বাংলা সাহিত্যের বিশাল একটি জায়গা জুড়ে রয়েছে কাব্য। বলা যায়, সাহিত্যে কাব্য তথা কবিতার আগমন ঘটেছে অনেকটা লাজ-নম্র বধূর বেশে। সময়ে কবিতার শরীর জুড়ে লেপ্টে দেওয়া হয়েছে নানা রঙের প্রলেপ। কবির আত্মচেতনা ও অনুভূতির নির্যাস কবিতায় দেয় ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনা। কবিরা শুধু দর্শক নন, পর্যবেক্ষকও। তাঁরা শুধু ধ্যানী নন, কর্মীও। জগৎসংসারের নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ভাবের গভীরতা দিয়ে কবি কাব্যবাগানকে করে তোলেন সমৃদ্ধ। সংসারজীবনের এমনই নানা অভিজ্ঞতা, প্রাকৃতিক নির্যাসের আবহে রোমান্টিক ভাব-ভাবনায় সমৃদ্ধ একটি কাব্য সরকার আমিনের ‘বিবাহিত প্রেমের কবিতা’। বইটি প্রকাশিত হয় মঙ্গলসন্ধ্যা থেকে। কবি নিঃসঙ্কোচে প্রকাশ করেছেন নিজের অনুভূতি। অথচ পাঠকালে মনে হবে বিবাহিত চিরায়ত তরুণ-তরুণীর মনের কথা।
নিজ স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে গেলে
বহু ঐশ্বর্য রাই বৃথা যায়।
মন্দিরে দেবী দর্শনে গিয়েও লুকিয়ে রাখতে হয় চোখ
মানিব্যাগ নিয়ে সতর্ক থাকার মতো প্রযযেত্ন রাখতে হয় হৃদয়।
(ডাকাতি)
লিখতে জানলে সাধারণ বিষয়গুলোও অসাধারণ হয়ে ওঠে। যাঁরা তা পারেন নিঃসন্দেহে তারা মহৎ, বড় মনের, বড় মানের সৃষ্টিশীল। কবি সরকার আমিনও সাধারণ শব্দ নিয়ে খেলেছেন। অনুভূতির জোছনাজলে স্নান করে সংসারজীবনের অভিজ্ঞতা শৈল্পিকভাবে লেপটে দিয়েছেন সে শব্দের শরীরে। অনুভূতি, অভিজ্ঞতাসমগ্রের নির্যাস আর সেইসঙ্গে নির্মাণ কৌশলে তাঁর কবিতা ভিন্নধর্মী ব্যঞ্জনা। যা পাঠে পাঠকমাত্রই আবেগে উদ্বেল হয়ে ওঠে।
কন্যার অসুখ হলে কিছু সময়ের জন্য মরে যাই—
অসুখ সেরে গেলে হেসে উঠি
এভাবে কতবার মরেছি, কতবার বেঁচেছি!
রাধার অসুখ সাধারণত হয় না
মনে হয় সে সুখের রানি
মাঝে মাঝে আমার অসুখ করে
তখনই শুরু হয় আসল রাহাজানি।
(আমাদের অসুখবিসুখ)
আজ অফিসে যেও না গো
কাঁদছে আকাশ যেন বাচ্চা মেয়েটি।
খুব মেঘ করেছে—
মেঘগুলি মনে হচ্ছে শুয়ে আছে মেটার্নিটি হাসপাতালের বেডে
সহসা বাচ্চা হবে।
(শত্রুতা)
প্রমথ চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধসংগ্রহ গ্রন্থে ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে বলেন—‘যিনি গড়তে জানেন তিনি শিবও গড়তে পারেন বাঁদরও গড়তে পারেন (প্রমথ চৌধুরী, ২০০৮: ৭৮)।’ সরকার আমিনের ক্ষেত্রেও যেন উক্তিটি প্রযোজ্য। তিনি অত্যন্ত দক্ষ শব্দশ্রমিক। শব্দে শব্দে সম্পর্ক পাতানোতে তিনি বেশ সিদ্ধহস্ত। নির্মাণের নিপুণতায় তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে চিরায়ত, বর্ণিল, গন্ধবহ।
একটা মিষ্টি আঁধারে হৃদয় ডুবিয়ে বসে থাকি
বৃষ্টির শব্দের মতো বদমাশ আর কেহ নাই জগতে
আমার চোখ খোলা
হৃদয় দৌড়াচ্ছে দুষ্টু শিশুর মতো,
যেন সে এক অনিচ্ছুক আসামি
