একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে, অমিতাভ রেজা চৌধুরী পরিচালিত ‘আয়নাবাজি’ প্রচলিত-অলিখিত নিয়ম ভাঙা চলচ্চিত্র। বর্তমান জীবনধারা তুলে ধরা হয়েছে এতে, তবে একটু ভিন্ন ধারায়। এই ছবিতে মানুষের অবচেতন মনকে উপস্থাপন করা হয়েছে গভীরভাবে। মানুষ প্রতিনিয়তই যে ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, সেগুলোই উঠে তুলে ধরা হয়েছে এতে। আর এসব অনুষঙ্গ নাড়া দিয়েছে দর্শকদের। বিশেষ করে নারীদের ব্যবহার, পুঁজিবাদের আগ্রাসী চেহারা, রাজনৈতিক অপতৎপরতাসহ ’অর্থবহ গোসলে’র চিত্রায়ণ করা হয়েছে এই ছবিতে।
মূল ধারার বাংলা মুভিতে সাধারণত দেখা যায়- মেয়েদের ব্যবহার করা হয় যৌনউত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপাদান হিসেবে। গানের সময় নাভী বা স্তনের কিছু অংশ বের করে দেওয়া, ‘বৃষ্টি ভেজা নায়িকার নাচ, ধর্ষণ দৃশ্য এবং অন্যান্য যৌন সুরসুরি দেয়া দৃশ্য ও সংলাপ’ (বিধান রিবেরু, ২০১১) ইত্যাদির মাধ্যমে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ভোগ্যপণ্য হিসেবে নারীদের উপস্থাপন করা হয়। এটা জেনেশুনে না করা হলেও মূলত অবচেতন মন থেকে সিদ্ধান্তটা আসে। লরা মালভি (১৯৭৫) বলেন, ‘মূল ধারার সচরাচর মুভিতে মেয়েদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পণ্য বা বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। নারীরা নির্মাতা নয় বরং নির্মিত বস্তু বহনকারী হিসেবে উপস্থাপিত হয়।’ এ ধরনের বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে অভিনিত হয়েছে ‘আয়নাবাজি’। খুব বেশি নারী চরিত্র নেই। প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত ছিলেন হৃদি নামের একটি চরিত্র। আমরা মুভিটি দেখে বুঝতে পারি- তিনি কতটা মানুষ চরিত্র এবং হৃদয়ের অধিকারী। তার চেয়েও বড় কথা হলো- তার সত্তা আছে, একইসঙ্গে উন্নত মনও। আবার আয়নার মায়ের কথা জানতে পারি। যদিও তিনি বাস্তবে উপস্থিত নেই, তার সঙ্গে ফোনে কথা বলে আয়না। এটা অবশ্য ফোনালাপ বলা যায় না। অনেক আগে হারিয়ে ফেলা মা ছাড়া কেউ নেই আয়নার। সে মূলত স্বগতোক্তিই করে মায়ের সঙ্গে। মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাতেই বদলি হিসেবে ৩মাসের চুক্তিতে জেলে যায়। সেটা ৩ বছরে দাঁড়ায়। বের হয়ে দেখে- তার মা আর বেঁচে নেই। তারপর সে এপথেই থেকে যায়। ঠিক এভাবেই একজন মাকে সন্তানের অবচেনতনে দেখতে পাই আমরা। পুরো মুভিতে কোথাও ‘ভালোবাসি’ শব্দটার উল্লেখ নেই। অথচ পুরো ফিল্মই ভালোবাসা আর প্রেমে ভরপুর। এখানে প্রেম-ভালোবাসা থাকলেও সম্পর্কে কোনো মোড়লীপনা নেই। সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সামান্য প্রয়াস লক্ষ করা যায়।
‘আয়নাবাজি’র আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো- পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার চিত্রায়ণ। আয়না এমন একটা সমাজে বাস করে, যেখানে বেঁচে থাকতে টাকা আয় করার জন্য অসৎ পথ অবলম্বন করতে হয়। মানুষ টাকা দেয়- কিন্তু পথটা পবিত্র নয়। আবার ইচ্ছা করলেও এপথ ছেড়ে আসার সুযোগ থাকে না। আয়নাকে মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখিয়ে জেলে যেতে বাধ্য করে নিজাম সাঈদ চৌধুরী। এভাবেই পুঁজিবাদের কাছে হার মেনে যায় আয়না। আয়না যেন পুরো দেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে।
