খুলি
তবারক জানে না এটি তার আব্বার মাথার খুলি কি না। তবু সে বিশ্বাস করতে চায়, তার আব্বারই। খুলিটা বুকে জড়িয়ে তবারক কান্দে।
পাথরের কণার মতো ঠারঠার কুয়াশা পড়ছে তবারকের মাথার ওপর। শীতে কাঁপছে। গায়ের চাদরটা আরেকবার গায়ে টাইট করে চেপে ধরে তবারক কবরের আরও কাছে যায়। রাত বাড়ে। ঘোর অমাবস্যার রাত। নিজের হাত-পা নিজেই দেখতে পায় না সে। মোবাইলের ঢিমে টর্চের আলোটা মৃদু হয়ে মাটির গর্তের ভেতরে ঢোকে।
চর মাজারদিয়ার রাস্তাটা দিনের বেলায় ধূলায় গড়াগড়ি খায়। সারাদিন এই রাস্তা দিয়ে টমটম চলে। একেকটা টমটম যায় আর পেছনে উড়িয়ে যায় ধূলার সমুদ্র। কখনো গর্তে চাকা পড়ে ক্যারক্যার করে ওঠে। টমটমের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ত্যাঁদড় পোলাপান নেমে দ্বিগুণ উৎসাহে ঠেলতে থাকে। অনেক চেষ্টার পর হয়তো চাকাটা গর্ত থেকে ওঠে। হই হই করে ওঠে যাত্রী আর আশপাশের মানুষজন। ড্রাইবার তবারক চিল্লায়, ওই সর সর। সর কইতাছি বজ্জাত পুলাপাল। গাড়ির চাক্কায় পইরা মরবি। সেই চর মাজারদিয়া রাস্তার মাথায় তুলা গাছের তলে তবারকের আব্বার কবর। সন্ধ্যায় মালিকের কাছে গাড়ি জমা দেওয়ার সময় কে এসে খবরটা দিলো। তবারকের আব্বার কবরে শেয়াল ঢুকেছে। তবারক হনহন করে দৌঁড়ে যায় কবরের দিকে।
গত বর্ষায় বিলে মাছ ধরার সময় আসমানের ঠাডা পইরা তবারকের আব্বা মারা যায়। কবর দেওয়ার সময় তবারকের কান্না কেউ থামাতে পারে নাই। হাউমাউ করে, ওরে আব্বারে আমারে ফালাইয়া কই গেলারে আওয়াজ তুলে ঘণ্টা চারেক কেঁদেছে তবারক। এরপর ঠাণ্ডা চুপ। তিন দিন কারও সঙ্গে একটা রাও করে নাই। কিচ্ছু খায় নাই। মুজিবরের মা মুখের কাছে পানির গ্লাস ধরেছে, খা বাবা তবারক। আরে না খাইলে তো তুইও মইরা যাইবি! তবারক কথা বলে না। হাত দিয়ে গ্লাস সরিয়ে দেয়। টপটপ করে চোখের পানি পড়ে বুকের ওপর।
সেই কবরের মাটি ভেঙে ভেতরে কলকল করে পানি ঢুকেছিল এক ঝড়ে। তবারক লুঙ্গি কাছা মেরে কোদাল দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে পাশের ক্ষেত থেকে মাটি এনে কবরের ওপর দিয়েছে। বৃষ্টিতে তবারকের চোখের পানি বোঝা যায়নি। মিশে গেছে।
এখন এই শীতেও কুকুর-শেয়ালের হাত থেকে কবরটাকে রক্ষা করে চলেছে তবারক। তবারক বিড়বিড় করে বলে, ওরে আব্বারে, ওরে আমার আব্বারে, আমারে একলা ফালাইয়া তুমি কই গেলাগা। সাদা ধবধবে খুলিটা বুকে নিয়ে তবারক কান্দে। খুলির ফাঁকা চোখের কোটর দুটি হা করে চেয়ে থাকে। আশপাশে অনেক কবর—একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। কোনটা কার কবর বোঝার উপায় নেই। হাত দিয়ে কবরের ওপর মাটি লেপে তবারক। এমন শীতের রাতে পৃথিবী আরও একা হতে থাকে। একা হতে থাকে তবারক। দূর পথের পাশে তুলা গাছের তলে হাঁটু মুড়ে চুপ করে থাকে। রা রা শীতের চোটে শরীরের চাদরটা আরও টাইট করে চেপে ধরে। এমন সময় তবারকের পিঠে কে যেন হাত চাপড় দিয়ে ওঠে—ওঠ শালা! ওঠ!
