্ছে না। অনেকের লেখা পড়ে মাঝে–মাঝে পরিস্থিতি বেশ আশা জাগানিয়া মনে হয়। আবার কখনো হতাশও হই খুব।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সাহিত্য নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
জুনান নাশিত: বড়সড়ো কোনো পরিকল্পনা আপাতত নেই। কবিতা ও প্রবন্ধ লিখছি। আরও ভালো কবিতা লিখব, প্রবন্ধ লিখব। এর পাশাপাশি উপন্যাস লেখারও ইচ্ছে আছে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সাহিত্যের কোন শাখা আপনাকে বেশি টানে?
জুনান নাশিত: টানে বেশি কবিতাই। কবিতার অন্তঃস্রোত সবসময়ই যাপিত জীবনে প্রবহমান। কবিতার ঊর্ধ্বে আর কিছুই বলতে গেলে নেই। এরপরই প্রবন্ধ আর নানা জাতের গদ্য ভালো লাগে। ভ্রমণকাহিনিও টানে বেশ।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা…
জুনান নাশিত: আমার যাপিত জীবনই আমার অনুপ্রেরণা। এর বাইরে বলতে গেলে বলতে হয় বই পড়ার কথা। আমার আব্বার কথা। বই পড়া শুরু করি সেই ছোটবেলায়। ক্লাশ টুতে পড়ার সময়ে বড়ো বোন দুটি বই উপহার দেন। একটি হাবীবুর রহমানের ল্যাজ দিয়ে যায় চেনা এবং অন্যটি স্বপন কুমার গায়েনের আশ্চর্য আর আশ্চর্য। সেই শুরু বই পড়ার। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি গল্প কবিতার বই পড়া নিয়মিত অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। ঘরের বুকশেলফ ভরা ছিল আব্বার বইয়ে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, ফাল্গুনী, নীহাররঞ্জন ও বিভূতিসহ অনেকের বইয়ে ছিল বুক শেলফ ঠাসা। সেসব বইসহ ওই্ ছোট্ট বেলোতেই পড়ি আরব্যরজনীর উপন্যাস। বই পড়তে পড়তে নানা রঙের এক কল্পনার জগত তৈরি হয় নিজের ভেতর। সেই কল্পনাকে ভাষার আঁচড়ে প্রকাশের এক তাগাদাও তৈরি হতে থাকে ভেতরে ভেতরে। যদিও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ভেতরে লেজ না থাকলে লেজ গজায় না। সে অর্থে হয়তো বলা যায়, লেখার একটা তাড়না ভেতরে ভেতরে জন্মগতভাবেই ছিল। পরিবেশ পরিস্থিতি সে তাড়নাকে গতিপথ দিয়েছে। আর আমিও অনুপ্রাণিত হয়েছি লিখতে। কারণ না লিখে উপায় ছিল না এবং এখনো নেই। কারণ আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, এই লেখার কারণেই জীবনের জটিল গ্রন্থিগুলোকে সহজ ও সরলভাবে উন্মোচনের সুযোগ পেয়েছি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: প্রচারবিমুখ থেকে সাহিত্যচর্চার সার্থকতা কতটুকু?
জুনান নাশিত: যদিও বলা হয় সাহিত্য চর্চা নীরব ধ্যানের কাজ। কিন্তু সাম্প্রতিকতার দিকে তাকালে একথা কতটুকু খাটে তাই জিজ্ঞাস্য। আমরা হরহামেশাই বলি, ভালো লিখলে একসময়ে সেটা বের হয়েই আসবে। কিন্তু এও কি সত্য নয় অতিরিক্ত ভিড়ে চাপা পড়ে গেলে মাঝে-মাঝে বাঁচার জন্যে চিৎকারও অনিবার্য হয়ে যায়। তাই আমার মনে হয় একটা ন্যূনতম ডিসিপ্লিন থাকা জরুরি। সেটা ভেঙে পড়লে পরিস্থিতি নৈরাজ্যকর হবে, আর সেটাই স্বাভাবিক।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনার বই আপনাকে কেমন পুলকিত করে?
জুনান নাশিত: অনেক বেশি মাত্রায় করে। কারণ জীবনের গতিময় আর মেধাবী সময় যার পেছনে সেই সৃষ্টিকর্ম যখন বইয়ের আকোরে হাতে আসে তখনকার শিহরণের মাত্রাতিরিক্ত হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনার লেখালেখির সাফল্যে অন্যের ঈর্ষা আপনাকে বিব্রত করে?
জুনান নাশিত: মোটেও না। কারও ঈর্ষা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথাই নেই্। সেটা তার সমস্যা। আমার না। ঈর্ষা বরং আমার কাছে উপভোগ্য। আমি লেখা নিয়ে থাকতে চাই, লেখা নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই। কারণ লেখা আমার জন্যে বেঁচে থাকার এক অনাবিল অনুপ্রেরণা।