প্রথম পর্বের পর:
গত দেড় যুগ ধরে যারা কবিতার সঙ্গে ঘর বেঁধেছেন, তাদের একজন জাকির জাফরান। তাঁর কবিতা সাধারণত সহজ-সরল শব্দসহযোগে রচিত। কোনো জটিল বাক্যের মারপ্যাঁচ নেই কিন্তু গভীর ইঙ্গিতপূর্ণ। তিনি দীর্ঘ বর্ণনার পক্ষে নন; অল্পকথায় যাপনচিত্র ও মনের নিগূঢ় বাসনা প্রকাশের পক্ষে। জীবনাভিজ্ঞতা বর্ণনায় বাস্তবচিত্রের পাশাপাশি কল্পনার আশ্রয়ও নেন। তবে সেই কল্পনা এতই জীবনঘনিষ্ঠ যে, প্রায় চেনাজানা জগত থেকে তাকে আলাদা করা যায় না। সে রকম একটি কবিতার নাম ‘চিঠি’।
মূলত এই কবিতাটিই তাঁকে তার সমকালীনদের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দেয়। এতে পঙ্ক্তিসংখ্যা মাত্র সাত, স্তবক দুই। চলুন কবিতাটি এবার পাঠ করা যাক।
আজ বাবা অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন
বললেন: ধরো ডালে বসা দুটি পাখি থেকে
শিকারির গুলিতে একটি পাখি মরে গেল
তবে বেঁচে থাকলো কয়টি পাখি?অঙ্কের বদলে এই মন চলে গেল
বেঁচে থাকা নিঃসঙ্গ সে পাখিটির দিকে
আর মনে হলো তুমি আজ স্কুলেই আসোনি।
(চিঠি: জাকির জাফরান)
পুরো কবিতাটি বিয়োগান্তক, দর্শনময়। মানুষের সঙ্গপ্রিয় স্বভাব, সর্বপ্রাণপ্রেমের পাশাপাশি হৃদয়বৃত্তির প্রসঙ্গও এসেছে এ কবিতায়।
মৃত্যু চিরন্তন। বিজ্ঞান, সভ্যতা অনেকে এগিয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভৃত উন্নয়নের কারণে মানুষের অকালমৃত্যু অনেকটাই কমেছে। কিন্তু আজও মৃত্যুকে জয় করা যায়নি। ফলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ধর্মীয় পুরোহিত এমনকি শিল্পী-সাহিত্যিক কিংবা বিজ্ঞানীরাও মৃত্যুচিন্তায় কাতর হন। মৃত্যু প্রসঙ্গ মনের কোণে উদিত হওয়া মাত্রই এক অভাবনীয় শিহরণ খেলে যায় মানবদেহে। কিন্তু সে মৃত্যু কেমন হওয়া উচিত? স্বাভাবিক জীবনযাপনকারী মানুষ সাধারণত একবাক্যেই বলেন: স্বভাবিক মৃত্যু চাই। কেবল সংসার জীবনে অসুখী কিছু মানুষ, সমাজচ্যুত কিছু মানুষ কিংবা জীবনের প্রতি বিরাগ জন্মেছে, এমন কিছু মানুষ আত্মহননের মতো সিদ্ধান্ত নেন। বাকিরা স্বাভাবিক মৃত্যুরই প্রত্যাশা করেন। কিন্তু অস্বাভাবিক কিংবা অপঘাতে মৃত্যু মানুষ কখনোই কামনা করে না।
মানুষ সাধারণত মানুষের অপমৃত্যু বা অকাল মৃত্যুতে ব্যথিত হন। প্রাণীজগতের অন্য কোনো প্রজাতির ক্ষেত্রে ব্যথিত না হয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং উল্লসিতও হন। আবার নিজেই অনেক পশু-পাখি হত্যা করেন। আর একাজে মানবজাতি প্রায় নির্বিচারী। পশু-পাখির প্রতি তাদের দরদ তুলনামূল কম। যেটুকু দরদ তারা দেখান, সেটুকু মূলত গবাদি পশুপাখির প্রতিই দেখান। কারণও সবার জানা।
মানবজাতি সুযোগ পেলেই বণ্যপশুপাখি শিকারে নামেন। আর সুযোগ পেলে গল্পচ্ছলে একজন আরেকজনকে শিকারের গল্প শোনান। কখনো কখনো শিকারের কাহিনীকে শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবেও উপস্থাপন করেন। স্বজন হত্যার বিচার চাইতে পারে মানুষ, সে বিচার তারা পায়ও। মানুষ যখন পশু-পাখি শিকার করে, তখন পশুপাখি সমাজে বেদনার স্রোত বয়ে যায় সত্য, কিন্তু তার প্রতিকার প্রার্থী তারা হতে পারে না। কেবল ভাঙা বুক নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকে। সে বেদনা মানুষকে সাধারণত স্পর্শ করতে পারে না। মৃত পাখি বা সঙ্গীহারা পাখিটির জন্য শিকারি মানবসন্তানের মনে কোনো বেদনা জাগে না। বরং মানবসন্তানের অনুশোচনার শেষ থাকে না এই ভেবে যে, উড়ে যাওয়া পাখিগুলো কিংবা পালিয়ে যাওয়া পাখিগুলোকেও কেন সে শিকার করতে পারলো না! পশুপাখির সমাজে নিশ্চয় মানবজাতির এই আচরণ বর্বরোচিত আচরণ। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এসব তেমন দোষের নয়। কিন্তু যিনি সর্বপ্রাণবাদী, প্রেমিকহৃদয়, তার মতে, প্রাণীহত্যা মানেই পাপ। তিনি প্রতিটি প্রাণীরই স্বাভাবিক জীবনযাপন ও স্বাভাবিক মৃত্যুর পক্ষে। জাকির জাফরান এই বার্তাটিই তার ‘চিঠি’ কবিতায় দিতে চেয়েছেন। তিনি বলার চেষ্টা করেছেন, যে মানবসন্তান বাবার কাছে অঙ্ক কষার ছলে পাখি শিকারের বেদনাময় গল্প শোনেন, তার মনে নিঃসঙ্গ পাখিটির জন্য মমতা জাগে। আর নিঃসঙ্গ পাখিটির সঙ্গে নিজের একাকিত্বকে মিলিয়ে বিচার করেন একই সমান্তরালে। তার মনে পড়ে যায়, প্রেয়সীর সঙ্গে তার দেখা না হওয়ার কথা।
আগেই বলেছি, কবিতাটি ছোট। জাকির জাফরানও খুব অল্পকথায় বলে যান অনেক কথা। এ সময়ের দাগ কেটে যাওয়ার মতো কবিতাগুলোর আলোচনা করতে গেলে সর্বপ্রাণে প্রেম, বেদনাবোধ ও হৃদয়বৃত্তির প্রসঙ্গ যেখানে উঠবে, জাকির জাফরানের ‘চিঠি’ কবিতাটি সর্বাগ্রে সে আসরে উঁকি দেবে বনেদি গৃহস্থবাড়ির সব সামলে শক্তহাতে সংসারের হাল ধরে রাখা লাজুক বউটির মতো। চলবে…
সমকালীন কবিতার সন্ধানে ॥ কমল ঠাকুর