চর মাজারদিয়ার পূর্বপাড়া এলাকায় ১১টি মানুষের কঙ্কালসহ তবারককে টানতে টানতে নিয়ে যায় পুলিশ। কুয়াশাভেজা সকালবেলা তবারকের চিৎকারে ঘুম ভাঙে শিশুদের। অ আব্বারে, ও আব্বা!
জিলাপি গরম
মতি মিয়া হাঁড়িতে হাত দিয়ে দেখলো জিলাপি ঠাণ্ডা। বললো, না মিয়া! এই ঠাণ্ডা জিলাপি খাইয়া জুত পাওয়া যাইব না। নতুন ভাইজ্জা দাও।
নুরানি হোটেলের পূর্ব পাশে একটা ছাপড়া ঘর নিয়ে যোগেন ঘোষের মিষ্টির দোকান। আজ বিশ বছর হলো দোকানে একটা ইট দূরের কথা, টিনও লাগেনি। ছন আর বাঁশের বেড়া দিয়েই ব্যবসা করছে যোগেন। সব মিলিয়ে দোকানটাতে একটা প্রাগৈতিহাসিক ভাব আছে—পোড়া মাটি, ধোঁয়ায় মাকড়সার জালগুলোও কালো হয়ে গেছে। সেদিকে যোগেনের নজর নেই। সেই সকালে আসে, সন্ধ্যা পর্যন্ত জিলাপি বেচে যোগেন। সঙ্গে থাকে দুই কারিগর রঞ্জিত আর সুবল। যোগেন চিৎকার করে বলে, অ সুবল! সুবলরে! আরে কই গেলি গা? মতি মিয়ারে কয়ডা জিলাপি ভাইজ্জা দে।
মতি মিয়া ভাঙা বেঞ্চটাতে এক পা উঠিয়ে বসে। বেঞ্চটার এক পা ভাঙা, ঠক ঠক করে। মতি মিয়া পায়ের খোলা হাঁটুতে হাত বুলিয়ে লুঙ্গিটা ধরে রাখে। বলে, একটু কড়া কইরা ভাইজ্জো সুবল ভাই। এমনিতে সুবলকে কেউ তুমি করে বলে না, তুই তুকারি করে। মতি মিয়ার কাছ থেকে বিশেষ সম্মান পেয়ে সেও কোমল করে উত্তর দেয়, চিন্তা কইরো না মতি ভাই, একটু বও। নতুন গুড় গুলছি আইজকা।
সুবল কারিগর জিলাপি বানাতে লাগলো, এক কড়াই তেলে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। জিলাপি পুড়তে থাকে, জিলাপি লাল হয়। জিলাপি গুড়ে ভেজে।মাছি উড়তে থাকে গুড়ের ওপর। সুবলের গালে। সুবল একটা চড় দেয়, কিন্তু নিশানা লাগে না। গুড়ে ভেজা জিলাপিতে একটা মাছি পা আটকে গিয়েও আবার উড়ে যায়—ভোঁওওও।
মতি মিয়া জিলাপি খেতে থাকে। ঠোঁটের নিচে এক হাতের তালু ধরে অন্য হাতে নিয়ে কড়মড় করে জিলাপিতে কামড় বসায়। পুরোটা মুখ রসে ভিজে যায়, জিবের চারপাশটা চটচট করে। সারাদিন ভ্যান টানার কাজ শেষে জিলাপি খায় মতি। আর ভাবে— জগতের কত কিছুর মধ্যেই তো প্যাঁচ, রাইজ্যের বদনাম সব জিলাপির।
সালমান
মাঝবয়সী এক যাত্রী চোখে-ঠোঁটে আদর মাখিয়ে তার নামটা জিজ্ঞেস করলো—এই বাবু তোমার নাম কী? ছেলেটা বলল, সালমান। লেগুনা চলছে। সালমান নামটা বাতাসে উড়ে না গিয়ে গাদাগাদি যাত্রীদের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো। সালমান। সালমান তার নাম।
সালমান ফিল্মি নাম। এই ছেলের নাম সালমান, কেমন যেন মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। গরিবের নাম আবার সালমান হয় নাকি! ছেলেটা এই লেগুনার কন্ডাক্টর, বয়স পনের পেরোয়নি নিশ্চিত। গায়ে ময়লা শার্ট আর তেল চিটচিটে জিন্স। বাদামি কালো মুখের রঙটা রাস্তার ধূলা লেগে আরও ধূসর হয়ে আছে। দুই ঠোঁটের মাঝখানের রেখাটা গোলাপি এবং ভেজা। থুতুর হালকা ফেনা লেগে আছে। চিৎকার করলে ঠোঁটের এই দশাই হয় হয়তো। কণ্ঠও ভাঙা, ফ্যাসফ্যাসে। লেগুনা থামতেই সালমান চিৎকার করে ওঠে, মহাখালী মহাখালী মহাখালী। ওই মহাখালী মহাখালী…গেলো গা গেলো গা মহাখালী…ওই।
দু’জন নামে, তিনজন ওঠে। ওই মিয়া পা কই রাখছেন! সরান সরান। মিয়া আহাম্মক, আমার গায়ের উপ্রে উইট্টা আইবেন্নি! লেগুনা আবার চলে। সালমানের দিকে ঘুরে ঘুরে তাকায় সবাই। ভাবখানা এমন—আহারে বাচ্চা ছেলেটা, কোন মায়ের পোলা কে জানে! বাপ কি আছে? আহারে! এমুন কচি মুখ!
