শিল্প-সাহিত্য হতে পারে মানুষের বিশেষ কোনো লক্ষ্য। রাজনীতি সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর উপায়। বিশেষ করে সাহিত্যকর্ম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করে দেখানোর জন্য নানা ধরনের চেষ্টা থাকতে পারে। এ চেষ্টায় কে কতটা সফল হলেন—তারও খতিয়ান তৈরি করা যেতে পারে। যে কারণে সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতির সম্বন্ধ-বিচার বিরল বিষয় নয়। নানা সময় সাহিত্যে কিংবা রাজনীতিতে এ ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ দেখা গেছে। লেনিন-মাও সেতুঙের মতো রাজনৈতিক তাত্ত্বিককরাও সাহিত্য বিষয়ে কথা বলেছেন। সমাজের বিচিত্র চিত্র সাহিত্যে লীন। এ থেকে উঠে আসা প্রকার-প্রকরণ রাজনীতির জন্য খবুই মূল্যবান জিনিস। একই সঙ্গে সাহিত্যিককে দেখা যায়, রাজনীতির গতিপ্রবাহ নিয়ে নানা ধরনের খেলায় মত্ত হতেও। রাজনীতিক যদি ইতিহাস লেখেন, ফসকে যেতে পারে তথ্য। সাহিত্যিক যখন লেখেন, তখনো।
এসব বিষয় মনে করিয়ে দিতেই হয়তো কবি-প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন ‘সাহিত্যের রাজনীতি’ লিখতে। গ্রন্থভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে—‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতা: ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার’, ‘স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা ছোটগল্প: সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’, ‘বাংলায় রহস্য সাহিত্য’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় বুদ্ধিবৃত্তি’, ‘নজরুলের কবিতায় পঙ্ক্তিবিন্যাস ও মাত্রাচেতনা’, ‘হেলাল হাফিজ: দ্রোহী প্রেমিক, বিনীত বিদ্রোহী’, ‘আবু হাসান শাহরিয়াররের কবিতায় নিরীক্ষা’, ‘সাহিত্যের রাজনীতি’, ‘বাংলা কবিতায় দশকের রাজনীতি’, ‘ফেসবুক-ব্লগকেন্দ্রিক বাংলা কবিতা’, ‘সাহিত্যে ছোটকাগজ : কতদূর সুসম্পাদিত’।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতা : ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার’ বলতে আমরা কতদূর সীমারেখা রাখব? ভারতীয় উপমহাদেশের অভিন্ন ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর কবিতার উত্তরাধিকার রেখায়ন করা সম্ভব কি না। মোহাম্মদ নূরুল হক যে বিবেচনায় বলেছেন, শেকড়বিহীন বৃক্ষের কথা, সে বিবেচনায় আমরা বর্তমান বাংলাদেশ মানচিত্রের ঐতিহ্যকে উত্তরাধিকারের মান ধরে এগোতে পারি কি? আমার ধারণা, লেখাটির মধ্যেই তার একটি ধারণা ধরা দেয়।
সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ছোটগল্পের জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়। এখানে মানুষকে ভেঙেচুরে দেখানোর একটা চেষ্টা গল্পকারকে করে যেতে হয়। ফলে ভেতরেরও ভেতরে ডুব দেওয়ার বিকল্প নেই। মোহাম্মদ নূরুল হক লিখেছেন, ছোটগল্পের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক কেমন হবে, তার অনেকখানিই নির্ভর করে লেখকের অভিজ্ঞতার ওপর। এই সত্য এড়িয়ে গিয়ে এগোনোটা একেবারেই সহজ নয়। বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তি আর হৃদয়বৃত্তির ভারসাম্য নিয়ে একটি পুরনো তর্কের ভিন্ন উত্থাপন করেছেন লেখক। বিশেষ করে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা সম্পর্কে কথা বলতে গেলে এ ধরনের একটি আলোচনা অবশ্যই সেরে নিতে হয়। এটি এ কবির পাঠকরা খুব ভালো করে জানেন। এক্ষেত্রে মননশীল ও সৃজনশীলের দূতিয়ালি দেখিয়েছেন লেখক। কবিতার পাঠক-আকালে কবি হেলাল হাফিজ বাংলাদেশের পাঠকের কুর্নিশ কুড়িয়েছেন। তার কবিতার এ দিক-ও দিক সম্পর্কে প্রাবন্ধিক একটি দিকনির্দেশক বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। এটি আমাদের কবিতা ও পাঠতর্কে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে হাজির হতে পারে।
অস্থির সমকালে বাস করেও কবিকে এক ধ্যানী মহাকালের বাসিন্দা বলেছেন কবি আবু হাসান শাহরিয়ার। বাংলা কবিতায় সম্পূর্ণ নিজস্ব রীতির এই কবির কাব্যস্পর্ধা সম্পর্কে পাঠককে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ‘আবু হাসান শারিয়ারের কবিতায় নিরীক্ষা’ গদ্যটি এ কবি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা নয়। বলা যেতে পারে তার ভুবনে প্রবেশের প্রাক-পরিকল্পনা। বাংলা কবিতার নিরীক্ষার ইতিহাসে কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের কাজ স্বীকৃত। কবিতাকে আঁড়বাঁশির মতোই বাজিয়ে চলেন তিনি। আর সুরের মূর্ছনা ওঠে পাঠে ও পাঠকে। কালের দপ্তরে সমকাল অনেক কিপটে বলেই আবু হাসান শাহরিয়ারের অসামান্য কীর্তিটি নিয়ে আশানুরূপ তরঙ্গ নেই। যদিও জানা আছে, হালের বিচার আর কালের বিচার এক নয়। সময় হচ্ছে ঈশ্বর। তাকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা সম্ভবত মানুষকে দেয়নি প্রকৃতি। ফলে মোহাম্মদ নূরুল হকের মতো তরুণরা ফোঁস করে ওঠেন। বাংলা কবিতায় যে কজন কবি তরুণ কবিদের প্রভাবিত করতে পেরেছেন, আবু হাসান শাহরিয়ার তাদের অন্যতম। পূর্বসূরি অনেকের কবিতায়ও তার প্রভাব সুস্পষ্ট। ফলে পাঠকের কবি হওয়ার পাশাপাশি আবু হাসান শাহরিয়ার লেখকেরও কবি। কোনও পুরস্কারের মুকুট দিয়ে এটি পরিমাপ করা যায় না। এ ক্ষেত্রে মোহাম্মদ নূরুল হক ‘কবিতায় দশকের রাজনীতি’ ও ‘সাহিত্যের রাজনীতি’ গদ্যের মাধ্যমে বয়ানটি আরও প্রয়োজনীয় করে তুলেছেন। সব মিলিয়ে গ্রন্থের মধ্য দিয়ে লেখক নূরুল হক চিন্তাশীর্ষের নিরীক্ষা চালিয়েছেন দক্ষতার সঙ্গে। এতে ভাষার সাবলীল ও যৌক্তিক ব্যবহারও স্পষ্ট।
সাহিত্যের রাজনীতি
মোহাম্মদ নূরুল হক
প্রচ্ছদ: শতাব্দী জাহিদ
প্রকাশক: সাকী
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৪
মূল্য: ১০০ টাকা