কিছু কথা
কিশোর মনের নানা ভাবনাকে প্রথমত ছন্দবদ্ধ করে তারপর মলাটবদ্ধ করার এই প্রথম প্রয়াস আমার ‘বোতাম খোলা দুপুর’। ২২টি ছড়া-কবিতার মধ্যে কতটি কবিতার কাছাকাছি গিয়েছে আর কতটি ছড়া হয়েছে, কিংব নিছকই পদ্য—সে হিসাব বিজ্ঞজনদের জন্য তুলে রাখলাম। আমি শুধু আমার কিছু ভাবনা এখানে তুলে ধরলাম।যারা গ্রামে থেকে শৈশব-কৈশর কাটিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠেছে, আর যারা পুরোপুরি শহুরে তাদের উভয়ের থেকে আমি কিছুটা আলাদা। আমার শৈশব-কৈশর কেটেছে গ্রামে আর বয়ঃসন্ধির সময়ে চলে আসি শহরে। যারা গ্রামে থেকেই বয়ঃসন্ধি অতিক্রম করেছে তাদের সঙ্গে আমার কিছু সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে। আমার ধারণা, যারা একই গ্রামে ছোট থেকে বড় হয়েছে, গ্রামের পরিবর্তন দেখেছে, সঙ্গে-সঙ্গে নিজেরও পরিবর্তন হয়েছে, তাদের কৈশর স্মৃতি অনেক ফিকে হয়ে যায়। যেই পথে সে ছোটকালে মার্বেল খেলেছে, সেই পথেই যখন সে বড় হয়ে মোটরসাইকেল চালায়, তখন বাইকের চাকায় নষ্ট হয়ে যায় মার্বেল খেলার সেই দাগ। মুছে যায় স্মৃতি।
কিন্তু আমার ক্ষেত্রে হয়েছে অন্যরকম। আমি কৈশরের নাটাই-ঘুড়ি, গুলতি, রিং, রিক্সার পুরাতন টায়ার, বড়শি—সব সযতনে রেখে শহরে এসেছি। আরও রেখে এসেছি পাখির বাসা, খোকসা গাছে টুনটুনির ডিমে তা দেওয়া, রাজহাঁসের পালক, শালিক পাখির রঙিন ডিম, ডাহুকের ডাক, মাছরাঙার ঝিম ধরে বসে থাকা আর কচুরিপানার আঁশটে গন্ধে মাছের সন্ধান। আমার স্মৃতিতে সব যেন আগের জায়গাতেই আছে। আমার কৈশর এখনো এই শীতে ঝরে যাওয়া শুকনা পাতায় মচমচ শব্দ করে হেঁটে বেড়ায়। শীতের সকালে হা মুখ করে খেজুর গাছের রসের দিকে চেয়ে থাকে, কখন এক ফোঁটা এসে জিহ্বায় পড়ে। খেজুর গাছের ঝুলে পড়া পাতা ধরে এখনো ঝুল দিয়ে পুকুরের ঠিক মাঝখানটায় লাফ দেয় আমার কৈশর। জাম গাছের মগডালে উঠে জাম খায়, আম গাছে আম। পেয়ারা বেঁধে রাখে কাপড় দিয়ে, যেন বাদুড় খেয়ে না যায়। আমার কৈশর এখনো মাইলের পর মাইল হেঁটে যায় এক অচেনা পাখির পিছু পিছু।
আমি যখন ছোটদের জন্য লিখতে বসি, তখনই সেই কিশোর এসে আমাকে আবিষ্ট করে ফেলে। আমার লেখায় জায়গা করে নেয় সে। সেই কিশোরের দুরন্তপনা, সরল জিজ্ঞাসা, শহরে এসে স্বপ্নভঙ্গ, মায়ের থেকে দুরে থাকার যন্ত্রণা—সব ধরা দেয় কবিতায়। আমারই কৈশোর নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে আমার কবিতা-ছড়ায়। সেই ভাবনাগুলো অন্যদের মনেও যদি একটু অনুরণন তোলে, তবেই আমার স্বার্থকতা।
এই কিশোর সেই কিশোর
এই কিশোরের সময় কাটে সারাক্ষণই ফোনে
সারাক্ষণই খোঁচাখুঁচি ফেসবুকে আনমনে।
এই কিশোর আজ সেই কিশোর নয় যেই কিশোরের গায়
গন্ধ ছিল সোঁদা মাটির সবুজ ঘেরা গাঁয়।