লেগুনার টিনের খাঁচার ভেতর চৌদ্দ পনেরো জন যাত্রীর মুহূর্তের হতাশাটা আমি নিশ্চিত দেখতে পেলাম। একজন নারী বলে উঠলেন, ওই বাবা তুই থাহস কই? সালমান কথা কয় না। লেগুনার পাদানিতে দাঁড়িয়ে লোহার বেড় লটকাইয়া ধরে টাকা গোনে। মাঝবয়সী লোকটা ঠারে ঠারে সালমানকে দেখে। বলে, আহা এমন সুন্দর বাইচ্চা। আহহ! দেশটার কি অবস্থা!
লেগুনা চলছে। সালমান চিল্লায়, অই বাড়াডা হাতে লন! অই বাড়াডা হাতে লন! লোকজন ভাড়া দিতে থাকে। অন্যান্যবার কিংবা অন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ভাড়া তোলার সময় যে অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়, এবার তেমন হলো না। সবাই কোমল করে টাকা হাতে ধরে অন্যান্যবারের চেয়ে অধিকতর মার্জিত ভঙ্গিতে ভাড়া দিতে লাগলো। ভাড়া নিয়েও কেউ তর্কাতর্কি করলো না। পরিবেশটা এমন যে, পারলে কেউ দ্বিগুণ টাকা দিয়ে দেয়।
ভাড়া ওঠানো শেষ। লেগুনা মহাখালী পৌঁছে পৌঁছে অবস্থা। সালমান ডান হাতে লেগুনার টিন থাবড়ায়—ওই মহাখালী, মহাখালী, মহাখালী। আরেক হাতের পাঁচটা আঙুলের ফাঁকে দুই টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকার নোটগুলো আলাদা-আলাদা করে ধরে রাখে। সালমান লোহার রড় ধরে শরীরের ভারসাম্য তার ওপর ছেড়ে দিয়ে কাত হয়ে বাম হাতের টাকাগুলো গোনে। মোট যাত্রী সংখ্যা আঙুল চালিয়ে গুনে দেখে।
মহাখালী প্রায় এসে গেছে লেগুনা। হঠাৎ সালমান চেঁচিয়ে ওঠে—ওই বাড়াডা দিসে না ক্যাডা, অই বাড়াডা দিসে না ক্যাডা। ওই মিয়া আফনের বাড়া কই? অই যে মাঝ বয়সী লোকটা যাত্রীদের মধ্যে সর্বপ্রথম সালমানের খুইয়ে ফেলা সম্ভাবনার কথা বলেছিল, তাকে সালমান ফ্যাসফ্যাস স্বরে বললো—ওই মিয়া হাউয়া! পিরিতের আলাপ মারান, বাড়াডা না দিয়া চুপ মাইরা আছেন ক্যান? বাড়া দেন…।
লোকটা নেমে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলো। সালমানের ডাকে ফিরে এসে কড়াইয়ের তলার মতো কালো পাছার পেছন থেকে মানিব্যাগ বের করে সালমানের হাতে দশটি টাকা ধরিয়ে দিয়ে আবার ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো। সালমান লেগুনার দেয়ালে হেলান দিয়ে দুই পা ক্রস করে দাঁড়িয়ে নায়কের মতোই অগোছালো টাকা থেকে পাঁচ টাকার নোটগুলো আলাদা করতে থাকে।