প্রাগৈতিহাসিক
খুব ভোরে পাড়া বেড়াতে বেরুতাম আমরা
ফজরের আজান অন্তে ঘুম ভাঙলে, মসজিদ অবধি
যেতাম,মাঝে-মাঝে আল্লাহর পায়ে সেজদা
বেশিরভাগ দিনই ফাঁকি হয়ে যেত
কাকে ফাঁকি দিচ্ছি আল্লাহকে না নিজেকে
ভাবতে ভাবতে দেখতাম আমাদের শিবু দাস
অর্থাৎ ক্ষ্যাপা শিবু হাতছানি দিয়ে ডাকছে
তার ডাকে কিংবা তার পিছু নিলে পাড়ার
ফাঁক ফোকরগুলো অনায়াসে হাওয়া হয়ে যেত
শিশির লেগে থাকা ঘাস মাড়িয়ে
পৌঁছে যেতাম মনুর পাড়ে, লাগোয়া জমিনের
দুই প্রান্তে গোলপোস্টে আমাদের দৌড়াদৌড়ি
শুরু হলে ক্ষ্যাপা শিবু হয়ে উঠত আমাদের কালের
পেলে, ফর্সা আদলের শিবুর পায়ে কালো মানিকের
ঘূর্ণি আমাদের জিতিয়ে দিলে ভাবতাম
একদিন আমরাও আন্তঃস্কুল শিল্ডের অধিকারী হব
এমন ভাবনায় মন আন্দোলিত হচ্ছে জেনে গেলে
ক্ষ্যাপা শিবু তার অনুগামী হতে আমাদের বাধ্য করত
ফিরতি পথে কামিনী স্যার অর্থাৎ শিবুর বাবার
তুলসী মন্ত্র কানে প্রবেশিলে ক্ষণিকের তরে
থমকে যেতাম,সম্মোহনী সুরের এ মন্ত্র শিরা-উপশিরা দিয়ে
মস্তিষ্কে পৌঁছালে নিজেদের ধ্যানমগ্ন সাধুর ন্যায় পবিত্র ভাবতাম
পবিত্র মনে আমপারা পড়তে আমরা মক্তবে যেতাম
মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে শিবু
কিছু একটা বলতে চাইলে ইমাম সাহেবের নিমন্ত্রণে
উঠে আসত মসজিদের চৌহদ্দিতে
আলাপ অন্তে শিবু ফিরে গেলে উজ্জ্বল হাসিতে
উদ্ভাসিত হয়ে উঠত ইমাম সাহেবের মুখমণ্ডল
মসজিদের বারান্দায় সারি-সারি আমপারা
পাঠরত আমাদের রসের পিঠায় আপ্যায়িত করতে
উপস্থিত হতেন দীপকদা, শিবুদের বাড়ির কাজের লোক
মুচ্ছদ্দীতে লেগে থাকা রস মুছতে মুছতে
কামিনী স্যারকে প্রণাম পাঠাতেন মসজিদের ইমাম
মসজিদ মন্দির পাশাপাশি অবস্থানে
সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির কোনো হেরফের হয় কি না
ভাবতেই দেখি ছোট পণ্ডিতের অনুপস্থিতিতে
হিন্দু ধর্মের ক্লাসে যাচ্ছেন ফয়জুর রহমান, ছোট মওলানা
কিন্তু ওসবই প্রাগৈতিহাসিক কালের কথা
একালের হিসাব ভিন্ন, মসজিদের লাগোয়া মন্দির…
উলুধ্বনি সেজদায় ব্যাঘাত ঘটলে আমরা মেনে নেই না
ফাঁকিবাজি অনেক হয়েছে এবার পুষিয়ে দেওয়ার পালা
কামিনী স্যারের তুলসী তলার ধূপ চোখে
জ্বলন ধরালে উচ্ছেদই একমাত্র সমাধান মনে হয়
দাসদের উদ্বিগ্ন চোখের সামনেই কাজ সারতে হবে
সফলতায় প্রশান্তি বিফলতায় সত্তর হুর…
একদার অনুগামী আমরা এখন মালাউনের বাচ্চাকে
এড়িয়ে চলি, তার স্পর্শে অশুচি হয়ে যায় আমাদের আত্মা
পরকালের অনন্ত জীবন, সত্তর হুরের সাথে সহবাস কামনায়