আয়না বুড়িগঙ্গার ওপারে বাসা ভাড়া নিয়েছিল, ছেড়ে দিয়েছিল বদলি হয়ে জেল খেটে টাকা আয় করার পথ। হৃদির সঙ্গে সিলেট যাওয়ার কথা থাকলেও নিজাম সাঈদ চৌধুরী হয়ে জেলে যেতে বাধ্য হয়। নিজাম চৌধুরী একজন ‘নেতা’। অর্থাৎ man of peoples. যিনি ‘আদর্শ’রক্ষার জন্য একজন স্কুল শিক্ষককে খুন করেছেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়- তিনি সীমানার ওপাশ থেকে সবকিছু দেখাশোনা করবেন, আর জেলে থাকবে আয়না। অফিস থেকে সূত্রাপুর থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে তাকে। আইনি প্রক্রিয়ার পর ‘নিজাম চৌধুরী’র মৃত্যদণ্ড ঘোষিত হয়। তাকে মুক্ত করার জন্য কিছু চেষ্টা করা হলেও পরে আর কোনো তদারকি করা হয় না। ফাঁসির দিন ঘনিয়ে আসে। এ ঘটনাটির মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদের প্রকৃত রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে জনগণ রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে যে ধরনের শঙ্কার মধ্যে আছে, মানুষের অবচেন মনে যে ভয় কাজ করছে, সেটাকে চিত্রিত করলেন অভিতাভ রেজা চৌধুরী।
কিছু অসদুপায়ী পুলিশের কর্মকাণ্ডকেও আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যান তারা। রাস্তায় যখন আসল অপরাধীর পরিবর্তে আয়না উঠেপড়ে পুলিশ ভ্যানে, তখন পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা আমাদের তিক্ত বাস্তবতার কথা মনে করিয়ে দেয়। আবার সঙ্গে-সঙ্গে এসি সাজ্জাদের মতো আদর্শবান পুলিশকেও উপস্থাপন করা হয়েছে মুভিতে।
‘আয়নাবাজি’-তে দেখা যায়, প্রতিবার জেল থেকে এসে আয়না গোসল সেরে নিচ্ছে। এমনকি একবার গোসলের সময়েই কেক নিয়ে হাজির হয় হৃদি। এই গোসল পূর্বের সব ঘটনা মুছে ফেলে নতুন জীবনের সূচনা প্রকাশ করে। অর্থাৎ গোসলের সঙ্গে-সঙ্গেই ধুয়ে যাচ্ছে তার অভিনীত মিথ্যা পরিচয়। হৃদি গোসল দেখে ফেলার পর আয়না একাজ ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা দেখায়, যা আমরা পরবর্তী সময়ে আয়নার মুখেই শুনি। নিজাম চৌধুরীর সামনে সে বলে- ‘আমি কাজ ছেড়ে দিয়েছি।’
মুভিটা শেষ হয়েছে একটা আয়নাবজি অর্থাৎ চাপাবাজির মাধ্যমে। অনেকে এখান থেকে ভুল ম্যাসেজ পেতে পারেন। কিন্তু আমি ব্যাপারটি একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে চাই। জোনাথান সুইফটের বিখ্যাত গালিভারস ট্রাভেলস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফকরুল আলম বলেন- ‘যদি গালিভারস ট্রাভেলস-এর স্যাটায়ারটা পাঠক যদি না ধরতে পারে, তাহলে সে নিজেকেই স্যাটায়ার অর্থাৎ ব্যাঙ্গ করবে।’ আমি এই বক্তব্যের সুরে বলতে চাই- যদি আয়নাবাজির ব্যাঙ্গাত্নক চিত্রায়ণটা কেউ না ধরতে পারে, তাহলে সে নিজেই স্যাটায়ারের ফাঁদে পড়ে যাবে। আমাদের বুঝতে হবে- এই মুভিতে কোনো সমাধান দেওয়া হয়নি। এই মুভিতেও আমরা কোনো সমাধান দেখতে পাই না। যেটা দেখতে পাই, সেটা হলো- খপ্পরে পড়া মানুষগুলো সুযোগ পেলে কাউকে ধোঁকা দিতে ছাড়ে না। আর এখানে আয়না পালিয়ে আসে, এটা সমাধান নয় বরং আয়নাবাজি বা চাপাবাজি। এই চাপাবাজির সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে বিদ্যমান আছে। ফিল্মে আসল নিজাম চৌধুরীর কী অবস্থা হয়- জানতে পারি না। মুভির কেন্দ্রীয় চরিত্র আয়না অর্থাৎ নকল নিজাম চৌধুরীর মৃত্যদণ্ড কার্যকর হবে, এতে সব দর্শকই কষ্ট পেয়েছে। আয়নার মা চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে শুনেও দর্শক দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু আয়না নিজেও যে তথাকথিক নায়কের মতো শতভাগ সাচ্চা মানুষ নয়, সেটা প্রমাণিত হয়েছে। আবার সে সাধারণ মানুষের মতো শুধু ভুলই করে যায়, এমনটি নয়, বরং অনুশোচনায় ভোগে। আয়নাবাজির প্রতিটি চরিত্র বাস্তবতার বাড়াবাড়ি উপস্থাপণ নয়, বরং হুবহু বাস্তবতা তুলে ধরার প্রয়াস মাত্র।