এই কিশোর আজ সময় কাটায় বদ্ধ এসি ঘরে
সেই কিশোরের উড়তো ঘুড়ি হাওয়ায় তেপান্তরে।
বাবুই পাখির বয়ন রেখা সেই কিশোরের জানা
মেঘের দেশে ঝাপটা দিতো সেই কিশোরের ডানা।
খেজুর গাছের পাতায় ঝুলে ঝাঁপ দিত সে জলে
দুরন্ত লাটিমের সাথে তার তুলনা চলে।
পাখির সাথে ফুলের সাথে তার মিতালি রোজ
আমের মুকুল প্রথম ফুটে তারেই করে খোঁজ।
দুরন্ত সে বাড়ন্ত সে সবাই তারে জানে
বাম হাতে তার বাটুল ছিল সুরের বাঁশি ডানে।
বয়স হলেও সেই কিশোরটা মনের পলি স্তরে
বসত করে নিত্যদিনই আমার আপন ঘরে।
কিন্তু শোন ধীরে—
এই কিশোরটা খেই হারাবে নীলচে আলোর ভিড়ে
খুঁজবে না কেউ খরস্রোতা সেই ঢেউ ভাঙানো তীরে।
দুঃখ বিনিময়
বীজগণিতে গর্দভ আমি সূত্র মাথায় ঢোকে না
মার খেয়ে তাই দাঁড়িয়ে রই অন্য কোনো শোকে না।
তুই কেন গাছ বছর ধরে একলা থাকিস দাঁড়িয়ে
কোন কালে কে বকলো তোকে কে দিয়েছে তাড়িয়ে।
দুঃখ আমার মায়ের বকা হাঁটছিরে তাই সাঁঝের বেলা
তুই কেন চাঁদ হাঁটিস পিছু দুঃখ নিয়ে করিস খেলা?
খাঁচার পাখি ছুট দিয়েছে মনটা শুধু কাঁদে আজ
কিন্তু নদী তোর কী ব্যাথা আছড়ে পড়িস বাঁধে আজ?
এতই যদি দুঃখগাথা কষ্ট মনে তোদের
আজকে সময় বিনিময়ের দুঃখ পরিশোধের।
দুঃখ তোদের সব দে’আমায় আমারগুলো তোদের
আমরা সবাই বন্ধু হলাম সাক্ষী দুপুর রোদের।
আজকে আমি
একটা পাখির পিছু পিছু ছুটতে গিয়ে
অনেকটা পথ একলা গেলাম মাড়িয়ে
কতটা রোদ হজম করি দাঁড়িয়ে
একটা বুনো ফুলের মতো ফুটতে গিয়ে।
জোনাক পোকার আলোতে পথ চলতে গিয়ে
খেই হারিয়ে হোঁচট খেলাম আহারে
ফুল বাগানে রঙের কত বাহারে
হয়নি কিছু বলা আমার বলতে গিয়ে।
আজকে আমি হইনি পাখি কিংবা ফুলও
আধেক মানুষ রিকশা ঠেলি হাঁপিয়ে
কষ্ট নামের ঘাম ঝরে যায় ছাপিয়ে
আজকে আমার নেইতো বাড়ি নেইতো চুলো।
বন্দি খোকা
একটা তারা দুইটা তারা অনেক তারার মেলা
বেলকনিতে তোমার ছবি আঁকছি মনের খাতায়
তুমিও মা দেখছ না কি শিমুল গাছের পাতায়?
উথাল-পাতাল আলোর নাচন অনেক তারার খেলা।
একটা পাখি দুইটা পাখি সাঁঝের বেলা ডাকে
আমি যখন ইটের ঘরে ফিরছি ভেজা ঘামে
হাজার পাখির পুচ্ছ দোলায় সন্ধ্যা তোমার নামে
হাতড়িয়ে মন খোঁজো কি গো তোমার এ খোকাকে?
একটা ফুলের দুইটা ফুলের সুবাস আমার ঘরে
হাজার বুনো ফুলের সুবাস তোমায় থাকে ঘিরে
তখন কি মা আশায় থাকো আসবে খোকা ফিরে?
কিন্তু মাগো বন্দি আমি নিষ্ঠুর এ শহরে।
চলো যাই গ্রামে
বর্ষায় ঢাকা ছেড়ে চলো যাই গ্রামে
ঝুম ঝুম বৃষ্টিরা যেই গাঁয়ে নামে।
বর্ষায় ঢাকাতে কি ময়লার মেলা
চলো চলো গ্রামে যাই ভাসাবোই ভেলা।
ড্রেন পানি গার্বেজ বদ্ধ এ ঢাকা
বিপদটা টের পাও, ম্যানহোল ফাঁকা!
কদম কেয়ার সাথে কাগজের নাও
ভাসাতে কি চাও?
চলো যাই গ্রামে—
যেথা রোজ ঝুম ঝুম বৃষ্টিরা নামে।