কয়েক ডজন কামিনী বলি দিতে প্রস্তুত আমাদের হাত…
বেঁচে থাকি সমকালে
সমকালের মাটি আমাকে ছুঁয়ে যাক
মহাকালের উৎকীর্ণ মুখাবয়বে
লালায়িত হয় না আমার হৃদয়
চৌরাস্তার মোড়ে স্থাপিত ভাস্কর্যে
মহাকাল পুষ্প ঝরাবে
এই ভাবনা তাড়িত করে না
আমার স্মরণে অর্ধ নমিত পতাকার
সামনে কে বাজাবে করুণ বিউগল
এই ভেবে আন্দোলিত হয় না
সমকালের বোধ, বরং এখনই পিঙল রঙে
রাজপথ মুখরিত হবে
এই বাসনায় খুলে দেই বুকের বোতাম
সমকালের বৃষ্টিতে ভিজব বলেই বাইরে দাঁড়াই
ফোঁটা ফোঁটা জলের কণা পাঁজর ভেদ করে
অন্ত্রে পৌঁছালে নিজেকে পরিশুদ্ধ মনে হয়, মানবের
তাই চাওয়া উচিত, সমকালে নিজেকে লিপিবদ্ধ করা
কোথাও ভেসে যাওয়া হয়ত হবে
নুহের কিস্তি অতিক্রম অন্তে লিখিত হবে
যাপিত জীবন, নতুন পাখির গানে
আমোদিত হবে পরিপাশ, ঘাসফুলে ফড়িঙের
ওড়াউড়ি দেখে উদ্বেল শিশু তার ভুবন ভোলানো
হাসিতে ছড়াবে রৌদ্রের রঙ, রোদ পোহানো শেষে
ক্লান্ত দেহ পালকের বিছানায় আয়েশ ছড়ালে
শিয়রে দাঁড়াবে রাজার কুমারী কন্যা
এসবই মহাকালের জন্য তোলা থাকুক, স্বপ্নময় পৃথিবীর ওপারে
মানুষেরা স্বপ্ন দেখুক, মাখুক স্বপ্নের রঙ, আমি শুধু বর্তমানের
শিশুর কপালে ঠোঁটের পরশ দিয়ে জানাতে চাই
তাকে আমি ভালবেসেছিলাম,নরম গালে নাক ডুবিয়ে
বলতে চাই তার মঙ্গলের জন্য বিক্রি করেছি পাঁজরের হাড়
বর্তমানের জ্যোৎস্না আমাকে আবৃত করুক, ভবিষ্যতের কোনো
নক্ষত্র আমার নামে উল্কা খসাবে এ নিয়ে ভাবিত হতে
রাজি নই, আমি চাই পরিপাশে ছড়ানো নক্ষত্র
নিজেদের আলোকিত করুক, চাই নক্ষত্ররা তাদের
পরিচয় উন্মোচনে সচেষ্ট হোউক…
বর্তমানের মানুষেরা বেঁচে থাকুক…পরিধেয় বস্ত্রে থাকুক
আহ্লাদি রঙ, ভোজন পর্ব শেষে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলুক…
নিরাপদ ছাদের নীচে সুশীতল মাদুরে নিদ্রা যাক…
আমি বেঁচে থাকতে চাই বর্তমান সময়ে, অতীতের
গায়েবি আওয়াজ ধারণ করে হতে চাই না
ভবিষ্যতের মহামানব…আমি চাই বর্তমানের মানুষ জানুক
আমি আছি তাদেরই একজন হয়ে…
একটি পুরুষবাদী কবিতা
ইতিহাসের পৃষ্ঠায় হাঁটতে চায় না
চুড়িপাঠে মগ্ন নারীরা
তাদের আকাশে শাড়ি উড়ে
তারা সাঁতার কাটে
ম্যাচিং ব্লাউজ, পেটিকোটের নদীতে
লিপস্টিকের আয়নায় স্নান সেরে
তারা কপালে ঘষে মনোহর দোকানের ফাউন্ডেশন
অফিস কাচারিতেও তারা
চোখে রাখে রোদ চশমা
সুগন্ধি বাজার তাদের খুব প্রিয়
আলু পটলের দরে কিনে
ঘাম তাড়ানোর ক্রিম, তারপর
নিজেদের অপূর্ণতার গল্প করতে করতে…
অথচ মনে ও মননে তারা ভীষণ নারীবাদী…