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঢাকা শহরে যানজট একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়টিও অমিতাভ রেজার ভাবনার বাইরে ছিল না। তিনি এটাকে দেখাতে গিয়ে হৃদির বাবার মৃত্যু রচনা করেন অ্যাম্বুলেন্সে। অর্থাৎ যানজটে আটকে থাকা অবস্থায় রোগীর অ্যাম্বুলেন্সও যে মুক্তি পায় না, সেটা ফুটিয়ে তুলেছেন। এ ব্যাপারে পরিচালকের বক্তব্য- ‘অ্যাম্বুলেন্স ইস্যুটা মূল স্ক্রিপ্টে ছিল না। আমি সচেতনভাবে বিষয়টি যোগ করেছি।’
অনেক চমকপ্রদ বিষয়ের মাঝেও কিছু অসঙ্গতি থেকে যায়। আয়না যখন জেলে, তখন ক্রাইম রিপোর্টার সাবের হোসেন হৃদিকে আয়নার আগের ঘটনা, মা-বাবার ঘটনা বলে। কিন্তু আমরা দেখেছি সে যখন কনডেম সেলে আয়নার সঙ্গে দেখা করতে যায়, তখনো আয়না নিজের পরিচয় গোপন করে। তাছাড়া আয়নার কন্ট্রাক্ট স্টুডিওর মালিকও তখন খুন। এ সম্পর্কে জানার জন্য আলুপুরীর দোকানদার মজনুর সঙ্গে সামান্য আরাপচারিতা ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। আবার, অন্য কোনো উৎসেরও উল্লেখ নেই মুভিতে। তাহলে সাবের হোসেন আয়নার আগের সব ঘটনা জানল কিভাবে? এ ধরনের সামান্য বিচ্যুতি থাকলেও ‘আয়নাবাজি’র অন্য সব দিকই দর্শকের মন কেড়েছে।
বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম (বিডিএসএফ)-কে পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরি বলেছেন, ”এই মুভিটির প্লট ২০১১ সালে প্রথম শোনেন। তারপর থেকে দীর্ঘ গবেষণার পর স্ক্রিপ্ট রচনা হয়। দীর্ঘদিনের গবেষণার ফসল এই ‘আয়নাবাজি’।’
যদি জাতির অগ্রগতির পথের বাধাগুলো চিহ্নিত করে এবং বাধা থেকে উত্তরণের মাধ্যমে যে সম্ভাবনা দেখা যায়, সেগুলো মূল্যায়ন করে জনগণকে তাদের বন্দিশা থেকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে ফিল্ম তৈরি করা হয়, তাহলে সেটা আলোড়ন সৃষ্টি করবে। জনগণ গ্রহণ করবে সে ফিল্ম- অন্তত সাময়িকভাবে মানসিক মুক্তি পাওয়ার জন্য হলেও। আশিষ রাজধ্যক্ষ একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ”তামিল চলচ্চিত্র তারকা রজনিকান্তের ‘মুটু’ মুভিটি জাপানের বাজারে ‘টাইটানিক’ ফিল্মের পরে সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।” এটার কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রাবন্ধিক বলেন- ”সে সময়ের জাপানের অর্থনৈতিক ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় ফিল্মটির ‘টাকাই সবকিছু না’ দর্শনটি জাপানি তরুণদের ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে।” আমার মনে হয়- ‘আয়নাবাজি’-তে বাংলাদেশের মানুষের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অস্তিত্বসংকট, রাজনৈতিক দুর্দশাসহ নারী চরিত্র ব্যতিক্রমভাবে চিত্রায়িত হয়েছে, যা বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা ও দর্শনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ফলে ‘আয়নাবাজি’অনেকেরই মনজয় করতে পেরেছে।
মন্তব্য