কনডেম সেলের নির্জন ঘরে বসে ডিম পাড়ছে মহাকালের।
(জরুরি কথাবার্তা আছে)
জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতার ভাঁজে ভাঁজে উপমার প্রয়োগ করেছে। সমগ্র পঠনপাঠনে মনে হবে উপমাই হচ্ছে কবিতা। সত্যিই তাই। উপমাই হচ্ছে কবিতার প্রাণ। কবি সরকার আমিনের কাব্যেও দেখি উপমার নিখুঁত ব্যবহার।
সন্তানসম্ভবা মেঘগুলো ছুটে যাচ্ছে চেরাপুঞ্জির দিকে।
এমন বৃষ্টির দিনে
রাত্রির হাত ধরে নীরবে বসে থাকা অপরাধ
চল বৃষ্টির প্রতি ছুড়ে দিই সৃষ্টির শীস
মৃত্যুর দূতও জানে রোদ্দুরের স্পর্শে ভেঙে যায়
যে কোন সকালের হালকা ঘুম
এখন ঘুমানোর একদম সময় নয় রাধামনি
(তখন ঘুমানোর সময় নয়)ভয় লাগে, ভয়কে বুকের ভেতর বিছানা পেতে শুতে দেই
পড়তে দিই রঙিন জামাকাপড়
তবে ভয়ের নির্দেশ সব সময় গায়ে মাখি না।
(ভয় লাগে)
কবি বিবাহিত প্রেমের কবিতা কাব্যটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর স্ত্রী শাহনাজ মুন্নিকে। এ কাব্যটিতে আপাদমস্তক স্ত্রীবন্দনা করা হয়েছে! যেহেতু স্ত্রীর প্রাত্যহিক জীবনাচারণকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সেহেতু কবিতার বিষয়বস্তু গৃহের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। যদিও তা থেকে কবি কৌশলী ভূমিকায় সর্বজনীন করার চেষ্টা করেছেন। তবে সত্যিকার অর্থেই কবিতাগুলো সর্বজনীন হয়ে উঠেছে কি না, তা বিচারের ভার পাঠকের হাতেই রইলো। তবে গৃহ থেকে কবির উত্তরণের প্রয়াস নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
রাধে আমার হৃদয়ের সাংবাদিক
সে সাড়ে সাতটায় কেন সকলের প্রিয় হয়ে যায়!
(হৃদয়ের সাংবাদিক)রাধে ঘুমুতে থাকে
আর আমি ঢুকে যাই ইঁদুরের গর্তে
প্রতিটি ঘুম তার মুখে নাচে, হাসে, গায়
আমি জেগে থাকি, পাহারা দেই মন, শৃগালের শর্তে।
(রাধের ঘুম : দুই)রাধার মানিব্যাগে জমা থাকে
গরিব মানুষের দীর্ঘশ্বাস
লাল নীল হলুদ বেগুনি কাদায়
আমার রাধা যেন উড্ডয়ন-প্রবাসী হাঁস।
(হাঁস)প্রি-প্রেইড কার্ডের ফুরিয়ে যাবার মতো
রাধে, কথা বলতে বলতে
বলতে বলতে বলতে বলতে
ফুরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
(শেষ মিনিট)
ব্যক্তিগত অনুভূতি সামগ্রিক অনুভূতিতে পরিণত করার মধ্যেই কবি বা লেখকের স্বার্থকতা। কবিতার বিষয়বস্তু আঙিনার দ্বোরগোরায় হলেও তাতে রূপ-রস-অলঙ্কারে শৈল্পিক করে বিশ্বমানের করা যায়। কবিতা যদি নিচের চৌকাঠ না পেরোয়, তার শরীরে যদি বৈশ্বিক বাতাস না লাগে তবে তা বহুল প্রচার-প্রসার হলেও মহাকালের বিচারে টেকে না।
সরকার আমিন বিবাহিত প্রেমের কবিতা কাব্যটিকে বৈষ্ণিক উষ্ণতাদানে কিংবা অনুভূতিসমগ্রকে সর্বজনীন রূপদানে নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। তাঁর শব্দচয়, উপমা, অলঙ্কার পাঠককে আমোদিত, আহ্লাদিত করবে নিঃসন্দেহে।